রাধা
দেবব্রত রায়
বাইরের
আকাশে তখন সবে নিটোল চাঁদটা উঠেছে। জ্যোৎস্নার নীলচে আলোয় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী,আকাশ-পাতাল
! একটা আধার গেলা কেলেখড়িসের মতোই হা-ক্লান্ত পিচ রাস্তা,মাঠ-ঘাট সব যেন চাঁদনি আলোয়
একেবারে ঝকমক করছে ! যদিও,রাধা এসবের কিছুই দেখতে পাচ্ছে না তবে, মাথাটা
অনেকখানি কাত করলে ঘুলঘুলির মতো ঝিঁটেবেড়ার খুপরি জানলাটা দিয়ে ঢাউস চাঁদটার সামান্য
একটু অংশ মাত্র-ই সে দেখতে পাচ্ছিল । আসলে,এতক্ষন ধরে রাধা
ঘরের মেঝেই জলকাদার উপরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ! ওর শাশুড়ি পদ্মমণি ঘর থেকে বেরোবার সময় রাধা-র মাথাটা দেয়ালে
সজোরে ঠুকে দিয়ে বলেছিল,হারামজাদি, (জোয়ান) ভাতারটাকে খেয়েচু, আখুন আবার লালজুর মন্দিরে কিত্তন শুনতে যাবার
রস হইচে! জানুসনাই,আইজ রেতে উখানে ফাগুয়া হব্যাক!
দেয়ালে একটা ধাক্কা খেয়ে রাধার জ্ঞান হারানোর
সময় ওর পায়ে লেগে জলের ঘড়াটা ভেঙে গিয়েছিল। অজ্ঞান হওয়ার মুহূর্তে সে শুনতে পেয়েছিল
বাইরের থেকে টিনপাতের দরজায় শেকল দিতে দিতে তার শ্বশুর আর,শাশুড়ি-র গজগজানি। জ্ঞান ফিরে আসার
পর রাধা কপালে এমন একটা টনটনানি ব্যথা অনুভব করলো যে ভুষো-অন্ধকারের মধ্যেও নিজের কপালে
হাত বোলাতে গিয়ে সে "বাবাগো! "বলে কঁকিয়ে উঠল। বুঝতে পারলো,খুব জোরেই লেগেছে
কপালটায়! রাধা ওইভাবে শুয়েশুয়েই কাঁথের খুপরি জানলাটা দিয়ে সেই ঢাউস চাঁদটার একচিলতে
অংশ দেখতে দেখতে একসময় নিজের কপালের যন্ত্রণার কথাটা যেনো ভুলেই গেলো !
ঠিক এরকম একটা চাঁদনিরাতেই মাধবপুরের দোলের
মেলায় বৃন্দাবনের সঙ্গে ওর আসনাই হয়ে গেছিল ! সে রাতে লজ্জা-হায়া সবকিছু ভুলে রাধা
যেন একেবারেই ভেসে গিয়েছিল বসন্তের পাগলা হাওয়ায়। নিশিগ্রস্তের মতো সেদিন যেন সত্যিসত্যিই
একটা অদ্ভুত ঘোরে পেয়ে বসেছিল ওদের দুজনকে ! রাধা সেবার মাধবপুরে ওর পিসির বাড়িতে এসেছিল
দোলের মেলা দেখতে। পিসি বলেছিল, মাধবপুরের দোলের মেলা, সে তো এমনিসেমনি মেলা
লয়, যেন বিশ্ববোহ্মাণ্ডি এসে জড়ো হয় সিখেনে !
