ধর্ষিতা মা

 

                               গল্প 

 


                          ধর্ষিতা মা

                     জাহাঙ্গীর আলম - (সোহেল)

           

                               ১-পর্বঃ

 

মেয়েটির নাম মায়া, শ্যাম কালো গড়ন। কাজল কালো বড় বড় চোখ। বোকাবোকা চাহনি, কম কথা বলা স্বভাব। দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে এবার এসএসসি পাশ করেছে অতি কষ্টে পাশের গ্রামের হাই স্কুল থেকে। কিন্তু দুনিয়া বাস্তবতা নিয়ে জ্ঞান খুবই সামান্য তার। গরীব বাবা আর সৎ মায়ের অবহেলায় সারাদিন গুমরে গুমরে কাঁদে। সবে মাত্র ১৬ বছর বয়স হয়েছে। সৎ মায়ের চোখে যেনো এ ১৬ বছরের কিশোরী সংসারে বুঝা হয়ে গেছে। তাই বিয়ে দেবার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। কালো মেয়েকে কেইবা বিয়ে করবে !

তবো ঘটককে বলে রেখেছে মায়ার সৎ মা, যেমন বর আর ঘরই হোক, পার করে দেন৷

একদিন ঘটক পাত্র পক্ষ নিয়ে এসে মায়ার বিয়ের দিন ঠিক করে যায় । মায়া বিয়ে কি সেটা বুঝলেও সংসার কি সেটা খুবই অল্প বুঝে।  

এক সপ্তাহ পর মায়ার বিয়ের দিন ঠিক হলো, মায়ার বাবা মা দুজনেই যেনো মনে মনে তৃপ্তি পেতে লাগলো। অবশেষে কলঙ্কিনী মায়াকে ঘর ছাড়া করতে পারবে।

 

বিয়ের সামান্য বাজার করে কোনমতে বিদায় করতে পারলেই ওরা বেঁচে যায়।

 

বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো, পাত্রপক্ষ খাওয়া শেষ করে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখনি পাত্রের এক বন্ধু বলে উঠলো এ বিয়ে হবে না। কেনো জানতে চাইলে বললো, এ মেয়েকে বিয়ে করলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবোনা আমরা। কারন এ মেয়ে ৩/৪ বছর আগে ধর্ষিতা হয়েছে এলাকার এক বখাটের কাছে। আমি তা খবর পেয়েছি এবং তা পেপার পত্রিকাতেও এসেছিলো।

থানায় এখনো মামলা চলছে।

এটা শুনে মায়ার বাবা কান্নায় ভেঙে পড়ে । অনেক বুঝিয়ে বলেও পাত্রপক্ষকে রাজী করাতে পারেনা।  মায়ার বাবা বলে, “সেটা একটা দুর্ঘটনা ছিলো মাত্র, মায়া তখন ছোট ছিলো, সে কিছুই বুঝতোনা। তাই পাশের গ্রামের একটা বখাটে সুযোগ বুঝে মেয়েটার সর্বনাশ করে দিছে, স্কুল থেকে একা একা ফেরার সময়। আমরা গরীব বলে আজো বিচার পাইনি। আর সে অপবাদ থেকে বাঁচতে ওর মা আত্মহত্যা করে মারা যায়। তারপর সৎ মায়ের কাছে মায়া অবহেলায় বড় হয়েছে৷ এখন যদি সমাজ এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আমারো মরন ছাড়া গতি থাকবেনা” ।  

এ বলে হাতজোড় করেও পাত্রপক্ষকে মানাতে পারেনা।

অবশেষে বিয়েটা ভেঙ্গে ওরা চলে যায়। মায়াকে পাড়ার সব মহিলারা কর্কশ ভাষায় কথা বলে একে একে চলে গেলো। মায়ার সৎ মা মায়াকে চুল ধরে মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বললো, “এ বয়সে যখন ইজ্জত বাঁচাতে পারিসনি তবে মর গিয়ে মায়ের মতো”।

বেচারি মায়া লাল শাড়ি আলতা পড়ে বসেছিলো, হয়তো সৎ মায়ের হাত থেকে বাঁচতে পারবে। এখন বিয়েটাও ভেঙ্গে গেলো, সবাই ছি ছি করে চলে গেলো। মায়া ঘরের দিকে তাকাতেই মায়ার সৎ মা দরজা বন্ধ করে দিলো । বাবাকে ডেকেও কোন সারা পেলোনা।

