পৃথিবী ও জীবন
আজিজুল হাকিম
~~~~~~~~~~~~~~~
ও সুউচ্চ
পাহাড়ের মাথায় উঠে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেখানে একটি মস্ত পাথরখণ্ড দেখে তার উপরে
গিয়ে বসল। তারপর চারিপাশে চোখ মেলে দেখতে থাকল। ভীষণ সুন্দর, সুসজ্জিত, মনোরম সবুজ
বনানী আর সুদূরের সাগর। আরো কত কি!
সবুজ
বনানীর মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়টি। তার তিন পাশে ঘন জঙ্গল আর এক পাশে
উত্তাল সমুদ্র । সে আস্তে আস্তে তার চোখের দৃষ্টির সীমা আরো প্রসারিত করল। কি অপরূপ
শোভা! আশ্চর্য সুন্দর এই পৃথিবী কেমন নিরব উল্লাসে হেসে যাচ্ছে। বহুদূরের নীল আকাশ
সাগরের নীল জলে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এ যেন অদ্ভুত সুন্দর অনন্ত মিলন দৃশ্য।
এদিকে গাছেদের ডালে ডালে নানান পাখিদের চিৎকার
সমস্ত পরিবেশকে আনন্দধারায় মুখরিত করে তুলছে। পাশে একটি পাহাড়ি ঝর্ণা পাথরের ধাপে ধাপে
লাফিয়ে লাফিয়ে পা রেখে যেন ঘুঙুর পায়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। এসব কিছুই ওর মনের মধ্যে একটি
বিরাট প্রশান্তির ঝড় তুলে দিয়েছে।
পাহাড়ের
কোলে গাড়ি থেকে নেমেই ও মাস্কটা মুখ থেকে খুলে ফেলেছে। এই বস্তুটা সে আর কোন মতেই সহ্য
করতে পারছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাস্ক পরে মুখ বুজে সে কাজ করে যায়।অসহ্য লাগলেও কিছুই
করার থাকে না। অনেকক্ষণ মাস্কের মধ্যে রেখে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসকেও দুর্গন্ধ মনে হয়,
মনের মধ্যে বিরক্ত লাগে। কি আজব সময় চলছে আজকাল!
ও ‘হু’
মানে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থায় কোভিড-১৯ সেকশনে কাজ করে। এই দু বছর ধরে সে বিশ্বের লাশ
গুনতেই ব্যস্ত। এই লাশ গুনতে গুনতে বারবার ভাবনা এসেছে, মানুষের জীবন কোন কীট পতঙ্গের
চায়তে কি কোন অংশে বেশি? সারা পৃথিবী জুড়ে মৃত্যুর উৎসব চলছে। কখনো কখনো দেখা গেছে
এত মানুষ মরছে যে একটি একটি করে সমাধি করার সময় নেই। জেসিবি দিয়ে গণকবর খুঁড়ে মৃত জীবজন্তুর
মতো লাশগুলোকে সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাদের বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা
করার মতো পাশে কোন আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। ইতালি, আমেরিকায় তো রাস্তায় রাস্তায় অগুনিত
লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। যে মানুষটির সংস্পর্শ একদিন না পেলে, যে মানুষটিকে এক বেলা
না দেখতে পেলে জীবনটাকেই বৃথা বলে মনে হয়েছে সেই প্রিয় মানুষটি অসুখের খবর শুনে অসুস্থ
রুগীকে একা ফেলে রেখে কোথায় পালিয়ে গেছে। নিরবে নিভৃতে, চিকিৎসাহীনভাবে মারা গেছে হাজার
হাজার মানুষ। ভারতের রাজধানী দিল্লীতে তো শ্মশানের অভাবে ছেলে মেয়েদের খেলার পার্কে
লাশ দাহ করতে হয়েছে। এমনকি অনেক লাশ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যত সব বীভৎস কাণ্ড
ঘটে যাচ্ছে সারা বিশ্ব জুড়ে। এসব দেখতে আর হিসেব রাখতে আতঙ্কে কখনও কখনও নিজেকেও একটি
মৃত লাশ ছাড়া কিছুই মনে হয়নি।
হঠাৎ
ওর চোখ পড়ল অনতিদূরে কিছু ফুলের উপর। অদ্ভুত সুন্দর ফুলগুলি। যেন স্বর্গ হতে নেমে এসেছে
এই আশ্চর্য সুন্দর ফুলগুলি। এর আগে সে কখনও এত সুন্দর, এত চমৎকার ফুল দেখেনি। ও ধীরেধীরে
ফুলগুলির দিকে এগিয়ে গেল। কি সুন্দর সুগন্ধে ভরে আছে জায়গাটি। ও আরো কাছে গেল। দেখতে
থাকল সৌন্দর্যের শেষ চূড়াটুকু। এক হৃদয় আনন্দধারায় সে বিগলিত হয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে
সে তার হাত বাড়াতে লাগল। অমনি ওর চোখ পড়ে গেল একটি সাপের উপর। কি সাঙ্ঘাতিক সুন্দর
সাপটি। টুকটুক করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাতটি টেনে নিল। তারপর আস্তে
আস্তে পিছিয়ে যেতে থাকল।
পাহাড়
থেকে নিচে নেমেই ও মাস্কটা পরে নিল। তারপর বাড়ি ফেরার পথে একটাই কথা বারবার ঘুরে ফিরে
আসতে থাকল, “এটাই পৃথিবী, এটাই জীবন।”