হাইপেশিয়া:
এক বিস্মৃতপ্রায় গণিতজ্ঞ
নারীর বেদনাময় কাহিনী
কলমে- ইসমাত রিজুয়ানা
সত্যিকথা বলতে কি, ইউক্লিডের পর আলেকজান্দ্রিয়াতে
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এত বড় গণিতজ্ঞের আর জন্ম হয়নি । হাইপেশিয়ার বাবা থিওন নিজেও
ছিলেন একজন বড় মাপের গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ এবং আলেকজান্দ্রিয়া মিউজিয়ামের পরিচালক
। যে সময়টাতে মেয়েদের আক্ষরিক অর্থেই দেখা হত কেবল পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে, কথিত আছে,
সে সময়টিতেও থিওন তাঁর মেয়েকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ‘একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে’ ।
পূর্ণাঙ্গ মানুষ তো হাইপেশিয়া হয়েছিলেনই, আর
সেই সাথে ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী, আর বিদুষী । এ যেন সত্যিকারের মনি-কাঞ্চন যোগ । তাঁকে
বলা হত , ‘পরমাসুন্দরী আফ্রোদিতির দেহে প্লেটোর আত্মা’ যেন’ ! স্বভাবতাই সুদর্শনা আর
বিদুষী হাইপেশিয়াকে বিয়ে করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন অনেকেই, কিন্তু স্বাধীনচেতা হাইপেশিয়া
তাদের প্রত্যেকের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, আর নিজেকে নিয়োজিত করেন গণিতের
নিবিড় সাধনায় ।
বেশ কিছুটা সময় দেশের বাইরেও কাটান তিনি, তারপর
দেশে ফিরে এসে গ্রহণ করেন আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞের পদ । অচিরেই তিনি
নিজেকে পরিণত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম জনপ্রিয় শিক্ষিকা হিসেবে । তিনি পড়াতেন গণিত,
জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন আর মেকানিক্সের বিভিন্ন জটিল জটিল বিষয়গুলো । দূর দূরান্ত থেকে
ছাত্ররা শহরে চলে আসতো তার বক্তৃতা শুনতে, আর আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের একটি বিশাল
কক্ষে প্রতি সন্ধ্যায় সর্বসাধারণের জন্য হাইপেশিয়া বক্তৃতা দিতেন । পয়সা খরচ করে এই
নারীর বক্তৃতা শুনতে হত তখন ! সাধারণের জন্য দর্শনী ছিলো একটি মোহর ।
তবে সভায় যারা স্বচ্ছল ও স্থায়ী সদস্য, তারা
আবার মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সম্মানী প্রদান করতেন । হাইপেশিয়া তাঁর বক্তৃতায়
প্লেটো, আ্যারিস্টটলের দার্শনিক কাজকর্ম নিয়ে প্রচুর কথা বলতেন, তাদের পর্যালোচনা করতেন
আর দূর দুরান্ত থেকে আসা লোকজন যেন সম্মোহিত হয়ে তার কথা শুনতো পিন পতন নিস্তব্ধতায়
।
হাইপেশিয়ার মৌলিক কাজের মধ্যে রয়েছে দায়োফ্যান্তাস
রচিত অ্যারিথমেটিকা পুস্তকের উপর ১৩ অধ্যায়ের একটি আলোচনা, যার বেশ খানিকটা অংশই পরবর্তীতে
দায়োফ্যান্তাইন পান্ডুলিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় । এছাড়া তিনি অ্যাপোলোনিয়াসের কৌণিক ছেদ
পুস্তিকার উপর একটি আলোচনা লেখেন , আর টলেমীর কাজের উপর আলোচনা লিপিবদ্ধ করেন