অবশেষে মায়া সিদ্ধান্ত নেয়, সে আর বেঁচে থাকবেনা। মায়ের মতো সেউ মরে যাবে গলায় ফাঁসি নিয়ে। তাই অন্ধকারে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো সে, গ্রামের শেষে বড় রাস্তার মোরে একটা বকুল গাছে আছে। সেখানেই ওর মা রাতের আঁধারে ফাঁস নিয়েছিলো কাপড় পেচিয়ে। সেও ধীরে  ধীরে এলো বকুল গাছটার নীচে । যখনি আঁচলটা গাছে ঢিল মারতে যাবে তখনি একটি বাচ্চা শিশুর কান্না ভেসে এলো মায়ার কানে।

এতোরাতে এখানে শিশুর কান্না শুনে কাপড় টেনে পুকুরের দিকে একটু এগোতেই দেখে সদ্য জন্ম নেওয়া একটি ছেলে শিশু, গায়ে এখনো তাজা রক্ত। মায়া চমকে উঠে কোলে নেয়, ভালো করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো কেউ আছে কিনা ! দেখে, একটি গাড়িতে একটি মেয়ে দৌড়ে উঠে চলে গেলো। মায়া ডাকতে ডাকতে দৌড়ে এসেও তাকে ধরতে পারলোনা।

মায়া শিশুটির দিকে তাকিয়ে আছে, সে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। যে নিজেই মরতে আসছে, সে আবার কাকে বাঁচাবে ! ভাবলো, বাচ্চাকে রেখে সে গলায় ফাঁস নিবে। বাচ্চাটিকে ঝোপের ধারে রাখতে গিয়ে দেখে দুটো শিয়াল সামনে।

সে ভাবে, এমন মাসুম বাচ্চাকে এখানে রেখে দিলে শিয়ালে খেয়ে ফেলবে। এদিকে বাচ্চাটিও মাটিতে পরে কাঁদছে। মায়া বাচ্চাটিকে আবার কোলে তুলে নেয়, কিন্তু কান্না থামেনা।

তাই মায়া কান্না থামাতে নিজের স্তন বাচ্চাটির মুখে ভরে দেয়। বাচ্চাটি দুধ না পেলেও কান্না থামিয়ে দেয়। মায়া বসে রইলো বকুল তলায় কি করবে ভাবছে। সারারাত বসে থাকার পরেও কেউ আসলোনা বাচ্চাকে নিতে, মায়াকেও আর খুঁজতে এল না কেউ।

মায়ার কানে আজানের সুর ভেসে এলো, মায়া হাটতে হাটতে রাস্তায় আসতেই দেখে শহরের গাড়ি বেরিয়ে পড়েছে। মায়া ভাবে মরতে যখন পারলোনা তখন একে নিয়ে দূরে চলে যাবে। গাড়ি ইশারা করে উঠে বসলো।

সে চলে এলো ঢাকা শহর। তার মনে হলো বাচ্চা তো সারারাত কিছুই খায়নি, তাই ওকে খাওয়ানো দরকার। এক চায়ের দোকান থেকে দুধ নিলো চেয়ে, তাই খাওয়ালো বাচ্চাকে। খাওয়া শেষে হাটতে লাগলো । কোথায় যাবে এসব ভাবতে ভাবতে।

কিছুদুর হাটতেই একটি পার্কে বসে পড়লো গাছের ছায়ায়। সেখানে বাচ্চাটিকে নিয়ে এমন ভাবে বসে থাকতে দেখে অনেকেই ভিক্ষুক ভেবে টাকা আর ওদের কিছু অবশিষ্ট খাবার পানি দিয়ে গেলো। সে এসব দেখে খিদের জ্বালায় তা খেয়ে পেট ঠান্ডা করে নিলো।

মায়া বাচ্চার দিকে তাকিয়ে রইলো, বাচ্চাটি হাসছে মুখের দিকে তাকিয়ে। তার মনে এ বয়সেই মায়ের মমতা ফুটে উঠলো। বাচ্চাকে বুকে নিয়ে চুমু দিয়ে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।

সারাদিন পর যখন রাত হলো তখন কিছু বদমাশ বখাটে পার্কের ভিতর নেশা করছিলো।

মায়াকে হলুদ আলোতে অপূর্ব লাগছিলো। এ বখাটে মায়ার শরীর দেখে ভীষণ লোভ হলো, মায়া তখন গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। বখাটে আরো দুজনকে ডেকে আনলো তাকে নষ্ট করতে ৷

মায়ার উপর হামলা করতেই পার্কের প্রহরী সুজন মিয়া লাঠি দিয়ে সবাইকে মেরে তারিয়ে দেয়।

সবাই ভেগে গেলে মায়াকে সুজন বলে, “কে আপনি ? দুপুর থেকে দেখছি আপনি এই গাছটার নিচে বসে আছেন বাচ্চা কোলে নিয়ে !”

