অভিশপ্ত মাতৃগর্ভ
রচনা - লিপিকা
ভদ্র
সবে রেলগাড়িতে উঠেছি। ফার্স্টক্লাস এর সিটে
আরাম করে বসলাম। সাথে ছিল একখানা ছোটো সুটকেস আর হাতে একখান কাপড়ের ব্যাগ। কুলি সুটকেস
খানা সিটের নিচে দিয়ে টাকা নিয়ে নেমে গেলো।
আমি বসে আছি। হাত ঘড়িটা একবার দেখলাম। না এখনো
দশ মিনিট বাকি আছে।
একটি অল্প
বয়সী মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে আমার কামরায় উঠে উল্টো দিকের সিটে ধপ করে বসে পড়লো। আমার দিকে
চেয়ে মুখে একখানা মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পকেট থেকে মোবাইল
নিয়ে মনোনিবেশ করলো সেদিকে। ওকে দেখে মনটা বড়ো ভালো হয়ে গেলো। যেটুকু গ্লানি মনে পুষে
রেখেছিলাম সে মুছে গেলো নিমেষে। চেয়ে দেখলাম ওর পরনে একটা আকাশি রঙের জিন্স আর লাল
রঙের টি শার্ট । মাথায় চুলে একটা বেশ মোটা হর্সটেল। রোলগোল্ডের গোল ফ্রেমের সানগ্লাস।
ভারী মিষ্টি শান্ত চেহারা। মুখের মধ্যে একটা সরলতার ছাপ। এমনিতে মুখে তেমন প্রসাধন নেই। দেখতে
এতটাই সুন্দর যে আমি এই বৃদ্ধ বয়সেও চোখ ফেরাতে পারছিনা। মায়া মায়া মুখখানা দেখে খুব
ভালো লাগলো।
এই যাঃ!
জলের বোতল খানা হাত ফসকে নিচে পড়ে গেলো। মেয়েটি তাড়াতাড়ি তুলে দিল আমার হাতে, নিন আন্টি।
উঠে ভালো করে বসুন।
এরপর মাঝে
মাঝেই দুজনে না না কথা কইছিলাম। নিউজলপাইগুড়ি থেকে গৌহাটি পর্যন্ত পথ যেন খুব তাড়াতাড়ি
শেষ হয়ে আসছে।
গন্তব্য
দুজনেরই এক। মনের সব মলিনতা যেন ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। মেয়েটির নাম বললো শান্তা। শান্ত
স্নিগ্ধই বটে। আর আধা ঘন্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাবো। শান্তা ডাকলো, মাসিমা জানাই হোলোনা
আপনি স্টেশনে নেমে কোথায় যাবেন। সংক্ষেপে বললাম, বাড়ি শিলিগুড়ি, যাচ্ছি গৌহাটি, তবে
কোথায় উঠবো জানিনা। অনেক পরিচিত আত্মীয়ই আছে সেখানে। শুনেছি ওখানে একটা ভালো বৃদ্ধাশ্রম
আছে। সেখানে নাকি ভারী সুন্দর পরিবেশ।
শান্তা বলে উঠলো, মাসিমা বৃদ্ধাশ্রমে কখনো সুন্দর পরিবেশ হয়না।
আপত্তি না থাকলে একটা কথা বলি।
আমি বললাম, বলো গো মা।
- আপনার সংসারে কে কে আছেন?
- মনে পরলো আসবার সময় নাতিটা খুব কাঁদছিল। দুদণ্ড দাঁড়িয়ে রিভুকে একটু আদর করে
শান্ত করে বেরোতে চেয়েছিলাম। বৌমা বললো, দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট না করে দুগ্গা দুগ্গা
বলে বেরিয়ে পড়ুন। এমনি সময় তো ছেলেটাকে ঠিক মতো না দেখেই টিভি সিরিয়াল দেখতে বসে যান।
আজ যে বড়ো মায়া দেখাচ্ছেন।
ওহ কি জ্বালা করছে চোখে। কখন যেন জলের উচ্ছাস
এসে গাল বেয়ে নেমে এসেছে।
মাসিমা,
আমার কথা শুনছেন? একি মাসিমা কাঁদছেন কেন? কেউ কি সত্যিই নেই আপনার?