বৃন্দাবন
ছিল রাধার পিসতুতো দাদা মঙগলের বন্ধু। বন্ধুর নেমণত্তন্নেই মাধবপুর থেকে প্রায়
আট-দশ ক্রোশ দূরের চূরামণিপুর নামের একটা গ্রাম থেকে বৃন্দাবনও মেলা দেখতে এসেছিল ।
মঙগলই ওদের দুজনের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল মানে গাঁয়ে-ঘরে যেমন পরিচয় হয় আর কি ! তারপর,সপ্তাহ
ফিরতে না ফিরতেই দু-পক্ষের বাপ-মা,পাড়ার মাতব্বরজনেরা মিলে একটা দিন ধার্য করে ওদের
চার হাত এক করে দিয়েছিল ! বিয়েতে কত হৈচৈ হয়েছিল ! মা বিশালাক্ষী-র থানের সিঁদুর দিয়ে
বৃন্দাবন ওর সিঁথি আর, কপালখানা একেবারে টকটকে করে রাঙিয়ে দিয়েছিল ! বন্ধু-বান্ধবী,পাড়ার
বউদিদিরা ওদের বাসর ঘরে কী আমোদ-আলহাদটাই-না করেছিল! কিন্তু ,অত অত আনন্দ-আমোদের বিয়েটাও
সুখের হলো কৈ ! দু-বছর যেতে না যেতেই সব ফিকে হয়ে গেল!
সেই ছোটোবেলার থেকেই
তুষু আর, দোল পরব রাধার কাছে ছিল দুর্গাপূজার থেকেও বড্ড প্রিয় ! গতবছর সেই দোল পরবের আগের দিনই
বৃন্দাবন বলেছিল," ইবার টাউন থিক্যা তোমার জন্য রঙ লিয়ে আসব! "
রাধা পিছন থিকে বৃন্দাবনের
কানের লতিতে একটা চুমু খেতেই বৃন্দাবনও রাধাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর শক্ত-জোয়ান হাতে রাধাকে
একেবারে এলোমেলো করে দিয়েছিল । শরীর থেকে শায়া-ব্লাউজ খসে পড়তেই রাধা বৃন্দাবনের বুকের
ভিতরে মুখ লুকিয়েছিল।
যাব
যাব করেও ঠিক এই কারণেই বিকেলের আলোয় সেদিন গোধূলির রঙ ধরে গিয়েছিল ! বৃন্দাবন সাইকেলটা বের করতেই ওর মা-বাপ একসঙ্গে এসে
ছেলেকে আটকেছিল। বলেছিল,"এই সাঁঝবেলায় টাউনে যাসনে বাপ, জঙ্গলে মহাবাদি-রা আছে!
তেনাদেরকে বিশ্বাস নাই ! মাথায় বোন্দুক ঠেকায়ে উয়াদের ডেরায় তুলে লিয়ে যাবেক!
"বৃন্দাবন সেদিন কারোর কথাই শোনেনি। রাধাকে যে সে কথা দিয়েছে টাউন থেকে রঙ,পিচকিরি
এনে দেবে ! কারোর বারণ না
শুনেই সে বেরিয়ে পড়েছিল তারপর, সারারাত কেউ দুচোখের পাতা আর এক করতে পারেনি। গাঁয়ের
লোকজন এসে ভিড় জমিয়েছিল বৃন্দাবনদের উঠোনে কিন্তু, সে রাত্রে বৃন্দাবন আর ফিরেনি !
পরেরদিন
সকালবেলা পুলিশ আর, সেন্ট্রালবাহিনী জিপগাড়িতে করে বৃন্দাবনের শক্ত হয়ে যাওয়া বরফের
মতো ঠাণ্ডা শরীর আর ওর ভাঙাচোরা সাইকেলটা নিয়ে এসেছিল ! জামাপ্যান্টে শুকিয়ে যাওয়া
রক্তের উপর তখনও মাছি ভনভন করছিলো
! সব রঙ যেন বৃন্দাবন একাই খেলে ফেলেছে ! রাধা বৃন্দাবনের বুকের উপর আছড়ে পড়ে চিৎকার
করে উঠেছিল, আমার রঙ কৈ ! আমার রঙ কৈ....
বৃন্দাবনের
লাশ নিয়ে পুলিশ-গাড়িটা পোস্টমর্টেমর জন্য রওনা দিতেই রাধার শরীর থেকে সমস্ত রঙ সারা
জীবনের মতোই যেন সেদিন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল!