ধর্ষিতা মা
জাহাঙ্গীর আলম সোহেল
শেষ পর্ব
সুজনের
বেতন খব বেশি না, পার্কে কাজ করে যা পায় তা দিয়ে ওদের সংসার খরচ চলে, কিন্তু মায়াকে
ডাক্তারি পড়ানোর খরচ চালানো সম্ভব না। তবুও সুজনের চিন্তা মায়ার পড়ার দিকে রয়েই গেলো।
একদিন
রাতের বেলা সুজন পার্কে ডিউটি করছে, তখন দুটি লোক বড় বড় দুটি ব্যাগ লেনদেন করছিলো এক
কোনায় দাড়িয়ে। সুজন তাদের একজনকে চিনে, নাম জাফর মিয়া, এখানকার বড় ব্যাবসায়ী ও চোরাকারবারিদের
লিডার বলা যায়। সুজন মনে মনে ঠিক করে জাফর মিয়ার সাথে কথা বলবে এবং তার কাছে কোন কাজ
পেলে পয়সা কামাতে পারবে।
সুজন
পেছন থেকে সালাম দিল জাফর মিয়াকে।
জাফরঃ
অলাইকুম সালাম, তুমি প্রহরী সুজন তাইনা?
সুজনঃ
জে কাকা, আমি সুজন।
জাফরঃ
কিছু বলবে?
সুজনঃ
আমি জানি কাকা আপনে অনেক বড় লোক, মেলা ফ্যাক্টরী আছে আপনের৷
আমায় জদিনএকটা মেলা
পয়সা কামানোর কাম দিতেন!
জাফরঃ
হাহাহা মেলা পয়সা কামানোর কাজ, তাও আবার ফ্যাক্টরীতে!
বলো কি কি কাজ জানো
তুমি?
সুজনঃ
কাকা আমিতো রাইত জেগে পহরা আর বাঁশি বাজানো ছাড়া আর কোন কাম জানিনা।
জাফরঃ
এসব কাজে তো তারাতারি মেলা পয়সা কামানো যায়না।
সুজনঃ
কাকা তাহলে যে কামে তারাতারি বড়লোক হতে পারুম হেই কাম দেন, আমি একবার দেখলেই শিখা নিবার
পারুম৷
জাফরঃ
জীবন বাজি রাখতে পারবে?
সুজনঃ
যদি মেলা টেকা পাই তাইলে, জীবনডা আগে আপনার হাতে দিয়া লমু।
জাফরঃ
গুড, তাহলে এসো আমার সাথে৷
সুজন
চলে যায় জাফরের সাথে অন্ধকার জগতে ।সুজন প্রথমে চমকে যায় চারদিক বন্ধুক, মদের বোতল,
অসভ্য মেয়েছেলের ব্যাবসা দেখে। সুজন ভেবেছিলো জাফর হয়তো তার কোন কারখানায় চাকুরী দিব;
কিন্তু সুজনকে নিয়ে এলো সব অবৈধ ও অনৈতিকের ভিতর৷ সুজনের বিবেক মানা করলেও টাকার জন্য
জাফরে দলে ঢুকে যায়৷ সেই রাতেই একটা স্মাগলিং করায় সুজনকে দিয়ে জাফর সুজনকে ১০ হাজার
টাকা দিয়ে বলে পোশাক নতুন করে কাল থেকে কাজ শুরু করে দে, তবে তোর আর টাকার অভাব হবেনা।
কিন্তু পুলিশের হাতে ধরা পড়লে যদি কারো নাম বলিশ তবে জেলের ভিতরেই তোকে মেরে ফেলা হবে।
সুজন সব কিছু মেনে নিয়ে সকাল বেলায় ওর কুটিরে চলে আসে।
মায়া
সারারাত দরহার পাশে বসেই কাটিয়েছে, কখন সুজন আসব, তাকে খেতে দিয়ে তারপর নিজেও খেয়ে
ঘুমাবে৷ সুজন এলো ভোর বেলায়, দেখে মায়া ভাতের থালা সব ঢেকে চৌকির কোনায় মাথা লাগিয়ে
ঘুমিয়ে আছে৷ আস্তে করে ডাক দিতেই মায়া লাফিয়ে উঠে বলে, সারা রাত কোথায় ছিলে?
