৪
স্বপ্নের গ্রাম
আমরা পৌঁছালাম একটি গ্রামে। সুদূর
বিস্তৃত একটি উপত্যকা। এই উপত্যকা সমতল নয়। চারিদিকে চড়াই উতরাই। টিলার মতো ছোট ছোট
প্রত্যেক উচ্চভূমির উপরে একটি করে বাড়ি। প্রতি বাড়িতে একটি করে ঝঁকড়া গাছ। সেই গাছগুলি
সাদা ফুলে ভরে আছে। সেই ফুল থেকে বেরিয়ে আসছে এক অপার্থিব মধুর সুগন্ধ। ফুরফুরে বাতাসে
মনটা চনমন করছে। চারিদিকে সুউচ্চ পাহাড়। যেন এই গ্রামের চারিদিকে বিশাল উঁচু দেয়াল।
সেই পাহাড় ঢেকে আছে ঘন সবুজ গাছপালায়। যেন সবুজ চাদরে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে আজীবন।
চারিপাশের পাহাড়ের ঠিক কেন্দ্রস্থলে
গ্রামটি। একটি বাড়ি থেকে আর একটি বাড়ির দূরত্ব কম করে পাঁচশ হাত দূরে। প্রত্যেক বাড়ি
মাটির তৈরি। প্রতি ঘরের উপরে সোনালি রঙের খড় দিয়ে ছাওয়া। বাড়ির প্রাচীরের দেওয়াল চিকন
করে লেপা। তার উপরে বিভিন্ন রঙ দিয়ে নানান রকমের লতাপাতা, গাছগাছালি ও ফুল-ফলের ছবি
আঁকা হয়েছে। গাছগুলির উপরে সুন্দর সুন্দর নানান রঙের পাখি বসে আছে। গাছের নীচে হরিণের
ছবি। এ সবই দেয়ালের গায়ে অঙ্কন করা হয়েছে।
প্রতি বাড়ির পিছুনে ছোট ছোট বাগান।
সেই বাগানে কি নেই! আপেল, আঙ্গুর, বেদানা থেকে শুরু করে সব সুস্বাদু ফলগুলি ঝুলে আছে।
আমি আলবেলার পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছি
সামনের দিকে। একটির পর একটি বাড়ি পার হয়ে চলে যাচ্ছি আঁকাবাঁকা পথ ধরে। কিন্তু আশ্চর্যের
বিষয় হল, রাস্তা ঘাটে কোন মানুষ নজরে পড়ছে না।
আমার মনের মধ্যে কৌতূহল জাগল। আলবেলাকে
বললাম, এখানে ঘরবাড়ি দেখতে পাচ্ছি; কিন্তু মানুষ কোথায়?
ও আমার দিকে ঘুরল। মুখে একরাশ প্রসন্ন
হাসি। বলল, এ এলাকায় লোকজন খুব একটা নেই। তাছাড়া এ সময় বিশ্রাম নেওয়ার পালা। লোকজন
বিশ্রামে আছে।
আমি আর কোন কথা বললাম না। কি আর বললব?
এই জায়গাটাই তো আলাদা। আমি কেবল এদিক ওদিক তাকাতেই ব্যস্ত। দেখার স্পৃহা মনের গভীরে।
পৃথিবীতে কোথাও এমন জায়গা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। যদি না পাওয়া যায় তাহলে এখানেই
বা এলো কি করে? হয়তো আছে। পৃথিবীর কতটুকুই বা দেখেছি?
