ঝাড়খণ্ডের মানুষ ও প্রকৃতি (একটি ভ্রমণ কাহিনী)

 

পাহাড় যখন ডাকে

(একটি ভ্রমণ কাহিনী)

পর্ব-৩ 

আজিজুল হাকিম

------------------ 

হয়তো আরো কিছুক্ষণ থাকা যেত; কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার কারণে আমরা আর মলুটি গ্রামে থাকিনি। সেখান থেকে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। ঝাঁ চকচকে পিচঢালা রাস্তার উপর দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছিল। আশেপাশের আর দূরের টিলাগুলো পিছনে সরে যাচ্ছে। রাস্তার দুপারে আদিগন্ত ঢেউ খেলানো সবুজ খোলা মাঠ। মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে শারদ সময়ে মেতে উঠা কাশফুলের উচ্ছ্বাস।  

প্রায় কয়েক কিলোমিটার গাড়ি চালার পর একটি ফসল বিহীন ফাঁকা মাঠে চৌরাস্তার মোড়ে এসে আমরা থামলাম। সেখানেও দেখলাম যুবতী থেকে বিভিন্ন বয়সী মেয়ে আর কয়েকটি পুরুষ মানুষ মদ বিক্রি করছে। রোদবৃষ্টি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য মাথার উপরে ত্রিপল টাঙিয়েছে। প্রায় সব মেয়েগুলোর সামনে মদের হাঁড়ি। পাশে থালার উপরে বিভিন্ন প্রকারের গ্লাস, বাটি।



আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। জায়গাটার নাম জিজ্ঞেস করতেই একজন বললেন, এই জায়গাটার নাম লালতা কুনড়ি। সেলিম একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের মদের নাম কি? ওরা টেনে টেনে বাংলায় বলল, তাড়ি আছে, মহুয়া আছে। মীর বলল, তোমরা এসব না বেচে অন্য  কাজ কর্ম তো করতে পার?

একজন মহিলা বলল, কি করব বাবু, কাজ কোথায় পাব? তোরা কি কাজ দিবি? এ করেই আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হয়। 

আমরা আর কিছুই বলতে পারলাম না। ওদের কয়েকটি ছবি তুললাম। তখন একজন মেয়ে বলল, “ছবি তুললি তো পয়সা দে?” তখন সেলিম একশ টাকা বের করে একজনের হাতে গুঁজে দিল।

ওখানে কিছুক্ষণ থাকার পরে আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম। সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমাদের গাড়িটি এগিয়ে চলতে লাগল।

তারপর আমরা গিয়ে পৌঁছালাম চেরা পাথর নামক একটি জায়গায়। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। রাস্তার পশ্চিমে ছোট-বড় পাথরের গভীর হ্রদ। একশ ফুটেরও অধিক গভীর। যাকে স্টোন লেকও বলা যেতে পারে। একটি লোকের কাছে জানতে পারলাম, এসব হ্রদগুলি আসলে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। যার যেমন সম্পত্তির পরিধি সে সেই পরিমাণে পুকুর কেটে পাথর বিক্রি করছে। লাল মাটির তলায় কালো পাথর, তার উপরে সবুজ ঘাস ও গাছপালা সৌন্দর্যের শিখর ছুঁয়ে গেছে। আরও জানতে পারলাম, এখানে পাহাড় কাটতে দেওয়া হয় না। এখানে কয়েক ফুট মাটি কাটলেই কালো পাথর বেরিয়ে আসে। সেই পাথর কেটে কেটে বিক্রি করা হয়।



আমরা পাশের একটি পুকুরে ধারে গেলাম। পুকুর ভর্তি জল। সেখানে আদিবাসী ছোট ছোট ছেলেরা স্নান করছে। অনেক উঁচু পুকুরের পাড় থেকে ঝাঁপিয়ে জলে পড়ছে। সাঁতার কাটছে। কালো পাথরের বুকে জল এত কালো অথচ স্বচ্ছ যে কয়েক ফুট জলের তলায় থাকলেও তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এটি সেই কালো হীরের দেশ।

চেরা পাথর থেকে আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। ঢেউ খেলানো আঁকাবাঁকা চকচকে রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চলতে লাগলাম। মাঝেমাঝে ফসল বিহীন শূন্য মাঠ। খাঁখাঁ করছে। মাঝে মাঝে গ্রামের মুখমুখি হতেই আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এ রাজ্যে গ্রাম বলতে আমাদের রাজ্যের মত ঘন বসতি নেই। পাঁচ-দশখানা বাড়ি নিয়ে একটি গ্রাম। বাড়িগুলির অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় এদের আর্থিক অবস্থা ভাল নেই। এরা প্রান্তিক সীমার নীচে বাস করছে বলেই মনে হচ্ছে।

