ভাষা শহীদ বরকত

 


(জীবনীমূলক গল্প)

ভাষা শহীদ বরকত

 হাবিবুর রহমান

 

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি।”

এই এক টুকরো গানে জাতপাত উঁচু-নিচু, এপার-ওপার সবপার- একাকার হয়ে যায়। সাংবাদিক আব্দুল গাফফার  চৌধুরী কতদিন আগে এই গানটি লিখেছিলেন। কিন্তু এখনো তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি।

 ১৯৫২র ২১শে ফেব্রুয়ারী পাঁচ পাঁচটি শহীদ – রফিক, শফিক,  জব্বার, সালাম, বরকতের রক্তে ঢাকার রাজপথ রাঙ্গা হয়েছিল। ১৭ জন  মানুষ গুরুতর আহত হয়। কেন জানেন? প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা - মাতৃভাষার টান। এই পাঁচ ভাষা শহীদের একজন ছিল বরকত। একমাত্র ভারতবাসী পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি।

 আমরা অনেকে বরকতের নাম শুনেছি। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো কজনে তার পরিচয় জানি? এই কলমে আজ  সেই অমর শহীদ বরকতের কাহিনী শুনুন।

 আমার সৌভাগ্য, আমি সালার থানায় তিন বছরের ওপর ওসি ছিলাম। তাই সহজে তথ্য জোগাড় করতে পেরেছি।

 এপার বাংলার এক অখ্যাত গ্রাম বাবলা। পোস্ট অফিস কাগ্রাম, থানা শালার, জেলা মুর্শিদাবাদ। ১৬ই জুন ১৯২৭ সালে সেখানে জন্মায় এক টুকরো  আগুনের ফুলকি। তাঁর  নাম আবুল বরকত। বাবা শামসুজ্জোহা ওরফে ভুলু  মিয়া, মা হাসিনা বিবি, এক ভাই আবুল হাসনাত আর ৬ বোন। ভুলু মিয়া গ্রামের সম্পন্ন চাষী। ১০০ বিঘার মতো জমি ছিল।

 বাবলা গ্রামে তখন কোন  স্কুল না  থাকায় পায়ে হেঁটে বহুদূরে তালিবপুর স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়াশোনা করেন বরকত। পরবর্তীতে বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ম্যাট্রিক ও আইএ পাস করেন যথাক্রমে ১৯৪৫ ও ৪৭ সালে।

 তারপর এই কৃতি সন্তান চলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স করেন এবং ১৯৫২ সালে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন এই কৃতি ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকারী ছাত্র। কিন্তু নিয়তির অমোঘ টান তাঁকে টেনে নিয়ে গেল একুশের ভাষা আন্দোলনে।

 ঢাকা ইউনিভার্সিটি চত্বরে চারদিকে কারফিউ, ১৪৪ ধারা জারি, খান সেনার  দাপাদাপি। তারি মাঝে বুক চিতিয়ে মাতৃ ভাষা বাংলা ভাষার টানে নিষেধের সব বেড়া টপকে গেলেন। গর্জে উঠলো খান সেনার বন্দুকের নল। সেই বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেল বরকতের তাজা প্রাণ। রক্তে ভেসে গেল ঢাকার রাজপথ।

 এটা শোনালাম একুশের পটভূমি।

 কিন্তু আপনাদের কি জানতে ইচ্ছে হয় না -কি এর প্রেক্ষাপট?

 তবে শুনুন পেছনের কথা। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পশ্চিম এবং পূর্ব নিয়ে  তৈরি হয় পাকিস্তান। পশ্চিমীরা  উর্দুভাষী  আর আর পূর্ব পাকিস্তান সাবেক বাংলা ভেঙে, সবাই বাংলা ভাষাভাষী। সরকারি ক্ষমতার মসনদে ছিল উর্দুভাষী পশ্চিমীরা। তারা চাইল সমগ্র পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করতে। সংখ্যাগুরু বাঙালি পূর্ব পাকিস্তানের লোক তা মানতে নারাজ। এই নিয়ে পাকিস্তান পার্লামেন্টে শুরু হয় তুমুল বাদানুবাদ এমপি ধীরেন দত্ত তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী  খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

 পূর্বপাকিস্তানের চারদিকে শুরু হলো বাদানুবাদ প্রতিবাদ প্রতিরোধ, হরতাল ও তীব্র আন্দোলন। অন্যদিকে চলতে থাকল খানসেনাদের অত্যাচার  ও ধর ধরপাকড়।

