Love story of Orpheus and Eurydice / অর্ফিয়াস ও ইউরিডাইসের প্রেমকাহিনী

 

অর্ফিয়াস ও ইউরিডাইস-এর প্রেম-কাহিনী

 আজিজুল হাকিম

~~~~~~~~~~~  

      বিশ্বের শাশ্বত ও অমর প্রেম-কাহিনীগুলির মধ্যে অর্ফিয়াস ও ইউরিডাইসের প্রেম-কাহিনী অন্যতম প্রেমগাঁথা । গ্রীক-পুরানের এই যুগল চরিত্র সারা বিশ্বের দরবারে প্রেম আখ্যানে শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করে নিয়েছে ।

        তাহলে আসুন আমরা জেনে নিই, কেমন ছিল এই প্রেমিক যুগলের প্রেমকাহিনী ।

        গ্রীক-পুরাণ অনুযায়ী অর্ফিয়াস একজন বীণা বাদক, কবি ও শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত শিল্পী । তার কণ্ঠে ও বীণাতে এতই জাদুকরী ও মোহনীয় ঝংকার থাকতো যে, যে কোন মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মত তন্ময় হয়ে পড়ত । সকল বন্য পশুরা তার গান শোনার নেশায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ভিড় জমাত । তারা তাদের ভুলে হিংস্রতা ভুলে যেত । গাছেরাও তার গান শোনার নেশায় তাদের শিকড় উপড়ে ফেলে অর্ফিয়াসের দিকে ঝুঁকে পড়ত । নদীও তাদের গতিপথ হারিয়ে অর্ফিয়াসের গান শোনার নেশায় কূল ভেঙ্গে ফেলত । এমন কি  পাহাড়গুলোও চারিদিক থেকে এসে তাকে ঘিরে ধরত । তার সঙ্গীতের মনোহরি জাদুতে সকলেই মুগ্ধ হয়ে যেত । একসময় তার সঙ্গীতের মধুর মূর্ছনায় দেবতাদের যুদ্ধ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছিল ।

        সেই অর্ফিয়াস একদিন এক উপত্যাকায় তার আকর্ষণীয় সুর ও মধুর কণ্ঠ দিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছিল । সেই আসরে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সঙ্গে বিভিন্ন বয়সী পুরুষ মহিলারা উপস্থিত ছিলেন ।

যখন অর্ফিয়াস মন-প্রান দিয়ে তার গানের ঝর্ণাধারায় সকলকে বিমোহিত করছিল, ঠিক তখন তার চোখ ইউরিডাইসের উপর পড়ল । ইউরিডাইস ছিল বন-পরী । ইউরিডাইসও ওর দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে গান শুনছিল । যখন অর্ফিয়াসের চোখ ইউরিডাইসের চোখে পড়ল তখন পরস্পরের চোখ আটকে গেল । বিমোহিত হয়ে তারা স্থিরভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল । অর্ফিয়াস প্রথম দেখাতেই ইউরিডাইসের প্রেমে পড়ে গেল । তার সঙ্গীতের ধারাতেও পরিবর্তন দেখা দিল । ইউরিডাইস অর্ফিয়াসের চোখে চোখ রেখে তন্ময় হয়ে ওর গান শুনছিল । এদিকে অর্ফিয়াসের সুর ঝঙ্কারে দেখা গেল ইউরিডাইসের প্রতি মন মাতানো গভীর প্রেমের নিবেদন । অবশেষে অর্ফিয়াস রূপসী, বন-পরী ইউরিডাইসকে প্রেমের প্রস্তাব দিল । যার কণ্ঠে ও বীণায় এত জাদু তার প্রেম প্রত্যাখ্যান করবে এমন নারী কোথায় ! তাই ইউরিডাইসও অর্ফিয়াসের প্রেমে সাড়া না দিয়ে পারল না । তারপর ধীরেধীরে তারা প্রেমে এতই উন্মত্ত হয়ে পড়ল যে অর্ফিয়াস ভাবল, ইউরিডাইসকে সারা জীবনের মতো না পেলে ওর জীবনটা যেন বৃথা হয়ে যাবে । তাই সে ইউরিডাইসকে বিয়ের প্রস্তাব দিল এবং ও মেনেও নিল । অবশেষে খুব ধুমধাম করে বিয়েও হল । বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠান শেষে যখন সকল অতিথি বিদায় নিল তখন ওরা দুজনে পরস্পরের হাত ধরে বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে ওদের ঘরে ঘরে ফিরছিল ।

