Simanter Deyal-Azizul Hakim/সীমান্তের দেয়াল-আজিজুল হাকিম

 

সীমান্তের দেয়াল 

পদ্মার পাড়ে পড়ে থাকা চাঁইয়ের ওপর বসে থাকি আমি । বড় ভাল লাগে । বর্ষায় পদ্মার বুকে জল ভীষণ দুরন্ত গতিতে প্রবাহিত হয় । দিগন্ত বিস্তৃত ঘোলা জল বহু দূর গিয়ে আকাশের ঘোলাটে মেঘের সঙ্গে মিশে যায় । সাদা সাদা সারসের দল পদ্মার বুকে উড়ে, না আকাশের বুকে উড়ে বুঝতে পারিনা । কানে বাজে সর্বগ্রাসী গর্জন । ভয় লাগে, ভাল লাগে । পদ্মার বুকের ঠান্ডা বাতাস আমার সারা দেহ স্পর্শ করে প্রবাহিত হয়ে যায় । মন দারুণ চাঙ্গা থাকে । আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যায় পদ্মার ওপার --- দূরে, আরো অনেক অনেক দূরে । বুকের মাঝে অদৃষ্ট সীমান্তের দেয়াল । বাংলাদেশের গাছপালা, আকাশ, মাটি আমার নাগালের বাইরে । হৃদয়ের মাঝে আর্তি জাগলেও পারব না তার বাতাস-ঘ্রাণ-আলো উপভোগ করতে । কেউ তা মেনে নেবে না । বাবা-মাও মেনে নিতে পারবে না রোজীর উষ্ণ ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকালে ।

গ্রীষ্মের সময় পদ্মা বেশ ভাল লাগে । তখন বুকে স্বচ্ছ আয়নার মতো অতি হালকা সবুজ জল ধীর গতিতে প্রবাহিত হয় । এপাড়ে পদ্মার পাড় ভেঙ্গে গভীর খাঁড়ি সৃষ্টি করেছে আর ওপারে পদ্মার চর ধূ……ধূ …… প্রান্তর । চরের বুকে মাঝে মাঝে মরুদ্যানের মতো কাশবন । বাতাসের তালে তালে তারাও দোলে । পদ্মার জলের মতই তাদের মাথায় খুব সুন্দর ঢেউ খেলে । মাথার অবাধ্য চুলগুলো তাদের সাথে চলে যেতে চায় ---- দূরে আরো অনেক অনেক দূরে । সাত সমুদ্র তের নদী পারে । হয়তো আকাশ-পৃথিবীর মিলন প্রান্তরে । তারপর ? তারপর আর জানি না কত দূরে । আমার দৃষ্টিও তার সাথে যেতে চায় । যেতে যেতে কোথায় হারিয়ে যায় ! কেবল কুয়াশা দেখে । এক সময় চোখ ফিরে আসে । কেবল ব্যর্থতা অনুভব করে । কোন দিন হয়তো সেখানে যেতে পারব না; যেখানে আমার ডার্লিং, স্বপ্না দাঁড়িয়ে আছে । তার পিছন থেকে ঝড় আসছে । ওর অবাধ্য চুলগুলো বারাবার ওর মুখের উপর ঝাপটা মারছে । ঢেকে যাচ্ছে ওর মুখ । ওকে দেখতে মিন্যাডস-এর মতো লাগছে । আলথালু চুল । অবাধ্য চুলে বুকটা ঢেকে যাচ্ছে আর উদোম হয়ে যাচ্ছে । অলৌকিক কোন মেয়ের মতো দেখাচ্ছে । সেই আকাশ পৃথিবীর মিলন-প্রান্তের দিকে আমি ছুটছি । আমাকে দেখে তার আকাশি রঙের শাড়িটি খুলে ফেলল ।উড়িয়ে দিল হাওয়ায় । শাড়িটি আকাশের দিগন্তে উড়ে চলে যাচ্ছে । ওর চারিদেকে বালি ঘোলা করে উড়ছে । ঐ বালি ঝড়ের মধ্যেই ও হাসছে । সেই হাসির কোন শব্দ নেই । শব্দ থাকলেও ঝড়ের গর্জনে চাপা পড়ে গেছে; কিন্তু চরম উচ্ছ্বাস আছে । শাড়িটি উড়তে উড়তে আমার দৃষ্টির সীমানার বাইরে চলে গেল । কিন্তু যখন দেখতে পেলাম; তখন আমার খুবই কাছে । উড়তে উড়তে আমার সারা শরীর জড়িয়ে গেল । আমার পা দুটো স্লথ হয়ে গেল । চোখে কেবল অন্ধকার দেখলাম ।

