পর্ব - ১৫
বুড়া পীরের নিশ্চিহ্নের গল্প
আলবেলা
বলল, তুমি যে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলে তার নামধাম, স্কুলটি দেখতে কেমন কিছুই তো বললে
না।
আমি
বললাম, এসব জেনে তোমার লাভ কি?
ও বলল, আমার যে সব জানতে ইচ্ছে করছে।
আমি বললাম, তাহলে শুনো। পৃথিবীতে যখন থেকে ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন থেকেই অনেক মানুষ সুযোগ পেলেই অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করছে। সে দেবত্ব সম্পত্তি হোক বা পীরত্ব সম্পত্তি হোক। যারা সেই সম্পত্তি দখল করছে তারাই আবার ধর্মের রক্ষক। সমাজের সামনে তাদের মুখে ধর্মের মহান বানীগুলি বারবার উচ্চারিত হয়। নিজেদের ক্ষেত্রে কোন রকম ধর্মীয় ভয়, আল্লাহর ভয় থাকে না। কিন্তু অন্যান্য সাধারণ মানুষদেরকে সেই ভয় দেখাতে সর্বদা তৎপর থাকে। এমনই অনাচার আমাদের গ্রামেও দেখা গেছে।
আমি যে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম
সেই স্কুলের নাম বুড়া পীর বিদ্যানিকেতন। কে এই বুড়া পীর? প্রশ্নটি মাঝে মধ্যেই উঁকি
দিত। কিন্তু কাউকে প্রশ্ন করিনি। ভর্তি হওয়ার মাস তিনেক পরই একদিন বেশ ধুমধাম করে আমাদের
স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপিত হল। আমাদের হেড মাষ্টার সেই অনুষ্ঠানে বললেন, তোমরা
সকলেই জানো যে আজ আমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস। এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে আমাদেরকে
অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে। অনেকের সহযোগিতা পেতে হয়েছে। কিন্তু একজন মহান ব্যক্তি স্বয়ং
উপস্থিত না থেকেও আমাদের স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পূর্ণ আর্থিক সহযোগিতা করেছেন; তিনি
হলেন বুড়া পীর। উনার সম্পত্তি যদি আমরা না পেতাম তাহলে আমরা হয়তো এই স্কুল প্রতিষ্ঠা
করতে পারতাম না। অথচ উনার সম্পূর্ণ ইতিহাস আমরা জানি না। এই এলাকার কিছু উদার ব্যক্তির
সহযোগিতায় উনার সম্পত্তি খাজনা দিয়ে আমরা যে টাকা পেয়েছিলাম সেই টাকা থেকেই আমাদের
স্কুলের জন্ম। আমরা তার ঋণও স্বীকার করেছি। যার কারণে ওই ব্যক্তির নামানুসারে আমরা
স্কুলের নাম রেখেছি বুড়া পীর বিদ্যানিকেতন।
স্কুল থেকে বাড়ি গিয়ে সন্ধ্যার পরে
নানার কাছে গেলাম। নানা তখন মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে বৈঠকে বসে বাড়ির রাখালদের সঙ্গে
গল্প করছিলেন। নানাকে বললাম, কে এই বুড়া পীর, যার নামে আমাদের হাই স্কুলের নাম হয়েছে?
নানা হেসে আমাকে পাশে বসালেন। বললেন,
তাহলে শুনবি? সে তো লম্বা কাহিনী।
আমি বললাম, যতই লম্বা হোক আমি শুনব।
নানা বললেন, ঠিক আছে। গাঙ্গুলী পাড়ায়
পীরপালের নাম শুনেছিস?
আমি বললাম, না।
উনি বললেন, গাঙ্গুলী পাড়া থেকে ছকন্নগর
যেতে যে মাঠ আছে সেখানে বুরহান পীরের কবর আছে। উনাকে বুড়া পীরও বলা হয়। যে সম্পত্তিতে
কবর আছে সেই সম্পত্তির এরিয়া এক দাগে সাত বিঘা। সমস্তটাই সেই পীরের নামে। এছাড়া বিভিন্ন
মাঠে উনার অনেক সম্পত্তি আছে। এমনকি এলাকার মধ্যে যাদেরকে এখন বড়লোক বলে মনে হয় তারাই
বিভিন্ন কৌশলে উনার অনেক সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে ভোগ করে যাচ্ছে। আমরা ছোট থেকে দেখে
এসেছি অনেক মানুষ সেই কবরের কাছে গিয়ে মানত দিয়ে আসত।
আমি বললাম, মানত আবার কি?