Astronomical canon শিরোনামে । তিনি তার বাবাকে জ্যামিতির কালজয়ী গ্রন্থ Euclid’s
element-এর নতুন সংস্করণ তৈরীতেও সহায়তা করেছিলেন – যে সংস্করণটি আজও পাঠ্যপুস্তকে
ব্যবহৃত হয় । হাইপেশিয়া আর তার বাবা যৌথভাবে টলেমীর অলমাগসেত এর উপরও কাজ করেন।
তবে যে দুটি যন্ত্রের আবিস্কার হাইপেশিয়াকে
‘উদ্ভাবক’ হিসাবে মহিমান্বিত করেছে তার একটি হল অ্যাস্ট্রোলেব – যেটি ব্যবহৃত হত গ্রহ-নক্ষাত্রাদির
দৈনন্দিন ঘূর্ণন গণনায়, আর মহাজাগতিক নানা সমস্যা সমাধানে; আর একটি হল হাইড্রোস্কোপ
- যা দিয়ে তরল পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্ব মাপা হয় । এছাড়া তিনি জলের লেভেল মাপার জন্য
একটি যন্ত্রও তৈরী করেছিলেন ।
তাঁর বিচক্ষণতা আর বিচার বুদ্ধি সমাজে এতটাই
প্রভাব বিস্তার করেছিলো যে নগরপাল অরিস্টিস হাইপেশিয়ার মতামত না নিয়ে কোন কাজ করতেন
না । এই সমৃদ্ধি আর স্বীকৃতিই বোধ হয় হাইপেশিয়ার কাল হল ! ‘তুচ্ছ নারী’র মেধা, মনন
আর জ্ঞান অনেক সময়ই পরাক্রমশালী পুরুষতন্ত্রের কাছে নিতান্ত অসহনীয় । তার মধ্যে আবার
সে নারী যদি হয় বিজ্ঞানমনস্ক মুক্ত-বুদ্ধির চর্চাকারী, রাজনীতি সচেতন এক স্বাধীনচেতা
রমণী !
হাইপেশিয়ার অনেক বক্তব্যই ছিলো গোঁড়ামী বিরোধী
আর মুক্তবুদ্ধির প্রতি সমর্থনসূচক, যা নিঃসন্দেহে কট্টরপন্থিদের উষ্মার কারণ ঘটিয়েছিলো
। হাইপেশিয়া তাঁর এক শিষ্যকে বাইবেল সম্পর্কে বলেছিলেন : ‘আমি খ্রীষ্টান নই । কিন্তু
বাইবেলের প্রাচীন ও নবীন দুটো খন্ডই আমি পড়েছি । বিশ্বাসের কথা, ঈশ্বরের প্রেমের বাণী
ও-দুটিতে আছে ঢের কিন্তু দার্শনিকের দৃষ্টিতে ওসব বালকসুলভ উচ্ছ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়।
পরিণত বুদ্ধির জাতির জন্য থাকা উচিৎ যুক্তি-নির্ভর জ্ঞানভিত্তিক ধর্ম একটা, যা ছিলো
গ্রীকদের, যার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প নিয়ে আমি যথাসাধ্য কাজ করে যাচ্ছি আলেকজান্দ্রিয়ায়
বসে।’
তখনকার আলেকজান্দ্রিয়া খ্রিস্টান ও ইহুদি দুটি
ধর্মেরই সমান অনুসারী থাকলেও, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে খ্রিস্টানদের প্রভাব বৃদ্ধি
পাচ্ছিলো। তারা আলেকজান্দ্রিয়াকে সম্পূর্ণ চার্চের অধীনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলো ।
অসংখ্য ইহুদিকে শহর থেকে তাড়িয়ে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
শহরের গভর্নর অরিস্টিস নিজে খ্রিস্টান হয়েও
তখন খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের ভেতর সমঝোতা করানোর জন্য ইহুদিদের পক্ষ নিলে চার্চের বিশপ
সেরিল এবং শহরের অন্যান্য খ্রিস্টানরা চরম ক্ষেপে ওঠে । হাইপেশিয়ার সঙ্গে অরিস্টিসের
বন্ধুত্ব ছিল । রাজনৈতিক নানা ব্যপারে অরিস্টিস তার সাথে আলোচনা করতেন । এই সম্পর্কই
হাইপেশিয়ার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
এই জন্যই সিরিল প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে হাইপেশিয়াকে
