রূপক গল্প
গোপন প্রত্যাঘাত
সামসুন নাহার
রাত্রিকালীন
সময় ।স্থান আফ্রিকান সাফারি ।পশুরাজ সিংহ ফ্যামিলির সঙ্গে ডিনার করছেন । গিন্নি সিংহী
কর্তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, হ্যাঁগো তোমার কপালে দুশ্চিন্তার রেখা দেখছি যে!
--- মন্দ বলোনি গিন্নি, দুশ্চিন্তা একটু করছি
বটে।
---
কিরকম দুশ্চিন্তা তাকি জানতে পারি?
---
পারো বৈকি, তুমি যে আমার সহধর্মিণী। একথা বলে পশুরাজ ,সিংহীকে সবিস্তারে তার চিন্তিত
হওয়ার কারন সমূহ বর্ণনা করতে আরম্ভ করলেন ।
এই যে
বানরের বংশধর মানব জাতি, যারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রাণী নামে বড়াই করে, আজ তাদের কার্যকারিতায়
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জীবকূলের জীবন সংশয় ঘটছে । আর তাতে তো মনুষ্য
প্রজাতির কোন হেলদোল দেখছি না । এইভাবে চললে জীব-বৈচিত্র নষ্ট হবে এবং পৃথিবী ধ্বংসের
মুখে পড়বে ।
সিংহের
কথাগুলো শুনে সিংহী ও ভয়ানক চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন এবং এর বিহিত কিভাবে করা যায়
সেই উপায় খুঁজতে লাগলেন । অনেক ভাবনা চিন্তা করে গিন্নি সিংহী সিংহকে বললেন,
মহারাজ ! আপনি এক
কাজ করুন, সমস্ত প্রাণীকূলকে নিয়ে এক মহা আলোচনা সভার আয়োজন করুন । তারপর সকলের কথা
শুনে কি করা যায় তার নির্ণয় নিন ।
---
তুমি আমায় বাঁচালে গিন্নি । খানিক চিন্তা মুক্ত হলাম ।
তারপর সিংহ একটি
নির্দিষ্ট দিন ধার্য করে সকল প্রাণীকূলকে একত্রিত করলেন ।সুদূর থাইল্যান্ড থেকে এলেন
সাদা হাতি, অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারু, আফ্রিকা থেকে জিরাফ, নিউজিল্যান্ড থেকে কিউই পাখি,
ভারতের সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কাজিরাঙার একশৃঙ্গ গন্ডার, কুমির, হাঙ্গর,
তিমি, শালিক, চড়াই সহ সমস্ত পাখিরাও সেই সভায় উপস্থিত হল।
এবার
মহারাজ সিংহ শেয়াল পন্ডিতকে ডেকে সভাপতি নিযুক্ত করলেন । শেয়াল উঠে দাঁড়িয়ে সকলের
উদ্দেশ্যে অভিবাদন জানিয়ে বলল, বিশিষ্ট মহোদয়গণ, এক মহৎ উদ্দেশ্যে আজকের এই সমাবেশের
আয়োজন করা হয়েছে। মনুষ্য জাতীর বদান্যতায় আজ পৃথিবী ধ্বংসের মুখে। ভয়ঙ্কর ভবিষ্যত অপেক্ষা
করছে সকলের জন্য। আজ আমাদের অনেক সহোদর প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে । অনেকে আবার বিলুপ্তির
পথে। এবিষয়ে আমাদের কি করনীয় বলে আপনারা মনে করেন? একথা বলে শেয়াল পন্ডিত প্রথমেই
মেরু ভালুককে ডেকে নিলেন।
মেরু
ভালুক উঠে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, নমস্কার বন্ধুগণ, আমি এসেছি সুদূর সুমেরু
মহাদেশ থেকে। আগে আমরা সহজেই পুরু বরফের উপর দাঁড়িয়ে আমাদের প্রধান খাদ্য সিলমাছ
শিকার করতাম। কিন্তু এখন বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলে যাচ্ছে। তাই একদিকে যেমন আমাদের
বসবাসের জায়গা কমে যাচ্ছে তেমনি শিকার করতে খুব সমস্যা হচ্ছে। ভীষণ কষ্টের মধ্যে দিন
কাটাচ্ছি আমরা। খিদের জ্বালায় পুরুষ ভালুকরা বাচ্চা ভালুকদের খেয়ে ফেলছে। আমাদের
সংখ্যাও কমতে শুরু করেছে। এরকম চলতে থাকলে পৃথিবীতে আমাদের প্রজাতি খুব শীঘ্রই ধ্বংস
হয়ে যাবে ।
সভাপতি
শেয়াল বলল, ভালুক ভায়ার কথা শুনে যা বুঝলাম,
তারা মারাত্মক বিপদে' দিন কাটাচ্ছে। এই কথা বলে, শেয়াল এবার হাতিদের এক প্রতিনিধিকে
ডেকে নিল।
হাতি
শূঁড় দুলিয়ে সকলকে সেলাম জানিয়ে তার বক্তব্য শুরু করল --- বন্ধুগন, আমি সুদূর বর্মা
থেকে এসেছি । আগে আমরা ভীষণ সুখে দিন কাটাতাম। নদীর তীরে জ্যোৎস্নালোকে বসে প্রিয়তমার
সাথে কত গল্প করেছি, জলকেলিতে মেতেছি। কিন্তু এখন জঙ্গল কেটে নগরায়ন হয়েছে । ফলে
আমাদের বসতি ও খাদ্যের অভাব যেমন দেখা দিয়েছে। তেমনি আমাদের প্রাইভেসিও নষ্ট হয়েছে
।
হাতির
