ছোটগল্প
রবীন্দ্রনাথের ছবি
সৈয়দ আসরার আহমদ
এ বছর
শৈত্যপ্রবাহের জন্য জাঁকিয়ে শীত পড়েছে৷ রেজাউল এখন বিপত্নীক৷ তার ঘুম আসতে অনেক
দেরী হয়৷ বয়স বেড়েছে আর ঘুম কমেছে৷কখনও কখনও রাত দুটো বেজে যায়৷ কখনও আবার ফজরের
আজানের সময় ঘুম আসে৷ যখন ঘুম আসে না তখন স্মৃতিরা এসে ভীড় করে৷একেকদিন একেক
স্মৃতির রোমান্থনে রেজাউলের তেমন খারাপ লাগে না৷ লেখিকা প্রতিভা বসু ঠিকই
বলেছিলেন,'স্মৃতিরা সতত সুখের'!
শীতের রাত খুব বড় হয়৷ ঘরের ডিমড বাল্ব
জ্বালিয়ে রেজাউল কম্বল জড়িয়ে বিছানায় পড়ে আছে৷ আজ প্রায় ৪৯ বছর আগের স্মৃতি তার
চোখের সামনে খুলে গেল৷ মনে পড়ে গেল সেই শীতের রাতে কলকাতার মেসবাড়ির তক্তোপোশে লেপ
গায়ে দিয়ে ঘুমাতে পারছিল না সে৷ সেদিন ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল তার৷ সে তীব্র এক অব্যক্ত
যন্ত্রণায় ছটফট করছিল৷ গরম অনুভূত হওয়ায় একবার লেপটা সরিয়ে দিয়েছিল৷ কিন্তু শীত
অনুভব করায় ফের গায়ে তুলে নিয়েছিল৷ ওই অবস্থায় কারই বা ঘুম আসে৷ কবিগুরুর ছবিটাকে
তক্তোপোশের নিচে খবরের কাগজের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছিল৷ সেদিন লুকিয়ে রাখার যথেষ্ট
কারণও ছিল৷ কেন না প্রেসিডেন্সি কলেজের তার চারজন সহপাঠি চারু মজুমদারের কমরেডরা
যারা কিছুক্ষণ আগে কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে যখন সন্ধ্যাবেলায় তার
মেসবাড়িতে এসেছিল বিফ রোল খেতে তখন সে তার ঘরের এক কোণে রাখা কবিগুরুর ছবিটায়
ধুপকাঠি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছিল৷ সেসময় রেজাউলের ঘরের দরজা ভেজানো ছিল৷ রাজা
চক্রবর্তী,শহীদুল ইসলাম,তপন দাস আর দীপক ঘোষ হইচই করে ঘরে ঢুকে রেজাউলকে জিজ্ঞেস
করে, ধুপকাঠি জ্বালিয়ে ঘরের কোণে কি করছিস রে?
রাজা চক্রবর্তী রেজাউলের পিছনে দাঁড়িয়ে
রবীন্দ্রনাথের ছবিতে রেজাউলের ভক্তি প্রদর্শন দেখে গর্জে উঠল,শ্লা, তুই বুর্জোয়া
কবিকে পুজো করছিস?তোকে মেরে ফেলব৷ তুই শ্লা, মুর্শিদাবাদের জোতদারের ছেলে তাই
রবিঠাকুরকে ভক্তি শ্রদ্ধা করিস? এরপরে তোকে একাজ করতে দেখলে মাথায় একটা ক্যাপসুল
এপার ওপার করে দেব৷
রাজা তালতলার ডাক্তার লেনের ছেলে৷ কিছু
দিন আগে লালবাজারের একজন সাদা পোষাকের কন্সটেবলকে মেরে গলায় দড়ি দিয়ে ওরা
ল্যাম্পপোষ্টে ঝুলিয়ে দিয়েছিল৷ সেই খোচরটার লাশ রেজাউল নিজে দেখে এসেছিল৷ সে
ডাক্তার লেনের মিষ্টির দোকানে দই খেতে গিয়ে লোকজনের কাছে শুনে কৌতূহল দমন করতে
পারে নি৷ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তালতলা থানা আর লালবাজার থেকে তিন চার গাড়ি পুলিশ
এসে পড়ায় রেজাউল কেটে পড়েছিল৷
তারপর থেকে রেজাউল রাজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে
মিশলেও ওদের ভীষণ ভয় করত৷ ওরা শ্রেণীশত্রুর খুনে হাত রাঙিয়েছে কখন যে কি করে বসে
ভয়টা সেখানেই ৷ কেন না এদের কর্মকাণ্ডকে রেজাউল হঠকারিকতা বলে মনে করে৷ পুলিশ
মারাকে ওর নাপসন্দ৷ নিরীহ ছাপোষা মানুষকে মেরে কি লাভ? মারলে পূঁজিপতি মারো
শিল্পপতি মারো! সে মুরোদ নেই৷
রেজাউল
তেমাথার মোড়ে গুলিস্তান হোটেল থেকে বিফ রোল আনতে যাচ্ছিল৷ রাজা একশো টাকার নোট বের
করে হাত বাড়াল৷ রেজাউল বলল, রাখ৷ আমি আনছি৷ তোরা আমার গেষ্ট৷
রোল এনে
খাওয়ার পর রেজাউল স্টোভ জ্বালিয়ে কন্ডেন্সড মিল্ক দিয়ে চা বানাতে লাগল ৷ দীপক গান
গাইতে লাগল:—
সময় এসেছে বন্ধু আজিকে সংগ্রাম আজি দিয়েছে ডাক,
আরামের কথা আয়াসের কথা বিলাসের কথা এখন থাক!....
