বহুগামী আমি-৯২-সৈয়দ আসরার আহমদ

 


বহুগামী আমি

সৈয়দ আসরার আহমদ

পর্ব-৯২

 

    আমি অফিসে চলে গেলাম আর মৌ মেডিকেলে গেল৷ দুপুরে মেডিকেলে ফিমেল ওয়ার্ডে পুরুষদের নো এন্ট্রি ফলে দুপুরে গিয়ে লাভ হয় না৷ বিকেলে সাড়ে পাঁচটায় শোভার বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ সে আমাকে দেখে খুব খুশি হল৷ মৌ বলল, তোমার নবজাতক পুত্রকে দেখবে না?

 ওর সঙ্গে নার্শারিতে গিয়ে নার্সকে বলতে তিনি বাচ্চাটাকে কাঁচের দেওয়ালের ও পাশে কোলে করে এনে দেখালেন৷ খুব ভাল দেখতে হয়েছে শোভার বাচ্চা৷ 

 আমরা শোভার বেডের পাশে ফিরতেই সে বলল, ডাক্তার বলেছে পরশু ছুটি দেবে৷ 

- ভাল তো৷ সুসংবাদ৷ আমি কি ওদিন ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে তোমাকে রিলিজ করে নিয়ে যাব৷

- মৌ বলল, তোমাকে সি.এল.নিতে হবে না৷ আমি শোভাকে নিয়ে চলে যাব৷

- একা পারবে কি তুমি?

- বহুত পারব৷

 শোভা বলল, তোমাকে ছুটি নিতে হবে না৷  মৌ ঠিক পারবে৷

  শোভা ও তার নবজাতক সন্তানকে নিয়ে মৌ গাঙুলিবাগানে পৌঁছে গিয়েছিল৷ আমি সন্ধ্যায় গিয়ে মৌকে বললাম, আমি রাতে থাকব না৷ তুমি শোভার সঙ্গে ঘুমাবে৷

- আচ্ছা তাই হবে৷

 মৌ আমাকে চা বিস্কুট দিয়ে বলল, তুমি রাতের খাবার খেয়ে যাবে৷

- আবার ঝামেলা করবে? আমি হোটেলে খেয়ে নিতাম৷

- ঝামেলার কি আছে আমাদের দু জনের তো রান্না করতে হবে৷ আমি ভাত চাপিয়ে দিচ্ছি তুমি দু মুঠো খেয়ে যাবে৷

 চলে আসার সময় শোভাকে বললাম,তুমি প্রয়োজনে আমাকে অফিসে বা আমার বড়দির বাসার নম্বরে ফোন করবে৷ আর পহেলা তারিখে বেতনের আগে আমি এসে তোমার বেতনের টাকা তুলতে letter of authority নিয়ে যাব৷

- ঠিক আছে৷ তুমি সপ্তাহে সম্ভব হলে তিনদিন আসবে৷

- আসব৷

 রাত সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছিল মেসে ফিরতে৷ রবু চাচার কাছ থেকে চাবি নিতে গেলে উনি জানতে চেয়ে বললেন, কতি ছিলেন গো এত্দিন?

 - বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম বলে চাবি নিয়ে ঘরে ঢুকলাম৷ 

  ক্লান্তির জন্য তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ রবু চাচা চা, গরম ডালপুরি ও জিলাপি এনে ঘুম ভাঙালেন৷ সকাল সাড়ে নটায় আমি অফিসে যাবার জন্য বেরিয়ে পড়লাম৷ 

 টিফিনের কিছুক্ষণ আগে শ্রদ্ধানন্দ ব্যানার্জি আমাকে ইশারায় ডাকলেন৷ আমি যেতে উনি বললেন, তুমি অভিনয় করতে পার?

- পারি তবে খুব ভাল পারি না৷ স্কুল কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে নাটক করেছি৷ দর্শকের হততালিও কুড়িয়েছি৷ কিন্তু কেন দাদা?

- আমাদের অফিসের বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমরা নাটক করি৷ তোমাকে এ বছর অংশ নিতে হবে৷ 

- ঠিক আছে আপনি তো বড় অভিনেতা বহুরূপীতে ছিলেন৷ আমাকে দেখিয়ে পড়িয়ে নেবেন৷

- সে কথা কি আর বলতে হবে৷ ২৪ ডিসেম্বর রঙমহলে আমাদের নাটকের শো হবে৷ লক্ষ্মীপূজোর পরে রিহার্সাল শুরু হবে৷ 

- কোন নাটক মন্চস্থ করবেন সিলেক্ট করেছেন?