আমি আনমনে চরের বুকে দাঁড়িয়ে পড়ি । এক পা এক পা করে লক্ষ্যবিহীনভাবে এগিয়ে চলি । চরের বালির বুকে পা-র ছাপ পড়ছে । জানি, সেটি বেশীক্ষণ থাকবে না । অনেক দিন আগে ভৈরব নদীর বালুচরে সুন্দর করে আমার নাম লিখে ছিলাম । পরের দিন সকালে গিয়ে তার কোন চিহ্ন পাইনি । রোজী, খালেদা, সুস্মিতা, সুজাতা, এমনকি স্বপ্না—কারো বুকে আমার ছবি একে রাখতে পারিনি । এদের বুকটাও কি তাহলে চরের মতো !

একদিন আমি পদ্মার চরের গ্রামে বেড়াতে গেছিলাম  । তখন আমার বয়স পাচ-ছয় বছর । সময়টি ছিল ফাল্গুন মাস । শীতের রেশ কাটেনি । সূর্য্যটা কেবল মাত্র তার সোনালি হাসি প্রস্ফুটিত করতে পেরেছে । আমি দাঁড়িয়ে আছি পদ্মার তীরে । দুধের মতো সাদা সাদা বকেরা সারি বেঁধে ইংরাজি V-এর মতো হয়ে শিশিরভেজা ডানা মেলে সূর্য্যস্নানে ব্যস্ত । V-এর নিচের দিকটি সামনের দিক । সামনের শীর্ষস্থানে আছে একটি বক । তারপর দুই দিকে হতে আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়িয়ে পিছনের দিকে চলে যাচ্ছে । যেন একটি ডাঁটিবিহীন তীরের ফলা উড়ে চলছে তো উড়েই চলছে । পশ্চিম থেকে পূর্ব দিগন্তে যেতে যেতে অরুণাভায় মিশে যায় । তারপর আর দেখতে পাইনা । তখন মনে হয় ভারত সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ চলে গেছে । হয়তো বা আকাশ-পৃথিবীর মিলন প্রান্তে ওরা চলে যায় । ওরা যেতে পারে । আমি কেন পারিনা ? কেন রোজিকে নিয়ে গ্রীষ্মের চাঁদনী ছড়া মাঠে কোন এক উচ্ছ্বাসময় আনন্দে মেতে উঠতে পারি না ? কবে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারব বৈসাম্যের দেয়াল ? এগুলি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে আসছি । সভ্যতার শেষ সীমান্তেও একে বহন করে চলব ! লালন করব !

তার কয়েক মাস পরে একদিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম । পদ্মার বুকে একটি নৌকা ভাসছে । নৌকার সামনে বসে আছি আমি একাই । জোয়ান মাঝি আনন্দে গান গেয়ে যাচ্ছে --- “সখীরে… আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি” । দুকুল প্লাবিত করে, সীমান্তের সীমানা পেরিয়ে গান ভেসে চলেছে । তাহলে কেন আমার বেলায় সীমান্তের কাঁটার বেড়া তৈরি হতে পারে ?

রাত দশটার সময় মামা আমার ঘরে ঢুকলেন । চকিতে শুয়ে আমি প্রাইভেট-এর নোট লিখছিলাম । মামাকে ঢুকতে দেখে আমার কলম থমকে গেল । খাতা, কলম বিছানার একপাশে সরিয়ে রাখলাম । তারপর চুপচাপ চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলাম । চোখ দুটি কোঠার উপর আঁটকে থাকল ।

মামা টুলে বসলেন । কোন ভনিতা না করেই বললেন----- রোজী কেন এসেছিল ?

আমি বললাম--- একটি উপন্যাস ওকে পড়তে দিয়েছিলাম; সেটি ফেরত দিতে এসেছিল ।

---- কত বড়ো শিক্ষিত যে সে উপন্যাস পড়ে ?