সুজন
মায়ার হাতে ১০হাজার টাকা দিয়ে বলে এই নাও ১০হাজার টাকা৷
এবার তুমি ডাক্তারি
পড়ার সব তৈয়ার করে নাও। টাকার আর কোন অভাব হইবোনা৷
মায়াঃ
তুমি এতো টাকা কোথায় পেলে?
সুজনঃ
নতুন একটা কাম পাইছি, তোমার ডাক্তারি পড়তে আর কোন অসুবিধা হইবোনা৷
যতো টাকাই লাগুক।
মায়াঃ
সত্যি বলছো?
সুজনঃ
হুম সত্যিই!
মায়াঃ
এখনো সময় আছে, আমি তাইলে আইজকাই ফরম কিনে আনবো, পরিক্ষায় টিকতে পারলে আর কোন চিন্তাই
থাকবোনা৷
সুজনঃ
তুমি ডাক্তার হইবা, আমি তোমার রোগী হমু।
কি মজা হইবো তূইনা!
মায়াঃ
হইছে, তোমার রোগী হওনের দরকার নেই৷ এখন গোসল করে আসো আমি খাবার গরম করে দেই৷
সুজনঃ
আইচ্ছা গামছাটা দাও তাইলে।
এভাবেই
চলে যাচ্ছে ওদের ব্যাচেলর সংসার।
মায়া
এখন মেডিক্যালে ভর্তি পড়ছে । বকুলকেও ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। সুজন এখন জাফরের
অন্ধকার জগতের বিশ্বস্ত বাসিন্দা। জাফরের যতো চোরাকারবারি লেনদেন সব সুজন করে৷ সুজন
এখন আগের চেয়ে অনেক স্মার্ট সুদর্শন হয়ে গেছে৷ আগের প্রহরীর কাজ ছেড়ে দিয়েছে৷ সে বাসা
রেখে নতুন ফ্ল্যাট বাসায় উঠেছে৷ সুজনের খাওয়া দাওয়া কিছুই সময় মতো হয়না। কখন বাসায়
আসে যায় ঠিক নেই৷ দিনের বেলায় প্রায়ই জাফরের চেলা চামচারা ডেকে নিয়ে যায়। গভীর রাতেও
ফোন করে নিয়ে যায়৷ এ নিয়ে রোজই সুজনের সাথে মায়ার কথা কাটাকাটি থেকে ঝগড়া শুরু হয় ওদের
মাঝে। এসব বকুল যেনো না দেখে তাই মায়া বুকলকে আবাশিক হোস্টেলে রেখে পড়ানোর ব্যাবস্থা
করেছে৷ মায়া এক সময় সুজনের এসব কাজে বিরক্ত হয়ে মায়াও সুজনকে রেখে কলেজের হোস্টেলে
উঠে যায়৷ সুজন বাড়ি এসে মদ খেয়ে অসহায়ের মতো পড়ে পড়ে ঘুমায়।
এক সময়
সুজন যায় মায়ার সাথে দেখা করতে। সুজন বলে মায়া তুমি নেই বকুল নেই, তাই বাসাটা কেমন
খালি খালি লাগে৷ চলো বাসায় থেকে ক্লাশ করো, আমি গাড়ি করে রোজ নামিয়ে দেবো৷
মায়াঃ
তুমি এখন অনেক বদলে গেছো, সব সময় বাজে লোকদের সাথে তোমার উঠাবসা।
আমার ভীষণ ভয় লাগে
ওদেরকে।
সুজনঃ
তুমি জানো ওদের সাথে চলি বলেই আজ তুমি এখানে পড়তে পারছো৷
মায়াঃ
আমি বলছিনা তুমি ওদের সাথে চলোনা৷ আমি বলতে চাইছি যতদিন আমি পাশ না করে বের হই ততদিন
এখানেই থাকবো।
সুজনঃ
তাহলে তুমি ফিরবেনা?
মায়াঃ
তুমি কি আমায় ডাক্তার হিসেবে দেখতে চাও?
সুজনঃ
অবস্যই!
