ভাতারমারীর মাঠ-আজিজুল হাকিম

 
(ছোট গল্প)

ভাতারমারীর মাঠ

আজিজুল হাকিম

 

আজ আর অত বড় মাঠটি নেই । ওই মাঠটির মধ্যে কয়েকটি গ্রামও বসেছে । তাছাড়া মাঠটি এখনো যা বড় আছে তা বিজ্ঞানের যুগে অনেক ছোট হয়ে গেছে । সমস্ত মাঠটি অতিক্রম করতে আর বেগ পেতে হয় না । সেই মাঠের ভিতর দিয়ে হেঁটে গেলেও তৃষ্ণায় আর ছটপট করে মারা যেতে হয় না; ডিজেল ইঞ্জিনের সাহায্যে জল উঠে । সেই জল কোথাও না কোথাও পাওয়া যায় ।

আমি যে কালের কথা বলছি, তা আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগের কথা । তখন এই মাঠে চাষ আবাদ হতো বর্ষা-বাদল, রোদ–বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে । মাটির নীচ থেকে জল তুলে সেচের কোন ব্যবস্থা ছিল না ।

আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে গ্রীষ্মকালে পরী তার ছোট মা’র সঙ্গে কলাডাঙ্গা যাচ্ছিল । তার ছোট মা’র বাবার বাড়ি নাকি সেই গাঁয়ে । তারা সেই সকালে বেরিয়েছে; তারপর সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে তবুও সেই মাঠের আধেক পথ পেরিয়ে আসেনি । কোন দিকে কোন গ্রামের চিহ্ন মাত্র নেই – পুরো দৃষ্টির অগোচরে । শূন্য মাঠখানি কেবল ধূ…ধূ… করছে । দূরে তাকালে মনে হচ্ছে, সারা মাঠটায় দাও দাও করে আগুন জ্বলছে । সেই আগুনের শিখা উপরে উঠে শূন্যে হারিয়ে যাচ্ছে । মাঠের সমস্ত মাটি যেন ফেটে বাষ্প-নালী হয়ে গেছে ।

এদিকে সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে পরীর গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে । এভাবে ওরা যতই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পরীর পিপাসা আস্তে আস্তে বেড়েই চলেছে । দুপুরের প্রখর রোদে তার সুন্দর মুখখানা ঝলসে যাচ্ছে । অসহ্য গরমে কোমল মুখমণ্ডলটি গেমে লাল হয়ে গেছে । মনে হচ্ছে গালে একটু টোকা মারলেই গলগল করে রক্ত বেরিয়ে পড়বে । পা দুটিও আর চলতে চায়ছে না । রাস্তার আশেপাশে তেমন কোন গাছও নেই যে সেখানে বসে দু-দণ্ড প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলবে । রাস্তার পাশে মাঝে মধ্যে কিছু ঝোপঝাড় দেখা গেলেও সেখানে বসার মত কোন ছায়া নেই । সারা মাঠখানি খাঁ খাঁ করছে ।

অবশেষে পরী বলল—আমি আর চলতে পারছি না, ছোট মা । খুউব তিষ্যা পায়্যাছে । একটু পানি না হলে আর পারছি না মা ।

ছোট মা দূরে একটি বড় গাছ দেখিয়ে বলল – ওই গাছ তালায় চল, মা – পানি পাওয়া যাবে । তাছাড়া এই মাঠে কুথাও পানি পাওয়া যায় না ।

গাছটাও প্রায় এক মাইল দূরে । এত বড়ো মাঠ পরী এর আগে কখনো দেখেনি । আর দেখবেই বা কোথায় – তার বয়স মাত্র এগারো বারো বছর বয়স । এর আগে এমন দূরেপারে কোথাও যায়নি । এর মধ্যে মাত্র ছয় বছর বয়সেই পাড়ার এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেছে । ছেলেটির নাম সোলেমান । তখন তার বয়স নাকি দশ বছর ছিল । বহু দূরের কোন এক স্কুলে এখন সে সাত ক্লাসে পড়ছে । পরী তো লেখাপড়া কিছুই শিখেনি । গাঁয়ে কোন স্কুলও নেই ।

পরী তার গায়ের উর্ণাটি দিয়ে মাথা ও মুখ ভাল করে ঢেকে নিল । তারপর বলল, আমি আর পারছি না, মা । গাছের পাতা চিবিয়্যা রস খালে হয় না ?

