ঝুঁজকি আলোর রেখা-১৪/আজিজুল হাকিম

 


১৪ 

ধার্মিক আর সমাজের কর্মকাণ্ড


তখন হয়তো সিক্স কিংবা সেভেনে পড়ি। শুনলাম আমাদের গ্রামের মাদ্রাসায় একটি নতুন মৌলবী এসেছে। সে নাকি বলেছে, ইসলাম ধর্ম মতে কিয়াম করা হারাম। প্রথম অবস্থায় এই কথা কানেকানে ফিসফিস করে আলোচিত হতে লাগল। তারপর আস্তে আস্তে প্রকাশ্যে বলাবলি শুরু হল। এই নিয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে এই প্রথম দ্বিমত শুরু হল। কেউ দাঁড়াল কিয়ামের পক্ষে আবার কেউ থাকল কিয়ামের বিরুদ্ধে। কিয়াম আর আনকিয়ামিদের মধ্যে প্রথমে শুরু হল ঠাণ্ডা লড়াই। সেই লড়াই ধীরেধীরে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে গ্রামটি যেন একটি বিড়াট বোমের স্তূপে পরিণত হল। যে কোন মুহূর্তে বিস্ফারিত হয়ে সারা গ্রামটিকে ধূলিসাৎ করে দেবে।

সামনের শুক্রবার জুম্মা মসজিদে এই নিয়ে একটি আলোচনা হবে। তাতে উভয় দিকেরই লোক থাকবে। আলোচনা যাই হোক না কেন মসজিদ দখলের জন্য একটি বিড়াট মারপিট, খুনখারাপি হবে। যার জন্য উভয় দিকের লোকই চাল-ধান বেচে অস্ত্র মজুত করার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

এই ঝামেলার কিয়ামের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন তার বিপক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছে তার আপন জামাই। এটি একদিকে যেমন কিয়াম আনকিয়ামের লড়াই; তেমনি জামাই শ্বশুরের লড়াই।

কিন্তু বলা যায় গ্রামের ভাগ্য ভাল। শুক্রবারের আগেই সেই পঁয়তাল্লিশ ঊর্ধ্ব মৌলবি এক রাতে গ্রামের তেরো – চৌদ্দ বছরের এক অপরূপ সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে চম্পট দিল। মেয়েটি ওই মৌলবির কাছে মাদ্রাসায় পড়ত।

গ্রামের মধ্যে ঝামেলা হল না। কিন্তু একটি চিড় ধরে থাকল। সময়ের স্রোতে সেই চিড় আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। শবেবরাতের হালুয়া-রুটি কারো বাড়িতে চালু থাকল আর কারো বাড়ি থেকে চিরকালের মতো হারিয়ে গেল।

আলবেলা বলল, তোমাদের বাড়িতে?

আমাদের বাড়িতে চালু থাকল। কিন্তু পাড়ার মধ্যে যেই আনন্দ বিরাজ করত সেই আনন্দও ধীরেধীরে ম্লান হয়ে পড়তে লাগল। একটা আনন্দ উজ্জ্বল দিন তার নিজস্ব দীপ্তি হারিয়ে ফেলল। ধর্মের মধ্যে চালু হতে থাকল গোঁড়ামি আর ভণ্ডামির সূত্রপাত।

একদিন বিকেল বেলায় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। গ্রামের মধ্যে একটি বড় ফাঁকা জায়গায় প্রচুর মানুষের সমাগম দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু সেখানে আমাদেরকে দাঁড়াতে দেওয়া হল না। বাড়ি যেতে যেতে আমি রিমিকে বললাম, কি ব্যাপার রে, এখানে কি হচ্ছে?

রিমি বলল, শুনিস নি, আরজুমার মা করিমের সাথে গত রাতে পালিয়ে গেছিল? ওরই বিচার হচ্ছে।

আমি বললাম, কই না তো!