হত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন । এক দিন কর্মস্থলে যাওয়ার পথে হাইপেশিয়া মৌলবাদী আক্রোশের
শিকার হলেন, হাইপেশিয়া-হত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় পনের শতকে সক্রেটিস স্কলাসটিকাসের
রচনা হতে।
‘পিটার নামের
এক আক্রোশী ব্যক্তি অনেকদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিলো, শেষমেষ সে হাইপেশিয়াকে কোন এক জায়গা
হতে ফিরবার পথে কব্জা করে ফেলে । সে তার দলবল নিয়ে হাইপেশিয়াকে তার ঘোড়ার গাড়ী থেকে
টেনে হিঁচড়ে কেসারিয়াম নামের একটি চার্চে নিয়ে যায়। সেখানে তারা হাইপেশিয়ার কাপড়-চোপড়
খুলে একেবারে নগ্ন করে ফেলে, তারপর ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে তাঁর চামড়া চেঁছে ফেলে,
তার শরীরের মাংস চিরে ফেলে, আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত হাইপেশিয়ার উপর
তাদের অকথ্য অত্যাচার চলতে থাকে। এখানেই শেষ নয়; মারা যাবার পর হাইপেশিয়ার মৃতদেহ টুকরো
টুকরো করে সিনারন নামের একটি জায়গায় জড় করা হয় আর তারপর পুড়িয়ে তা ছাই করে দেওয়া হয়’।
হাইপেশিয়াকে হত্যা করা হয় ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দের
মার্চ মাসে। সিরিলকে পরবর্তীতে ধর্মীয় অধিকার বলে সেইন্ট বা সন্ত হিসেবে অভিষিক্ত করা
হয়। ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধের উপযুক্ত ধর্মীয় ‘শাস্তি’ই বটে !
অরিস্টিস এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড সম্বন্ধে রিপোর্ট
করেন এবং রোমকে এর তদন্ত পরিচালনা করতে অনুরোধ করেন । তারপর তিনি তার কর্মস্থল থেকে
অব্যহতি নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে চিরতরে বিদায় নেন । আর ওদিকে তদন্তকাজ পদে পদে ‘পর্যাপ্ত
সাক্ষীর অভাবে’ বাধাপ্রাপ্ত হয়, আর শেষপর্যন্ত সিরিল জল ঘোলা করতে জনসমক্ষে প্রচার
করতে শুরু করেন যে, হাইপেশিয়া নাকি জীবিত আছেন এবং এথেন্সে বহাল তবিয়তে বাস করছেন ।
হাইপেশিয়ার হত্যাকান্ড আলেকজান্দ্রিয়া এবং পুরো
রোমান সাম্রাজ্যে বৈজ্ঞানিক আর যুক্তিবাদী শিক্ষার বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দেয়। ইউরোপ পুরোপুরি
প্রবেশ করে ‘অন্ধকার যুগে’। গোঁড়া খ্রীষ্টধর্মের প্রসারের সাথে সাথে আলেকজান্দ্রিয়া
নানা ধরনের ধর্মীয় সংস্থার ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে যায়, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ব্যহত হয় ;
নানা ধরণের ধর্মীয় তুক-তাক, জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চা, কুসংস্কার, অতীন্দ্রিয়তা আর আধ্যাত্মিকতা
ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্থান দখল করে নেয়।
হাইপেশিয়াকে হত্যার পর তাকে যেন আক্ষরিক অর্থে
ভুলেই গিয়েছিলো মর্তের বিস্মৃতিপরায়ন মানবজাতি । স্মৃতির পরতে পরতে পড়েছিলো ধুলোর পুরু
