হৃদয় নেই
আজিজুল হাকিম
(সীমান্তের দেয়াল)
তিন
আমি
তখন ক্লাস টু-এ পড়ি । সাত বছর বয়স । সেই সময় আমার ক্লাসের একটি মেয়েকে খুব ভাল লাগত
। বড় হয়ে তাকে বিয়ে করব, এ সব ভেবে মনের অন্ধকারে আনন্দের আলোয় পুলকিত হতাম । তাকে
নিয়ে রঙিন কল্পনায় নানান ছবি আঁকতাম । সে গালে হাত দিয়ে বসলে আমিও গালে হাত দিয়ে বসতাম
। ও হাসলে আমারও মুখটি প্রসন্ন হয়ে যেত । তার অঙ্গভঙ্গির প্রায় আমি অনুকরণ করতাম ।
কিন্তু খুব গোপনে । আমি ভাবতেই পারিনি, আমার দেহে বসন্তের জৌলুস আসার অনেক আগেই ওর
যৌবনের বাসন্তিক মেলায় মৌমাছি গুনগুন করবে । ফুল ও ফলে পল্লবিত করতে সে অন্যের সংসারে
চলে যাবে বরাবর ।
তারপর
যেদিন ও আমাকে কথা বলল--- “তোমার বাড়ি ?” তখন সঙ্কোচ অনুভব করলাম । তারপরে ও যখন আমার
সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে যেতে শুরু করল তখন কেন যেন ওকে নিয়ে যত সব রোম্যান্টিক কল্পনা
হারিয়ে যেতে লাগল । তখন আমার মধ্যে লজ্জাবোধ গাঢ় হচ্ছিল । যদি ও আমার অভিলাষ জেনে নেয়
তাহলে ! ও নিশ্চয় আমাকে খারাপ ভাববে । আমাকে ঘৃণা করবে ! তবুও ক্লাস ফোর পর্যন্ত মাঝে
মাঝে ওর দিকে তাকাতাম । তাকাতে ভাল লাগত ।
কিন্তু
যেদিন আমাদের ক্লাসের আমার থেকে সাত-আট বছরের বড় ছেলেদের সঙ্গে বেট করে এক প্যাকেট
সিগারেট এনে খেতে শুরু করল; সেদিন ওকে আর চিনতে পারছিলাম না । আমার জীবনের সঙ্গী হিসেবে
ওকে আর চাইতে পারলাম না । দরজা বদ্ধ ঘরে অন্য ছেলেদের সঙ্গে ও এভাবে সিগারেট টানবে
আমি কল্পনাই করতে পারিনি । ওর সঙ্গে সিগারেট টানতে পেরে ছেলেরা খুব এনজয় করছিল । ঘরটা
আস্তে আস্তে দম বন্ধ করা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল । ও যখন অভ্যস্ত নেশাখোরের মতই
ধোঁয়া ছাড়ছিল তখন আমার সমস্ত ভালোবাসা ও ধোঁয়ার মধ্যে দিশেহারার মতই ঘুরপাক খাচ্ছিল
। ওর মুখটা আমার সামনে ধোঁয়ার অন্ধকারে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল । আমি কেবল নির্বাকভাবে
ওর সিগারেট টানা এবং ধোঁয়া ছাড়া মুখটা দেখছিলাম । ওই অবস্থায় ওকে মেনে নিতে পারছিলাম
না । ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ।
সে সময়
বাবা-মা আমাকে খুব একটা ভালোবাসত বলে মনে হতো না । সংসারের অর্থনৈতিক হাহাকারের দোলায়
আমাকেও দোলাত । একটা অন্তহীন দুরবস্থার ঘূর্ণি ঝড় সব সময় প্রবাহিত হতো । একটু ভুল পেলেই
আমার উপর চড়, থাপ্পর আর চির পরিচিত গালি বর্ষিত হতো । আমার প্রতি তাদের প্রিয় গালি
ছিল, ‘ডাল কুত্তা’ । তখন বর্ষার বারিধারার মতই আমার চোখ ভেঙে কান্নার বৃষ্টিধারা ঝরে