নানা বললেন, ধর কোন মেয়ের সন্তান হচ্ছে
না। তার স্বামী আর সেই মেয়েটি ওই কবরের কাছে গিয়ে বলল, আমাদের যদি সন্তান হয় তাহলে
আমরা এখানে বিশটা লোককে ক্ষীর, খিচুড়ি খাওয়াবো। দেখা গেল, কয়েক মাস পরে সেই মেয়েটির
সন্তান হল। তখন ওই মেয়েটির পরিবারের সদস্যরা সেখানে গিয়ে গরিব মানুষ ও তাদের ছেলে মেয়েদের
ক্ষীর-খিচুড়ি খাইয়ে এলো। এরকম কেউ মাংস-ভাত, কেউ ক্ষীর-খিচুড়ি খাওয়ায়। এই ধরণের খাওয়ানোকে
বলে মানত। তাছাড়া মাটির ঘোড়াও অনেক লোকজন সেখানে রেখে আসত।
আমি বললাম, মাটির ঘোড়া কেন?
নানা বললেন, অনেকে বিশ্বাস করে এই
পীর ঘোড়ার মতই উনার যারা মুরিদ তাদেরকে পুলসুরাতে পার করে দিবেন।
আমি বললাম, উনি কতদিন আগে বেঁচে ছিলেন?
নানা বললেন, কোলানের ইতিহাস তো আজকের
নয়। শতশত বছরের পুরনো ইতিহাস। হাজার বছর আগেরও হতে পারে।
ছকন্নগর যাওয়ার যে রাস্তা তার আশেপাশে,
এমন কি রাস্তার উপরে পোড়া মাটির অনেক খোলা এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা
যায়। এদিক ওদিক তাকালে ডিহিও চোখে পড়বে। তাছাড়া রাস্তার উত্তর দিকে তাকালে দেখবি সব
জমিগুলি উঁচু উঁচু। কোলানের আদি বাস ওখানেই ছিল। কারণ মানুষ প্রথমে নদীর ধারেই বসবাস
শুরু করে। আর ওই মাঠের উত্তরেই একটা মস্ত বড় নদী ছিল। এখন অবশ্য বিল হয়ে গেছে।
ওই এলাকায় যখন মানুষ বসবাস করত তখন
এই পীর বুরহান এসেছিলেন সেই এলাকার মানুশকে মুরিদ করার জন্য। তবে কেউ কেউ মনে করেন
সুলতানি আমলে আবার কেউ কেউ বলেন মুঘোল আমলে তিনি এসেছিলেন।
আমি বললাম, শুনেছি উনারা কোন ধনসম্পদ
নিয়ে বেড়াতেন না; তাহলে উনি অত জমি পেলেন কি করে?
নানা হেসে বললেন, উনারা যখন যেখানে
যান সেখানকার লোকের কাছে কিছুটা জমি চেয়ে নেন। আবার এরকমও হয়, সে রকম পরিবেশ হলে কিছুটা
জমি তিনি নিজেও কিনে নেন। এরকমই কোনভাবে তিনি এখানে বসতি শুরু করেছিলেন। তারপর কোন
লোকের অসুখ হয়েছে। তিনি কোনভাবে সেই অসুখ সেরে দিয়েছেন তখন সেই লোক খুশি হয়ে উনাকে
জমি দান করেছেন। কেউ কোন সমস্যায় পড়েছে; কিন্তু তার প্রভাবে সেই সমস্যা থেকে উদ্ধার
হয়েছে তখন তাকে জমি দান করা হয়েছে। এইভাবেই তার অনেক জমি হয়েছিল। উনি মারা যাওয়ার পর
ওই পীর পালে তার নিজের জমির উপরে তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল। তারপরও আশেপাশের অনেক লোক
সেখানে গিয়ে মানত করত আর ঘোড়া রেখে আসত। এরকমই একটা প্রচলন চলে আসছিল। কিন্তু আশেপাশের
গ্রামে যখন ফারাজির প্রভাব বাড়তে লাগল আর এদিকে সেই সময়ের প্রভাবশালী মানুষেরা পীরের
জমি ভোগ করছিল তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় সেখানে মানত করা সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করে দেওয়া
হল। কারণ ওরা জানতো, সেখানে এমন কাণ্ডকারখানা চললে একদিন তাদের মুখোশ খুলে রাক্ষুসে
মুখ লোকের সামনে চলে আসবে। এমনকি তারা সেই সব জমি আর ভোগ করতে পারবে না।
আমি বললাম, যারা এই সম্পত্তি ভোগ করছে
তারা পরকালে শাস্তি পাবে না?
নানা বললেন, সেদিন কাউকে ক্ষমা করা
হবে না। কিন্তু কজন মানুষ আছে যারা পরকালের ভয়ে কারো কোন কিছু আত্মসাৎ করে না?
আমি আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদটা ধোঁয়াতে
মেঘের আড়ালে কখন হারিয়ে যাচ্ছে আবার কখনো মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে পড়ছে।
আলবেলা বলল, মানুষের চরিত্র বড়ই অদ্ভুত।
নিজের স্বার্থের জন্য ধর্মটর্ম কিছুই মানে না আর অপরের স্বার্থের কাছে ধর্মের আস্ফালন
শানিত চোখ রাঙায়।
আলবেলার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কেবল মুচকি হাসি হাসলাম।