পর্ব-১১
আমার যখন জ্বর
যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন দেখলাম আলবেলা আমার মাথাটা ওর কোলের উপরে তুলে নিয়েছে। কখন যে ও আমার মাথা ওর কোলে নিয়েছে আমি বুঝতেই পারিনি। ভোরের শুভ্র আলোর মতোই ওর একরাশ হাসি আমাকে দেখাল। আমার সারা দেহ মোটা চাদরে ঢাকা। ওর নরম তুলতুলে হাত দুটো আমার মাথায়, কপালে, মুখের উপর অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর স্নিগ্ধ নরম হাতের ছোঁয়ায় আমি বিভোর হয়ে পড়ছি।
আমি উঠতে গেলাম। ওর হাত দুটি দিয়ে
বিছানার সঙ্গে চেপে ধরে বলল – তুমি উঠো না। তোমার জ্বর হয়েছে। দেখছ না, তুমি কাঁপছ?
দেখলাম সত্যি আমার দেহে কোন শক্তি
নেই। শরীরটাও কেমন যেন কাঁপছে। এমন হল কেন? এই দেশেও কি জ্বর আছে! এখানেও কি জ্বর হয়!
আমি বললাম, পানি দাও। ভীষণ পিপাসা পেয়াছে।
ও বালিশটি টেনে আমার মাথার নীচে গুঁজে দিল। তারপর
খাট থেকে নেমে বাইরে চলে গেল।
আমি চোখ দুটি বুজলাম। জ্বর হলেই আমার
এমন অভ্যাস। শুলে আর তাকাতে ইচ্ছে করে না।
ও গ্লাসে পানি নিয়ে এল। আমার মাথাটা
তুলে ওর বুকের উপর রেখে পানি খাওয়াতে লাগল। ওর বুকের স্পন্দিত গোলাপের পেলব উচ্ছ্বাস
আমি অনুভব করলাম। ওই জ্বরের অবস্থাতেও এক মৃদু শিহরণ আমার সারা দেহে খেলে বেড়াচ্ছে।
পানি খেতে গিয়েও যেন গলায় ব্যাথা হচ্ছে।
কয়েক বার মুখ থেকে গ্লাস ছেড়ে আবার মুখে গ্লাস নিয়ে সব পানি খেলাম।
ও গ্লাসটাকে পাশে রেখে ওর বুক থেকে
যখন আমার মাথাটি নামিয়ে বালিশে রাখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক তখনই আমি আমার দুহাত
দিয়ে ওর মাথাটা জড়িয়ে ওর গোলাপি তুলতুলে ঠোঁট দুটিকে আমার মুখে গুঁজে দিলাম। ওর ঠোঁটের
দু এক বার রসাস্বাদন করতেই ও ঠোঁট দুটি আমার ঠোঁট আর মুখের সামনে মেলে ধরল। তারপর কিছুক্ষণ
পরে আচমকা আমার হাত থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে হেসে বলল, তুমি খুব দুষ্ট
হয়েছ। এমন করলে তোমাকে রেখে আমি পালিয়ে যাব।
আমি বললাম, কোথায়?
ও বলল, যেদিকে দুচোখ যাবে।
আমি বললাম, সত্যি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে
পারবে?
ও আমার চোখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির
তাকিয়ে রইল। তারপর কোঠার দিকে চোখ ফিরিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল, যদি পারতাম তাহলে এতদিন বছরের
পর বছর ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারতাম? আমার দিকে আবার তাকাল। বলল- তোমার
জ্বর হয়েছে। সুস্থ হয়ে উঠো।
ও আবার আমার কাছে ফিরে এল। আমার পাশে
খাটে বসল। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। তোমার জন্য ওষুধ নিয়ে
আসি।
আমি বললাম, কত দেরি হবে?
বেশি নয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়ে আসছি।
আলবেলা চলে গেল। মরার মতই আমি বিছানায়
পড়ে রইলাম। তাকিয়ে রইলাম কোঠার দিকে। এখনো আলবেলার বাবা-মায়ের খবর কিছুই নেওয়া হয়নি।
এ বাড়িতে কি ও একাই থাকত? এছাড়া এ গ্রামে মানুষজন কিছুই তো তেমন দেখতে পেলাম না। অথচ
ঘর বাড়ি সবই আছে। এক রহস্য মনের মধ্যে উঁকি মেরেই যাচ্ছে। কোথায় আছি? কোন ঠিকানায় চলছি?
কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি কি ফিরে যেতে পারব আমার আগের ঠিকানায়?