ও আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, আসলে তো তুই হুদকা আছিস। তাই শুনিস নি।

সেদিন সন্ধ্যা বেলায় তেমাথার দিকে চরম হইহুল্লড় আর টিন বাজার চিৎকার শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গেলাম। দেখলাম, তেমাথার দিক থেকে প্রচুর লোক চিৎকার করতে করতে আমাদের দিকে আসছে।

যখন আমার পাশ দিয়ে সেই লোকেরা যাচ্ছিল তখন দেখলাম, করিম আর আরজুমার মায়ের মুখে চুনকালি লেপা আর ওদের গলায় দুটি ভাঙ্গা টিন ঝুলছে। ওরা দুজন সামনে সামনে হাঁটছে আর ওদের পিছুনে পিছুনে পাড়ার যুবকের দল ভীষণ উল্লাসে টিন বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে। ওদের চোখের দিকে তাকালাম। ওরা কাঁদছে আর মাথাকে নিচু করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।

কখন রিমিও এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। লোকজন চলে গেলে আমি পাশ ফিরলাম। রিমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। রিমিকে বললাম, এটা আবার কি হচ্ছে?

রমি বলল, আমাদের ধর্ম মতে এটাই বিচার। মৌলবি ডেকে ফতুয়া জারি করে এই ফয়সালা হয়েছে। যেন ইচ্ছে করলেই কেউ কাউকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। আর পালিয়ে গেলে এরকমই বিচার হবে। এটা একটি ধর্মীয় বিধান। এরকম না করলে সমাজে কোন নিয়ম শৃঙ্খলা থাকবে না। বুঝলি? ওদেরকে তো একশ এক দূররাও মারা হয়েছে।

দূররা আবার কি?

তুই তো কিছুই বুঝিস না। আসলে তুই তো মানুষই না। তুই দেখতেই কেবল মাত্র মানুষের মতো।

ওই কারণেই রিমির সাথে কথা বলতে ভাল লাগেনা। ও কেবল মাত্র আমাকে পাগলা বানানোর চেষ্টা করেই যাবে।

ও বলল, কঞ্চি দিয়ে একশ একবার মারা হবে।

আমি বললাম, এতবার! তাহলে তো মরেই যাবে।

মারার মতো কি আর মারা হয়? কেবল আস্তে আস্তে করে মারে। শুধু লজ্জা দেওয়ার জন্য এমন কাজ করা হয়।

দেখলাম এ বিষয়ে আমার চেয়ে রিমির অনেক জ্ঞান আছে। অথচ আমরা দুজনে প্রায় একই বয়সের। বয়স আর কতই হবে খুব বেশি হলে চোদ্দ পনের বছর।  

ওই ঘটনার পরের দিনই মায়ের মুখে শুনলাম আবু হামজার কাহিনী। উনি হজরত উমারের ছেলে ছিলেন। বেশ পরহেজগার। উনার কণ্ঠ এত মধুর ছিল যে, উনি যখন কোরান তেলওয়াত করতেন তখন আশেপাশের লোকেরা উনার কোরআন তেলয়াত শুনতে ভিড় করতেন। তাছাড়া চরম ধর্মভীরু ছিলেন।

কিন্তু এক সময় এক সুন্দরী যুবতীকে দেখে তার প্রেমে পড়ে গেলেন। মেয়েটি আবু হামজাকে এত এতই পাগল করল যে সে তার সঙ্গে দৈহিক মেলামেশা হয়ে গেল। এই ঘটনাটি চারিদিকে চাউর হয়ে গেল। ফলে এক বিচার সভা বসল। সেই বিচারে হজরত উমার ঘোষণা করলেন যে তাকে একশ এক দূররা মারা হবে এবং তিনি নিজেই সেই দূররা মারবেন।

তিনি এমনভাবে মারলেন যে পঞ্চাশ দূররার আগেই মারা গেলেন। তারপরও তাকে ছাড়া হয়নি। ওর লাশের উপরে বাকি দূররা মারা হয়েছিল।

আমি তো শুনে চমকে গেলাম। মাকে বললাম, নিজের ছেলেকে এমন করে হত্যা করলেন?

মা বললেন, আল্লাহর হুকুম মানতে এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না। এরকম কাজ যদি তুই করিস তাহলে তোর বাপও তোকে ওইভাবে কতল করবে।

আমি কোন কথা না বলে মায়ের সামনে থেকে সরে গেলাম।

এই ঘটনার পর বছর যেতে না যেতেই একদিন সকাল বেলায় শুনলাম কালার স্ত্রী বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে।

কথাটা শুনেই আমি চমকে উঠলাম। তাহলে কালার মেয়েদের কি অবস্থা হবে! ওরা বাঁচবেই বা কিভাবে?