সে সুজনের বয়স দেখে কি বলবে বুঝতে পারছেনা; যদি এও ওদের মতো হয় !

সুজন আবার জিগ্যেস করায় হুশ ফিরে পেয়ে বলে, “আমি একজন এতিম মা,

আজকেই প্রথম শহরে এসেছি”।

সুজনঃ কোথায় যাবেন, আর কোথা হতে এসেছেন? আর এ বাচ্চাটি কার ?

মায়া তখন ভাবে বলা যাবেনা এটা অন্যের বাচ্চা, তাহলে চোর ভেবে পুলিশে দিতে পারে।

আর যদি বলে বিয়ের আসর থেকে উঠে এসেছে তবে বিপদ আরো হতে পারে। তাই মিথ্যে বললো, “এ আমারই সন্তান । ওর বাবাকে খুঁজতেই আমি শহরে এসেছি গ্রাম থেকে। কিন্তু ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি আমি, তাই এখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম বাচ্চাকে নিয়ে”।

সুজনঃ বুঝেছি, এখানে রাত কাটানো বিপদ। তাছাড়া দিনে পার্ক যতটা ভালো দেখা যায়, রাত ততটা ভালো নয়। এখানে বাজে লোকের অভাব নেই, ওরা গেছে আরো আসবে৷ ঐ যে দেখেন মদ খাচ্ছে, ওরাও হামলা করতে পারে আপনাকে একা পেয়ে এখানে। আপনি যদি আমায় বিশ্বাস করেন তবে আমার ঘরে আজকের রাতটা থাকতে পারেন। কাল না হয় তাকে না পেলে আবার ফিরে যাবেন গ্রামে। আমি রাতে ঘরে থাকিনা, বাহিরে পাহারা দেই পার্কে। আমার ঘর ঐতো বাংলোর পিছনেই ছোট্ট একটি কামরা।

মায়াঃ না আমি ঠিক আছি, সব কিছুর মালিক আল্লাহ।  বিপদ হলে ঐতো পুলিশ ডাকবো।

সুজনঃ বুঝেছি, আপনি আমায় ভরসা করতে পারেননি। ঠিক আছে এ চাদরটা রাখেন আর বাচ্চাকে ঢেকে দেন। এ ঠান্ডা বাতাস বাচ্চার গায়ে লাগলে সর্দি-জ্বর লেগে যাবে; তখন আরো সমস্যায় পড়বেন। আমি আশে পাশেই আছি। চলি……..

 

সুজন চলে যাওয়ার পর মায়া চাদরটা নিয়ে বাচ্চাকে ঢেকে দিলো আর বড় বড় করে আশে পাশের দিকে নজর করতে লাগলো। সে দেখে কিছু খারাপ মেয়েছেলেও এদিক ওদিক ঝোপের দিকে যাচ্ছে। সে ভয়ে ভয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে রইলো বাচ্চাকে কোলে নিয়ে। এভাবেই সে ঘুমিয়ে গেলো। ভোরে ফজরের আযানের সময় ঘুম ভাঙ্গলো।

সে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে পার্কের দিঘিতে নেমে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তারপর

সে যখন সেই গাছটার নীচে এলো দেখে, বাচ্চাটি ক্ষুধার্ত, বুকের দুধ খুঁজছে।  মায়া একটা স্তন বাচ্চার মুখে দিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো।

কোথাও এখনো দোকান খুলেনি ৷ অবশেষে একটি দোকান খুলা দেখতে পেয়ে সেখানে দুধ চেয়েও পেলোনা৷ দোকানি সকাল সকাল ঝাড়ি শুনিয়ে দিলো।  ও অসহায়ের মতো কিছুদুর হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলো৷ বাচ্চাটি ক্ষুধায় একটু একটু কান্না শুরু করে দিয়েছে৷ সে কোন কিছু না পেয়ে ভাবলো ঐ পার্কে গেলে হয়তো কেউ খাবার দিতে পারে। তাই আবার ফিরে এলো পার্কে। বসে পড়লো গাছটার নিচে। অনেক সময় হয়ে গেলো, কোন খাবার কেহো দিলোনা৷ বাচ্চাটি এবার জোরে জোরে কাঁদছে, মায়ার দুধ মুখে নিয়েও কান্না থামছেনা৷