মায়াঃ
তাহলে আমায় এখানে থাকতে দাও।
সুজনঃ
ঠিক আছে, আমি চলি তাহলে।
মায়াঃ
আমার টাকা লাগবে।
সুজনঃ
তোমার একাউন্টে টাকা আমি রেখে দিয়েছি৷ উঠিয়ে নিও যা লাগে। আর তোমার কলেজের যত খরচ আমি
সব কলেজের ফান্ডে জমা করে দিয়েছি৷
তোমায় বলতে ভুলে
গিয়েছিলাম। আজকাল নিজের জীবনের প্রতি একদমি বিশ্বাস পাইনা।
মায়াঃ
সুজন তুমি আমার জন্য অনেক করেছো, আর দুটো বছর অপেক্ষা করো, তারপর আমরা এখান থেকে অনেক
দূরে চলে যাবো৷ যেখানে ঐসব লোক তোমায় আর ডাকতে আসবেনা। প্লিজ সুজন রাগ করোনা।
সুজনঃ
আচ্ছা চলি আমি।
সুজন
চলে আসে, মায়া ভেতরে চলে যায়৷ এভাবেই পার হয়ে গেলো দুটি বছর৷
সুজন এখন অন্ধকার
জগতের বাদসা, নিজের বাড়ি গাড়ি সব হয়েছে। বাসায় চাকর বাকরের অভাব নেই৷ বকুল এখন বেশ
বড়ো হয়ে গেছে। একদিন বকুলের হোস্টেল থেকে ফোন এলো সুজনের কাছে। বকুল ভীষণ অসুস্থ, সুজন
বকুলকে বাসায় নিয়ে এলো। বকুল মায়ের জন্য ভীষণ কান্না করছে। সুজন মায়াকে কল করে আসতে
বলায় মায়া আসতে পারবেনা বলে জানিয়ে দেয়৷
সুজন তা শুনে রেগে
গিয়ে বলে জোর করে আসতে বলায় মায়াও রেগে যায়৷
একসময় মায়া বলে,
বকুল সবসময় মা মা বলে কাঁদছে তা আমি কি করবো? আমি ওর মা নই!
সুজন
কথাটা শুনে একেবারে আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা হলো। মোবাইল হাত থেকে পড়ে গেলো। তারপর
দেরি না করে তখনি মায়ার হোস্টেলে পৌছে গেলো সুজন। মায়াকে জিগ্যেস করলো মায়া তুমি মা
হয়ে কি করে বকুলকে আজ অস্বীকার করলে?
মায়াঃ আমি সত্যি বলছি, বকুল আমার কেউ না।
সুজনঃ
তাহলে কে?
মায়াঃ
আমিও জানিনা, আমি ওকে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। আর আমি একজন অবিবাহিত মেয়ে। তাই মা
হওয়ার কোন প্রশ্নই আসেনা।
সুজনঃ
তাহলে এতোদিন কেনো বলোনি? আর আগেইবা কেনো বলেছিলে বকুল তোমার সন্তান?
মায়াঃ
তখন বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাছাড়া কোন উপায় ছিলোনা।
সুজনঃ
তার মানে তুমি এতগুলি বছর আমার সাথে মিথ্যে বলে আসছো?
মায়াঃ
হ্যা, আর আমি তোমায় আগেই বলতে চেয়েছিলাম৷ পরিস্থিতি আমায় বলতে দেয়নি৷
আর পরীক্ষার পর আমি
সব বলতাম তোমার কাছে৷
সুজনঃ
তাহলে তুমি কে?
মায়াঃ
থাকনা সুজন, আগে পরীক্ষাটা হতে দাও সব বলবো বাসায় এসে৷ আর তো একটি মাসের ব্যাপার৷
সুজনঃ
তুমি কি বলবে আর বলবেনা তা শুনার ইচ্ছে নেই এখন, বকুল কান্নাকাটি করছে, প্রচুর জ্বর৷
তাই তুমি যাবে ওর কাছে এখন।
মায়াঃ
ওহ্ সুজন একটু বুঝার চেষ্টা করো, সামনে আমার পরীক্ষা, তুমি একটু সামলে নাও ওকে৷
সুজনঃ
ঠিক আছে, মা হয়ে না গেলে, একজন ডাক্তার হয়ে রোগীর কাছেতো যেতেই পারো৷ বলো কতো টাকা
বিজিট লাগবে?