দীপকের গানের সঙ্গে সবাই গলা মেলাল৷
তারপর শহীদুল গায়তে থাকল:—
দ্যাখো কমরেড ভিয়েতনাম থেকে বর্মা মলয় তরাইতে মুক্তিসেনার ঝাঁক
চেয়ারম্যানের ডাক,নকশালের ডাক...
রেজাউল
চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেই গান থামল৷চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তপন বলল,দারুণ চা করেছিস তো
গুরু৷রাজা বলল,রেজা চা বানায় কিছু !
চা পান করে চারজন উঠে পড়ল ৷ তপন যাবার সময় কড়কে গেল,রেজা শুনে
রাখ রবির ছবিটা রাখবি না৷ পরের বার এসে যদি দেখি তোকে ল্যাম্পপোষ্টে ঝোলাব৷
ওদের কাজে
কোন বিশ্বাস নেই কখন কি করে বসে ! সেই ভীতিবোধে কবিগুরুর ছবিটাকে তক্তোপোশের নীচে
লুকিয়ে রেখেছিল রেজাউল৷
রাত তখন গভীর শহর কলকাতা
ঘুমাচ্ছে৷ইমদাদ আলি লেনে কোন মানুষের সাড়া শব্দ নেই৷রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলো
চিৎকার করছে ৷ রেজাউল ভাবল, এটাই সঠিক সময় গুরুদেবের ছবিটাকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলে
ভাল হয়৷ কিন্তু শীতের রাতে কোন যানবাহন পাওয়া যাবে না ভেবে মহসীন স্কোয়ারের পুকুরে
ডুবিয়ে দিয়ে আসার সে সিদ্ধান্ত নিল৷
বিছানা
ছেড়ে উঠে পড়ল রেজাউল করিম৷গায়ে চাদরটা জড়াল৷ তারপর তক্তোপোশের নীচে থেকে
কবির ছবিটা বের করে বগলদাবা করল৷ঘরের দরজায় তালা মেরে দোতলা থেকে নীচে নেমে যেই
সদর দরজা খুলতে যাবে তখন দুমদাম করে বিশাল শব্দে কয়েকটা বোমা পড়ল৷ রেজাউল রাস্তায়
একটা পা নামিয়ে দিয়ে ছিল৷ওদিক থেকে ভারি বুটের শব্দ শোনা গেল৷ বোমা ফাটার শব্দ
শুনে থমকে গিয়েছিল সে৷ আর মুহূর্তের মধ্যে তার কানের পাশ দিয়ে বোঁ শব্দ করে
পুলিশের রাইফেলের গুলি চলে গিয়েছিল৷ রেজাউল ঘটনার আকস্মিকতায় বিপন্নবোধ করেছিল৷
তার রবীন্দ্রনাথের উপরে প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল৷ সে স্বগতোক্তি করে বলছিল শ্লা,
রবীন্দ্রনাথের জন্য আমার জীবন চলে যাচ্ছিল৷ আমিই মারা পড়তাম ! একথা বলে সে
গুরুদেবের কাঠের ফ্রেমে আঁটা ছবিটাকে নীচে ফেলে এক লাথি মেরে ভেঙে হাউমাউ করে
কাঁদলে লেগেছিল৷
সে
রাতের ঘটনার রোমান্থনে রেজাউল বিচলিত বোধ করল৷ সে সেদিনের ঘটনার মূল্যায়ণ করতে
গিয়ে যেন স্মৃতির এক মহাসাগরে সাঁতার কাটলে থাকল৷
****