-      না, না । অ সব খালে পাগলী হইয়্যা যাবি, মা । আর ইটু চল, মা; তাহিলে কত পানি

খাবি খাস ।

-      আমার যে গলা শুক্ক্যা যাচ্ছে, মা !

-      ওই তো চল্যা আস্যাছি, মা । আর ইটু কষ্ট কর ।

খুব কষ্টে, কোন প্রকারে একটু একটু করে পা তুলে পরী তার ছোট মা’র সাথে তাদের

কাঙ্খিত বিরাট বকুল গাছতলায় এসে পৌঁছাল ।

       গাছটির নীচে একটি বেশ বড় কুয়ো রয়েছে । কুয়োর ওপরে একটি মোটা রশি এবং কুয়োর পাশে মাটির ওপর একটি বালতি আছে, যেটি ওই রশিতে বাঁধা । গাছের তলায় একটি লাঠি পুঁতা আছে যেটিতে দুটি বলদ বাঁধা আছে । গাছের গোড়ায় মাথা রেখে একটি বৃদ্ধ লোক শুয়ে আছে । তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে ।

       পরী ও তার ছোট মায়ের কথাবার্তার শব্দে বৃদ্ধের তন্দ্রা কেটে গেল । সে উঠে বসলেন । বললেন – তোমরা পানি খাবা ।

       পরী বলল – হ্যা, খুব তিষ্যা পাইয়াছে ।

       তিনি পরীর ছোট মাকে উদ্দ্যেশ করে বললেন – বেচারির খুব তিষ্যা পাইয়াছে । টপাক কর‍্যা ইন্দারা থাক্যা পানি তুল্যা খাওয়াও ।

       পরীর ছোট মা কুয়ো থেকে এক বালতি জল তুলে দিলে পরী ঢকঢক করে জল খেতে লাগল । বুড়োটি বললেন – আস্তে আস্তে খাও । একবারে খাইওনা । না হলে গলায় বাধ্যা যাবে ।

       পরী বালতি থেকে মুখ তুলে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল – আল্লাহ ! আর ইটু হলে মর‍্যা যাতুক । 

লোকটি যেন না দেখতে পায়, তাই তার দিকে পিছুন ফিরে ছোট মাও জল খেল । তারো অনেক পিপাসা পেয়েছিল কিন্তু বলতে পারে নি; যেন পরী নিরাশ না হয় ।

তারপর তারা গাছের তলায় বসে ক্লান্তি সারতে লাগল । এমন সময় পরী বল – ছোট মা, এখানে তো পাড়া গাঁ কিছুই নাই; তাহলে এখানে কুহ্যা কেনে বসাল ।

পরীর ছোট মা কোন উত্তর করল না । লোকটি বললেন – শুনব্যা ।

পরী বলল – হ্যাঁ শুনব ।

- তাহলে তো তোমাদেরকে একটু বসতে হবে ।

- এত রোদে এখন আর যাব না । ইটু আরাম করি, তারপর যাব ।

বৃদ্ধ লোকটি যা বলে চললেন তার বর্ণনা এরূপ –

 

        তখন থেকেও প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের কথা – এই বৃদ্ধ লোকটির গ্রামে মালেক নামে একজন অতি গরীব লোক বাস করত । তার ছোট অবস্থায় তাকে রেখে বাবা মা মারা যান । তার ভাই বোন বলতে আর কেউ ছিল না । ছোট বেলা থেকেই সে এক মোড়লের বাড়িতে কাজ- কর্ম করে বড় হয় । তারপর মোড়ল আর দেশের লোকজন মিলে তার বিয়ে দেয় আদিনা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে । ছোট বেলা থেকে মোড়লের বাড়িতে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করার জন্য মোড়ল তাকে মাঠে বিঘা দুয়েক জমি আর দশ কাঠা জমির উপরে তাকে একটি বাড়ি তৈরি করে দেয় ।

