হজরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর কাব্যজীবনী



  হজরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর 

কাব্যজীবনী 

(প্রেক্ষাপট)

আব্দুল্লাহ আল আযীয

দ্বিতীয় অধ্যায়

বিশ্বনবীর(দঃ) আবির্ভাবের সমসাময়িক কালে

ঐক্য ছিলোনা মরু-আরবের সামাজভিত্তিমুলে।

তমশাযুগের দিকেদিকে ছিলো বিবিধ অন্ধকার

সমাজে রাষ্ট্রে কোথাও ছিলোনা আলোকের উৎসার।

ঘুটঘুটে কালো নিদারুণ ওই জাহেলিয়াতের রাতে

আত্মম্ভরিতার কদর্য্যতাই মিশে ছিলো মরুজাতে।

কথায় কথায় হটকারীতা আর রক্তপাতেরই রেশ

বংশপরম্পরায় চলেও কখনও হতোনা শেষ।

আঁধার জাহানে জ্বলতো সতত যুদ্ধেরই দাবানল

ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলতো বিদ্বেষ ও হলাহল।

প্রতিশোধস্পৃহা এমনই ছিলো মিটতোনা কোনো মতে

পিতার বদলা পুত্রে না পেলে যেতো পৌত্রের হাতে।

গোত্রে গোত্রে লড়াই চলতো পরম্পরতা ধরে

শাস্তি ছিলোনা জীবনের মানে শান্তি ছিলোনা ঘরে।

গোত্রবৃত্ত ধারনাতে এরা ছিলো দৃঢ় অবিচল

শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা ছিলো আর ছিলো তেজবল।

গোত্রবৃত্ত বিরোধই যেহেতু চলতোই আজীবন

আপন গোত্রে ঐক্যের তাইই বুঝেছিলো প্রয়োজন।

নিজের গোত্র নিজের বংশ ভুল হলে তাও ঠিক

অন্যের বেলা ব্যবহার ছিলো বিপরীত ও পাশবিক।

নেতৃত্বের অভিলাষী এরা দাম্ভিকও ছিলো বেশি

কারণে অকারণে শূন্যে অযথা উচাঁতো শানিত অসি।

স্বেচ্ছাচারিতায় ও বর্বরতাতে রত ছিলো অবিরত

পশু পালনের দেশের মানুষ বাঁচতো পশুরই মতো।

উচ্চ-নিম্ন-মধ্যবিত্ত সবার জীবন জুড়ে

মদ-জুয়া-খুন-ব্যাভিচার ছিলো সমাজ আঁধার করে।

কুসংস্কার ও দূর্নীতি আর অনাচার ও পাপাচার

নৈমিত্তিক ঘটনা আছিলো জীবনব্যবস্থার।

কুপমণ্ডুকতার অস্থিরতাই ছিলো জীবনের স্থিতি

কুসংস্কার আর অজ্ঞানতাই ছিলো সামাজিক রীতি।

আভিজাত্যের দাম্ভিকতার ও অহংকারের বসে

হিংসার যেন মহামারী ছিলো জাহেলিয়াতের দেশে।

দাসদাসী আর পশুর জীবনে ছিলোনা'ক ব্যবধান

এদের জীবনে কষ্টের কোনো ছিলোনা'ক সমাধান।

সমাজের কোনো দায় ছিলোনা'ক মরুনারীদের নিয়ে

ভোগের বাসনা মিটাতো পুরুষ শুধু ইহাদের দিয়ে।

হাটে-বাজারে পণ্যের মতো বিক্রিত হতো নারী

ছিলোনা এদের নিজ সংসার ছিলোনা নিজের বাড়ি।

কণ্যা শিশুর জন্মগ্রহণে লজ্জা মানিতো এরা

জীবিত তাদের কবর দেওয়া ছিলো সমাজের ধারা।

ঘোড়ার সঙ্গে নারীদের বেঁধে ছুটাতো নেশার ঘোরে

উপভোগ্য ছিলো এ দৃশ্য জ্ঞানের অন্ধকারে।

দুর্ভিক্ষে বা জীবনযাপনে ব্যয়নির্বাহ-ভয়ে

নিঃসংকোচে পুত্র হত্যাও করতো নিঃসংশয়ে।

ধনী-নির্ধনী স্থায়ী-যাযবর যাবতীয় মরুবাসী

কদর্যতার অন্ধকারেই আছিলো অহর্নিশি।

ব্যাতিক্রম যে ছিলোনা সমাজে এমন কথাও নয়

কোটিতে তা ছিলো গুটির মতো গভীর অনিশ্চয়।

অবস্থানের ও অবস্থিতির তারতম্য লক্ষ্য করে

জনগোষ্ঠীর বিভিন্নতাতে ভিন্নতা চোখে পড়ে।

