মুর্শিদাবাদ
আজিজুল হাকিম
স্মৃতির পাতা থেকে
******************
দুই
সেই ছোট্ট বেলায়, তখন হয়তো খুব বেশি হলে থ্রি-ফোর-এ পড়তাম । একদিন বাবার সঙ্গে বহরমপুর থেকে ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরছিলাম । সেদিনই বাবা ট্রেন থেকে আমাকে প্রথম হাজারদুয়ারি দেখান । সেদিন হাজারদুয়ারির ছাদের দিকের সামান্য অংশ ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনি । কারণ যেখান থেকে বাবা আমাকে হাজারদুয়রি দেখিয়ে ছিলেন সেখান থেকে তার দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের বেশি হবে । সেই চলমান ট্রেন থেকে হাজারদুয়ারি দর্শন । তবুও মনের মধ্যে একটি আনন্দের শিহরণ জেগে উঠেছিল । এই হাজারদুয়ারি বর্তমানে মুর্শিদাবাদের একটি বড় নিদর্শন । মুর্শিদাবাদকে জানতে গেলেই হাজারদুয়ারির কথা প্রথম আসে । যদিও হাজারদুয়ারি ছাড়াও মুর্শিদাবাদে ঐতিহাসিক প্রচুর নিদর্শন আছে
তারপরে অনেকবার হাজারদুয়ারি দেখেছি । বেশ কয়েকবার হাজারদুয়ারির ভিতরে প্রবেশ করেছি । কিন্তু আজকের মতো পরিবেশ বিগত দুই দশক ধরে দেখিনি । হাজারদুয়ারি আর ইমামবাড়ার মাঝের বিশাল মাঠটি খাঁখাঁ করছে । হাজারদুয়ারি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে দুচারজন লোক থাকে তাদের ছাড়া কোন জনমনিষ্যির দেখা পাওয়া গেল না । মানুষের পদস্পর্শ না পাওয়ায় আর প্রায় লাগাতার বৃষ্টির ছোঁয়া পাওয়ায় মাঠের ঘাসগুলো সবুজ হাসির নিরব উল্লাসে মেতে উঠেছে । হাজারদুয়ারির চারিপাশে বিভিন্ন ফুলের ও লতা জাতীয় গাছগুলি দিয়ে সাজানো আছে, সেগুলিও মানুষের ছুরি কাঁচির নির্মম স্পর্শ না পাওয়ায় সেগুলিও বাঁধভাঙা আনন্দে বিচিত্র রঙের আস্ফালনে উৎফল্লিত হয়ে শান্ত বাতাসের দোলায় দুলছে । সেগুলিও তাদের স্বাভাবিক ছন্দে বেড়ে উঠছে । আমি অবাক বিস্ময়ে সেগুলি দেখছি আর সেই ছোট বেলার স্মৃতিগুলির সঙ্গে তুলনা করছি । ফিরে যাচ্ছি বারবার ফেলে আসা দিনের সেই সোনালি প্রেক্ষাপটে ।
যে সিঁড়িতে সবসময় লোক গিজগিজ করে সেই সিঁড়িতেও আজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য নির্জনতার বিরতি চিহ্ন অদৃশ্যের আকারে কে যেন ফেলে রেখে গেছে । যার ফলে বৃষ্টির ধারার আঁচড়ে সিঁড়ির ধূসর রঙ হালকা কালো রঙ ধারণ করেছে । সিঁড়ির দুপাশে যে দুটি কামান আছে চারিপাশের লতা ও ফুলের গাছগুলি তাদের ইতিহাসকে সমাধিস্ত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় মরিয়া হয়ে পড়েছে ।
ছবি- ঘড়িঘর
আমি সিঁড়ি থেকে নেমে ঘড়ি ঘরের রাস্তার দিকে যেতেই
আমাকে একজন কেয়ার টেকার বললেন, “ওদিকে যাবেন না । সাঁপ থাকতে পারে” । আমি পায়ে হাঁটা
রাস্তার দিকে তাকালাম – দুই দিক থেকে ফুলের গাছগুলি এসে রাস্তা বন্ধ করে একটি ভয়ঙ্কর
ঝোপে পরিণত করেছে । ওরা এক বন্য আস্ফালনে নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে ।
আমি বারবার এদিক ওদিকে তাকাচ্ছি আর ফিরে যাচ্ছি
ছোট বেলায়, তখনো এরকম নির্জনতার পরশ নিয়ে হাজারদুয়ারি হলুদ আর ইমাম বাড়া সাদা রঙের
আচ্ছাদনে নিমগ্ন ছিল, আজ যেমন আছে ।
আমি কিছুক্ষণ এদিকে ওদিকে পায়চারী করে বেড়ালাম ।
যেদিকে তাকালাম, কেবল সবুজ ঘাস, লতাপাতা আর গাছগুলি অনাবিল সবুজ আনন্দধারায় যেন মুচকি
হেসেই চলেছে ।
অবশেষে আমি নিউ প্যালেস গেলাম । সেখানেও দেখলাম একই চিত্র । তারপর আমি বাইক ছাড়লাম । কিছু যানবাহন বাদ দিলে রাস্তা প্রায় ফাঁকা । করোনার আবহে স্তব্ধ নগরজীবন । ঘরবন্দি মানুষেরা বন্দি দশায় অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে । কিছুটা বাইক চালিয়েই আবার ফিরে এলাম হাজার দুয়ারীর দক্ষিণ দিকে । একটি চায়ের দোকান দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম । সেখানে অন্য সময় হলে দাঁড়ানোর কোন সুযোগ থাকতো না । এক্কা গাড়ি আর মানুষের ভিড়ে ভীষণ ঠাঁসাঠাসি হয়ে থাকে । অথচ আজ কেবল হাতে গুনা তিনটি ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পেলাম । চায়ের দোকান থেকে হাতে চা নিয়ে চুমুক দুয়েক দিয়েই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানকে বললাম, “এখন আপনাদের অবস্থা কেমন চলছে ?”
উনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গোড়াটির গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “আমাদের অবস্থার কথা বাদ দিন, এই যে একে দেখছেন, এর খাবারের ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি । কয়েক বছর থেকে ও আমার সংসার টানছিল । আজ কি করে ওকে ফেলে দিতে পারি বলুন ? ভীষণ অভাবের মধ্যে দিয়ে দিনগুলি যাচ্ছে । লকডাউন কবে উঠবে কে জানে !”
কথাগুলি বলে উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । উনার
চোখেমুখে দেখলাম এক করুণ আর্তি ।
উনার চোখ থেকে চোখ ফিরাতেই আমার চোখ গিয়ে আঁটকে
পড়ল একটি বয়স্ক নারীর দিকে । উনি হাতে কয়েকটি সানগ্লাস নিয়ে একটি গাছের তলায় ঝিমাচ্ছেন
। সেগুলি কেনার মতো আশেপাশে কেউ নেই ।
আমি কিছুক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম । বুঝতে পারলাম, না উনি আমার দিকে না আমার মাথার উপর দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছেন । ভীষণ বিধ্বস্ত চেহেরা । অথচ একদিন এদের রমরমিয়ে ব্যাবসা চলত ।
(চলবে...)