মালেক একদিন ভোর রাতে লাঙল ঘাড়ে করে বলদ দুটিকে সঙ্গে নিয়ে চাষ করতে এই মাঠে এসেছিল । তখনও ফজরের আযান দেয়নি । রাত্রে কেবল দুটি রুটি খেয়ে ঘুমিয়েছিল । হাঁড়িতে ভাত চাল ছিল না । একটু আটাও ছিল না যে ভোর রাতে ওর জন্যে দুটি রুটি তৈরি করে দেবে । খালি পেটেই তাকে মাঠে যেতে হল ।

এদিকে আদিনা ধান ভানতে বেরিয়ে পড়ল । কিন্তু বাড়ির আসে পাশের কোন বাড়িতে খালি ঢেঁকি পাওয়া গেল না । এ বাড়ি, সে বাড়ি করতে করতে অবশেষে পাড়ার শেষ প্রান্তে গিয়ে একটি ফাঁকা ঢেঁকি পাওয়া গেল । ততক্ষণে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে ।

সেই জন্যে আদিনার ধান ভানতেও অনেক দেরি হয়ে গেল । সকালের সূর্যটা বেশ উপরেই উঠে গেছে । পূব দুয়ারী বারান্দায় কম আধেক ছায়া পড়ে গেছে । অন্যদিন এতক্ষনে খাবার হয়ে যায় ।

আদিনার মনটা খুব ছটপট করতে লাগল । খুব তাড়াতাড়ি রান্না করেও দেরি হয়ে গেল । রান্না করতে করতে বারবার বারান্দার ছায়া দেখছে । যখন রান্না শেষ হল তখন তখন চালের ছায়াটি বারান্দার শেষ প্রান্তে এসে ঠেকেছে ।

রান্না হতেই নিজে না খেয়ে আদিনা মালেকের জন্যে খাবার ও মাটির কলসিতে জল নিয়ে মাঠের দিকে বেড়িয়ে পড়ল ।

 

জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রায় শেষ । তখন প্রচণ্ড রোদ পড়ছে । সূর্য তার লকলকে আগুনের জিভ দিয়ে চেটে নিচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত রস । মালেক আর লাঙল ধরে হাঁটতে পারছে না । তৃষ্ণা আর খিদেয় ছটপট করছে আর আদিনা আসছে কিনা তাই বারবার বাড়ির পথের দিকে তাকাচ্ছে । এদিকে লাঙল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলেও চলবে না । এত দূরের মাঠে প্রতিদিন আসা যায় না । সমস্ত জমিটা চাষ করতেই হবে । প্রচণ্ড গরম পড়ছে । কখন যে উপর ওয়ালা পানি দেবে তার ঠিক নেই । আর পানি হলেই ধান লাগানোর জোর চলবে । পাট কাটার কাজ শুরু হবে । তখন লোকের জমিতে কাজ না করলে দু-পয়সা ঘরে আসবে না ।

আদিনা তখনও খাবার নিয়ে আসছে না – মাঝে মাঝে ওর ওপর রাগও হচ্ছে । রাগটা আবার সামলে নিচ্ছে – বেচারা মাগীর বা দোষ কি; ধান ভানতে গেলে তো দেরি হবেই ।

আস্তে আস্তে মালেক জমি চষেই চলেছে । কোন রকম কথা বেরোচ্ছে না; কেবল হাতের ইশারায় গরু দুটিকে কোন রকমে হাঁটাচ্ছে । প্রাণটা একেবারে যায় যায় অবস্থা ।

অবশেষে সে আর এক পাও হাঁটতে পারছে না । সে দাঁড়িয়ে গেল । আশেপাশে কোথাও একটিও পুকুর নেই । বাড়ির দিকে আবার তাকাল । একটি মেয়ে দ্রুত পায়ে এদিকে আসছে । ভুঁই তো আর কাছে নয় যে তাড়াতাড়ি চলে আসবে ।