স্তর । ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁকে হত্যার পর প্রায় তের’শ বছর ধরে সত্যিকার অর্থেই যেন
নিশ্চুপ হয়ে পড়ে ছিল সবাই। অনেক অনেক বছর পরে – সেই ১৭২০ সালে জন টোলান্ড হাইপেশিয়াকে
স্মৃতির ছাইভস্ম হাতড়ে আমাদের সামনে তুলে আনেন । তিনিই বিশ্ববিবেক কে প্রশ্নবিদ্ধ
করে তোলেন এই বলে যে হাইপেশিয়ার মত অনিন্দ্যসুন্দর, বিজ্ঞ এবং নিষ্পাপ দার্শনিকের রক্তে
হাত রঞ্জিত করার দায়ে সমস্ত পুরুষতন্ত্রের লজ্জিত হওয়া উচিৎ ।
টোলেন্ডের হাত ধরে পৃথিবী যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম
থেকে জেগে উঠলো । যে ভলটেয়ার তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ইতিহাসে এর আগে কোন ‘নারী উদ্ভাবক’
পাননি, তিনিই হলেন এবার হাইপেশিয়া বন্দনায় উচ্ছসিত । তিনি বলেন : এই পাশবিক হত্যাকান্ড
পরিচালিত হয় সিরিলের মাথা-মুড়োনো ভিক্ষু হিসেবে খ্যাত কতকগুলো ‘ডালকুত্তা’র সহচর্যে,
আর উগ্র, গোঁড়া ধর্মবাদীদের আস্ফালনে’।
এটি নিঃসন্দেহ যে, নারীরা সভ্যতা-নির্মানের
এক বড় অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও পুরুষশাসিত সমাজের সীমাবদ্ধতায় পথ হারিয়েছে বারে বারে।
কিন্তু যে নামটি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব নিয়ে উঠে এসেছে, যার মৃত্যুর সাথে জড়িয়ে আছে আলেকজান্দ্রিয়া
গ্রন্থাগারের ধ্বংস, আর মধ্যযুগীয় অন্ধকার যুগের সূচনা – তিনি হলেন হাইপেশিয়া । হাইপেশিয়া
হত্যায় বিক্ষুব্ধ হয়ে চার্লস লিকন্ট দ্য লিসল এক সময় নিবেদন করেছিলেন আবেগময় পংক্তিমালা:
সে একা বেঁচে
আছে, যেন শাশ্বত চিরন্তনী হয়ে
মৃত্যু কেবল
বিক্ষিপ্তই করতে পারে এই কম্পমান বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডকে
কিন্তু আজো
সৌন্দর্য তাঁর আগুন হয়ে জ্বলে
আর তাঁর
ভিতর পুনর্জন্ম ঘটে যেন সকলের
এবং ধরিত্রী
ভুলুন্ঠিত হয়ে পড়ে রয় তাঁর শুভ্র চরণ তলে।
বার্ট্রান্ড রাসেল তার হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন
ফিলোসফি গ্রন্থে স্পষ্ট করেই বলেছেন, হাইপেশিয়াকে হত্যার মাধ্যমে আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রীষ্টিয়
মৌলবাদীরা নিশ্চিত করেছিল যেন আর কোন দার্শনিক ভবিষ্যতে তাদের এমনিভাবে যেন না জ্বালায়
। হাইপেশিয়ার বেদনাঘন উপাখ্যান মনে করিয়ে দেয় আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির বিদুষী নারী
‘খনা’কে যার খ্যাতি ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো তদানিন্তন পুরুষতন্ত্রকে । শেষপর্যন্ত খনার
জীহ্বা কেটে ফেলে পুরুষতন্ত্র একসময় পালন করেছিলো তাদের জয়ন্তী উৎসব । ঠিক তেমনিভাবে
হাইপেশিয়াকে হত্যার মাধ্যমে পুরুষতন্ত্রের পুরোধা খ্রীষ্টিয় চার্চ আকাশে ওড়াতে চেয়েছিলো
তাদের বিজয় কেতন, যা প্রকারান্তরে সূচনা করেছিল মানব-ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক ঘোর অন্ধকার
এক যুগের ।
********