---- উপন্যাস পড়তে শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না ।

---- সেই সকালে এসে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার নাম উপন্যাস ফেরত দিতে আসা ?

আমার কোন উত্তর দিলাম না । চুপচাপ শুয়ে থাকলাম । ও বিকেলে এসেছিল । তখন তিনটে বাজে । ওর শরীরে জ্বর ছিল । আমার বিছানায় শুয়ে পড়লে ও ঘুমিয়ে যায় । ও প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে থাকে । তারপর ঘুম ভাঙলে ও বাড়ি যেতে চেয়েছিল । ওকে আমি বসতে বলি । কারণ তখন আমি প্রাইভেট পড়াচ্ছিলাম । ও বসে থাকল, শান্ত-অচঞ্চল্ভাবে । ছাত্রদের পড়া শেষ হলে যখন সকলে বাড়ি ফিরে গেল । আমি টুলে বসলাম । এই টুলটাই আমার বসে পড়া ও লেখার একমাত্র সম্বল । ও বলল--- কাল থেকে আব্বার ভীষণ মন খারাপ ।

বললাম---- কেন ?

---- কাল লালবাগ গেছিলাম । ডাক্তার বলল যে আমার হার্টের অসুখ আছে । মোটামুটি বছরখানের মধ্যে অসুখ না সারলে হার্টে ক্যানসার হবে । এত তাড়াতাড়ি মরে যাব, ভাবতেই পারিনি । দশ-পনের টাকার আমার ভীষণ দরকার । কিন্তু কোথায় পাব ?

ও শেষের কথাগুলি একটু টেনে টেনে বলছিল---- জীবনের কতটুকুই বা স্বাদ পেলাম ! খুব জোর পনের-ষোল বছর বয়স হল । শুধুই তো দুঃখ যন্ত্রণা !

সেই তো, বয়স কতই বা হবে ! খুব বেশি হলে ষোল । এর মধ্যেই হার্টের অসুখ ! আমি চমকে গেলাম । তবুও বললাম---- আমার সঙ্গে এভাবে অভিনয় করতে পারলে !

মামা টুলে বসে আছেন । কিছুক্ষণ পর বললেন—তুমি জাননা, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি । যেখানেই যাই কেবল তোমার নাম করি । আর আজ একটি নোংরা- দুশ্চরিত্র মেয়ের জন্যে বাড়িতে অশান্তি বাধছে । তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমাকে বলতে আসি । হয়তো তোমাকে কিছু দিতে পারি না; কিন্তু সবার চেয়ে তোমাকে বেশি ভালোবাসি ।

--- আমি তো অস্বীকার করছি না । আমি বললাম ।

--- তাহলে কেন আমাদের কথা অমান্য করে ওর সঙ্গে গল্প করছ ? কেন তাকে এখানে ডাকছ ? একজন বেশ্যা মেয়ের সঙ্গে এমন কি কথা থাকতে পারে ? জান, সমাজে ওর কত দুর্নাম আছে ?

মামার মুখে ‘বেশ্যা’ কথাটি শুনে আমার মুখটা ফাঁক হয়ে গেল । কপালে ভাঁজ পড়ল । এর কি জবাব দেব ? রোজি নোংরা বা বেশ্যা যাই হোক না কেন আমার সঙ্গে তো এমন ব্যাবহার করছে না । তাছাড়া ওর উপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে--- ও আমার কোন ক্ষতি করবে না । আমি ওকে পথ দেখানোর চেষ্টা করি । যে পথ কুৎসিত অন্ধকারের নয় --- উজ্জ্বল সোনালি আলোর । আমি ওকে অন্ধকার পথ থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে চাই--- যা এই সমাজের কেউ কোনদিন পারেনি ।

মামা বললেন--- ও খারাপ না হলে বলতে পারে, পলাশ আমাকে ভাল করতে চায় ? ও জানে না, কাউকে ভাল করতে কারো প্রয়োজন হয় না । নিজে থেকে সে যতক্ষণ না ভাল হবে ।

বললাম--- হ্যাঁ, রোজিও স্বীকার করে সে একদিন খারাপ ছিল । কিন্তু এখন সে আর ও পথে নেই । থাকতেও চায় না ।

কথাটি বলে আমি চুপ করে গেলাম । ভাবলাম, যদি কাউকে খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে কারো প্রয়োজন না হত তাহলে শিক্ষার প্রয়োজন হত না । বিশ্বে নবী, পয়গম্বরদের আবির্ভাব ঘটতো না । মহা মনিষীদের প্রয়োজন হতো না । ধর্মসভা, মিটিং-এ সবের প্রয়োজন হতো না । অবশেষে বললাম---- আপনার কথা ঠিক বলে মনে হচ্ছে না । কাউকে ভাল করতে কারো প্রভাবের প্রয়োজন আছে । তা না হলে আপনি কেন আমার কাছে আসবেন ?