অভিজাতদের শ্রেণী-সমাজের ইতিহাসে দেখা যায়

সম্পর্কের ন্যায়ভিত্তি মানের মর্যাদায়।

অনেক বিষয়ে এখানে নারী স্বাধীকার তার পেতো

ব্যাক্তিতের নিরিখে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হতো।

নারীর সকল দায়দায়িত্ব ও মান-অপমানের দিকে

সজাগ দৃষ্টি রাখতো পুরুষে নিজেরই তাগিদ থেকে।

অবমাননাকর ঘটিলেই কিছু নারীদের অবিধাতে

কোষমুক্ত হইতো কৃপাণ কদর্য সংঘাতে।

সংসারে বা সামাজিকতায় মতামতও দিতো নারী

ইহারাই ছিলো সমাজজীবনে প্রকৃত কর্ণধারী।

তদানীন্তন আরবের লোকে প্রচলিত রীতি মতে

পুরুষত্বের প্রতাপও দেখাতো নারীদেরই প্রেক্ষিতে।

নিজেদের কোনো উদারত্বে বা শক্তি প্রদর্শনে

প্রশংসোক্তি ইহারা শুনাইতো নারীদেরই প্রকরণে।

অধিকক্ষেত্রে ইচ্ছা প্রকাশে স্বাধীনই ছিলো নারী

দুযিত পুরুষে ইহারা ধরাতো যুদ্ধের তরবারি।

লড়াইয়ে করিতো উদ্বোধিত আরবের নারীগণ

যুদ্ধের আগুন জ্বেলে দিতো এরা যথেচ্ছা অকারণ।

পুরুষপ্রধান সমাজকাঠামো আছিলো মরুতে তবু

সমাদৃত হতোনা নারীরা মর্যাদাবোধে কভু।

এ বৈশিষ্ট্য মরু-আরবে নির্বিশেষ তা নয়

অভিজাতদের ইতিহাসে ইহা গোত্রীয় অন্বয়।

একদিকে যখন এরকম ছিলো অভিজাতদের রীতি

আর একদিকে অন্য রকম ছিলো বর্বর জাতি।

এরা সমাজের নীচুস্তরের সাধারণ জনগণ

জাহেলিয়াতের জঘণ্যতার ঘৃণার্হ উপকরণ।

এরা নির্মম ও পাশবিক ছিলো সামাজিক ভাবনায়

অনাচার ছাড়া এদের জীবনে তেমন কিছুই নাই।

সাম্য-প্রেমের শিক্ষা এদের ছিলো একেবারে ক্ষীণ

মনুষ্যত্বের নীতি-আদর্শে ছিলো আদর্শহীন।

ছিলো ইহাদের যৌনজীবনে শুধু-ই পাপাচার

ব্যাক্তিজীবনে সমাজজীবনে সবখানে অনাচার।

আঁধার যুগের নারী-পুরুষের সম্পর্ককে নিয়ে

মিমাংসার আয়োজন হতো খোলা তলোয়ার দিয়ে।

কোন পুরুষের ভাগ্যাকাশে কোন নারী দেবে দেখা

তীরের ফলায় ও বল্লমে হতো সেই ইতিহাস লেখা।

যুদ্ধে বিজিত নারীদের নিয়ে বিজয়ীপক্ষ যত

বন্দীশালায় রেখে ব্যবহার করতো পশুরই মতো।

নিজের মাতা সহদোরা বোন বাদ দিয়ে যত নারী

সব্বাই ছিলো ভোগের পণ্য ছিলোনা রিস্তাদারী।

সমাজের এই ঘৃণিততম জঘন্য পাপাচার

জাহেলিয়াতের মানসে ছিলো সবখানে বিস্তার।

অবশ্যই কিছু নারী ও পুরুষ এমনও দেখা যেতো

জাহেলিয়াতের গর্ভে যাঁহারা ছিলো প্রদীপের মতো।

এরা বিমুক্ত ও নির্মল ছিলো বর্বরতার থেকে

হানিফ নামে পরিচিত এরা আঁধার মরুর বুকে।

অজ্ঞ আরবে দাসের জীবন আছিলো দুঃখে ভরা

ছিলোনা এদের জীবন মরুতে কোথাও শান্তিধারা।

এমন মনিব কমই ছিলো যারা গৃহদাসীদের পেয়ে

যথেচ্ছচারে লিপ্ত হতোনা ভোগের কামনা নিয়ে।

দাস-দাসীদের জীবন কাটতো অশেষ যন্ত্রণায়

এদের জন্যে ছিলোনা সমাজে স্নেহ ও প্রেমের ঠাঁই।

আরবভূমিই পাশবিকতার আছিলো আঁতুরঘর

অধঃপতনের যাবতীয় রোগে আছিলো এ জর্জর।

মরুচারী এই আরবীয়দের জীবনে যখন এ দশা

তখনও বিশ্বে নৈতিকতায় এরাই আলোর দিশা।

একদিকে এরা হানাহানিপ্রিয় মদ্যপ ও ব্যাভিচারী