সুজনঃ
তুমি আমার উপর জোর খাটাতে পারোনা৷ তাছাড়া তুমি আমার উপর জোর খাটাবার কে? ঘরের বউতো
নই আমি তোমার৷
সুজনঃ
এসো তবে, আজি তোমায় বিয়ে করে বউ বানাবো।
মায়াঃ
কি পাগলামো করছো? সবাই দেখছে।
সুজনঃ
আর কি পাগল করার বাদ রেখেছো আমায়? এতটা দিন তুমি আমার সাথে প্রতারণা করে আসছো৷
মায়াঃ
আমি কোন প্রতারণা করিনি তোমার সাথে৷ তুমি যদি মনে মনে কিছু ভেবে থাকো তাবে তা তোমার
ভুল৷
সুজনঃ
আমার ভুল ! হ্যা তাইতো আমারি ভুল৷ আমার কথা না ভেবে তোমার স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য
নিজেকে অন্ধকার জগতে হারিয়ে ফেলেছি, এটাই আমার ভুল। আরো অনেক ভুল আমি করেছি এতগুলো
বছরে, আজ তা পুষিয়ে নেবো চল আমার সাথে।
মায়াঃ
কি অসভ্যের মতো টানা হিচড়ে করছো?
সুজনঃ
আজি তোকে বিয়ে করবো আমি।
মায়াঃ
তুমি আমাকে আজ বলছো বিয়ে করবে? তোমার দুটো পয়সা হয়েছে বলে নিজেকে ভুলে যেতে পারো দামী
পোশাকের ভিতর, কিন্তু আমি নই৷ তুমি একজন সমাজের অবৈধ পথের যাযাবর, কি করে ভাবলে তুমি
বিয়ে করতে চাইলেই এখন আমি তোমার হাত ধরে চলে যাবো অনিশ্চিত যাত্রায়? একদিন ঠিকই মনে
মনে ভেবেছিলাম তোমায় বিয়ে করবো, কিন্তু আজ তুমি আর আমি অনেক ব্যাবধানে এসে গেছি।
সুজনঃ
ওহ্ তাইতো, কেনো বিয়ে করবে আমায়? আরে তুমিতো সমাজের একজন ভদ্র ডাক্তার, মানুষের ভগবান৷
আমিতো গুন্ডা বদমাশ, কিন্তু একবার ভেবে দেখেছো? আমি কেনো আজ গুন্ডা বদমাস?
মায়াঃ
অতীত দিয়ে জীবন চলেনা, আর অতীতের কর্মফল দিয়ে বর্তমান বিচার করাটা বোকামি৷
সুজনঃ
হো ঠিকই বলেছো, আমি আসলেই বোকা। বোকা না হলে কি তোমার মতো অকৃতজ্ঞর জন্য নিজের জীবন
ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতাম? তবো শেষ বারের মতো বলছি, বকুলের জন্য একবার আমার সাথে চলো।
মায়াঃ
আমি ঔষধ লিখে দিচ্ছি, দোকান থেকে কিনে খাইয়ে দিও৷
সুজনঃ
চুপ কর হারামজাদি! আমি ইচ্ছে করলে দেশ বিদেশের অনেক বড় বড় ডাক্তার টাকা দিয়ে বকুলের
চারপাশ ভরে রাখতে পারি৷ তুই যাবি কিনা বল?
মায়াঃ
এতখন আমি অনেক সহ্য করেছি, এবার কিন্তু আমি দারোয়ান ডাকতে বাধ্য হবো৷
কথাটা শুনে সুজন
কষে একটা চর মারে মায়ার গালে। মায়া চারপাশে খেয়াল করে দেখে সবাই দেখছে, তাই অপমানের
শোধ নিতে মায়াও পাল্টা চর মারে সুজনের গালে। আর বলে, তোর মতো দুটাকার ভারাটে গুন্ডা
আমার গালে চর মারার সাহস করিস? আমি যদি এখন বলি এখানে সকল ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে তোকে
মেরে এখান পুলিশে দিয় সারা জীবন জেলের ঘানি টানাতে পারি৷ তুই আমাকে বিয়ে করতে চাস?