---- সেটা তো সমাজ বলছে না । তুমি ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখছ, সমাজ সেটি বলছে ।

---- সমাজের ধর্ম সমালোচনা করা । এরা প্রথমে কোন কিছুই মেনে নিতে পারে না । সকলকে হতাশ করতে পারে, ধ্বংস করতে পারে । তাই সমাজ আমাকে কি দিল সেটি বড়ো কথা নয়, আমি সমাজকে কি দিলাম সেটিই বড় কথা ।

মামা বিড়ি ধরালেন । তারপর একটি টান দিয়ে উপরে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন --- খুব সামাজিক হয়ে গেছ তাই না ? সমাজ তোমাকে কিচ্ছু মনে করে না ।

আমি জানি, সমাজ আমাকে কিছুই মনে করে না । কারো অসুবিধায় পঞ্চায়েত, ব্লক, থানায় দরখাস্ত লেখা ছাড়া সমাজের কোন কাজে আমাকে প্রয়োজন হয় না । সমাজ যাকে ভাল বলে আমার মধ্যে সব গুণগুলি ছিল । আমি কারো সাথে-পাঁচে ছিলাম না । প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল সৎ ব্যবহার । এটিই একমাত্র ভাল হওয়ার সহজ পথ । তবুও সমাজে আমি নগণ্য । কোন কাজে আমার প্রয়োজন হয় না । হয়ত মামাদের মতো লোকগুলোকে সমাজ চায় ।

মামা বিড়ির ধোঁয়া উপরে ছুড়ে দিলেন । ধোঁয়া বৃত্তের মতো উপরে ঘুরপাক খাচ্ছে । বললেন---- ওর হায়া লজ্জা বলে কিছুই নেই । ও যদি বাড়াবাড়ি করে, তাহলে প্রকাশ্য রাস্তায় ওর মুখে অ্যাসিড ঢেলে মুখ ফ্যাকচার করে দিব । তার আগে থানায় গিয়ে আমার নামে একশটা ডাইরি করে আসতে পারো । এ বিষয়ে থানায় দু-ঘণ্টা ধরে আলোচনা করেছি । তারাও জানে রোজী একটি সামাজিক ব্যাধি । সমাজের ইয়াং ছেলেদেরকে পথ ভ্রষ্ট করার ওস্তাদ ।

কথাটা শুনে আমি ভীষণ শান্ত হয়ে গেলাম । আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরিয়ে এল না । দারুণ ভয় পেলাম । উনি ইচ্ছে করলে পারেন । উনি যেমন একজনের হাতে গোলাপ তুলে দিতে পারেন; তেমনি হাসতে হাসতে অন্যের বুকে ছোরাও বসাতে পারেন ।

উনি টুল ছেড়ে উঠলেন । বললেন---- আর কোনদিন যেন ওর সঙ্গে কথা বলতে না দেখি ।

মামা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন । বিড়ির গন্ধ এখনো সারা ঘরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । বিচ্ছিরি লাগছে গন্ধটা ।

আমি চুপচাপ শুয়ে থাকলাম । মনের মাঝে অস্বস্তির ঘূর্ণ ঝড় । বুকের মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা । শেষ পর্যন্ত মেয়েটির জীবন আমার কারণে চলে যাবে ? ওর যদি কিছু হয় তাহলে ! ওর অ্যাসিড-পোড়া মুখ আমার সামনে ভাসছে ।

সারারাত ঘুম এল না । চাঁদের বুকে মেঘ জমছে । আমার স্মৃতির আকাশে অতীতের হারিয়ে ফেলা দিনগুলি চলে যাওয়া ধূমকেতুর মতই ফিরে আসতে থাকে বারবার ।

Post a Comment

Previous Post Next Post