পর শেয়াল পন্ডিত ডেকে নিলেন ক্যাঙ্গারুকে ।
---
হ্যালো ফ্রেন্ড ,আমি অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা । আজ মানুষের বিবেচনাহীন কাজের জন্য আমরা
চরম দূর্দশার সম্মুখীন হয়েছি। যেহেতু আমরা ভেজিটেরিয়ান, গাছগাছালি, লতাপাতাই
আমাদের প্রধান খাদ্য
। কিন্তু গাছপালা কমে যাওয়ার জন্য আমরা চরম দূর্দশার শিকার হয়েছি। ছানাদের মুখে খাবার
তুলে দিতে না পারায় সবসময় মনোকষ্টে ভুগছি।
একথা
শুনে জিরাফ বলে উঠল, ক্যাঙ্গারু ভায়ের
সাথে আমি ও সহমত পোষণ করছি। আমরা ও ভেজিটেরিয়ান, তাই একই সমস্যা আমাদেরও ।
এবার সিংহের উদ্দেশ্যে কুমির বলল, মহারাজ,
মানুষ জাতির লোভ লালসার কারণে আমরা আমাদের শক্তিশালী সহদর ডাইনোসরকে চিরদিনের জন্য
হারিয়ে ফেলেছি। ডোডো আর হুইয়া পাখিদের বংশ নির্বংশ হয়ে গেছে। শকুন, একশৃঙগ গণ্ডার
ও আরো কিছু প্রাণী প্রায় হারাবার পথে। অথচ আমরা নিকৃষ্ট প্রাণী হয়েও প্রতি নিয়ত
পরিবেশের কত উপকার করে চলেছি।
কুমিরের
সঙ্গে একমত হয়ে শালিক পাখি বলে উঠল, বন্ধুরা, আমি এক অতি সাধারণ শালিক পাখি। পৃথিবীতে
প্রত্যেক দিন আমি যে পরিমাণ গাছ লাগাই, সারা জীবন ধরে একজন মানুষ তা লাগাতে পারে না।
সভাপতি
শেয়াল বলে উঠল, শালিক ভায়ার বক্তব্য তিনি যদি একটু ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেন তাহলে
খুব ভালো হতো। রাজামশাই ও উপস্থিত প্রতিনিধিগণ শেয়ালের কথায় সহমত হলেন।
শালিক
বলল, আমরা যেসব ফল খাই, সেই ফলের বীজ মুখে করে অন্যত্র ফেলি এবং আমরা যেখানে পটি করি
সেইসব স্থানে গাছ জন্মায়। শালিক পাখির কথা শুনে সকলেই হতবাক।
এবার
ডেকে নেওয়া হল, গণ্ডার ভায়াদের একজন প্রতিনিধিকে। গণ্ডার ভায়া হেলেদুলে বিষন্ন মুখে
গিয়ে বলল, মহারাজ ও সকলের উদ্দেশ্যে প্রণাম। আমি ভারতের কাজিরাঙা থেকে এসেছি। আমাদের
প্রধান সমস্যা হল আমাদেরই মাথার এই মূল্যবান খড়্গটি। শিকারীর দল এই খড়গের লোভে নৃশংস
ভাবে আমাদের হত্যা করছে। তাই দিনে দিনে আমাদের সংখ্যা কমছে।
সবশেষে
এল রয়েল বেঙ্গল টাইগার। হুঙ্কার দিয়ে বলল, নমস্কার । আমি হলাম ভারতের জাতীয় পশু
। বিখ্যাত সুন্দর বনে আমার বাস। গাছ কেটে কলকারখানা ও বসতি স্থাপনের জন্য আমরা খাদ্য,
বাসস্থান দুইয়েরই অভাবে অনেক সময় লোকালয়ে ঢুকে পড়ি এবং মানুষের হাতে প্রাণ হারাই।
কিছু মানুষ আবার নিজের শৌর্য বীর্য প্রমাণ করতে আমাদের হত্যা করে বাহাদুরি প্রকাশ করে।
লোভি শিকারীর দল আমাদের ছাল, নখ ও হাড়ের লোভে আমাদের মেরে ফেলে। এত ষড়যন্ত্রের মাঝে
কি বাঁচা যায়? তাহলে আপনিই বলুন মহারাজ, কি হবে আমাদের উপায়? আপনাকে ভাবনা-চিন্তা
করে কিছু একটা উপায় বের করতেই হবে । সবাই একসাথে বলে উঠল , উপায় বের করতেই হবে
…. করতেই হবে…..
মহারাজ
সিংহ এবার মুখ খুললেন । তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, মানুষের অপকর্মে সব প্রাণীরাই
আজ জরাগ্রস্ত, নানা রকম রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে , ভাইরাস জনিত রোগেও আক্রান্ত
হচ্ছে আবার ওই ভাইরাসগুলোই এই পণ্ডিত দ্বিপদী প্রাণীদের ও আক্রমণ করছে। তাঁরা নিজেরাও
ক্ষতি গ্রস্ত হচ্ছে। যেমন, করোনা ভাইরাস আমাদের থেকেই মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে। বাদুর, শূকর,
শিম্পাঞ্জি তোমরা সবাই একথা জান, এর আগেও দু-একবার মানুষের মধ্যে এসব ভাইরাস জনিত রোগ
ছড়িয়ে ছিল এবং মহামারী আকার ধারণ করেছিল। তবে আমাদেরকে যে কোন মূল্যে এই সুন্দর পৃথিবীটাকে
রক্ষা করতে হবে। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে পৃথিবীর পরিবেশকে রক্ষা করবোই।
এই মন্ত্রে
দীক্ষিত হয়ে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে পরিবেশ রক্ষার কাজে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে
পড়ল।