মরুকান্না/আজিজুল হাকিম

 

মরুকান্না

   আজিজুল হাকিম

 

ব্যস্ত শহর। রাস্তার দুপাশে বিস্তৃত ফুটপাথ। সেই ফুটপাথের দু প্রান্তে বড়বড় বিল্ডিং। তারা আকাশের সূর্যের চোখে চোখ রেখে হেসে যাচ্ছে সারাক্ষণ। সেই ফুটপাথ ধরে মানুষেরা এদিক ওদিক ছুটে যাচ্ছে যে যার কাজে। সেই ফুটপাথের ধারেই একটা মোটা স্তম্ভের আড়ালে সাত আট বছরের একটি ছেলে বসে আছে। সামনে একটি খোলা কাগজের প্যাকেট। ও বসে বসে বাজিয়ে যাচ্ছে একটি বাঁশি। বাঁশির মধ্যটাকে দু হাতে ধরে আর সুরু প্রান্তটি দুই ঠোঁটের মাঝে ভরে এক মন মাতানো সুরের লহরী তুলে যাচ্ছে সারাক্ষণ। 

এই বাঁশিটিই তার বেচেঁ থাকার একমাত্র সম্বল। সে যখন বাঁশিটি মাথা দোলাতে দোলাতে বাজিয়েই চলেছে তখন পথ চলতি মানুষের মধ্যে কেউ কেউ ওর সামনে পড়ে থাকা খোলা কাগজের প্যাকেটে একটি করে লিরার কয়েন ফেলে চলে যাচ্ছে। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পরে সে চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও। অন্য ফুটপাথে। এভাবেই সে সারা দিন ধরে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে। তাতে যা লিরা হচ্ছে, তার পেট চলে যাচ্ছে।  

কিন্তু ও বাঁশি বাজিয়ে গেলেও ওর মন আর কান পড়ে থাকে রাস্তার দুই প্রান্তে। ও জানে, এখানে ভিক্ষা করা মানা। তাই তার কান দুটোকে খাড়া করে রাখতে হয়। পুলিশের গাড়ি আসছে কি না। পুলিশের গাড়ির আওয়াজ পেলেই তাকে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে। নইলে সর্বনাশ! পুলিশে থানায় তুলে নিয়ে যাবে। বাঁশি কেড়ে নেবে। হেনস্থা করবে। এর আগেও দুবার সে পুলিশের হাতে পড়েছিল। তখন কান্না ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।

ছেলেটি বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এসে একটা একটা করে কয়েন দিয়ে চলে যাচ্ছে। এমন সময় পুলিশের গাড়ির শব্দ ওর কানে ভেসে এলো। থেমে গেল বাঁশির সুর। ও একহাতে বাঁশি আর অন্য হাতে কাগজের প্যাকেটটি কুড়িয়ে নিয়েই ছুটতে শুরু করল। শহরের বিভিন্ন অলিগলি পেরিয়ে ও অন্য একটা জায়গায় পালিয়ে গেল। তারপর শুরু হল আবার বাঁশি বাজানোর পালা। কিন্তু সেখানে অন্য একটি পুলিশের নজরে পড়ে গেল। ওর ভিক্ষা করা দেখে ওকে ওর কাছ থেকে বাঁশিটি কেড়ে নিল। ওকে শাসাল। তারপর চলে গেল।  

যখন বাঁশিটি ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পুলিশটি চলে গেল তখন ও নিস্পলক চোখে পুলিশটির দিকে তাকিয়ে থাকল। আস্তে আস্তে দুই চোখ দিয়ে আবারও ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। বাঁশিটি তো ওর বেচেঁ থাকার একমাত্র সম্বল। এটাই ওর জীবন ধারণের সর্বোচ্চ মাধ্যম। এতটুকু ছেলে কি কাজই বা করবে? অন্য কোন কাজ যে সে করতে পারবে না। তাই ও জীবনধারণের জন্য এই কাজটা বেছে নিয়েছে। তাকে তো বেঁচে থাকতে হবে। এছাড়া তার সামনে আর কোন পথ নেই।