গরু দুটিকে দাঁড় করিয়ে মালেক বসে পড়ল । চোখ দুটি পড়ে থাকল আদিনার আসার দিকে ।

আদিনা যখন অনতিদূরে খাবার নিয়ে প্রায় দৌড়ে আসছে তখন মালেক লাঠির ইশারা করে আরো তাড়াতাড়ি আসতে বলল । আদিনা যতই কাছে এগিয়ে আসছে মালেক ততই লাঠির ইশারা করছে ।

বারবার লাঠির ইশারা দেখে আদিনা থমকে দাঁড়াল । ভাবল, এখানে তো কেহ নাই । যদি আমাকে মারে তাহলে আমাকে কে বাঁচাবে ? আর লাঠি দিয়্যা গরুপিটা করলে তো মর‍্যা যাব ।

মালেক বিরক্ত হয়ে আবার লাঠির ইশারা করল । অমনি আদিনা ঝঙ্কার দিয়ে বলল – যার লাগ্যা এতো মরি সেই আমার পরানের বৈরি ! এই বলেই কলশিটি আর খাবার ফেলে দিয়ে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল । কলসিটি মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে গেলে সমস্ত জল তৃষ্ণার্ত মাটি মুহূর্তের মধ্যে গিলে ফেলল ।

আদিনার পালিয়ে যাওয়ার কারণ মালেক কিছুই বুঝতে পারলনা । বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত তাদের দাম্পত্য জীবনের ছায়াছবি তার হৃদয় পর্দায় এলোমেলোভাবে আসা যাওয়া করতে লাগল । আর তাকিয়ে রইল আদিনার বাড়ি ফেরার পথের দিকে । ধীরে ধীরে আদিনা মালেকের দৃষ্টির বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল ।

মালেক স্থিরভাবে বসে রইল । আস্তে আস্তে সূর্যটা মাথার উপরে উঠে গেল । না, কেউ না; এমন কি আদিনাও ফিরে এলো না । দুপুর গড়াতে শুরু করল । মালেক কোন রকমে উঠে দাঁড়াল । শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে লাঙ্গলটি জোয়ালের উপর রেখে গরু দুটিকে ছেড়ে দিল । তারপর মুখের উপর মাথল রেখে সেই তপ্ত রোদের মধ্যেই শুয়ে পড়ল ।  

 

এদিকে আদিনা গ্রামে গিয়ে পৌঁছালে একটি বয়স্ক মেয়ে তাকে বলল, “অ্যাত ক্ষুনে খাবার দিয়্যা আলি ?”

মেয়েটি আদিনার দূরসম্পর্কীয় শাশুড়ি । আদিনা বলল, “খাবার দিতে তো গেলছুনু” ।

-      তাহলে !

-      আমাকে দূরে থাক্যা লাঠি চুখাচ্ছে । ভয়ে পাল্যা আনু ।

-      পাল্যা আলি ! ছোড়াডা না খাতে পায়্যা মর‍্যা যাবে জি…রি… ।

আদিনার এতক্ষণে বোধশক্তি ফিরে এল – সত্যি যদি উ মর‍্যা যায় তাহলে ! ওর দাদুর

মুখে শুনেছিল, লাঙলের মুঠ্যা ধরলেই নাকি খুব তিষ্যা পায় । কিন্তু আদিনার আর মাঠে ফিরে যাওয়ার সাহস হল না । নিজেও না খেয়ে মালেকের ফিরার প্রতীক্ষায় বসে রইল ।

 

        আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল । সূর্যটা গড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে আরো পশ্চিমে । লোকটা এখনো আসছে না ক্যানে ! বাড়ির চালের ওপরে একটা কাক চিৎকার করতে করতে ঘুরপাক খেয়ে গেল । লোকটার কি হল ! এসব নানান চিন্তার মধ্যেই দেখতে পেল, বলদ দুটি লাঙল টানতে টানতে বাড়ি ফিরছে; কিন্তু লোকটা কই ! উ আসছে না ক্যানে ? গরু দুটির চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়াচ্ছে ।

 

সে ছুটে গিয়ে গরুর জোয়াল থেকে লাঙলটি নামিয়ে গরু দুটিকে চারা পানি খেতে

দিল । আস্তে আস্তে সূর্যও হারিয়ে গেল । পাড়ার মসজিদে মাগরিবের আযান পড়ল । পাখিরা  কিচিরমিচির করতে করতে চারিদিক থেকে বাসায় ফিরে এল । তাহলে লোকটার কি হল !