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্রছাত্রীরা  সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গণ আন্দোলন শুরু হয়ে গেল জনগণের মধ্যে যার ফলশ্রুতি একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।

 আন্দোলন থেকে বিক্ষোভ; তার  থেকে সশস্ত্র আন্দোলন। 

 শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সেই আন্দোলন ১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক রূপ পায়, যার ফলশ্রুতি স্বাধীন বাংলাদেশ, এবং “মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলাভাষা।”

 বুকটা আমার গর্বে ফুলে ওঠে, যখন আমি শুনি বরকত নামে এক অখ্যাত ছেলের বাড়ি ছিল এই এপার বাংলার মুর্শিদাবাদের বাবলা গ্রামে।

 ভাবুন তো তার কি দরকার ছিল ওই আন্দোলনে ঝাপানোর? পড়াশোনায় উজ্জ্বল নক্ষত্র, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, তাছাড়া তিনি তো পাকিস্তানি ছিলেন না, ছিলেন খাঁটি ভারতবাসী।

 কিন্তু শুধুমাত্র মাতৃভাষার টানে হিল্লালে  জীবন জলাঞ্জলি  দিলেন। সব উপেক্ষা করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অকালে নিজের জীবন ঝরে গেল।

 তিনি চলে গেছেন, কিন্তু ইতিহাস তাকে ভোলেনি।

 এক অক্ষত গ্রাম বাবলা থেকে উঠে আসা এক অখ্যাত শান্তশিষ্ট তরুণ, নিজের তাজা রক্তের বিনিময়ে ভাষা আন্দোলনের মানচিত্রে অমর হয়ে আছেন।

 যাঁর রক্তের বিনিময়ে একটা নতুন দেশ তৈরি হলো। একটা মাত্র ভাষার জন্য! এক দেশ এক জাতি এক ভাষা বিশ্বের আর কোথাও এমনটা পাবেন না।

 তাই, তাঁর রক্তের কাছে ঋনী গোটা বাংলাদেশ, গোটা বাঙালি জাতি।

 যাঁর  রক্ত ছিনিয়ে এনেছে বাংলা ভাষাকে বিশ্বে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে পালন করতে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো এই দুর্লভ সম্মানের কথা ঘোষণা করে।

 আমাদের গর্বের ধন আদরের দুলাল সেই শহীদ আবুল বরকতকে কি আমরা ভুলে যাব? না ভুলতে পারি কখনো!

 বহু কষ্টে যোগাড় করা তার এক খন্ড চিঠির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরলাম:-

 “আম্মাজিগো, আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি। বুকের গভীরে যেন ধুধু মরীচিকা। সহপাঠীদের অজস্র সান্তনা মনের গভীরে তুষ্টি জোগাতে ব্যর্থ, তাই সত্ত্বর বাড়ি ফিরব।

গতকাল বিকাল থেকেই সারা শহর ১৪৪-এর নিস্তব্ধতায় ধুকছে, তারি মাঝে শোনা যায় সতর্ক সেনানির বুটের পদচারণা। বাড়ি যাওয়ার অদম্য বাসনা, শত সতর্কতা পায়ে ডলে চোখের জলে এই চিঠি লেখা। জানিনা এচিঠি তোমার হাতে পড়বে কিনা।

 মাগো ওরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। জোর করে শেখাবে অত্যাচারীর বর্ণমালা। তাহলে কি মা আমরা আর  রূপকথার কাহিনী, নাসিরউদ্দিনের কৌতুক, কচ্ছপের গল্প শুনতে পারবো না? যদি তাই হয় এই আশঙ্কায় আমার ঘরে ফেরা। তোমার মুখে শুনবো শৈশবের সেই সব স্মৃতি জড়ানো কথা, বাংলা গল্পমালা।”

 বাড়িতে মা শালী ধানের মুড়ি ভাজে আর ভাবে, খোকা আসবে ৮ই ফাল্গুন রাতে। খোকা এল। চারিধারে শকুনের লোলুপ বৃষ্টি এড়িয়ে- সাদা কফিনে ঢাকা রক্তাক্ত শরীরে।

 খোকার পকেটে এক টুকরো রক্তমাখা চিঠি।

 চিঠি পেয়ে প্রতীক্ষারত হতভাগা জননী নিঃশব্দে তা পড়তে থাকে - পাছে খোকার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কানের অনতিদূরে শোকার্ত মা ডাকে - খোকা, খোকারে, ওঠবাবা ওঠ। গল্প শুনবি না? আমি তোর প্রানের ভাষাতেই গল্প শোনাবো।....

 

Post a Comment

Previous Post Next Post