ও কোনক্রমে রাতটা কাটায় তাঁবুর অন্ধকারে। ও থাকে একটা রিফিউজি ক্যাম্পে। তুরস্ককের ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিম তীরে নিজিপ শহরের একটি ক্যাম্পে। ওর থাকাকে ঠিক থাকা বলে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে এ পথ ও পথ ঘুরে বেড়ায় এবং মানুষকে আনন্দ দিয়ে ক’টা লিরা পাওয়ার আশায় ও বাঁশি বাজিয়ে বেড়ায়। এটাই হল ওর নিত্যদিনের কাজ। কিন্তু সেটাও এ দেশের আইন করতে দিচ্ছে না। তাহলে সে বাঁচবে কি করে!

রাতের বেলায় ক্যাম্পে গেলে ওর মন মেজাজ সব খারাপ হয়ে যায়। কারণ ক্যাম্পে গেলেই ওর বাবার বয়সী, ওর মায়ের বয়সী অনেক লোকজন চোখে পড়ে। ওরা ওদের ছেলে মেয়েদেরকে কত আদর করে। ডেকে ডেকে ওদেরকে খাওয়ায়। ওদেরকে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয় আর ও যখন এসব কিছু দেখে তখন তার আর সহ্য হয় না। মনে পড়ে যায় তার বাবা মায়ের কথা। কত সুন্দর ছিল ওর বাবা মা! কত আদর করত, কত ভালোবাসতো তাকে! এ সব কথা মনে পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্যাম্প থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে মন চায়। এক দৌড়ে বাড়ি। গত সন্ধ্যায় ও দেখল এক মহিলা তার বাচ্চাকে নিয়ে কত আদর করছে। তাকে আদর করে ডাকছে এবং তার সঙ্গে সুন্দর সুন্দর কথা বলছে। 

ওর হাত থেকে পুলিশ বাঁশি কেড়ে নিলে সে এক পা এক পা করে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে শুরু করল। ওকে আবার বাঁশি কিনতে হবে! ও কে তো বাঁচতে হবে।  

ও ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে হাটতে একটি ফুটপাতের পাশে একটি স্তম্ভের আড়ালে বসে পড়লো। ও ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই আর তার কোন দিকে যেতে ইচ্ছে করল না। দৌড়ে দৌড়ে পা দুটোও কনকন করছে। তার সামনে দিয়ে অহরহ লোক আসছে আর যাচ্ছে। সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। কেউ তার দিকে খেয়াল করল না। কেউ তাকে একটি টাকাও দিল না।  

ওর এখন বেশি বেশি মনে পড়ছে ওর বাবার কথা, ওর মায়ের কথা। কতদিন ওদেরকে দেখেনি! কতদিন ওদের আদর যত্ন পায়নি! কতদিন ভালোবেসে তাকে ডেকে খায়য়ে দেয়নি। গল্প শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়িয়ে দেয়নি।  

ওর মনে পড়তে লাগলো স্কুলের কথা। স্কুলের দিদিমণিরা ওকে কত ভালোবাসতো। তাছাড়া ওর ক্লাসমেট সাবা, সাইরা, ইস্তাক, ঈসা ওরাও কত সুন্দর ছিল। টিফিনের সময় হলেই স্কুলের সামনে ফাঁকা মাঠে গিয়ে ওরা কতদিন খেলা করেছে। আর আজ, ও খেলাই ভুলে গেছে। আজ ওরা কোথায় হারিয়ে গেল? ওরা কি আজও বেঁচে আছে? সেই সব দিনগুলি কত মধুর, কত প্রাণবন্ত, কত উচ্ছল-ক্রীড়াচঞ্চল ছিল! ও হাওমাউ করে কান্না করতে লাগল। কিন্তু এখানে ওর কান্না শুনবে কে? এখানে একজনই আছে তার কান্না শোনার মতো, সে হল আল্লাহ্‌। কিন্তু সে-ই বা তার কান্না শুনেছে কবে?  