আরে আমাকে বিয়ে করার জন্য এই কলেজের এক ডজন টিচার লাইন ধরে আছে৷ যাদের সমাজে উচ্চ মর্যাদা
রয়েছে৷ তোর কি আছে? তুইতো একটা জিন্দা লাশ, শুধু কবরটাই বাকি৷ তাও হয়ে যাবে খুব তারাতারি৷
সুজনঃ
তোকে আর কিছু বলার নেই আমার, আমায় মাফ করে দিশ। তবে আজ থেকে কোন পুরুষ মানুষ কোন মেয়েকে
বিশ্বাস করবেনা, শুধু তোর জন্য। চলি, পারলে সুখ খুঁজে নিয়ে সুখী হোস, দেখ পারিস কি
না! কারন সুখ দুখের মালিক ঐযে উপরওয়ালা, যার কাছে মিথ্যে বলে কেউ পার পায়নি কোনদিন৷
ভালো থাকিশ। সুজন কথাগুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে কলেজ থেকে বেরিয়ে গেলো৷
মায়া জোরে জোরে বললো,
তোর পাশে চাঁদনীর মতো নষ্টা মেয়েকেই মানায়, ওকে নিয়েই সংসার কর। না হয় দালালী করে বাকি
জীবন পার করে দে।
মায়ার
পাশে ওর বান্ধবী তানিয়া এসে বললো, তুই ঠিক করেছিস মায়া৷ এমন গুন্ডা মাস্তানের সাথে
থাকলে কোনদিন সুখী হতিস না৷ আমি তোকে বারবার
বলেছি, সময় থাকতে কিছু টাকা পয়সা হাতিয়ে নে। শুনিসনি কথা৷
মায়াঃ
একটু একা থাকতে দে প্লিজ।
তানিয়াঃ
থাক ওসব পরে ভাবা যাবে, এখন তুই মুক্ত স্বাধীন। এই খুশীতে চল একটু মজা করে ড্রিংক করে
আসি৷
সুজন
রাগ করে চলে আসার পর আর কোন যোগাযোগ হয়নি মায়ার সাথে৷
মায়াও একটিবার আসেনি
বাসায়৷ এদিকে মায়ার পরীক্ষও আজ শেষ হলো। সবাই যার যার মতো বাড়ি চলে যাচ্ছে। মায়া চুপ
করে বসে আছে সিটের উপর৷ তানিয়াও বিদায় নিয়ে চলে গেলো,
মিনি তখন একটি চিঠি
ধরিয়ে দিলো মায়ার হাতে৷ মিনি ওর বান্ধবী, চিঠিটা পরীক্ষা চলাকালিন পেয়েছিলো। মায়ার
হাতে পড়ার আগে মিনির হাতে পড়ে৷ মিনি পড়ে দেখে সুজন ওকে ফেলে বকুলকে নিয়ে চলে গেছে৷
মায়ার পরীক্ষা খারাপ হবার ভয়ে ওকে আগে দেয়নি৷ মিনি কাগজটা পড়ে, তাড়াতাড়ি চলে আসে বাসায়৷
বাসায়
কলিংবেল বাজাতেই চাঁদনী এসে দরজা খুলে দিলো৷
মায়াঃ
তুমি এখানে?
চাঁদনীঃ
তোরতো এ বাসায় আসার কথা নয়!
মায়াঃ
ভদ্র ভাবে কথা বল, সুজন আর বকুল কোথায়?
চাঁদনীঃ
ওরা তোর জীবন থেকে মরে গেছে৷
মায়াঃ
বাজে কথা রেখে বল ওরা কোথায় আছে।
চাঁদনীঃ
ভেতরে ঢুকার সাহস দেখালে দারওয়ান ডাকতে বাধ্য হবো৷ সুজন চলে গেছে বকুলকে নিয়ে, কোথায়
গেছে জানিনা৷ জানলে তোর আগে আমিও ওদের সাথে যেতাম৷ যে শহরে তোর মতো মেয়ে রয়েছে সে শহরটা
বিষাক্ত হয়ে গেছে বাংলার সব নারীর জন্য৷
মায়াঃ
ওরা আমাকে ফেলে চলে গেছে?
