ঘুচিল মোর কেতাব ক্রয়ের নেশা
গাজি আব্দুল আউয়াল
সবুজ
সেদিন সাইন্সল্যাব গিয়েছিলাম আমার
দোতারা সুন্দরীদের কিছু অপরিহার্য দ্রব্যাদি কিনতে। শেষতক চিরাচরিত নিয়মে বাংলা একাডেমি
হয়ে হাজির হই বাংলাবাজারে গিয়ে। এ-লাইব্রেরি ও-লাইব্রেরি করে কিনেও ফেলি---
(১)বাতুল থেকে বাউল
(২)রবীন্দ্রনাথ : বাউল সংস্কৃতি ও
অন্যান্য
(৩) ওমর খৈয়াম
(৪) নজরুল-সংগীত স্বরলিপি সংগ্রহ-নবম
খন্ড।
(৫)ছোটদের সা রে গা মা
(৬)প্রবেশিকা সংগীত শিক্ষাপদ্ধতি
(৭)লালনভাষা অনুসন্ধান-১
(৮)লালনভাষা অনুসন্ধান-২
(৯)বাউলগান ও দুদ্দুশাহ
(১০)সুফি : মদিনা থেকে মহাস্থানগড়
(১১)মহাত্মা লালন : গুরুবাদী দর্শনের
মহাসাধক
(১২)সুনির্বাচিত লালন গীতির স্বরলিপি
(১৩)হাজার বছরের বাংলা
(১৪)ইবনুল আরাবির ওয়াহাদাতুল ওজুদের
রহস্যভেদ
(১৫) বাউল বৈষ্ণব সুফী
আরও ক'টি বই কেনার শখ থাকলেও পরিবহনের
অসুবিধার কথা ভেবে আপাতত কেনা থেকে বিরত থাকি।
বাংলা বাজার গিয়ে আমাদের কমনবন্ধু
ফিরোজ খান প্রিন্সের সাথে দেখা না করে চলে আসবো তা কি হয়?
ফিরোজ খান এক বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব।
চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, পরিবেশক, কবি, প্রকাশক, নবীন উদ্যোক্তা ইত্যাদি। তার সবচে'
ব্যতিক্রমী বিরল গুণটা হচ্ছে আজকাল আমরা যেখানে অন্যের থেকে খেতে আনন্দ পাই তিনি সেখানে
অন্যকে খাইয়ে আনন্দ পান। আর তার কাছে বসলে কত শ্রেণি, পেশার মানুষের সাথে যে পরিচয়
ঘটে বলে বোঝানো কঠিন।
ফিরোজ খানের কাছ থেকে ওঠে আরেকটা বই
না কিনে ফিরতে মনকে কোনোভাবেই রাজি করাতে না পেরে রুমি মার্কেটের দোতালায় যাই।
প্যারিদাস রোডের মোড়ে আসতেই এক যুবক
আমার পথ আগলে সরাসরি প্রশ্ন করে-স্যার, আপনি কি প্রফেসর?
আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলি -- যা করি
সেটাকে প্রফেসারি না বলে অনেকটা মাস্টারিই বলতে পারো । কারণ প্রফেসর হওয়ার মতো জ্ঞান,
মেধা আমার নেই। তা তুমি বুঝলে কেমনে?
ছেলেটি বলে-স্যার, একমাত্র প্রফেসাররাই
এভাবে পাগলের মতো বই কেনেন। তা না হলে মানুষ তো আজকাল বই কেনা-পড়া ছেড়েই দিয়েছে। তো
স্যার, চলেন পাশের স্টলে একটা চা খাই।
আমার হাতে সময় নেই বলে চলে আসতে চাইলে
সে-ছেলে বলে -- স্যার, আপনার কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট ছিল।
আমি এবার সন্দিগ্ধ চোখে তার দিকে তাকালে
সে বলে, না স্যার, আমি আপনার কাছে কিছু চাচ্ছি না, কিছু দিতে চাই।
কী ব্যাপার, আমাকে তুমি কী দেবে? আর
দেয়ার নিয়েত থাকলে তো ঢাকা শহরে লোকের অভাব নেই।
ছেলেটি একটু হেসে বলে---স্যার, এ জিনিস
সবাইকে দেয়া যায় না। তারপর যা বলে তা হচ্ছে---তাদের ঘরে হাজার পাঁচেক বই রয়েছে, তার
বাবার কেনা। এখন বইগুলো নষ্ট হবার পথে। তারা তিন ভাই, দু'বোন। কারোরই বই পড়ার মতো শখ
বা সময় নেই। তাই আমার মতো একজনকে সে বইগুলো বিনামূল্যে দিতে চায়। বইগুলো কেজি দরে বেচলেও
হয়তো সে হাজার বিশেক টাকা পাবে। কিন্তু বাবার প্রিয় বইগুলোকে সে বেচতে চায় না।
ছেলের কথায় আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে। চোখে ভাসে কবি সুনীল গঙ্গাপাধ্যায়ের স্ত্রীর
ছবি। তিনিও কবির বইগুলো কোনও লাইব্রেরিতে দান করতে চাচ্ছিলেন। কারণ তাদের ছেলেমেয়েরাও
আমেরিকা প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার, বই পড়ার টাইম নেই। কদিন আগে নারায়নগঞ্জের আড়াই হাজার থেকে
আরেক ছেলে ফোন করে তার বাবার অনেক বই আমাকে দিতে চেয়েছিল।
কিন্তু আমি জানি যে আমি এখন পঞ্চাশ পার হওয়া মানুষ। কখন ডাক
পড়ে যায় ঠিক নেই। এত বই পড়বো কখন। এতগুলো বই রাখতে আমার আরো দুতিনটে বুকশেলফ/আলমিরা
লাগবে, তা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমি অন্যের পুরনো বই নাড়াচাড়া করতে পছন্দ করি না। তাই সে-ছেলেকে
উত্তরবঙ্গের এক পাবলিক লাইব্রেরির ঠিকানা দিয়েছি। আজকের ছেলেকেও সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়ে
সিলেটের কমলগঞ্জের এক ছোটভাইয়ের লাইব্রেরির ঠিকানা দিলাম।
মনের ভেতর এতদিন যে বইকেনার এক দুর্মর নেশা ছিল তা যেন অনেকটাই
কেটে গেছে। ভাবছি--আমার বইগুলোর কী হবে? কতো কষ্ট করে, কতো যত্ন করে বইগুলো
কেনা। বাচ্চারা কি এমনি করে বিলিয়ে দেবে না কি পোকা দিয়ে খাওয়াবে? ওরাও তো বই পড়ে না।