আমরা আরো তিরিশ কিলোমিটার মতো এগিয়ে গেলাম। সেলিম আমাদেরকে একটি সুন্দর জায়গা দেখাল। রাস্তা ঘেঁষা জায়গাটি। সন্দুর সবুজ ঘাসের মখমলে মোড়া। জায়গাটি আমাদেরকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করল। আমরা খুব প্রশংসাও করলাম। সেখানে দুটি ছোট ছোট পাহাড়। এই দুটিকে পাহাড় না বলে টিলা বলা-ই ভাল। সেখানে একটি বিড়াট পাথরের গায়ে হিন্দিতে লেখা আছে ‘নির্মল ঝাড়খণ্ড’। স্বচ্ছতার দিক দিয়ে আমাদের রাজ্যের থেকে এই রাজ্যটি অনেক এগিয়ে। রাস্তাঘাট খুব চিকন। আশেপাশের পরিবেশ সত্যি প্রশংসনীয়। আমাদের রাজ্যের অধিকাংশ পিচ রাস্তাগুলো বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। গাড়ি ঠিকঠাক চালনো যায় না। কখনো কখনো রাস্তাগুলি সংস্কার হলেও ছয় মাস যেতে না যেতে রাস্তার পিচ পাথর কিছুই আস্ত থাকে না। কন্ট্রাক্টর থেকে পাড়ার দাদাদের পেট ভর্তি করতেই রাস্তার রসদ ফুরিয়ে যায়।



ওখানে নেমে আমরা কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। তারপর আবার চলতে লাগলাম।

কিছু দূর গিয়ে রাস্তার পাশে একটি সুন্দর জায়গা দেখে সেলিম গাড়ি থামাল। একটি আম গাছের ছায়া। গাছটি বেশ পুরাতন। এখানে রাস্তার ধারে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার জুড়ে এমন বড় বড় অথচ পুরাতন, মোটা মোটা আম গাছ দেখতে পেলাম। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। মাদুর বের করে সেখানে বসলাম। পাশে দুটি বাড়ি। তার পিছনে সবুজ গাছের ঘন জঙ্গলে আবৃত সুবিস্তৃত একটি পাহাড়। লম্বা হয়ে বহুদূর চলে গেছে। রাস্তার অপর পাশে ঢালু হতে হতে আনেক গভীরে নেমে গেছে। তারপর দূরে আর একটি পাহাড়।

আমরা ভুট্টা, ছোলা ও বাদাম মেশানো ছাতু নিয়ে গিয়ে ছিলাম। ওখানে বসে দুগ্লাস করে খেলাম। তারপর আড্ডা শুরু করলাম। এমন সময় আমাদের সামনে একটি আদিবাসী লোক এলেন। বয়স আনুমানিক তিরিশ। খালি গা। পরনে অতি সাধারণ একটি চাদর। শরীরের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এদের যথেষ্ট খাবারের অভাব আছে। উনাকে জিজ্ঞেস করে আমরা অনেক কিছু জানলাম। প্রথমত এদের জলের অভাব। এখানে টিউবয়েল পুঁতা যায় না। কিছু দূরে পুকুর আছে। সেই পুকুরের জল খান। আশে পাশের পাহাড় থেকে জল চুঁয়ে এসে সেই পুকুর ভর্তি হয়। পুকুরগুলো অবশ্য গ্রামের কয়েকটি পরিবার মিলে খনন করে তৈরি করে। উনার জমি প্রায় সাত বিঘার উপর। বছরে একবার ফসল হয়। তবে খুব একটি ফলন নেই। এছাড়া আশেপাশে কাজ করার মতো কোন ব্যবস্থাও নেই। মাসের পর মাস কর্মহীনতায় জীবন কেটে যায়। ফলে পাহাড়ের ঘন সর্পিল জঙ্গলে জীবনকে বাজি রেখে এরা ময়ূরের বাচ্চা খুঁজে বেড়ায়। যদি পায় তো ধরে নিয়ে আসে। গোপনে বিক্রি করে দিনপাত করে। কিন্তু সেই খদ্দেরই বা কয়জন আছে। আইনের ভয়ে সকলে কিনবেও না। এই সুদূর থেকে ময়ূরের বাচ্চা নিয়ে যাওয়া অনেক ঝামেলা। পুলিশের ভয়। সবই কাজ করে।

সেলিম বলল, কত করে জোড়া নাও?

-বাবু, পনের শ টাকা।

- কটি আছে?

- পাঁচটি আছে।

লোকটি দুটি বাচ্চা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু আইন আর পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য কিনলাম না।

আমরা মাদুর গুটিয়ে সেখান থেকে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর ম্যাসাঞ্জরের লেকের উত্তর পাশে চলে এলাম। গাড়ি বন্ধ করে লেকের ধারে গেলাম। দেখলাম পাহাড়ের গা থেকে বিভিন্ন দিক দিয়ে সুরু সুরু স্রোতস্বিনী বেয়ে জল নেমে আসছে। নদীর উৎস খুঁজতে গেলে মনে হয় তার উৎস পাওয়া মুশকিল। হয়তো বা পাওয়াও যায় না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখলাম অতি হালকা জল গড়িয়ে লেকে নেমে যাচ্ছে। সেখানে কালো কালো রঙের পলি। পা দিয়ে হাঁচড়ে দেখলাম পলির উপরের স্তরেই কালো দাগ। তার মানে পাথরের গায়েও কষ থাকে। সেই কষ বৃষ্টির জলে নেমে আসে।

লেকের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালাম। লেকের মধ্যে তিনটি ছোট ছোট দ্বীপ। সেগুলি খুবই সুন্দর। সবুজ ঘাসে ঢেকে আছে। ছোট বড় কিছু গাছও দেখা যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করার পর আমরা ম্যাসাঞ্জর ড্যামের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।                   

Post a Comment

Previous Post Next Post