পড়ত । কিন্তু চিৎকার করে কাঁদতে পারতাম না । তুষারের গলনাঙ্কের মতোই নিঃশব্দে আমার
চোখ থেকে অশ্রু খসে গাল বেয়ে গলে পড়ত । পুকুরের পাড়ে বসে বসে কাঁদতাম । কাঁদতে কাঁদতে
মাঠে চলে যেতাম । অঢ়লের ভুঁইয়ে বসে বসে কাঁদতাম । ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবেই কেটে যেত
।
একাই
অঢ়লে ভুঁইয়ে বসে থাকতে খুব ভাল লাগত । দূর থেকে অঢ়লে ভুঁইকে জঙ্গলের মতো লাগত । অঢ়লে
গাছগুলো দশ-বারো ফিট উঁচু । মাথা ঝাঁকড়া । ভিতরটা ফাঁকা । ওদের ছায়ায় কোন ঘাস জন্মাত
না । কেবল চাপড়ি ঘাসগুলো দু-একটি করে জন্মাত । ওই ঘাসগুলো ছাগলে খুব খেত । সে সব ঘাস
এখন আর দেখা যায় না । সারা ভুঁইয়ে জুড়ে অঢ়লের শুকনো পাতা বিছানো থাকত । ওর পায়ে হাঁটলে
একটা মধুর, মচমচ শব্দের সৃষ্টি হতো ।
একদিন
অড়হলের জমিতে আমি একটি সুন্দর খেলা ঘর তৈরি করেছিলাম । ওপরে অড়হলের ডালপালা আর পাতা
দিয়ে চাল তৈরি করেছিলাম । ঘরের চারিদিক লতাপাতার বেড়া দিয়ে সাজিয়েছিলাম । তার ওপরে
হলুদ রঙের অনেক বুনো ফুল দিয়ে সাজিয়েছিলাম । ফুলগুলি তখনও সম্পূর্ণ ফুটেনি । তবুও চমৎকার
লাগছিল । ঘরটির মধ্যে বসে বসে আমি চারিদিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলাম । ঝুলন্ত
ফুলগুলি খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল । এমন একটা মনোরম ঘর বানাতে পেরে আমি বেশ গর্ব অনুভব
করছিলাম ।
আমি
যখন ঘরটির মধ্যে বসে বসে আনন্দে বিহ্বল হয়ে ফুলগুলি লক্ষ্য করছিলাম তখন জহুরের আজানের
শব্দে আমার চোখের সামনে আমার ঘরের মধ্যে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল । আজানের শব্দ পাওয়া
মাত্র ফুলগুলির পাপড়ি সম্পূর্ণ রূপে ফুটে উঠল । আমি আনন্দে চমকে গেলাম । অবাক বিস্ময়ে
সেই প্রিয় ফুলগুলির দিকে তাকিয়ে থাকলাম ।
প্রায়
সারাদিন এই ভাবে মাঠে মাঠে কাটিয়ে দিতাম । হিজিবিজি কত কি ভাবতাম । দুঃখ যন্ত্রণায়
বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করত । অনেক অনেক দূরে চলে যেতে মন চায়ত । যেখানে গেলে আমার
বাবা-মা খোঁজ করে কোনদিনও পাবে না । পৃথিবীর ওপারে কি আছে ? আকাশ কি ওপর থেকে এসে পৃথিবীর
কোলে মিশে গেছে ? হয়ত তাই ! তারপর মনের কল্পনায় ডানা মেলে দিই । চলে যাই আকাশ-পৃথিবীর
মিলন প্রান্তরে । ঘুরে বেড়াই । মেঘেদের বুকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে কতই না আনন্দ হয়
! মেঘেদের বুকেও কি হেঁটে বেড়ানো যায় ? হাঁটতে খুব মজা লাগে বুঝি !
