চাঁন মিয়া বাউলের আখড়ায়
গাজি আব্দুল আউয়াল
সবুজ
দীর্ঘদিন ধরে যেতে চাচ্ছিলাম বাউল
কবি চাঁন মিয়ার বাড়িতে। এটি নেত্রকোণা জেলার সদর উপজেলার মৌগাতি ইউনিয়নের খাটপুরা অবস্থিত।
কবি তাঁর পরিচয় তোলে ধরেছেন এভাবে--
“কত দেশে খাদ্য খোঁজে
ঢাকা-সিলেট-বগুড়া,
কর্মফল ভোগ করিতে
জন্ম নিলে খাটপুরা।
নেত্রকোণা সাবডিবিশন
জেলা হৈল ময়মনসিংহ
মৌগাতি ইউনিয়নে
কাটিয়ে গেল বহুদিন।
পোস্টঅফিস হয় চুচুঁয়া
গ্রাম থেকে একমাইল দূরা।”
কিন্তু ব্যাটে-বলে মিলছিল না। গতকাল
নেত্রকোণা গেলে মন আকুল হয়ে ওঠে,ছুটে যাই বাউলবাড়িতে। চানমিয়া হলেন নেত্রকোণার বাউলকূলশিরোমণি রশীদ উদ্দীন আহমদের শিষ্য। এ রশীদ
উদ্দীন সাহেবই হলেন লালন প্রবর্তিত বাউলধারার বাইরে নতুন এক ধারার উদ্ভাবক-প্রবর্তক।
এখানে সে বিষয়ে আলোচনা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।
রশীদ উদ্দীনকে ঘিরে জালাল উদ্দিন খাঁ,
চাঁন মিয়া, শাহ আব্দুল করিম, মিরাজ আলী, ইদ্রিছ আলী, উকিল মুনশিসহ যে বাউলগণ বাউলাঙ্গণ
নিজেদের পদভারে মুখরিত করেন তাঁদের তালিকা সুদীর্ঘ। আমি এখানে শুধু বাউল চাঁন মিয়ার
উপর হাল্কা একটু আলো প্রক্ষেপ করছি মাত্র।
নেত্রকোণায় জ্ঞানীগুণীজনের ভীড় চিরকালই লেগে আছে। অসংখ্য বাউল এই অবক্ষয় কবলিত সময়েও নেত্রকোণার আনাছে-কানাছে তাঁদের গানের সুরধারা বিলিয়ে চলেছেন।
চাঁন মিয়ার কবর
বাউল রশীদ উদ্দীন সাহেব আমার জন্মের অনেক আগেই দুনিয়া
ছেড়েছেন। আর আরেক কিংবদন্তী জালাল উদ্দিন খাঁও আমার জন্মসনেই দুনিয়ার পর্দা তুলে নিয়েছেন।
কাজেই তাঁদের দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে নেত্রকোণার যেসব বাউলকবিকে আমি চাক্ষুষ
দেখেছি তাঁদের মধ্যে চাঁন মিয়া,উকিল মুনশি,আব্দুল মজিদ তালুকদার,ইদ্রিছ আলী,তৈয়ব আলী
অন্যতম। আর তাঁদের মধ্যে যাকে সবচে' বেশি দেখেছি তিনি হলেন চাঁন মিয়া। এই চাঁন মিয়াই
তাঁর সুরের যাদুতে আমাদের নির্মল শৈশব,বিমুগ্ধ কৈশোর আর জিজ্ঞাসু যৌবনোন্মুখ সময়টাকে
মাতিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর মুখে শোনা অসংখ্য গান এ পড়ন্ত বয়সেও স্মৃতিতে ঝলমল করে।
আর চান মিয়ার গান শুধু আমিই নই, বাংলাদেশের
তেমন বেরসিক কলোকটাও না শুনে থাকতে পারেনি।
যেমন -
“আমি কি তোর আপন ছিলাম না ওরে জরিনা”, “রজনী ভোর হইলো গো কোকিলায়
ডাকিলো”,
“কে কয় পিরীত ভালা গো এর মতো নাই জ্বালা”, “নৌকা ডুবলে ভাসানো
বড় দায়”--এমনি অসংখ্য গান।
আরেকটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। তা হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর
৬-দফা যে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তার মূলে চাঁন মিয়ার মতো বাউল তথা লোককবিগণও
একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্মর আকাঙ্খাকে
বাউল চাঁন মিয়াও তাঁর গানে বাঙময় করে তোলেছিলে। তিনি তখন চারণের মতো বিভিন্ন জনপদে
করা অনুষ্ঠানের শুরুতেই গাইতেন
“দেশের লাইগা পরাণ কান্দেরে জীবন গেল
জেলখানায়,
চলরে মন মুজিবের নৌকায় স্বাধীন জয়বাংলায়।”
তাঁর এসব গান শ্রোতা-দর্শকদের প্রবলভাবে আলোড়িত করতো। অনেক অনুষ্ঠানে দর্শক অনুরোধে একাধিকবার গাইতে হতো। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই যে, আজ এসব মহান শিল্পীদের কেউ খবর নেয় না। এখন স্বাধীনতাবিরোধিদের দারুণ দাপট। তাঁর ছেলে আজাদ মিয়াও বর্তমান সময়ের একজন নামকরা গায়ক। আজাদ মিয়ার ছেলেরাও গায়ক এবং বাদক।
চাঁন মিয়ার পাণ্ডুলিপি
এ সাধক তাঁর পার্থিব লীলানৃত্য শেষে তাঁর পৈতৃকভিটায় চিরনিদ্রায়
শোয়ে আছেন। আর তাঁর সমাধির পাশ দিয়েই কুলুকুলু তানে বয়ে চলেছে ডুপিখালি নদী। হয়তো নদী
তাঁর আপনভাষা এ কুলুকুলু তালের অন্তরালেই গেয়ে চলেছে চাঁন মিয়ার মরমিগানের সুর, হয়তো
দিব্যকান থাকলে এ ধ্বনির তালেই শুনতে পেতাম চাঁন মিয়ার মোহময়ী সুরের লহরি --
“আমি ফকির হইয়া যাব গো
দরবেশ হইয়া যাবো গো
নামের মালা লইয়া গলে”..