শবে কদরের রাত্রি জাগরণ ও আমার ছেলেবেলা
আজিজুল হাকিম
~~~~~~~~~~~
এই রমজান মাসে শবে কদরের রাত এলেই মনের স্মৃতির
সোনালি পথ ধরে এক ছুটে সেই ছেলেবেলায় । কতই না সুন্দর, সুমধুর ছিল সেই রাতগুলি ! আজও
ভুলতে পারিনি । আজও খুঁজে ফিরি স্নিগ্ধ, শান্তিময়, আনন্দধারায় মুখরিত সেই পেলব রজনীগুলি
। ধর্মের মধুর উদ্দীপনায় জেগে থাকতো সারা পাড়া । তার মধ্যে আমাদের বাড়ির তো তুলনাই
ছিল না ।
আমি তখন ক্লাস ফাইবে । নতুন বাড়িতে এলাম ।
বড়ো বড়ো দুটি মাটির ঘার । তার সামনে মস্ত উসরা (বারান্দা) । এই রাতগুলি এলে, বিশেষ
করে সাতাশ আর ঊনত্রিশের রাত এলে পাড়ার প্রায় সমস্ত মেয়েগুলো রাত জেগে নামাজ পড়ার জন্য
আমাদের বাড়িতে জমায়েত হতো । কারণ একটায়, সেই সময় পাড়ার মধ্যে ধর্মীয় ও বাংলা শিক্ষায়
আমার মায়ের সমতুল্য কেউ ছিলেন না । তাছাড়া আমার মা কোরান শরীফের আঠার পারা অবধি মুখস্ত
করেছিলেন । যাকে বলা হয় আঠার পারা হাফেজ (যারা কোরান শরিফকে মুখস্ত রাখেন তাদের ‘হাফেজ’
বলা হয়) । সেই সুবাদেই পাড়ার মেয়েরা মায়ের কাছে নামাজ পড়তে আসত । পাড়ার মেয়ে বলতে অধিকাংশ
বৃদ্ধ মহিলারা ছিলেন আমার সম্পর্কে দাদি বা নানি আর মধ্য বয়সি মেয়েরা ছিলেন সম্পর্কে
মামি অথবা কাকি ।
তারা সংখ্যায় এত বেশি জমায়েত হয়ে পড়তেন যে
তারা এক জামাতে সবে কদরের নামাজ পড়তে পারতেন না । পালা করে কয়েক জামাতে তারা নামাজ
পড়তেন । সকল ক্ষেত্রেই আমার মা ইমামতির কাজটি করতেন । ইমামতি বলতে মা সম্মুখে দাঁড়াতেন
আর সকল মহিলারা বারান্দা ভর্তি করে মায়ের পিছুনে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন । সে সব
দেখতে কতই না ভাল লাগত ! তখনই জেনেছিলাম, এই রাতের তাৎপর্যয়ই আলাদা । এই রাতে এবাদত
করলে হাজার বছরের এবাদতের চেয়ে তার মূল্য বা নেইকি বেশি । আর এই নেইকি পাওয়ার আশায়
সকল মা ও দাদি, নানিরা সারা রাত জেগে কোরান তেলোয়াত, নামাজ আর তসবি পাঠ করতেন । এমন কি অনেকে মোনাজাত করার সময় হাওমাও করে কেঁদে উঠতেন। মাঝে
মাঝে মনে হতো এদের তপস্যায় যেন ফেরেস্তা সকল আমাদের বাড়িতে নেমে এসে সকল মেয়েদের প্রার্থনারত
হাতে উজার করে নেইকি ঢালছেন ।
তবে কেবলই আমাদের বাড়ি নয়, যেহেতু আমাদের
বাড়ির একদম পাশেই মসজিদ ছিল, সেখানেও পাড়ার লোক সকল এসে মসজিদকে ইবাদতের আনন্দধারায়
মুখরিত করে তুলতো । সত্যি কথা বলতে কি আমাদের বাড়িতে যেমন পাড়ার মেয়েদের আগমনে ভর্তি
হয়ে পড়তো, তেমনি আমাদের বাড়ির বাইরের চত্তর আর মসজিদের আশপাশ সহ ভিতরের অংশে উপাসনার
গুঞ্জনে কল্লোলিত হয়ে থাকতো । মসজিদের ছাদে উঠে আমরা ছোট ছোট ছেলেরা চারিপাশের কার্নিশে
মোম্বাতি জ্বেলে দিতাম । একটু দূর থেকে মনে হতো আকাশের তারাগুলি যেন মসজিদের ছাদে নেমে
