পাহাড় যখন ডাকে
(একটি ভ্রমণ কাহিনী)
আজিজুল হাকিম
পর্ব-দুই
শত মন্দিরের গ্রাম মলুটি
নলহাটি থেকে আমরা রামপুরহাট গেলাম। রামপুরহাট থেকে বেরিয়ে আমরা ডান দিকের ছোট রাস্তায় কেটে গেলাম। একটি গ্রাম পেরিয়ে মাঠের মধ্য দিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করল। দুদিকে চোখ জুড়ানো ঢেও খেলানো সবুজ সুবিস্তৃত মাঠ। রাস্তার দুপাশে দোদুল্যমান কাশফুলের সফেদ হাসি মনের মধ্যে এক বিড়াট প্রশান্তি এনে দিচ্ছিল।
আমরা ঝাড়খণ্ডের কুচিবোনা নামক একটি জায়গা
পেরিয়ে মাঠের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে দেখলাম কয়েকটি সাঁওতাল মহিলা রাস্তার ধারে
মহুয়ার মদ বিক্রি করছেন। এই প্রথম দেখলাম রাস্তার ধারে প্রকাশ্যে মদ বিক্রি হচ্ছে।
ওদের কাছে গিয়ে দেখলাম মদ বিক্রির জন্য বিভিন্ন রকম গেলাস, বাটি রয়েছে। এগুলোর সাহায্যে
এরা মদের মরিমাপ করে বিভিন্ন দামে বিক্রি করে। তাছাড়া বিভিন্ন মাপের বতুলও দেখলাম।
সেগুলিতে মদ ভর্তি করা আছে। তাদের দামও বিভিন্ন রকম। কেউ যদি সেখানেই খায় তাহলে তাদের
জন্য চাটেরও ব্যবস্থা করা আছে। আমরা ওদেরকে কিসের তৈরি মদ জিজ্ঞেস করতেই বলল, এগুলি
সবই মহুয়ার মদ।
কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়ানোর পর আবার আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। তারপর সেখান থেকে মলুটি নামক একটি গ্রামে পৌঁছালাম। সেখানে একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এখানে টেরাকোটা মন্দির কোথায় আছে। উনি একটি সুরু রাস্তা দেখিয়ে বললেন, এই রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যান তাহলেই আপনারা টেরাকোটা মন্দির দখতে পাবেন।
(টেরাকোটা মন্দিরের নিদর্শন)
আমরা সেই সুরু রাস্তা দিয়ে কিছুটা গিয়ে টেরাকোটা মন্দিরের সংলগ্নে পৌঁছালাম। অদ্ভূত সুন্দর মন্দিরগুলি। সেখানে রাস্তার দুপারে ছোটছোট অনেক মন্দির দেখতে পেলাম। আমরা গাড়ি থেকে নেমে সেগুলি পরিদর্শন করতে লাগলাম। অতি সুন্দর কারুকার্যে মন্দিরগুলি তৈরি। বিভিন্ন ছাঁচে কাদামাটিকে কেটে তার উপর নানা প্রকারের নক্সা তৈরি করে অগুনে পুড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। সেগুলি দেওয়ালের গায়ে সুন্দর করে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সব কারুকার্যে অজন্তা ইলোরা গুহার চিত্রের মতো নারীপুরুষ মিলনের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ চিত্রিত হয়েছে। রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে অনেক চিত্র চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও শিকারের, বীণা বাদকের, নারীদের সম্মিলিত কারুকাজ দেখার মতো। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনেও অনেক পুড়ামাটির কাজ এসব মন্দিরগুলোর দেয়ালে দেখা যাচ্ছে।
ঢেও খেলানো এই গ্রামটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন
এবং সুন্দর। এই গ্রামটিকে মন্দিরের গ্রামও বলা যেতে পারে। সেলিমের কথা থেকে যা পেলাম
সেটি হল, এই গ্রামটি ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার শিকারি থানার অন্তর্গত। এই গ্রামের নাম
‘মলুটি’ হওয়ার কারণ; এখানে নাকি একসময় প্রচুর মহুয়ার গাছ ছিল। তবে এখন আর নেই। এই গ্রামের
অধিকাংশ লোকই বাঙালি। এরা রুজিরোজগারের সন্ধানে বিভিন্ন রাজ্যে চলে যায়। কেবল মাত্র
পূজোর মৌসুমে এরা বাড়ি ফিরে আসে। গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি লাল মাটির। কোনটি এক তলা কোনটি
আবার দোতলা। প্রত্যেকটা বাড়ি গড়ন খুব সুন্দর। এই গ্রামের দুপাশে দুটি ছিমছাম ছোট নদী
প্রবাহিত হয়েছে। এই নদীর ধারে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অস্ত্র পাওয়া গেছে বলেও কথিত আছে।
আরও কথিত আছে, এখানে মৌলীক্ষা নামে অনেক কাল আগের পুরনো মন্দির আছে। কালীপূজো উপলক্ষে সেই কাল থেকেই এই মন্দিরে নাকি একশটি করে ছাগল বলি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। শীতকালে পূজো উপলক্ষে এখানে বিশাল মেলা বসে। সেই সময় এই গ্রামটি লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে।
এখানে এতগুলো মন্দির পত্তনের গল্পও খুব মজাদার। গৌড়ের নবাব মোহম্মদ আলাউদ্দিন শাহ্ এক সময় উড়িষ্যা থেকে রাজধানী ফিরছিলেন। পথের মাঝে এখানে এসে তাঁবু খাটিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সঙ্গে উনার স্ত্রীও ছিলেন। তার সঙ্গে একটি বাজপাখি ছিল। সেই সময় উনার স্ত্রীর খাঁচা থেকে বাজপাখি উড়ে পালিয়ে যায়। তাকে আর কোনভাবেই ধরা যায় না। এদিকে বেগমের মুখ খুব ভারি। অবশেষে বেগমের দুঃখ নিবারণের জন্য নবাব ঘোষণা করলেন যে ওই বাজপাখিটি যে ধরে আনতে পারবে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। বসন্ত নামে এক দরিদ্র ব্রাম্ভ্রণের ছেলে ফাঁদ পেতে পাখিটিকে ধরে সিপাহী মারফৎ নবাবের কাছে পৌঁছে দেয়। তখন নবাব তাকে ডেকে বলেন সূর্য উদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পায়ে হেটে সে যতটা এলাকা ঘুরতে পারবে ততটা সম্পত্তির সে মালিকানা পাবে। কেবল তাই নয় সেই সম্পত্তির কোন কর বা শুল্ক দিতে হবেনা।
তখন থেকে সেই ছেলের নাম হয় বাজ বসন্ত। তিনিই
প্রথম এখানে টেরাকোটা মন্দির স্থাপন করেছিলেন বলে কথিত আছে।