বললুম, না, আমি একা, তাইতো দূরে কোথাও একটা
বৃদ্ধাশ্রম খুঁজছি। নিজের বাড়ির কাছে চেনা মুখের মাঝে থাকতে চাইনা তাই....।
শান্তা আমার দিকে হাসি মুখে চেয়ে আমার হাত দুটি
ধরে বললো, সে জন্যই ঈশ্বর আমার সাথে আপনার যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন। আপনি আমার সাথে আমার
বাড়িতে চলুন। কদিন থেকে পরে নাহয় ভাববেন কোথায় যাবেন।
আমি বললাম, সে হয়না রে মেয়ে। আমার আর সংসারে যেতে মন চায়না। বহু কষ্টে
একবার যখন মায়ার বাঁধন ছেড়ে ঘর থেকে বেড়িয়েছি আর আমি কোনো ঘরেই ফিরবোনা।
কে শোনে কার কথা। শান্তা আমাকে প্রায় জোর করে নিয়ে গেলো ওদের বাড়িতে।
ঘরে ঢুকে আর এক চমক। বাড়ি যেন নয়,
এ যে একখানা রাজপ্রাসাদ! রাতে আর ঘুরে দেখা হয়নি সেই বিলাসবহুল অট্টালিকাকে। তখন রাত
হয়ে গেছে অনেকটা। শান্তা বললো, মাসিমা আমি মালতিকে আগেই ফোন করে বলেছি আপনার জন্য আলাদা
ভাবে রুটি আর পনির করে রেখেছে। এইযে আপনার বাথরুম, ফ্রেস হয়ে নিন। আমার ছেলের সাথে বসে খাবেন।
তখন রাত প্রায় সারে এগারোটা। রাতুলের
সাথে শুয়ে গল্প করছি। ও শান্তার ছেলে। রাতুলের বাবার সাথে দেখা হোলোনা কারন তার আসতে
নাকি রাত হবে।
রাতুল ক্লাস ফোরে পড়ে। আমাকে পেয়ে সে খুব খুশি। মনে পড়লো আমার নাতনি মুনুর কথা। আমার একমাত্র ছেলের ঘরের
একটিই মেয়ে আমাদের মুনু। ও ফোরে পড়ে। বৌমা সেদিন যখন বলছিলো,- এখানে যদি থাকতে হয় তো আপনি যখন তখন
বাইরে বেড়াতে যেতে পারবেন না। মন্দিরেই যান আর মর্নিং ওয়াকেই যান। এতে আমার মেয়ের বাইরে
ঘোরার অভ্যেস হয়ে যাবে।' এতটুকু মেয়ে বলে উঠলো, মাম্মা, তুমিও তো সবসময় যাও, ঠাম্মি
তো আমার প্রাইজ আনতে যায়। সেদিন আমার ছেলে বাড়িতে থেকেও যখন চুপচাপ ছিল বুঝলাম আর থাকা
ঠিক হবেনা। বুঝতে পারছিলাম আমাকে বাড়ি থেকে বার করবার এটা একটা বাহানা।
তখন সন্ধ্যেবাতি দিয়ে সবে বাইরে বেরোনোর
জন্য তৈরী হয়েছি। মুনুকে কথা দিয়েছিলাম আজ বিকেলে যদি হোমটাস্ক নির্ভুল করে তাকে একটা
গল্পের বই গিফট করবো। যাহোক, আমি বিনাবাক্যব্যয়ে একটা সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম।
কেউ বাধা দেয়নি আমাকে। যখন দরজার বাইরে পা বাড়িয়েছি শুনলাম মুনু বলছে, ইউ ন্যটি মম।
ঠাম্মি না এলে আমি কাঁদবো। বেরিয়ে গেলাম চেঁচামেচি হচ্ছিল, তাই দাঁড়াইনি।
দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ার বাড়িতে কদিন থাকতে হয়েছিল ট্রেনের টিকিট কাটবার
জন্য।
ও দিদুন
কাঁদছো কেন? রাতুলের ডাকে চমকে উঠলাম।
বললাম, না না কাঁদবো কেন? রাস্তায় চোখে ধুলো
লেগে চোখে এলার্জি হয়েছে ভাই। এবার তোমার গল্প শুনি।
বললো দিদুন, আজ তোমার কাছে শুতে পারবো ভাবিনি।
মনটা খুব খারাপ ছিল।
বললাম, কেন ভাই মনটা খারাপ কেন গো ?
