(ছোট গল্প)
একটি নদীর কথা
আজিজুল হাকিম
নদীটি এক বুক আশা নিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষায় বসে থাকে। দিনের পর
দিন যায়, মাসের পর মাস। এক এক করে ঋতুরাও অদৃশ্য স্রোতে নদীর বুক দিয়ে গড়ে যায়।
চলে যায় বছরের পর বছর অতীত দিগন্তের কবরে।
ওর দুই পাড় ছোট হতে হতে কখন সে একটি
অবিস্তৃত ছোট ক্যানেলে পরিণত হয়ে যায়। বুকের গভীরে থাকা বালুরাশি ফুলে ফেঁপে উঠতে
উঠতে অগভীর হয়ে পড়ে। দু-দিকের বিস্তৃত সমতল মাঠ পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়ে নদী দখলে
মেতে উঠেছে। ওদের নির্দয় দখলে নদী অদৃশ্য হয়ে যেন আর কয়েকটি বছরের মধ্যেই পুরো একটি
মাঠে পরিণত হয়ে যাবে। নদীর শেষ চিহ্নটুকু লোপ পেয়ে যাবে একদিন।
এখন আর একটি উটকো ঝামেলা এসে পড়েছে
- আশপাশের গ্রামের লোকেরা এসে ওর বুকে ফসল ফলাতে শুরু করেছে।
পাখিরাও এদিকে তেমন আসে না আর। কখনও
কখনও মনে হয় পথ ভুল করে দু-একটি এদিকে চলে আসে। কিন্তু বুক ভর্তি হতাশা নিয়ে উড়ে
চলে যায় অনন্তের পানে। এবারও কয়েকটি পরিযায়ী পাখি এসেছিল। কিন্তু মনে হয় এক গভীর
নিরাশায় ওরা একবারের জন্যেও ওর বুকে নামলো না। নামবেই বা কি করে, এ নদী তো তাদের চারণভূমি
নয়।
ওর বুকে জল না থাকার কারণে জেলেরাও ভুল
করে আর এদিকে আসে না। ওরা ওদের বংশগত জীবিকা ফেলে অন্য জীবিকার সন্ধানে কে কোথায় পাড়ি
দিয়েছে চিরকালের মতো।
অথচ এক সময় এক সুগভীর সোহাগে থৈ থৈ
জলে নিত্য ভরে থাকতো এই নদীর বুক। কত গভীর ছিল তার বুকের উতল!
তালে বেতালে ছুটতে ছুটতে চলে যেতো সে দূর বহু দূরে। মিশে সাগরের বুকে। আজ কত কাল সাগরের
বুক ছুঁয়ে দেখা হয়নি তার! আশে পাশের গ্রামগুলি থেকে কত ছেলে মেয়ে, বৌ-ঝিরা এসে জলের
উপরে পায়ের আঘাত করে ময়ুরপুচ্ছের মতো চারিদিকে জল ছিটিয়ে সাঁতার কেটে বেড়াতো। স্নান-বেলায়
ওদের সুখ-দুঃখের কত গল্প করতো! ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সারা বেলা জলকেলি করে বেরিয়েছে
কত দিন। রাতের বেলায় লণ্ঠনের আলো জ্বেলে মাঝিরা মাছ ধরে বেড়াতো। দূর থেকে দেখলে মনে
হতো নদীর বুকে অসংখ্য তারা মিটিমিটি করে জ্বলছে। কোন কোন মাঝির গলাও ছিল খুব মিষ্টি।
যখন গভীর রাতে মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে গান ধরতো, "সখীরে! আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি....."
তখন ওই সুর চরাচর ছাড়িয়ে মেঠো পথ ধরে চলে যেত গাঁয়ের বুকে। কখনও কখনও সেই সুর গ্রামে
গিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসতো এই নদীর উতলা বুকে। তখন নিদ্রাহীন গাঁয়ের বধূ
অথবা কোনো যুবতী খোলা জানালায় কান পেতে বিভোর হয়ে শুনতো
সেই গান। পূর্ণিমার চাঁদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতো এক জোড়া চোখ। তখন জ্যোৎস্নার রুপোলি
আলোয় নিরব উল্লাসে স্নান করতো নিরব প্রকৃতি। কখনও কখনও কোন যুবতী নিজেকে সামালাতে
না পেরে প্রেমের নেশায় চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে গেছে সেই নদীর কূলে। নিসঙ্গ
মাঝির বুকে এসেছে রোম্যান্টিক সঙ্গতা। তখন নদীর বুকও যেন এক অচেনা শিহরণে দুলে উঠেছিল।
বিভিন্ন দিক থেকে দলে দলে এসেছে কত রঙ
বেরঙের পাখি। তাদের কিচির মিচির গানে কথায় সুরে সারাদিন ভরে থাকতো নদীর বুক। কত বিলুপ্ত
প্রায় পাখিরা এসে এখানে পেয়েছে নিশ্চিত সাহারা। রাখালেরা গরু চরাতে চরাতে গরুগুলোকে
নামিয়ে দিয়েছে এই নদীর কল্লোলিত বুকে। সারি সারি গরুগুলি তৃষ্ণা মেটাত খুব তৃপ্তি
সহকারে।
সেসব আজ কালের গর্ভে সমাধিস্থ হয়ে গেছে
বরাবর। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে প্রতিবেশী দেশ এই নদীর বুকে একটি বাঁধ বাঁধল। এই নদীর
জলকে নিয়ে যাওয়া হলো ওই দেশের অন্য অঞ্চলের দিকে। ফলে
যা হবার তাই হলো। ধীরে ধীরে নদীর জল শুকিয়ে গেল।
এর বুকে উচুঁ হতে লাগল বিস্তৃত বালুচর।
এভাবেই যাচ্ছিল দিনের পর দিন। মাসের
পর মাস, বছরের পর বছর। কিন্তু এক বর্ষায় হঠাৎ করেই কোথা থেকে এল মহাপ্লাবন। নদী জলকে
বুকে আঁকড়ে ধরতে পারলো না। বন্যার সেই জল চরাচর ভাসিয়ে নিয়ে যেতে যেতে নদীর পাড়ের
গ্রামগুলিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল।
অনেকদিন পর নদী সাগরকে ছুঁয়ার নেশায়
মাতাল হয়ে উঠলো। পাগলীর মতোই চিৎকার করে নাচতে নাচতে ছুটতে লাগলো সাগরের পানে।