প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে ওর বাবা ওর হাতে একটা করে চকলেট হাতে ধরিয়ে দিত। তারপর কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করত। তারপর পোশাক আশাক পাল্টে ফেলতো। আর ওর মা? তার তো কোন তুলনাই হয় না। কতই না ভালোবাসতো তাকে। তা বলে বোঝানো যাবে না। খাওয়া না হলে খাইয়ে দিত। সময় পেলে তার সঙ্গে খেলতো আর রাতের বেলায় সুন্দর করে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সেই পরীদের গল্প শোনাতো। 

ওরা তখন থাকতো আলেপ্পো নগরীতে। সুন্দর একটি ফ্ল্যাট বাড়ি। বারান্দার সামনে বিস্তৃত মরুভূমি আর সেই মরুভূমির মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর খেজুর গাছগুলি সারাদিন হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে যেত। আর রাতের বেলায় যখন পূর্ণিমার আলো মেঘহীন উন্মুক্ত নীল আকাশে ক্রাইস্ট্যাল জ্যোৎস্নার নিরব ঝড় তুলতো তখন সেই জ্যোৎস্নায় সারা মরুভূমি যেন রূপোলী হাসিতে হেসে উঠতো। 

কিন্তু দেশে হঠাৎ কি হল - সব স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। চারিদিক থেকে ধেয়ে আসতে লাগল আইএসআই আর সরকারের গোলাগুলি। বন্ধ হয়ে গেল বাবার অফিস। মানুষের চলাচলের রাস্তাঘাট গুলো বন্ধ হতে লাগলো। তারপর রাতের বেলায় দেখতে লাগলো ভয়ংকর বীভৎস শব্দে বিমানগুলি কিভাবে চারিদিকে আগুন ঝরাচ্ছে। তখন থেকে সমস্ত জানালা দরজা বন্ধ করে ফেলা হল। কিছুদিন ওর এ ঘর আর ও ঘর ছাড়া কোন কাজই ছিল না। ঘরের ভিতরে থেকে থেকে ও ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়ছিল।

সেদিন সে ঘুমাতে যাচ্ছিল। সব কিছু বুঝতে পারার আগেই যেন ছাদের উপরে বাজ ভেঙে পড়ল। মুহূর্তে সব কিছুই অন্ধকার। অত সুন্দর বিল্ডিংটি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। ছাদ ভেঙ্গে পড়ার আগেই ও অন্ধকার ঘরের এক কোণে গিয়ে আটকে পড়ল। আর বাবা-মা কোথায় গেল সে জানতে পারল না। কেবল তার নাম ধরে তিনবার ডাক শুনতে পেল। সেও চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু তার চিৎকারে আর কেউ সাড়া দিল না। ও আটকে গেল ভেঙে পড়া ছাদের আড়ালে। তারপর আর মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল তখন হাসপাতালে। সেদিন ও মা, মা করে কান্না করেছিল। কিন্তু একজন নার্স বলল, তোমার বাবা, মা কেউ বেঁচে নেই।

সেদিন নার্সের কথা শুনে হঠাৎ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল। কেবল নার্সের মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

তারপর একদিন সেখান থেকে তাকে এই ক্যাম্পে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল। এখন সে এই ক্যাম্পের অনাথ অতিথি। 

এখন তার হাতে যে কটা লিরা আছে তা দিয়ে বাঁশি কেনা হবে না। সে চারদিকে তাকাতে লাগল। এতো মানুষ! কিন্তু সে যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সবকিছুই যেন ঝাপসা দেখছে। সবকিছুই শূন্য দেখছে। ও জানে না, এরপর ওকে আর কি করতে হবে।

অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে আবার চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর সে ক্যাম্পে পৌঁছাল। বাচ্চাদেরকে দেখাশোনার দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি বললেন, তোমার কি হয়েছে? 

ও বলল, পুলিশে আমার বাঁশি কেড়ে নিয়েছে। তুমি আমাকে দশ লিরা দেবে? আমি তোমাকে শোধ করে দেব। 

উনি বললেন, না। তোমাকে বাঁশি দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ তুমি বাঁশি নিয়ে ভিক্ষা করবে। তুমি জানো না এখানে ভিক্ষা করা বারণ? 