কালার বাড়িটা ছিল আমাদের পাড়া থেকে মাঠে যেতে যে পথ সেই পথের ধারে। পাড়ার প্রায় শেষের দিকে। কালার বাড়ি থেকে দু-চারটি বাড়ি পার হলেই মাঠ। সেখানে একটি চালা বাড়িতে কালার স্ত্রী ও তার তিন মেয়ের জীবন চরম দুঃখ-কষ্টে চলে যাচ্ছিল। আর এমন সময় কঠিন বজ্রাঘাত নেমে এল এই তিন মেয়ের জীবনে। এটা আমি কোন মতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।

কালা বলেতে সেই কালা কেবল কালাই ছিল না – বোবাও ছিল। কোন কথা যেমন বলতে পারত না, তেমনি শুনতেও পেত না। কেবল মাত্র মুখে বিভিন্ন রকমের শব্দ করে আর হাতের ইশারা করে এটি ওটি মানুষকে বুঝাতে পারত। এদিকে ওই লোকটি কালা-বোবা হলেও ভীষণ কর্মঠ ছিল। গ্রামের এমন কোন কাজ ছিল না সে জানত না। ফলে কাজ কর্ম করে সে দিনপাত করত। কোন অসুবিধা হত না। বলা যায় তখন কালার স্ত্রীর একটি সোনার সংসার নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছিল। তাছাড়া সে কালা-বোবা হলেও তার স্ত্রী ছিল বুদ্ধিমতী, চালাক-চতুর, বাকপটু মহিলা।  

গ্রামে অবশ্য বারোমাস কাজ থাকে না। কখনও কখনও মাসের পর মাস কর্ম বিহীন জীবন কাটাতে হত। এরকম এক কর্মহীন সময়ে গ্রামের কয়েকজন মাঝ বয়সী লোক বাইরে কাজ করতে যাওয়ার উদ্যোগ নিল। তাদের সঙ্গে কালাকেও নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। কিন্তু কালার স্ত্রী কোন মতেই তাকে ছাড়তে নারাজ। ওর একটাই ভয়, সে গেলে আর ফিরে আসতে পারবে না। সে জীবনে আশপাশের দুচারটি গ্রামের বাইরে কোথাও যায়নি।

কিন্তু তারা তাকে আশ্বস্ত করল, তারা কালাকে কখনোই একা ছেড়ে যাবে না।

তাতেও কালার স্ত্রী জেদ ধরে থাকল, না কালাকে আমি কোথাও যেতে দেব না। ও কিছু জানে না, শুনে না, চিনে না; তাহলে কেনে যেতে দিব? আমি কেনে এমন অবোলা লোককে তুমাধের সাথে ছাড়ব, বল? আর ও কালা-বোবা যাই হোক, ওই তো আমার একমাত্র সম্বল, আমার মাথার একমাত্র ছাতা। ও ছাড়া আমি আর আমার তিন মেয়ে পথে বসে যাবো গো। তুমরা অকে লিয়্যা যাইও না।  

ওদের মধ্যে থেকে একজন বলল, আরে অতো ভয় পাচ্ছ কেনে? আমরা কেউ না কেউ তো ওর সাথে থাকব। তাছাড়া এখুন তো আর কোন কাজ নাই। বর্ধমানে ধান কাটার এখুন ম্যালাই কাজ। মুনিশের দরও ম্যালাই। কটা টাকা যদি হয় তাহলে তুমাধেরও তো ভাল লাগবে।

না, বাপু। আমার অত টাকার লোভ নাই। তুমরাই যাও।

আর একজন বলল, আরে, মিয়্যাডা পাগলি নাকি! আমাধের উপর তুমার বিশ্বাস নাই? আমরা তুমাকে কথা দিচ্ছি আমরা মর‍্যা গেলেও কালাকে ফেল্যা আসব না।

আমার ক্যামুন, ক্যামুন করছে গো। বুকের মাঝে ডর লাগছে। না জানি কি হয়! তবে যা ভাল মুনে হয় তাই করো।

ওরা কালাকে নিয়ে বর্ধমান ধান কাটতে চলে গেল। ধানও কাটল। কিছু টাকাও হল। তারপর যেদিন বাড়ি ফিরছিল তখন ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে স্টেশনে পৌঁছাল। এদিকে আবার স্টেশনে খুব ভিড়। ট্রেন ধরার জন্য সবাই ছুটতে লাগল। ট্রেন ধরার নেশায় ভুলে গেল কালার কথা। তখন অত ভিড়ের মাঝে কালা দিগভ্রান্ত। ট্রেন যখন ছেড়ে দিল তারপর মনে পড়ল কালার কথা। ট্রেনের উপরে খুঁজাখুঁজি চলল। কালাকে পাওয়া গেল না।

যখন ওরা বাড়ি ফিরল তখন কালার স্ত্রী ওদেরকে বলল, আমার পাগল কই?

