ঝুঁঝকি আলোর রেখা/আজিজুল হাকিম

 


১২ 

কোরবানির কেসসা


  আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম না। উঠেই বা কোথায় যাব? আলবেলা ছাড়া এই বাড়িতে কেউ নেই। অতএব গল্প করার মতো কেউ নেই।

আমি উপুড় হয়ে শুয়ে জানালার ওপারে চোখ গলিয়ে দিলাম। সামনে পাহাড়টি। সবুজ গাছপালায় ঢেকে আছে। জল প্রপাতের শব্দ ভেসে আসছে। বড় মধুর শব্দটি। নানান পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ মাঝে মাঝে আসছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত শান্ত গ্রামে এমন পরিবেশ আমাকে খুব আকৃষ্ট করছে।

ওদিকে তাকাতে তাকাতেই আলবেলার কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক তখনই দরজা থেকে গলা ঝাড়ার মৃদু শব্দ আমার কানে ভেসে এল। আমি মাথাটা ঘুরিয়ে তাকালাম। আলবেলা হাস্যজ্জল চোখে আমার দিকে তাকাছে। গালের টোলে, ঠোঁটের পাড়ে এক নিগুঢ় হাসির ঝলক খেলে বেড়াচ্ছে। স্নিগ্ধ মুখে মোলায়েম হাসির বিচ্ছুরণ। ওকে আবার বুকে টেনে নিতে ইচ্ছে করছে।

আমি দু হাত ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ও ছুটে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনাবিল চুম্বন ধারায় আমার সারা মুখ ভরিয়ে দিল। আমিও বিনিময় করলাম।

ও বলল, ছাড়ো। যাও, স্নান করে এসো।

আমি ঝর্ণার ধারে গিয়ে স্নান করে এলাম। শরীর ও মন দুটোই খুব ফ্রেস ফ্রেস লাগছে।

আমরা খাওয়া দাওয়ার পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। গ্রাম পেরিয়ে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আমরা হেঁটে চলেছি। চারিপাশে বিভিন্ন রকমের ছোট বড়ো গাছপালা। সেই গাছপালার তলা দিয়ে আলোছায়ার মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। অনেকটা পথ পেরিয়ে আমরা পাহাড়ের ওপারে চলে গেলাম। সেখানেও একটি ছোট নদী আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে চলেছে। সেই নদীর ধারে একটি খোলামেলা জায়গায় গিয়ে সবুজ ঘাসের উপর বসলাম।

আলবেলা বলল, তোমার ছোট বেলার জীবন ও পারিপার্শ্বিক অনেক ঘটনা এড়িয়ে গেছ। তাই না?

আমি অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম। ভাবলাম, ও কিভাবে জানল? তবুও আমি ঠিক বলেছি এমন ভঙ্গি নিয়ে বললাম, যেমন?

ও বলল, বল না, আমি যা বললাম তা ঠিক কি না?

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

খুঁজে দেখ। এখনো অনেক বাকি আছে।

আমি কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।

মিথ্যে কথা।

তাহলে বল, আমি কি কি বিষয় এড়িয়ে গিয়েছি?

যেমন তোমার ছোট্ট বেলায় তোমার কে মারা গেছে। তুমি কোন ধর্ম মতে বড় হয়েছ। সে সবের রীতিনীতি, আচার আচরণ কেমন ছিল; এমন কিছু।

 আমি একটু হেসে বললাম, সে সব কি পরে শুনলে হবে না? এত সুন্দর একটি রোম্যান্টিক জায়গা। এখন তো কেবল প্রেম করার সময়।

ও বলল, না। তোমার জীবন, তোমার চারপাশ, তোমার ধর্ম কি ছিল? সে সব তো আমার জানতে ইচ্ছে হয়। তারপর একটু দুঃখের সুরে বলল, আমার জীবনে তো সে সব কিছু নেই।

আমি চমকে উঠলাম, মানে!

ও কিছুটা জোর করে মুখে একরাশ হাসি টেনে বলল, ও কিছু না। আগে তুমি বল। শুনতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে।

আমি বললাম, তুমি কে আগে বল তো?