ও বলল, ভিক্ষা না করলে যে আমার চলবে না। আমার তো বাবা মা নেই যে তারা আমাকে লিরা দেবে আর সেই লিরা দিয়ে আমি কিছু কিনে খাব। অনেকের বাবা মা আছে যারা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে এখানেও লিরা দেয়। তোমরা তো কেবল খাবার আর পোশাক দাও। সেই খাবার আমাকে একটুও খেতে ইচ্ছে করেনা। আমি আগে কখনোই এমন নোংরা খাবার খাইনি। তুমি আমাকে একটু সাহায্য করো না, প্লিজ! 

কিন্তু প্রহরী তাকে সাহায্য করল না। 

তারপর সে এর কাছে, ওর কাছে লিরা সাহায্য চাইল। কিন্তু তার কথায় কেউ কান দিল না। 

বিকেল হলে সে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়ল। উদ্ভ্রান্তের মতো সে হাঁটতে লাগল শহরের দিকে। যখন সে শহর পেরিয়ে গেল তখন সূর্য ডুবে গেছে। শহরের আলোয় সে বুঝতে পারেনি দিনের বেলায় হাঁটছে, না রাতের বেলায়। যখন শহর পেরিয়ে গেল সে বুঝতে পারলো রাত হয়ে গেছে। তারাগুলি মিটিমিটি করে ভালই আলোকিত হয়ে থাকলেও আকাশের বুকে কোন চাঁদ ছিল না। ও রাস্তা পেরিয়ে মরুভূমির উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। ও বুঝতে পারল না পূর্ব-পশ্চিম, না উত্তর-দক্ষিন – কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু ও হেঁটেই যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চারিদিকে খাঁখাঁ শূন্য বালুকাবেলা।

তখন অনেক অনেক রাত। আর পা চলছে না। পা দুটো অবস হয়ে পড়ছে। এদিকে মরুর শীতের হিমেল হাওয়া তার শরীরটাকে বারবার কাঁপিয়ে দিচ্ছে। সেই দুপুর থেকে পেটে খাবার নেই। তবু সে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে সে একসময় একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। আর নিজেকে তুলতে পারল না। নিজের দেহটা নিজের কাছে খুব ভারী বলে মনে হল। মনে হচ্ছে চারিদিক থেকে ঝরঝর করে তুষার ঝরে পড়ছে। তার গায়ের পোশাক সেই ঠাণ্ডাকে প্রতিরোধ করতে পারছে না। হাতগুলিও কেমন যেন থর থর করে কাঁপছে। কাঁপছে তার পা, তার দেহ। নিজেকে ধরে রাখার মতো শক্তি তার কাছে আর থাকলো না।

একসময় চোখের পাতাগুলো বুজে এল। তার মনে পড়তে লাগল সেই সোনালী দিনগুলোর কথা। তার বাবা ও মায়ের মুখগুলো জ্বলজ্বল করে বারবার মনের সামনে ঘোরাফেরা করতে লাগল। কয়েকবার মা….মা…. বলে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু সেই শব্দ বেশি দূর গেল না। আরও কিছুক্ষণ অতিবাহিত হয়ে গেল। কম্পিত ঠোঁটে কয়েকবার আল্লাহ্‌কেও ডাকল। না, কেউ তার ডাক শুনল না।

বেশ দূর থেকে হায়নার চিৎকার শোনা গেল। মনে হচ্ছে সেই চিৎকারটা বাতাসের স্রোতে ভেসে ভেসে তার কর্ণকুহরে ধাক্কা মারছে অবিরাম। সে চোখ বুজে আছে। চেষ্টা করেও চোখ দুটো তুলতে পারল না। এদিকে হায়েনার চিৎকারটা আরো আরো প্রকট হয়ে পড়তে লাগল। মনে হচ্ছে সেই চিৎকারটা অনেক অনেক কাছে চলে এসেছে। 

Post a Comment

Previous Post Next Post