ওরা কিছুক্ষণ কোন কথাই বলতে পারল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর একজন ঘটনাটি বলল।

ঘটনাটি শোনার পরপরই “আমার কি হল গো…” বলেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। মেয়েগুলোও চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।

তারপর কান্নাই ওদের চির সাথী হয়ে রইল। কিন্তু পাগল আর একটি দিনের জন্যেও ফিরে এলো না।

এরপর আর কি করা যায়। কালার স্ত্রী এ বাড়ি, সে বাড়ি কাজ করে কোন মতে সংসার চালাতে শুরু করল। কালার বড় মেয়েটিও মায়ের হাতে হাত লাগায়। ওর বয়স তখন তের বছর। মেজটা এগারো আর ছোটোটার বয়স আট বছর।

পরের বাড়িতে কাজ করে মাস ছয়েক যেতে না যেতেই এক গভীর রাতে কালার স্ত্রীর চিৎকারে সারা পাড়া জেগে উঠল। কালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুটি জোয়ান মরদ মাঠের দিকে দিল ছুট। কিছু লোক ওদেরকে চিনে ফেলল। কিন্তু ধরতে পারল না।

পরের দিন সন্ধ্যা বেলায় বিচার বসল। জমায়েত হল প্রচুর লোক। বিচারে জানা গেল ওই দুজন কালার স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে গিয়েছিল। ওদের জরিমানা হল।

বিচারের একদিন পর সকাল বেলায় জানা গেল কালার স্ত্রী তিন মেয়েকে রেখে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে মারা গেছে।

তারপর বড় মেয়েটির ঘাড়ে পড়ল সংসারের পুরো দায়িত্ব। মেয়েটিও দু-বছর ধরে দুই বোনের পেটের খোরাক জোগাড় করতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বাড়ি সে বাড়ি কাজ করেই চলল। 

সে পনের বছরে পা দিল। শরীরের মধ্যে যৌবনের উঁকিঝুঁকি। দেখতেও খুব সুন্দর হল। তখন যে বাড়িতে কাজে যায় সেই বাড়ির জোয়ান ছেলেরা সুযোগ বুঝে ওর দেহকে খুবলে খেতে শুরু করে। দুই বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে সে আর তার মায়ের মতো ভুল করল না। কিন্তু ষোল বছর পুজতে না পুজতে এক রাতে সে চিরকালের মতো হারিয়ে গেল। কে কোথায় নিয়ে চলে গেছে, না কোথাও বিক্রি করে দিয়েছে তার কোন হদিস পাওয়া গেল না। কেবল বাতাসে উড়ে বেড়াতে লাগল, বিহারে অথবা ইউপিতে কিংবা জম্মু কাশ্মীরে বিক্রি হয়ে গেছে। আবার কখনও কখনও ভাসতে লাগল, কোন হোটেলে ওকে বেচে দেওয়া হয়েছে। 

তখন থেকে সময়ের ধারায় একে একে বাকি দুই বোনও কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেল। ওদেরকে খুঁজবার আর কেউ থাকল না। কেবল শূন্য বাড়ি আলোবিহীন খাঁখাঁ করতে লাগল। বাড়ির আঙ্গিনায় আর বারান্দায় বিভিন্ন গাছ, ঘাস আর আগাছায় ভরে উঠতে লাগল। শুধুমাত্র চালা ঘর দুটি ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওদের ফিরার অপেক্ষায় কয়েক বছর স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর একদিন দেখা গেল অতি বৃষ্টিতে ওরা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

এতক্ষণ শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে কেবল ঘটনাটি বলেই যাচ্ছিলাম। গল্প শেষে হলে আলবেলার মুখের দিকে তাকালাম। কোন এক স্বর্গীয় আলোয় ওর গালে চুয়ে পড়া অশ্রুগুলি মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

(চলবে)

Post a Comment

Previous Post Next Post