আলবেলা ঘরে ঢুকল। হাতে কিছু লতাপাতা।
বলল, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। মিক্সচার করে নিয়ে আসছি।
আমি ভেবেছিলাম, হোমিওপ্যাথি বা অ্যালপ্যাথি
এমন কোন ওষুধ হবে। কিন্তু না। ওর হাতে যা দেখলাম তাতে কেমন অরুচি অরুচি ভাব। কিন্তু
কিছুই করার নেই। ওই খেতে হবে।
এক গ্লাস সবুজ সরবত নিয়ে এসে ও আমার
মুখের সামনে মেলে ধরল।
আমি বললাম, আমি এসব খেতে পারব না।
ও বলল, রুগীকে এসব বলতে নেই। তুমি
এখন রুগী। আমি ডাক্তার। যা হুকুম করব তাই খেতে হবে। তাছাড়া খেয়ে দেখ, খুব টেস্টি।
আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। দেখলাম,
আমার না খেয়ে কোন উপায় নেই। আমি খুব কষ্টে উঠে বসলাম। আমার দুই হাত দিয়ে ওর গ্লাস ভর্তি
হাতটিকে ধরে চোখ বুজে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম। সত্যি খুব সুস্বাদু একটি রস।
খাওয়ার পর আমি আবার শুয়ে পড়লাম। ও
গ্লাসটিকে টেবিলে রেখে আমার পাশে এসে বসল। আবার ওর নরম হাতের মৃদু স্পর্শ আমার মুখে
আর মাথায় দিয়ে যাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই সারা শরীর
কাঁপিয়ে জ্বর চলে এল। সে কি ভীষণ কাঁপনি! লেপ-কম্বল যা ছিল ও সবই আমার গায়ের উপর চড়িয়ে
দিল। তবুও আমার দেহ থেকে একটুও জ্বর কমলো না। কাঁপুনিতে আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। মনে
হতে লাগল। আমি হয়তো আর বাঁচব না।
ও বলল, ওষুধ খাওয়ার পর জ্বর বাড়বে।
এতে ভয়ের কিছুই নেই।
ও বললে কি হবে? আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার
জন্য বলতেই পারে। কিন্তু আমার ভিতর যে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। আমি যে আর নিজেকে কন্ট্রোল
করতে পারছি না।
আমার অস্থির অবস্থা দেখে ও জানালা
দরজা বন্ধ করে দিল। ওর মুখমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসা এক মৃদু আলোর আভায় সারা ঘরটা কেমন
উদ্ভাসিত হয়ে পড়ল। আমি ওর দিকে তাকালাম। আস্তে আস্তে ওর পোষাক খুলে ফেলছে। এদিকে ঘরটিও
ধীরে ধীরে আরো আলোকোজ্জ্বল হয়ে পরছে।
এ কোন আলোকিত পরী! কি এর রহস্য? কোন
যাদুমন্ত্রে এই মেয়ের জন্ম? কোথা থেকে পেয়েছে এমন আলোর প্রভা?
ও বলল, আমার দিকে তাকাবে না। দেয়ালের
দিকে তাকাও।
আমি হাসলাম। বললাম, কেন তোমাকে দেখতে,
তোমার দেহ দেখতে আমার অসুবিধা কোথায়? তোমার নগ্ন দেহের ঐশ্বর্য, তোমার উদোম দেহের মাধুরী
আমাকে দেখতে দাও, প্লীজ! তোমাকে দেখায় সার্থক হোক এই জীবন।
ও বলল, না। আমারও তো লজ্জা হয়।
আমি বললাম, তোমার দেহও তো আমার। তাহলে
আমাকে দেখাতে লজ্জা কিসের?
আমি কোন কথা শুনতে চাই না। দেয়ালের
দিকে তাকাও। ও শাসনের সুরে বলল, আমি যা বলছি তোমাকে তাই করতে হবে। কোন অযুহাত চলবে
না।
আমি কথা না বাড়িয়ে দেয়ালের দিকে তাকাতে
লাগলাম আর মনে হতে লাগল ঘরটিতে কত সুন্দর এক মায়াবী আলোর প্রজ্জলতা খেলে বেড়াচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম, এক নগ্ন
দেহ আমার পিঠকে স্পর্শ করে আমার পাশে লেপের ভিতর ঢুকে পড়ছে। আমি দেয়ালের দিকে তাকিয়েই
বললাম, তুমি এলে?
আলবেলা বলল, ন্যাকামি করছ, তাই না?
কেন, বুঝতে পারছ না?
আমি এবার ঘুরলাম। দেখলাম, এক মায়াবী
আলো ওর নগ্ন দেহ থেকে পুরো লেপের ভিতর খেলে বেড়াচ্ছে। ওর মুখ, ওর হাত, ওর পা, ওর দেহ
– সমস্তটাই এক আলোকিত সত্ত্বায় গড়ে উঠেছে। এক আশ্চর্য সুন্দর আলোকিত মায়াবী সুন্দরী
আমাকে বুকের ভিতর টেনে নিচ্ছে। আমি হারিয়ে যাচ্ছি। আলোর মাঝে, না এই মায়াবী নারীর দেহে
তা বুঝতে পারলাম না। মনে হচ্ছে আমি কোন আলোকিত সত্ত্বার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি। কোথায়?
কোন নান্দনিক সুখ সাগরের অতলে আমি তলিয়ে যাচ্ছি? কোন এক মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আমাকে টেনে
নিচ্ছে। যে অনস্তিত্ত থেকে আমার উৎপত্তি সেই অনস্তিত্তের মাঝেই কি আমি বিলীন হয়ে যাচ্ছি?
জানি না, জানি না কোথায় আমি হারিয়ে যাচ্ছি। এটাই কি আলবেলার বুক, নাকি কোন স্বর্গীয়
নারীর বুকে আস্তে আস্তে আমি লীন হয়ে যাচ্ছি?
আমি বললাম, আলবেলা, কোথায় পেয়েছ তুমি
এমন সৌন্দর্য-নগরী?
ও কিছুই বলল না। কেবল হাসল। আর ওর
হাসি থেকে বেরিয়ে এল অদ্ভুত আলোর শিখা। ওর দুবাহুর বন্ধনে আমাকে আর শক্ত করে বাঁধতে
ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এক চরম উষ্ণ শিহরণে আদিম খেলার জগতে আমরা হারিয়ে যেতে লাগলাম।
যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন দেখলাম, ভোরের
মতো এক আলোয় ঘরটি ভরে আছে। জানালা, দরজা খোলা। আমার পাশে, এই ঘরে আলবেলা নেই। কেবল
আমি একেলা।
(চলবে)