শান্তির আলোতে মসজিদ আর তার চারিপাশ ভরে দিচ্ছে । এই সব রাতগুলি পাওয়ার জন্য সারা বছর
ধরে আমরা অপেক্ষায় থাকতাম । আর যেদিন জালসা হতো সেদিনের আনন্দ আরো একটা নতুন মাত্রা
পেত । জালসাও হতো আমাদের বাড়ির সামনের পানগায় (বাড়ির সামনে পড়ে থাকা ফাঁকা চত্তরকে
‘পানগা’ বলা হয়)। সেদিন তো আমাদের বাড়িতে পাড়ার মেয়েরা এতো বেশি জমায়েত হতো যে বাড়ির
অঙ্গিনা পর্যন্ত ভরে থাকতো । জালসা শোনার নেশায়
তারা আসতেন । যেহেতু জনসাধারণের মধ্যে তারা বসতে পারতেন না; তাই তারা আমাদের বাড়িতে
পুরুষদের আড়ালে থেকে জালসা শুনতেন । জালসার স্বেচ্ছাসেবকেরা মুড়ি, জিলাপি বা অন্যান্য
খাবার আমাদের বাড়িতে অগত মহিলাদেরকে দিয়ে যেত । জালসার শেষে যখন কেয়ামের জন্য সকল শ্রোতাগণ
মৌলবির সঙ্গে কেয়ামে দাঁড়াতেন; তখন দেখতাম আমার মায়ের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে আগত সকল
মহিলারাও দাঁড়িয়ে কিয়াম করতেন । কিয়ামের কথাগুলি আমাকে ভীষণ ভাল লাগত । “তুমি না এলে
দুমিয়ায় আঁধারে ডুবিত সবই”-এই কথা আমার শিশু ও কিশোর মনে ভীষণ নাড়া দিত । তারপর সেহেরি
রান্নার সময় হলে সেই রাতে যে যার বাড়ি চলে যেতেন । সেই সব রাতগুলো ছিল এক অনাবিল আনন্দময়
রজনী ।
আমি যখন মাধ্যমিক পাশ করার পরে ইলেভেন-এ
কলেজে ভর্তি হলাম; তখন আমাদের বাড়িতে আর একটা ঘর, বারান্দা ও বৈঠকখানা সংযোজিত হল ।
এর ফলে যেদিনই এই সবে কদরের রাত আসতো সেদিনই পাড়ার মেয়েদের আগমনে আমার ঘর আর উসরা ভর্তি
আর মুখরিত হয়ে উঠতো । সেই রাতে আমার আর ঘুম পাড়া হতো না । যদিও মাঝে মাঝে ওই ঘরের একদিকে
চকির উপরে আমি শুয়ে থাকতাম, তখন মামী, কাকি, নানী, দাদিরা এসে ঘরের ফাঁকা অংশে আর ওই
ঘরের বারান্দায় নামাজ পড়তেন । কখনো কখনো মামাতো বোনেরা এলে আমার আর শুয়ে থাকা হতো না
। তারা তাদের আদুরে জ্বালাতনে আমাকে বিছানা থেকে তুলে ঘর থেকে বের করে আমার বিছানার
দখল নিত । আমিও স্বেচ্ছায় তাদেরকে আমার বিছানা ছেড়ে দিয়ে পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে
বাইরে ঘুরে বেড়াতাম । যদিও আমি তেমন নামাজ পড়তাম না, তবুও মনে হতো সেই সব নির্মল রাতগুলি
যেন শান্তি আর বরকতের উচ্ছ্বাসময় শুভ্র নেইকির পরশে আমাদের বাড়ি আর আমার ঘরখানি ভরিয়ে
দিত ।
আজও সবে কদরের রাত আসে; কিন্তু ছোট বেলায়
দেখা সেই ধর্মীয় পবিত্র জৌলস আর কোথাও দেখতে পাই না আর যতটুকু দেখি তা মেকি, অনুদার
আর অগভীর সম্পর্ক মিশ্রিত ধর্ম পালন । আমার আরো মনে হয় সেই সব মেয়েদের সাথে সাথে সবে
কদরের যে ফজিলত তা কালের অদৃশ্য স্রোতে হারিয়ে গেছে । আমিও যেন সেই বাড়ি ছেড়ে কোন এক
অন্ধকার অসীম প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি অনন্তকাল ধরে ।