ও হেসে বলল, আমি আমি। এর বাইরে কিছুই না।

আমি বললাম, তোমার কথায় কোন গোলমাল মনে হচ্ছে। তুমি কে আগে বল।

ও বলল, তুমি তো আমার সম্পর্কে আগে কিছু জানতে চাওনি। অতএব আগে তোমাকেই বলতে হবে। আমারটা পরে হবে।

অগত্যা আমি শুরু করলাম, তখন আমার বয়স সাত বছর। সেই সময় আমার এক চাস্ত বোন মারা গেল। চাস্ত বলতে আমার বাবার চাস্ত ভাইয়ের মেয়ে। সে ছিল ফুটফুটে একটি মেয়ে। গায়ের রঙ পাকা সোনায় মোড়া। মুখের গড়নটা নিখুঁত কারুকার্যে খোদাই করা। নানি প্রায় বলত, এর সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। কিন্তু কি জ্বর হল, হঠাৎ করেই ও মারা গেল। সেদিন আমাকে ডেকে কোলে নিয়ে নানির বুক ভাঙ্গা করুণ কান্না কেবল শুনে গেছিলাম। তখন অবশ্য আমার মনের মধ্যে এসব মৃত্যু কোনো রকম রেখাপাত করতে পারেনি। আমি ওর মৃত মুখের দিকে তাকিয়ে নির্বাক ছিলাম।  

এতটা বলে আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আলবেলার দিকে তাকালাম। ওর চোখের দুই কোন থেকে অশ্রু গড়ে পড়ছে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি কাঁদছ?

আমাকে তাকাতে দেখে খুব তাড়াতাড়ি উর্ণার আঁচল দিয়ে চোখ দুটি মুছে একটি হাসির রেখা টানার বৃথা চেষ্টা করল। বলল, কই? না তো! তারপর ঢোক গিলে বলল, আসলে অকাল মৃত্যুর কথা শুনলেই আমার কান্না পায়।           

ও কিছুক্ষণ থেমে বলল, তোমার ধর্মীয় জীবন বলতে শুরু কর।

আমি বলতে শুরু করলাম, আমি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলাম সেই পরিবার ইসলাম ধর্ম মতে বিশ্বাসী। আমিও একজন মুসলিম ব্যক্তি।

ও বলল, তাহলে কোরবানি তোমার চোখে কেমন?    

আমি বললাম, তাহলে শুনো। কোরবানিতে আমার একটি খাসি ছাগল ছিল। তার আগেও ছয়টি খাসি ছাগল কোরবানি দিয়েছিলাম। তখন কিন্তু এমন অনুভূতির উদয় হয়নি, যদিও এর দু-বছর আগে একটি চরম আঘাত পেয়েছিলাম। সেদিন আমি ছাগলটার পা ধরেছিলাম। আমার মামাতো ভাই এসে ছাগলটি জবাই করল। তখন সেটি দেহ থেকে প্রাণ চলে যাওয়ার যন্ত্রণায় ছটপট করতে করতে এক সময় অসাড় হয়ে পড়ল। ভাবলাম ও মারা গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ও হঠাৎ মাথা তুলে আমার দিকে একবার ঘুরে তাকাল। কারণ আমি ওর পিছনে ছিলাম। তারপর ধপ করে পড়ে মারা গেল। আমি বুঝতে পারলাম না ও আমাকে আশীর্বাদ না অভিশাপ দিয়ে মারা গেল। কেবল মনে হতে লাগল, ও নিঃশব্দে ওর চাহনিতে বলে গেল, “তুমিও....!” তখন দু চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল।  কেবল আমি নই, দেখলাম বাড়ির সকলের চোখেই অশ্রু ঝরছে অবিশ্রান্তভাবে।

আমি আলবেলার দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর দুই গাল বেয়ে অশ্রু গড়ে পড়ছে।   

আমি ওর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে নদীর ওপারের অসীম দিগন্তে চোখ রাখলাম। তারপর বলতে শুরু করলাম। তার পরের বছর থেকে আমি আর কোরবানি দেওয়ার সময় সেখানে থাকি না। দু-এক জনকে সেই কাজ করার জন্য পাঠিয়ে দিই।

যাহোক, এবার আসছি শেষবারের কোরবানির কথায়। যে ছাগলটিকে এবার কোরবানি দিলাম সেটি জন্মেছিল জানুয়ারি মাসে। তার মানে ভরা শীতে। যেদিন জন্মেছিল সেই রাত থেকেই আমার বিছানায় লেপের তলায় আপন সন্তানের মতো নিয়ে শুয়ে থাকতাম। কেবল তাই নয়, বিছানায় যেন প্রসব পায়খানা না করে সেই কারণে রাতে কয়েকবার করে তাকে উঠতাম এবং ওর মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে দুধ খাওয়াতাম। মানুষ যেভাবে তার সন্তান বা পাড়ার শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে, আদর করে, যত্ন নেয়; সে ভাবেই আমরা ওর যত্ন নিতাম। ওর সঙ্গে খেলাধুলা করতাম। এমনকি ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার ভয়ে ওকে ঘরের মেঝেতে শুতে না দিয়ে কোলে নিয়ে কাজ করতাম।  আর এভাবেই সে বড় হতে থাকে ভীষণ আদর যত্নে। 