চাঁদনীঃ
হ্যা, যাবার আগে ওর সব কিছু আমাকেই দিয়ে গেছে৷ আর একটা অনুরোধ করেছে, তুই এলে যেনো
এই চাবিটা দেই তোর হাতে৷ এটা একটা ক্লিনিকের চাবি৷
তুই ডাক্তার হয়ে
মানুষের সেবা করবি ভেবে তোর জন্য একটা ক্লিনিক খুলেছিলো৷
এই নে এটা নিয়ে চলে
যা।
মায়া
এটা শুনে আর দাড়িয়ে থাকতে পারলোনা৷
চাবিটা
না খুটেই বেরিয়ে এলো৷
কোথায়
যাবে কিছুই মাথায় আসছেনা৷
অবশেষে মিনির বাসাতে
আশ্রয় নিলো। মায়া মিনির বাসায় এসে ওর কয়েকজন বয়ফ্রেন্ডদের কাছে বিয়ের কথা বলতেই সবাই
মুখের উপর মানা করে দিলো৷ কেউ বললো সহায়সম্বলহীন মেয়ে বিয়ে করে ছোট হতে পারবে না৷ কেউ
আবার সুজনের সাথে বেঈমানী করার কথা নিয়ে ঝগড়া করে মানা করে দিলো৷ মায়া কারো কাছেই মুখ
পেলোনা৷ মিনিও ওকে সুজনের সাপোর্ট নিয়ে কথা বললো৷
মায়াঃ
মিনি তুইয়ো বলছিস ঐ গুন্ডার হয়ে কথা?
মিনিঃ
সুজন কি ছিলো, আর কি হয়েছে সবি তোর কাছ থেকে এ ৫ বছরে অনেকবার শুনেছি৷ তুই কিন্তু সুজনের
প্রেমে একদিন অন্ধ ছিলি।
মায়াঃ
সেদিন আমার কোন উপায় ছিলোনা৷ কারন আমার একটা
আশ্রয়ের খুব প্রয়োজন ছিলো৷
মিনিঃ
আজ পেয়েছিস কারো কাছে আশ্রয়? আজ তো তুই কোন রাস্তার মেয়ে না,
সমাজে পরিচয় করেছিস
তোর। তবে কেনো কারো কাছে আশ্রয় পেলিনা জানিস?
মায়াঃ
কেনো?
মিনিঃ
কারন এটা তোর প্রায়শ্চিত্ত!
মায়াঃ
প্রায়শ্চিত্ত?
মিনিঃ
হ্যা তাই। তুই যে অন্যায় করেছিস সুজনের সাথে, তাতে তোর কপালে আরো অনেক কষ্ট আছে। কথাটা
তেতো হলেও সত্য৷ সমাজে একটা মেয়ে যত বড়ই হোকনা কেনো, তার পাশে কোন পুরুষ না থাকলে কোন মূল নেই৷ যদিও পুরুষটি
অন্ধ, কান্ লুলাও হয় তবো তার পরিচয়ে বাঁচা যায়। তা না হলে সমাজের এলোমেলো বাঁকে কখন
মেয়েরা অন্ধকারে হারিয়ে যায় বুঝতে পারেনা। তুইয়ো পারবিনা৷ এখনো সময় আছ, সুজনকে খুঁজে
বের কর, ওর পায়ে ধরে ক্ষমা চা৷ তুই যে ডাক্তার হয়ে ওকে ফেলে দিলি, সেই কিন্তু তোকে
ডাক্তার বানিয়েছে৷
কথাটা মনে রাখিস,
ওর মতো ছেলেরা পাশে থাকলে স্বর্গটা পৃথিবীর বুকেই দেখা যায়।
মায়াঃ
আমার ভীষণ ভুল হয়ে গেছে৷ সুজন আমায় ক্ষমা না করলে আল্লাহও আমাকে ক্ষমা করবেনা৷
মায়ার কাঁদার শুরু ওখান থেকেই৷ মায়া চাঁদনীর
কাছে বেশ কয়েকবার এসেও সুজনের ঠিকানা নিতে পারলোনা।এর ফাঁকে একটা বেসরকারি ক্লিনিকে
মায়া চাকরি জুটিয়ে নেয়।
মায়া মিনির বাসা
থেকে চলে এসে এক একটি বাসা ভারা করে থাকে৷ এভাবেই কয়েকমাস থাকার পর রেজাল্ট হয়ে গেলো।
মায়া
ভালোভাবেই পাশ করেছে৷ একটা সরকারী হাসপাতালে চকুরীও হয়েছে৷
থাকার জন্য বাসা,
চলার জন্য গাড়ি সবি পেয়েছে৷ পায়নি শুধু মনের শান্তি৷ তারপর চলে গেলো আরো তিনটি বছর।
একদিন
রাতে একা একা হাসপাতালের চেম্বারে বসে সুজন আর বকুলের পুরনো ছবি দেখে নীরবে চোখের জল