- আমার দিদুনকে মা দিয়ে এসেছে কাল ।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার দিদুন তোমার মায়ের কি হন?
- মাম্মি হয়। জানো, দিদুনের কেউ নেই আমি ছাড়া, তবু মা দিয়ে
এলো।
- দিয়ে এলো ! কোথায়?
- জানিনা। বড় একটা বাড়িতে। বাড়িটার নাম শিলিগুড়ি। দিদুন
তুমি চেন বাড়িটা?
- ধুর বোকা ছেলে। শিলিগুড়ি কোনো বাড়ি নয়, ওটা একটা শহর। বেড়াতে
গেছেন তোমার দিদুন। চলে আসবে দেখো।
- তবে পাপা যে বললো আর কোনোদিন আসবেনা।
- মানে !
- হ্যাঁ, ওই বাড়িটায় নাকি অনেক দাদু
আর দিদুন আছে। ওখানে দিদুনের একটুও কাজ
করতে হবেনা। দিদুনের হাতের ব্যথাও সেরে যাবে।
- আমার মাথাটা হঠাৎ ঝিমঝিম করে উঠলো।
এ আমি কোন শান্তার গল্প শুনছি ! যে এতো যত্ন করে ঘরে নিয়ে এলো?
রাতুলকে বললাম, তোমার দাদু কোথায়?
- দাদু নেই আমার। মাও চেনেনা দাদুকে। পাপা বলে দাদুর নাকি ছোট্ট
একটা খেলনার দোকান ছিল।
আমি উঠে বসলাম। আর দেরি করা ঠিক হবেনা।
রাতুল
যখন ঘুমালো আমি বসে রইলাম ভোরের অপেক্ষায়। বুঝলাম সে বেচারি পেনশন পেতেন না। হয়তো অসুস্থ
ছিলেন, তাই...
ঈশ্বর
সহায় আছেন, আমার পেনশনটা তবু আছে। তবে কেন এমন হয়? পরের ছেলে পরের মেয়েদের ওপর দোষারোপ
করি আমরা। আর নিজের ছেলে মেয়ে? সম্পর্কের মূল্যবোধ তারা কি বোঝে এতটুকু? মাতৃগর্ভ থেকে
ভূমিষ্ঠ হবার পর এইযে সন্তানের জন্য রাতজাগা...তাদের ছোট্ট ছোট্ট শরীর থেকে মায়ের কাপড়খানা
ভিজে ওঠা, ওদের অবোধ কান্নাকে বুকে জড়িয়ে রাখা..
মনে পড়ছে, বহুদিন আগে পড়েছিলাম, রবীন্দ্রনাথ
এর ‘গান্ধারীর আবেদন’। তার একটি পংক্তি মনে আছে আজও। “শাঁখাবন্ধে ফল যথা, সেই মতো করি,
বহুবর্ষ ছিলোনা সে আমারে আঁকড়ি, দুই ক্ষুদ্র বাহুবৃন্ত দিয়ে...?”
হাজারো ইচ্ছে, বায়নাকে প্রশ্রয় দিয়ে তিল তিল করে বড়
করে তোলা, সন্তানের ইচ্ছে, সখ, সৌখিনতাকে প্রাধান্য দিয়ে, নিজের
ইচ্ছেগুলোকে তুচ্ছজ্ঞান করে বড় করে তুলছি... এরই নাম এরই বোধহয় সন্তান সুখ? এরই
নাম জীবন?