- না এখনও করি নি৷ ভাবনা চিন্তা করছি৷ ঠিক সময়ে তোমাকে ডেকে নেব৷ জানো তো বহুরূপীর মুহম্মদ জ্যাকারিয়া আর অমর গাঙুলি আমাদের অফিসে চাকরি করতেন৷

- শুনেছি বাবার মুখে৷ আমি দুজনকেই দেখেছি৷ জ্যাকারিয়া সাহেব তো পূর্ব পাকিস্তান চলে গেছেন৷

- কলিম শরাফিও আমাদের অফিসে ছিলেন৷ তিনিও পাকিস্তান চলে যান৷ আমাদের কনক রায় খুব ভাল অভিনেত্রী৷ দারুণ অভিনয় ক্ষমতা ওর৷ তুমি এ বছর ওর সাথে কাজ করে দেখবে৷ যেমন  চমৎকার ডায়লগ থ্রয়িং তেমনই বডি ল্যাঙ্গুয়েজ৷ টালিগন্জের আচ্ছা আচ্ছা অভিনেত্রীর চেয়ে অনেক বেশি অভিনয় ক্ষমতার অধিকারিনী কনক৷

- কনক দি কোন ফ্লোরে বসেন

- থার্ড ফ্লোরে R.D Office এ৷ R.D. সাহেবের স্টেনো গ্রাফার কাম প্রাইভেট সেক্রেটারি৷ তুমি দেখেছ৷ খুব সেজেগুজে আসে৷ চোখে চশমা পরে৷

 শোভা আসে নি৷ ওদিকে করিম সাহেবও আসেন নি৷ আমি অফিসের গেটের সামনে ঝাল মুড়িঅলার কাছে মুড়ি কিনে সিটে এসে খাচ্ছিলাম৷ রন্জিতদা এসে ঠোঙায় হাত ভরে এক মুঠো নিলেন৷ আমি বললাম, রন্জিতদা আপনি শোভাদির সিটে বসুন আমি আপনার জন্য মুড়ি নিয়ে আসি৷

- ধুর পাগল আমি বাড়ি থেকে টিফিন আনি৷ দাঁড়াও আমার টিফিন বক্সটা আনছি৷ দুজনে খাবো৷ আমার আজ খিদে পাই নি৷

  রন্জিতদা টিফিন বক্স এনে আমাকে দুটো রুটি আলুর দম ও অর্ধেক ডিম দিলেন৷ আমাদের অফিসে রন্জিতদা খুব ভাল মানুষ৷ বাগনানের লোক৷ খুউব মানবিকতা সমৃদ্ধ সজ্জন৷ এই মানুষটিকে আমার খুব ভাল লাগে আর শ্রদ্ধানন্দদাকে৷ অফিসের ছ সাত জন খুব নিচু মানসিকতার তারা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি তাড়িত অসৎ লোক৷ ওরা এক একজন ঘুষ,মদ ও নারী মাংস লোলুপ পিশাচ৷ এদের কথাবার্তায় হিংসা, বিদ্বেষ, অমানবিকতা সব সময় লক্ষ্য করা যায়৷ আমার এই পরিবেশ একদম বিশ্রী লাগে মাঝে মধ্যে ভাবি চাকরি আর করব না৷ এদেশে একশ্রেণীর বিভেদকামি মানুষ মুসলিমদের পাকিস্তানের দালাল বলে মনে করে৷ অথচ তারা আসফাকউল্লাহ, শের আলিসহ কয়েক হাজার স্বাধীনতার জন্য কোরবানি দেওয়া শহীদানদের কথা ভুলে যায়৷ ভুলে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, সরকারি প্রশাসনের সেইসব শহীদানদের কথা প্রচারযন্ত্রে ইচ্ছে করেই তুলে না ধরা৷ তাছাড়া হসরত মোহানী, শাহনেওয়াজ, মুহম্মদ আলি,শওকত আলিদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে তাঁদের অংশগ্রহণ ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিয়েছে৷ আবুল কালাম আজাদ,অধ্যাপক হুমায়ন কবির,ফখরুদ্দিন আলি আহমদ প্রমুখ পাকিস্তান বিরোধি মুসলিম নেতাদের কথা কজন জানে?

  এক এক সময় মনে হয় আজাদীর লড়াইয়ে মুসলিমরা যে জান মালের মায়া ত্যাগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন বিভেদকামী প্রশাসন যন্ত্র উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তা কালিমা লিপ্ত করে চলেছে৷ তার পরিণতি কোনও দিন ভাল হতে পারে না৷ একদিন না একদিন দেশ ও জাতি এর ফল ভোগ করবে৷

স্বতঃ লেখক                   

চলবে - (৯৩)

 

Post a Comment

Previous Post Next Post