আমরা যখন গ্রামের মাঝে এলাম সেখানে
দেখলাম পাড়ার ছেলে মেয়েরা এক সঙ্গে সুর করে গান গায়ছে আর নাচছে। ওদের মাথায়, হাতে,
কোমরে সেই সাদা সাদা ফুলের মালা জড়ানো। ওদের নাচের তালেতালে সেই ফুলগুলোও হেলে, দুলে,
নেচে নেচে উঠছে।
ছোট বেলায় এমন গান শুনতাম সাঁওতাল
নারী পুরুষের কণ্ঠে। ওরা দল বেঁধে আমাদের গ্রামে কাজ করতে আসতো। পাড়ায় যারা মোড়ল থাকতো
তাদের বড় বড় বৈঠক। সেই বৈঠকে তারা ছেলে মেয়ে নিয়ে রাত কাটাত। কোন কোন জ্যোৎস্নার রাতে
তারা দলবদ্ধভাবে নাচত আর সুন্দর সুর করে গান গায়তো। সেই সুর গ্রাম ছাড়িয়ে চলে যেত মাঠের
দিকে। হয়ত অন্য গ্রামে। মাঝে মাঝে এমনও দেখেছি, ধান লাগাতে লাগাতে ওরা এক সঙ্গে সুর
করে গান গায়ছে। সেই গানের সুর মনের মধ্যে একটা আনন্দের শিহরণ নিয়ে আসতো; যদিও সেই গানের
অর্থ কিছুই বুঝতাম না।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা ওদের কাছে পৌঁছে
গেলাম। আমাদের দেখে ওরা কোন রকম লজ্জা বা সঙ্কোচবোধ করল না। ওরা আনন্দে আপন খেয়ালে
নাচছে আর গান গায়ছে।
আমি বললাম, এখানে একটু বসলে হয় না?
আলবেলা বলল, নাচ দেখবে?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
ও সামনের একটি গাছ দেখিয়ে বলল, ঠিক
আছে চলো। ওই গাছ তলায় বসি।
আমরা গাছতলায় গিয়ে বসলাম। মেয়েগুলি
খেলার ছলে গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেচে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর থামল। ওদের মধ্যে একটি
মেয়ে আলবেলাকে ডাকল। আলবেলা বলল, না রে আমি যাচ্ছি না। আমি নাচব না। তোরাই নাচ।
আমি বললাম, গেলে যাও। একটু নেচে এসো।
না, আমি যাব না। নাচতে চায়লে তুমি
গিয়ে নাচ।
আমি! আমি তো নাচের কিছুই জানি না।
তাহলে চুপচাপ থাক। - কথাটি বলে আমার
দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ওদের দিকে দিল। বলল, তোরা নাচ, আমরা দেখি। তোদের জন্য নতুন অতিথি
নিয়ে এসেছি। ওকে তোদের নাচ দেখা।
ওদের মধ্য থেকে একটি মেয়ে বলল, কে
ওটা?
আলবেলা আমার দিকে ওর চোখ আর ঠোঁটের
হাসি ছড়িয়ে দিল। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বন্ধু।
কোথাকার বন্ধু তোমার?
তোরা চিনবি না।
আমি আলবেলার দিকে চোখ মেলে তাকালাম।
এতক্ষণে আলবেলার উপর সম্পূর্ণ ভরসা ও আস্থা পেলাম। ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ থেকেও কেমন একটা
সংশয় মনের মাঝে উঁকি মারছিল। এখন সেটি মুহূর্তের মধ্যে কোথায় ভ্যানিস হয়ে গেল। আমি
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
ও নৃত্যরত মেয়েগুলির দিকে তাকিয়ে বলল,
এই আমরা আসছি রে। তোরা ভাল করে নাচ, আরো ভাল নাচতে হবে। - কথাটি বলেই ও দাঁড়িয়ে পড়ল।
তারপর আমার হাত ধরে টান দিল, চল যাই?