অন্যদিকে শৌর্যে-বীর্যে সততার অধিকারী।

যখন মরুর সমাজনীতিতে শুধুই কদর্যতা

জগতে তখনও সমাদৃত এদেরই নৈতিকতা।

এদের জীবন পর্যালোচনাতে প্রতিভাত ইহা হয়

নীতিতে এদের ঘটেছিলো দুটি ধারার সমন্বয়।

প্রতিহিংসাতে এরাই উপমা মানবেতর মানবতার

অপরদিকে সহজ-সরল-অনাড়ম্বর ও উদার।

এরা হিংসুক বিদ্বেষকামী খুনি জঘন্য জাতি

প্রতিজ্ঞাপরাণতা অনাড়ম্বরতা এদেরই হৃদয়দ্যূতি।

উদারতার ও দাক্ষিণ্যতার উন্নততম গুনে

বিশ্বে এরাই বিদিত আছিলো দেশে-দশে জনেজনে।

আমানতদারীর ও মেহেমানদারীর উদার-মুক্ত নীতি

আরব্যজাতির বৈশিষ্ট্যের স্বীকার্য-সংহতি।

দানশীলতার ও সারল্যতার ব্যাক্তিত্বসমাবেশে

মরুদ্যানেরই মতো ছিলো এরা ঊষড় মরুরই দেশে।

জুয়ার আড্ডা যেমন আছিলো ইহাদের কাছে প্রিয়

ওয়াদাপূরণে হেফাজতে ছিলো তেমনি বিশ্বশ্রেয়।

জাহেলিয়াতের জঘণ্যতার এই মরুবাসী জনগণে

মানবিকতার উদার আকাশ প্রসুপ্ত ছিলো মনে।

দুনিয়ায় এরা শ্রেষ্ঠ জাতি ছিলো নিকৃষ্ট রুপে

মেজাজে এরা আছিলো শানিত মরুর তপ্ত ধূপে।

অতিথিবৎসল সহজ সরল স্বচেতনাতার এই জাতি

অনুপযুক্ত প্রেক্ষিতে ছিলো অনপনেয়তার জ্ঞাতি।

যদিও মরুতে জ্ঞানের সূর্য হয়েছে অস্তমিত

মরুবাসীদের মানসে তখনও প্রাণ ছিলো আলোকিত।

সহজ-সরল-আমানতদার ও শৌর্যে-বীর্যে শেরা

সর্বশ্রেষ্ঠ জগতে যাদের নৈতিকতার ধারা।

প্রতিজ্ঞাপরাণতা মেহেমানদারী ও হেফাজতকারী গুনে

অনাড়ম্বর ও উদার যাহারা ছিলো সবে জনেজনে।

দানশীলতার তেজদীপ্তিতে যারা ছিলো ভাস্বর

অতিথিবৎসলতায় যাদের ছিলো সুবিশাল অন্তর।

তীব্র প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী যারা

কুরআনের বানী সংরক্ষণে মনোনীত হলো তারা।

সমাদৃত যারা চেতনাতার উপযুক্ততাগুনে

দ্বীন-ইসলাম আসিলো তাদেরই দায়িত্বপ্রকরণে।

বাহন হিসাবে সাবলীল এই জাতির ভাষাকে নিয়ে

মা'বুদের বানী এলো ধরনীতে কুরআন মাজিদ হয়ে।

সব কণ্ঠের লালিত্য এই ভাষাতে বিদ্যমান

তাছাড়া এ ভাষা জান্নতীভাষা তাই তার এই মান।

আল্লাহ পাকের জবানী ভাষাও আরবি যেহেতু তাই

এই ভাষাতেই দ্বীন-ইসলাম আসিলো এ দুনিয়ায়।

আরবই ধরার নাভিমূল তাইই সমদূর সবইদিকে

সম্পর্কিত জগতে এ দেশ বহিঃবাণিজ্য থেকে।

তাছাড়া যেহেতু আল্লাহর ঘর কাবা ছিলো মক্কায়

দ্বীনের ভিত্তি আরবভূমিতে মনোনীত হলো তাই।

শ্রেষ্ঠতম মানুষ মেনেছে যাঁহাকে ত্রিভুবন

তাঁরই হস্তে হইলো ন্যস্ত রিসালাত-আয়োজন।

মরুর রুক্ষ মরণশীতল নিদারুণ কালো রাতে

এলেন তিনি দ্বীন-ইসলামের আলোর প্রদীপ হাতে।

অধঃপতিত ও নিকৃষ্টতম জাতিকে চয়ন করে

দ্বীনের দীক্ষা দুনিয়ার শেরা করিয়া দেখালো তারে।

বিশ্বালোকের আয়োজন নিয়ে অন্ধ ছিলো যে জাতি

'হা-শিরুম মা-হি' সাজালেন সেথা কুরআনের সংহতি।

ভ্রষ্ট জাতিরই হৃদয়ে তিনি কাটিলেন এমনই দাগ

দীর্ণ আঁধার মর্মে স্ফুটিত হইলো উদয়রাগ।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post