কিন্তু
নানী মা তো বলতেন, পৃথিবীর ওপারে বিশাল পাহাড় আছে । ওই পাহাড়ের গুহায় ইয়াযুজ মাযুজের
বংশধর আছে । সেখানে কোন গুহাপথ নেই । ওরা এই পৃথিবীর আলোয় বেরিয়ে আসার জন্য প্রতিদিন
পাহাড় চেটে চেটে পাতলা করে দেয় । তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়লে ওই পাতলা অংশ রেখে ঘুমাতে
যায় । ওদের উদ্দেশ্য থাকে ওই পাতলা অংশ চেটে বেরিয়ে আসবে পৃথিবীর ওপরে । ওরা এতই তৃষ্ণার্ত
ও ক্ষুধার্ত থাকবে যে পৃথিবীর সব মানুষকে খেয়ে ফেলবে । তারপর যখন খাবার না পাবে পৃথিবীর
সমস্ত লতাপাতা নিঃশেষ করে দিবে । তবুও ওরা এখন আসতে পারবে না । কারণ ওরা যখন পাহাড়ের
পাতলা অংশ রেখে শ্রান্ত দেহে ফিরে যায় তখন রাতে ওই পাতলা অংশ আর পাতলা থাকে না । পাহাড়
পুনরায় তার পূর্বের রূপ ফিরে পায় । কিন্তু একদিন ওরা বেরিয়ে আসবে । যেদিন পরহেজগার
বলে একটিও লোক থাকবে না এই দুনিয়ার বুকে । সেদিন ওরা আসবে ।
নানীর
মুখে এই সব গল্প শুনতে শুনতে চলে যেতাম ওই পাহাড়ের গুহায় । মনের কল্পনায় সাজিয়ে নিতাম
তাদের ভয়ঙ্কর দৈতাকৃত দেহ ।
দুনিয়ার
ওপারে গেলে কি ওই পাহাড় দেখতে পাব ! শুধুই কি ওখানে পাহাড় ? পাহাড়কে নাকি দূর থেকে
দেখতে মেঘেদের মতো মনে হয় ! পাহাড় নাকি ঝাড়খণ্ডে, বিহারে আছে । পাহাড়গুলো নাকি খুব
উঁচু উঁচু হয় । কবে পাহাড় দেখতে পাব ?
কেন
জানি না, কখনো কখনো বাংলাদেশ চলে যেতে মন চায়তো । বাংলাদেশ ভীষণভাবে আমাকে টানত । মনে
মনে ভাবতাম বাংলাদেশের টিভি সেন্টারে গান গাইব, নাচব । সকলে দেখবে । কি হবে বাড়িতে
থেকে ? কিছুই হবে না । কেবল বাবা-মার অত্যাচার সহ্য করা আর কান্না ছাড়া বাড়িতে কি আছে
?
বাবা-মার
হাতে মাঝে মাঝে আমি রাতেও মার খেতাম । আমার এক কাকার কাছে রাতে পড়তে বসতাম । অঙ্কে
একটু ভুল হলেই কাকা আমাকে বেধরম মারতেন । উনার কাছে মার খেতে খেতে এক সময় অঙ্কের প্রতি
আমার চরম ভয় ঢুকে গেছিল । ফলে আর কোন দিন অঙ্কে ভাল হতে পারিনি । কোনভাবেই ওই বিষয়টি
আমার মাথায় ঢুকাতে পারিনি । যার কারণে জীবনের হিসেবও ঠিকভাবে মেলাতে পারিনি ।
যখন
রাতে রাতে আমি মার খেতাম তখন চাঁদ আর অজস্র তারাদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে যেতাম
। চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়ে পড়তো । চাঁদ আর তারাদের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
নিঃশব্দে কেটে যেত । চাঁদের উজ্জ্বল হাসির মাঝে আমার কান্নাকে বিলিয়ে দিতাম । চাঁদও
কি আমার মতো কান্না করে ? কখনো কখনো ? আমার মতো কি ওর মাঝেও দুঃখ আছে ? না কোন দুঃখের
পরশ ওর দেহ, হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারেনি ! ওর গায়েও তো কালো দাগ আছে । তার জন্য কি কোন
দুঃখ হয় ? এ প্রশ্নের উত্তর কোথায় পাব ? কে
দেবে ?