আদিনার বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল । তারপরই অজানা আশঙ্কায় নিরবে চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল । লোকটা আসছে না ক্যানে !

 

আস্তে আস্তে আঁধার নেমে এল চারিপাশে । আদিনা বিষণ্ণ মনে বাড়ির গলিতে মালেকের

পথ চেয়ে বসে আছে । এমন সময় জমিদারের ছোট ছেলে কিরণ ঘোড়া ছুটিয়ে আদিনার সামনে এসে দাঁড়াল । হঠাত কিরণকে দেখে আদিনা অবাক হয়ে গেল । কিরণ বলল, “মালেক কোথায় ?” ঘোড়াটি স্থির হয়ে থাকতে চায়ছে না – চঞ্চলতায় তার ধর্ম ।

 

আদিনা তার মাথার ঘোমটা কপাল পর্যন্ত টেনে ভোর রাত্রে মালেকের লাঙল নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে মাঠ থেকে তার পালিয়ে আসা পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করে গেল ।

       কিছুক্ষণের মধ্যেই জমিদারের সিপাহী এসে উপস্থিত হল । একটি ঘোড়ার পিঠে মালেকের মৃত দেহ ।

       মালেকের মৃত দেহ দেখে আদিনা আকাশ ফাটা চিৎকার করে উঠল – আমার কি হল গো…… !  তারপর ছুটে গিয়ে স্বামীর পা দুটি জড়িয়ে ধরে বলল – তোমরা আমার জানকে কেনে মার‍্যা ফেলল্যা গো……?

       মুহূর্তের মধ্যে পাড়ার লোকজন জুটে গেল । কয়েকজন কিরণকে বলল – “আপনি ক্যানে মালেককে মারলেন ? ও কি দোষ কর‍্যাছিল ?”

       কিরণ বলল – আমি মালেককে মারিনি । তাছাড়া ওর মতো ভাল ছেলেকে কেন মারব ? আমি সন্ধ্যা সময় সিপাহীদের কয়েকজনকে নিয়ে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । এমন সময় দেখলাম, আধচষা জমিতে কে যেন শুয়ে আছে । কৌতূহলের বশে সেদিকে এগিয়ে গেলাম । দেখলাম, মালেক । ঘোড়া থেকে নেমে হাত ধরে দেখলাম, ও মরে গেছে । এদিক ওদিক উলট পালট করে দেখলাম, কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন নেই । ওকে নিয়ে আসার জন্য সিপাহীদের হুকুম দিয়ে আমি চলে এলাম আদিনার কাছে । আদিনার মুখ থেকে যা শুনলাম তাতে মালেকের মৃত্যুর জন্য  আদিনাই  দায়ী ।

       তারপর আদিনার মুখ থেকে শোনা সমস্ত ঘটনাটি কিরণ বলে চলল । ঘটনাটি শোনার পর ভিড়ের মধ্য থেকে কে যেন বলে উঠল – মালেকের মাগী ভাতারমারী ।

       আর তখন থেকেই এই মাঠের নাম হল – ভাতারমারীর মাঠ । এর পরে যেন এমনভাবে কোন লোক না মারা যায়; সেই কারণে কিরণের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে এই কুয়ো ।

       পরী মনোযোগ দিয়ে গল্পটি শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল – ছোট মা, আর ইটু পানি…… !   

 

                                                                রচনাঃ ১৯৯৩ সাল

        

1 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো। একটা মাঠের নামকরণের জনশ্রুতিকে গল্পের মাধ্যমে ধরে রাখার প্রচেষ্টা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। এটা না করলে হয়তো একদিন ওই জনশ্রুতিটা হারিয়ে যেত।

    ReplyDelete
Previous Post Next Post