ফেলছে৷ আজ হঠাৎ সুজনকে বেশি মনে পড়ছে৷ তখনি এক নার্স এসে বললো এক গুলী খাওয়া রোগী নিয়ে
এসেছে পুলিশের গাড়ি করে৷ খুব সিরিয়াস এখনি দেখতে হবে৷ মায়া চোখের পানি মুছে, রোগীর
পাশে দাড়িয়ে দেখে, এতো সুজন! মূহুর্তের মধ্যেই
সে ভুলে গেলো সে একজন সরকারী ডাক্তার৷ খুব করে ডাকাডাকি করতে লাগলো৷ নার্স এসে মায়াকে
সামলে নিলো৷ মায়া তারাতারি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গুলি বের করে আনলো। সুজনের জ্ঞান
ফিরছেনা৷ আর ফেরার সম্ভাবনা নেই৷ মদ খেয়ে খেয়ে পেটের লিভারে ঘা ধরিয়ে ফেলেছে৷ তার উপর পুলিশের গুলিগুলো পেট আর বুক ছিড়ে ছিন্নভিন্ন
করে দিয়েছে৷ মায়া অনেক চেষ্টা করেও সুজনকে আর বাঁচাতে পারলোনা৷ ও শেষবারের মতো একটু
ক্ষমা চাওয়ার সুজোগটাও পেলোনা৷
মায়ার বুক ফাটা আর্তনাদে
হাসপাতাল কাঁপাতে লাগলো৷
অবশেষে
পুলিশ আর নার্স এসে মায়াকে সরিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক করে। মায়া বারান্দায় এসে দেখে বকুল
দাড়িয়ে আছে। মায়া বকুলকে দেখে ধরতে গেলেই বকুল দৌড়ে সরে যায়৷।
আর বলে তোমার জন্য
বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, বাবার আত্মা কোনদিন তোমায় মাফ করবেনা, আমি যতদিন বেঁচে থাকবো
আমিও মাফ করবোনা৷ বকুল এসব বলে কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলো। মায়া বকুলকে
ধরতে পারলোনা৷
বাহিরে
এসে বকুল অন্ধকারে হারিয়ে গেলো৷ মায়া আবার ভেতরে এসে সুজনের লাশ ধরে কাঁদতে লাগলো৷
শেষমেষ সুজনের পোষ্ট-মর্টেম মায়া নিজেই করলো। তারপর সকালে লাশটা সেই পার্কের এক কোনায়
দাফন করে দিলো। মায়া সারাদিন কবরের পাশে বসেই কেঁদে চলেছে৷
একসময়
পার্কের নতুন প্রহরী মায়াকে ধাক্কা দিয়ে বলে রাত হয়ে গেলো যাবেন না?
মায়া উঠে দাড়ালো।
কবরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলতে লাগলো, আমার জন্যই সুজন অন্ধকার জগতে পা বাড়িয়েছিলো।
মায়ার মনে অনুশোচনার
ঝড় বয়ে যাচ্ছে, যে ওর জন্য এতোকিছু করেছে, তাকেই অকৃতজ্ঞের মতো অপমান করেছে। দূর থেকে
চাঁদনী আর বকুল মায়াকে দেখতেছিলো।
অবশেষে
মায়া সুজনের কবর থেকে উঠে এসে দ্রুত গাড়িতে বসে যায় চাপা কান্না বুকে নিয়ে।
চাঁদনী
আর বকুল তখন কবরের পাশে এসে বসে পড়ে।
তারপর
মায়া ধীরে ধীরে চলে আসে ওর গ্রামের বাড়ির দিকে, চারদিকে জোসনার আলো জ্বলছে। সেই বকুল
গাছটার নীচে গাড়ি ব্রেক করে ধিরে ধিরে সেই গাছের নিচে আসলো।
সুজনের কথা ভেবে
ভেবে ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে বকুল গাছের ডালে কাপড় পেচিয়ে ঝুলে পড়লো মায়া।
চিরতরে
শেষ হয়ে গেলো তিনটি জীবনের গল্প পৃথিবীর বুক থেকে।
লোভ মানুষকে সাময়িক
প্রশান্তি দিলেও নষ্ট করে দেয় চিরতরে বেঁচে থাকার শান্তি