অতীত নক্ষত্রের সাথে

 


অতীত নক্ষত্রের সাথে

 আজিজুল হাকিম 
----------------------------


আজ আমি সেই পথ দিয়েই হেঁটে এলাম
যে পথ দিয়ে হেঁটে গেছো তুমি
হেঁটে গেছে ভাঙাগড়া স্রোত না ফেরার পথে।

আমি সেখানেই এসে থামলাম
যেখানে তুমিও থেমেছিলে একদিন
যেখানে থেমে যায় এই নশ্বর দেহ
কেবল দৃষ্টি গিয়ে হারায় ঐখানে
যেখানে বৃষ্টিরা সীমানা আঁকে দিগন্তের বুকে;
কিন্তু মন উড়ে যায় ওপারে
স্থান-কালের দেয়াল ভেঙে তোমার নিশ্চিহ্ন জীবন পথে ;
সহস্র আলোকবর্ষ থেকে তোমার হারানো হাসিকান্নাকে ছুঁয়ে দেখে। 

আমি এসে থামলাম ঠিক এই পাড়ে
যার সামনে সুবিস্তৃত পদ্মবন
দারুণ উল্লাসে খেলা করে
যেখানে মতিময় ঐতিহাসিক বাতাস আজও ঘুরে ফিরে; 
ঠিক এখানেই তুমিও থেমেছিল
যেখান থেকে পায়ে পায়ে নেমে গেছে সিঁড়ি
কত নক্ষত্রের চিহ্ন আঁকা ঝিলে
জলজ আকাশ নীলে,
সেই  সিঁড়ি আজ কথা বলে
ভাঙাচোরা অক্ষরে
নিশীথের ভাষায়।

আজ শত শত বছর পরে আমি এলাম ঠিক এইখানে
শতবছরের পুরনো কঙ্কাল সার গাছের তলায়
কয়লা মাখা নিঝুম রাতের বেলায়,
কেবল আমি একা।
তখন ঝিল থেকে উঠে আসছিল হুহু বাতাস
উথাল পাথাল ঢেউয়ের বুকে কি সব ভয়ংকর সুর
যেন কাদের কন্নাহাসির ঐক্যতান
ছিন্নবীনায় বেজেই চলেছে অবিরত।

নিভুনিভু নিঃসঙ্গ মোমবাতির মতো
সিঁড়ির গোড়ায় চুপিচুপি পড়লাম বসে
কত পায়ের চিহ্ন এঁকে গেছো তুমি এক কালে
এই সিঁড়ির বুকে অখেয়ালে
অনেকক্ষণ পরে মেঘের বুকে আগুন জ্বেলে
পূব আকাশে উঠে এলো খেজুর পাতার মতো চাঁদ।

এমন সময় হঠাৎ কার ছোঁয়ায় চমকে উঠলাম আমি
পাশ ফিরে চেয়ে দেখি, আমার পাশে তুমি!
যার সারা শরীরে নবাব নন্দিনীর জৌলুস
সময় কি পারেনি আজও তোমাকে ছুঁতে!
না আমি পড়ে আছি মোহাবিষ্ট কোন স্বপ্নের জগতে!
তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলে
মৃদু আলোর অদ্ভূত জ্যোতির্ময়ী খেলা
শুরু হলো তোমার শরীরে।

আমি উঠে দাঁড়ালাম, আমার সাথে তুমিও
অতীত আর বর্তমান আজ মুখোমুখী
পাশে ঝিলের উত্তাল উর্মিমালা
হওয়ার তালেতালে আসতে লাগলো বিস্মৃত ইতিহাসের খেলা।
জানি না কি মনে হলো, সব সংকোচ হারালো
আমি বাড়িয়ে দিলাম হাত তোমার দিকে
তুমিও এলে নিঃসংকোচে আমার বুকে
ঘুচে গেল অতীত বর্তমানের সীমানা
আমিও মিশে যেতে লাগলাম মুছে ফেলা ইতিহাসের পাতায়।

জানি না চলে গেছে কতটা সময় কত যুগ পরপারে।
অবশেষে মৌনতার বেড়া ভেঙে বললে,  "জানো,
এখান থেকেই শুরু হয়েছিল স্বাধীন সূর্যের অস্তাচলের পালা,
এখানে বসেই ষড়যন্ত্র করেছিলো ওরা
কেউ কেউ তো চায় কুর্শির নেশায় পুতুল জীবন!
তারপর এ গুলবাগেই চলেছিল বিরোধী শূন্য মাতম
মেঘের আয়নায় আজও ধরা পড়ে সেই রক্ত প্লাবনের আভাস
রাতের আঁধারে কেঁদে কেঁদে ফিরে এই ঝিলের বুকের বাতাস।

আমি চোখ মেলে তাকালাম সুদূর ছায়াপথে,
যেখানে পরাধীনতার শিকল হাতে
ক্লাইভ আজও হাঁটে,
পাশে সেই শেয়ালের দল দাঁত বের করে হাসে।

এভাবেই চলে গেছে কত সময় অদৃশ্য স্রোতে
আমি চমকে উঠলাম,
তুমিও নেই দেখি আমার বুকে! 
অতীত চলে গেছে অতীতের পথে,
বর্তমান পড়ে আছে অপার রহস্যে।
এদিকে কখন যেন হয়ে গেছে ভোর,
আমি তাকিয়ে দেখলাম সকলের সূর্যের দিকে
সুর্যটাও কি অবহেলায় ভেঙে ভেঙে গেছে।
কারা যেন আঘাত হানছে আজও শাণিত ছুরিতে
চির ধরে যাচ্ছে ভাঙা ভাঙা স্বাধীন সূর্যের বুকে।

***

কলমে: আজিজুল হাকিম
রচনা: মতিঝিল চত্বর
তারিখ: ১১/০৯/২০২২
সময়: রাত্রিবেলা

Post a Comment

Previous Post Next Post