           ঠিক তখন অ্যারিস্টাস নামে এক মেশ পালক যে মনে মনে ইউরিডাইসকে খুব ভালবাসত, সেই অ্যারিস্টাস ওদের আগমন পথে একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকল । যেই ওরা দুজন ওর কাছে এসেছে অমনি আচমকা ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ও অর্ফিয়াসকে আঘাত করল । তারপর ইউরিডাইসকে টানতে টানতে নিয়ে চলল । কিন্তু অর্ফিয়াস ও ইউরিডাইস পরস্পরের হাতকে শক্ত করে ধরে ছিল । তাই অ্যারিস্টাস ওদেরকে বেশি দূর নিয়ে যেতে পারল না । এই টানা হ্যাচড়ার সময় ইউরিডাইসের পা একটি গর্তে পড়ে যায় । সেখানে এক বিষধর সাপ ছিল । সেই সাপ ইউরিডাইসকে কামড়ে নেয় আর সেই সাপের বিষাক্ত ছোবলে ইউরিডাইস মারা যায় । যখন ইউরিডাইস মারা গেল তখন অ্যারিস্টাস সেখান থেকে পালিয়ে গেল । এদিকে অর্ফিয়াসের জ্ঞান ফিরলে ইউরিডাইসকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যার্থ হল ।

        গল্পের এখানেই শেষ নয় । ইউরিডাইসের বিরহে অর্ফিয়াস ব্যাকুল হয়ে পড়ল । এক অনন্ত কান্নায় ভেঙে পড়ল সে । ফলে তার সঙ্গীতে এতই বিরহ বেদনা ফুটে উঠল যে, তার কান্নায় কোলের শিশু থেকে সমস্ত জীবজগৎ হাহাকার করে উঠল । এমনকি স্বর্গের দেবতারাও তার ব্যাথাতুর গান শুনে চরম কান্নায় ভেঙে পড়ল ।

        অবশেষে দেবতা অ্যাপোলো ইউরিডাইসকে অর্ফিয়াসের জীবন সঙ্গী রূপে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মৃত্যুর দেবতার কাছে অনুরোধ করল । কিন্তু একটি শর্ত আরোপ হয় । অর্ফিয়াস তার স্ত্রীকে ফিরে পাবে; যদি অর্ফিয়াস তার সুর সঙ্গীতে মৃত্যুর দেবতাদের মন জয় করতে পারে । কিন্তু পাতালে অবস্থিত মৃত্যুপুরী থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় ইউরিডাইস থাকবে অর্ফিয়াসের পিছনে । তারা যতক্ষণ মৃত্যু-জগৎ থেকে পৃথিবীর সম্পূর্ণ আলোতে এসে না পৌঁছাবে ততক্ষণ অর্ফিয়াস ইউরিডাইসের দিকে তাকাতে পারবে না । সেই সর্তেই অর্ফিয়াস রাজি হয়ে গেল এবং দেবতা অ্যাপোলোর সাহায্যে এক বিড়াট পাহাড়ের গুহার ভিতরে প্রবেশ করে । ওটাই ছিল পাতালপুরীতে মৃত্যুর জগতে প্রবেশ করার পথ ।

        অর্ফিয়াস তার বীণায় সীমাহীন করুণ, বেদনার্ত সুর তুলে হাজারও সুড়ঙ্গ পথ পেরিয়ে অবশেষে মৃত্যুর জগতে পা রাখল । তারপর সেখানেও চলল মন জয় করার পালা । তার কণ্ঠে ও সুরে সকল বেদনাগুলি যেন নিংড়িয়ে ঢেলে দেওয়া হল । সমস্ত পাতাল জগত বেদনায় স্থবির হয়ে গেল । ফলে মৃত্যুর দেবতা হেইডেস-এর চোখে অশ্রু দেখা গেল ও তার স্ত্রী পার্সেফোনিও কেঁদে ফেললেন । অর্ফিয়াসের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ইউরিডাইসকে তারা ফিরিয়ে দিলেন ।

        অর্ফিয়াস ভীষণ খুশিয়ে হয়ে শর্ত মতো ইউরিডাইসকে পিছুনে নিয়ে ফিরছিল । এই পৃথিবীর পূর্ণ আলোতে ফিরতে হয়তো আর কিছুক্ষণ বাকি । ভোরের ঝুজকি আলোতে গুহাপথ উদ্ভাসিত হতে শুরু করেছে; এমন সময় অর্ফিয়াসের মনে হল পিছন থেকে ইউরিডাইসের উপস্থিতির কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না । তার কোন পায়ের শব্দও না । নিঃশ্বাসের শব্দও নয় । তাহলে কি ইউরিডাইস তার পিছনে নেই ! কৌতূহলের বসেই সে পিছনে ফিরে তাকাল । আর হায় ! মুহূর্তের মধ্যেই ইউরিডাইসকে চারিদিক হতে এক অনন্ত অন্ধকার ঘিরে ধরল । অর্ফিয়াস ও ইউরিডাইস পরস্পরের দিকে হাত বাড়াল । উভয়েই এমন বিচ্ছেদে চিৎকার করে উঠল । কিন্তু কেউ কাউকে ধরতে পারল না । কারা যেন মুহূর্তের মধ্যে ইউরিডাইস অন্ধকারের অন্তরালে টেনে নিয়ে চলে গেল । 

Post a Comment

Previous Post Next Post