আমার চোখ ওর চোখের মাঝে হারিয়ে যেতে
লাগল। জানিনা ওর চোখের মাঝে কি আছে, চোখের ওপারেও বা কি। কেবল মনে হচ্ছে এই চোখ দুটি
এক অসীম মায়ার সাগর। এখানে নিশ্চিন্তে পাল তোলা যেতে পারে। নৌকা ভাসিয়ে যেদিকে খুশি
ঘুরে বেড়ানো যায়। কোন ভয় নেই। এখানে দিশেহারার কোন কথাই নেই। ওর ওই দুটি চোখের তারায়
নিশ্চিন্ত এক দিশার আলো পরিপূর্ণ হয়ে আছে। ওর দুই চোখে দুটি আকাশ। দুটি ধ্রুবতারা।
একটি মেঘের চাদরে ঢেকে গেলেও অন্যটি জ্বলে যাবে, পথ দেখিয়ে যাবে অনন্ত কাল। আজ ওর চোখের
দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে যাইনি। এর আগেই আমি হারিয়ে ছিলাম হয়ত। আজ আমাকে পেয়েছি।
পেয়েছি আমার সঠিক ঠিকানা। সঠিক গন্তব্য। পেয়েছি কি! কি জানি, হতে পারে।
আমরা তাকিয়ে আছি পরস্পরের দিকে। ও
আমার হাত ধরে আছে। আমি ধরে আছি ওর হাত। নৃত্যরত মেয়ে ছেলের দল তাদের নাচ গান ফেলে আমাদের
দিকে চেয়ে আছে। ওদের চোখে মুখে এক আনন্দের ঝলক খেলে যাচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি উঠলাম। ও আমার
হাত ছাড়ল না। হাত ধরেই ও টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক গভীর আত্মবিশ্বাসে আমি ওকে কেবল অনুসরণ
করে গেলাম।
অবশেষে এক পাহাড়ের কোলে, একটি সুন্দর
ঝর্ণার পাশে একটি ছোট্ট মাটির বাড়িতে আমরা গিয়ে উঠলাম। আমি বললাম, এটা কার বাড়ি?
ও আমার দিকে হাস্যময়ী চোখে তাকাল।
বলল, এটিই তোমার বাড়ি। এটি আমারও বাড়ি। আজ থেকে এই বাড়িতেই তুমি থাকবে। আমার সঙ্গে।
কি, থাকবে তো?
আমি ঠোঁটে একরাশ হাসি নিয়ে বললাম,
তোমার হুকুম না মেনে কি থাকতে পারি?
থাক, আর প্রশংসা করতে হবে না। খুব
হয়েছে। চলো, ঘরে চলো।
আমরা ঘরে গেলাম। বেশ বড় ঘর। দুই দিকে
বড় বড় জানালা। দরজার দিকে আর এক দিকে কোন জানালা নেই। বেশ সুন্দর করে মাটি দিয়ে লেপা
মুছা ঘর। ঘরের এক দিকে খাট। খাটটি কাঠের তৈরি। খাটের মাথা আর পায়ের দিকে লতা পাতা আর
ফুল খোঁদায় করা আছে। মনে হচ্ছে দু-এক দিনের মধ্যেই খাটটি তৈরি করা হয়েছে। খাটের চারিদিক
থেকে যেন তেল চুঁয়ে পড়ছে। খাটের উপরে তোষক। তার উপরে গোলাপ ফুলে ছাপা সাদা চাদর।
একটি নতুন লুঙ্গি কাঠের বাক্স থেকে
বের করে আমাকে দিয়ে ও বলল, পোষাক চেঞ্জ করে নাও। তারপর বাড়ির পিছুনে গিয়ে ঝর্ণার ধার
থেকে স্নান করে এসো। এই নাও গামছা। আমি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে আসছি।
আলবেলা চলে গেল। আমি পোষাক চেঞ্জ করে,
গামছা নিয়ে বাড়ির পিছুনে ঝর্ণার ধারে গিয়ে পৌঁছালাম। ঝর্ণার চারিদিকে নানান রঙের ফুল
ফুটে আছে। সেই ফুলের গাছের ফাঁক দিয়ে পাহাড় থেকে জল ঝরে ঝরে পড়ছে। এর কোন বিরাম নেই,
কোন বিরতি নেই। ফুলের উপরে উড়ে বেড়াচ্ছে নানান রঙের বড় বড় প্রজাপতি। তাদের ডানায় বিচিত্র
রকমের চিত্র অঙ্কন। যতই দেখছি, মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। তার সঙ্গে মোটা মোটা ভিমরুল আর মৌমাছি
ফুলের উপর নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। ফুলগুলো থেকে এক মধুর সুগন্ধ বেরিয়ে আসছে। যেন এক বন্য
উন্মাদনায় আমাকে বিবশ করে দিতে চায়ছে।
আমি স্নান করে এসে খাটে গা এলিয়ে দিলাম।
মাথার উপরে সুন্দর কোঠা। মাটির বাড়িতে কতদিন শোয়া হয়নি! মনে পড়ে গেল আমাদের সেই পুরনো
বাড়ির কথা। কত সুন্দর ছিল আমাদের গ্রামটি!
(পরবর্তী পর্ব আগামী রবিবার)