তারপর ও যখন বড় হতে থাকল এবং কোলে নেওয়ার অবস্থা থাকল না, তখনও আমাকে চেয়ারে বসতে দেখলেই আমার কোলে এসে বসার চেষ্টা করতো। কেবল তাই নয়, আমি যদি দিনের বেলায় কখনো শুয়ে থাকতাম আর ও যদি সে অবস্থায় দেখে নিত, তাহলে ও লাফিয়ে খাটে উঠে আমার গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকতো। আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না উঠতাম ততক্ষণ ও আমার গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকত। ওকে বিশেষ কোন খাবার না খাওয়ালেও শরীর স্বাস্থ ভাল থাকতো ও শরীর থেকে তেল চুইত। অনেকে প্রশংসা করে জিজ্ঞেস করতো আমি কোন স্পেশাল খাবার দিই কি না। আমি উত্তরে বলতাম যে না, তবে এক্সট্রা কিছু দিই, সেটি ভালোবাসা।

শুধু কি তাই! যখন আমি উপুড় হয়ে শুয়ে ওকে বলতাম আমার পিঠ ম্যাসেজ করে দে। তখন ও আমার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াত। ওকে লাঠি দেখালে বা লাঠি নিয়ে তাড়া করতে গেলেও ও পালিয়ে যেতো না। আদর, ভালোবাসা পেয়ে পেয়ে ওর মনের মধ্যে এমন একটা আত্মবিশ্বাস জমাট বেঁধেছিল যে তাকে হত্যা করা তো দূরের কথা, আমি ওকে মারতেও পারব না। এমন অবস্থায় আমার মনে হতে লাগল, আমি কত বড় বিশ্বাসঘাতক! বিশ্বাসঘাতক না হলে এমন সরল বিশ্বাসী পশুকে আমি কোরবানি দিতে পারতাম না। 

অবশেষে যখন আমি ওকে কোরবানি করার জন্য বাগানে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ও কোন মতেই সেখানে যাচ্ছিল না। অথচ অন্যান্য দিন আমি ওকে যেখানে ডেকেছি সে নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে, চরম বিশ্বাসে আমার সঙ্গে গেছে। যাহোক, আমি ওকে জোর করে, শক্তি প্রয়োগ করে সেখানে নিয়ে গেলাম। 

তারপর ওকে জবাইকারীদের হাতে তুলে দিয়ে যখন ফিরে আসছি তখন ওর বাঁচার জন্য আকুতি ভরা চিৎকার যেন আমাকে বারবার বলছে, "তুমি একটি বিশ্বাসঘাতক, পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম, নিষ্ঠুর বিশ্বাসঘাতক।” আমি অশ্রু ভরা চোখে ফিরে আসতে আসতে মনে মনে ভাবলাম, ওকে কোরবানি দিয়ে আমি কি পাপের হাত থেকে মুক্তি পাবো? ও কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে? 

আলবেলা হাওমাও করে কেঁদে উঠল। আমি মনকে শক্ত করে ওর পিঠে হাত দিলাম। ও আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটি শিশুর মতো আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

অনেকক্ষণ কান্নার পরে সে থামল। আমার বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। আমি বললাম, কত নির্মম ঘটনা বল?

ও বলল, সত্যি তাই। তারপর উর্ণার আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আচ্ছা সাদ্দাদ বাদসা সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?

আমি বললাম, সেই ছোট বেলা থেকেই উনার জন্য আমার মনের মধ্যে এক গভীর মায়া লুকিয়ে আছে। বেচারা জীবনে খুব কষ্ট পেয়েছেন। আল্লাহর কি নির্মম পরিহাস! উনার জীবনের দিকে তাকালেই তা বুঝতে পারি।

ও বলল, ওটাই পৃথিবী, যেখানে মানুষ তার স্বপ্নের শিখরে কোন দিনও পৌঁছাতে পারবে না।

আমি কিছুই বললাম না। কেবল ওর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তারপরই আমার মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন জাগল, তাহলে আমরা এখন কোথায় আছি? কোন রহস্য ঘেরা জগতে আমরা বাস করছি? এই মায়াবী সুন্দরীর ফাঁদে পড়ে যাইনি তো? ও আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছে?

(চলবে) 

Post a Comment

Previous Post Next Post