তখন সুজন হাত মুখ ধুয়ে ঘরের দিকে যেতেই বাচ্চার কান্না শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখে মায়া অনেক চেষ্টা করছে কান্না থামাতে, কিন্তু থামছেনা৷  সে বাচ্চাকে নিয়ে দিঘীতে নেমে পানি খাওয়াতে লাগলো।

সুজন এটা দেখে বুঝে নিলো বাচ্চার ক্ষুধা নিবারণের জন্য দিঘির পানি খাওয়াচ্ছে। সুজন দৌড়ে মায়াকে নিষেধ করে বললো, “এ পানি বাচ্চাকে খাওয়াবেন না, এটা খেলে ওর পেটের অসুখ করবে। তখন বাঁচাতে পারবেননা।

মায়াঃ কি করবো, কোথাও একটু দুধ পেলামনা।

সুজনঃ এতো শিশু বাচ্চা, বুকের দুধ খাওয়ান।

মায়াঃ আমি না খাওয়া বলে দুধ হচ্ছেনা বুকে।

সুজনঃ আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি আসুন আমি দুধের ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি।

আসুন আমার সাথে। আহা ভয় নেই, পৃথিবীতে মানুষকে এতো অবিশ্বাস করলে বাঁচা যায়না।

আসুন ঘরে আসুন।

মায়াঃ আচ্ছা চলুন।

সুজনঃ এইতো আপনি এখানে বসুন, আমি দুধ নিয়ে আসছি রান্নাঘর থেকে।

সুজন চলে যেতেই মায়া সুজনের ঘরের চারপাশ তাকিয়ে দেখছে, পুরানো একটা সিমেন্টের দেয়ালের ঘর।  দেয়ালের চারপাশ প্রচুর ফাটল ধরে আছে। একটি বাঁশিও ঝুলে আছে সুতো দিয়ে, মনে হয় সুজন বাজায়। একটি ছোট্ট চৌকি, এলোমেলো কাথা বালিশ। দেয়ালের সাথে লাগানো তাতে ময়লা কাপড় রাখা আছে। মায়া মনে মনে ভাবে লোকটির বউ নেই মনে হয়। বউ থাকবে কেমন করে, বয়সটাওতো খুব বেশি নয়।

তখনি সুজন এসে পেছন থেকে বললো এইতো দুধ, ওকে খাইয়ে দিন। মায়া তারাতারি দুধ নিয়ে বাচ্চাকে খাওয়াতে লাগলো।

মায়া বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে, সুজন বলে উঠলো এতো সুন্দর বাবুর নাম কি?

মায়া চমকে উঠলো, সেতো কোন নামই রাখেনি, মনে মনে ভাবতে লাগলো কি নাম বলবে! তখনি মনে হলো বকুল গাছটার কথা, তাই বললো ওর নাম বকুল।

সুজনঃ বাহ দারুণ নাম, ঠিক যেনো বকুল ফুলের মতই দেখতে কেমন লালচে হয়েছে।

কথাটা শুনেই মায়া ঠোঁট টিপে হেসে দিলো, ততক্ষণে দুধ খাওয়ানোও শেষ। 

বাচ্চাটিও ঘুমিয়ে গেছে। মায়া তখন আমতা আমতা করে লজ্জিত কন্ঠে আস্তে করে বাথরুমে যাওয়ার কথা বললো।

সুজন বললো, “আপনি ভেতরে রান্না ঘর পেরিয়ে যান বাথরুম পাবেন । ভয় নেই, আমি আপনার বাচ্চাকে দেখছি”।

মায়া বাথরুম থেকে একটু পর এসে বাচ্চাকে নিয়ে বের হয়ে আসতেই সুজন বলে, “দাঁড়ান একটু”। বলেই ভেতরের রুমে চলে গেলো । ফিরে আসলো এক থালা ভাত নিয়ে।

সুজনঃ আমি জানি আপনি কাল থেকে কিছুই খাননি, এ ভাতটা আপনি খেয়ে নিন দয়া করে।

মায়া মানা করে বের হয়ে আসতে সুজন বললো, “অনেক দিন কারো সাথে ভাত খাইনা৷

আপনি যদি পাশে বসে খেতেন খুব ভালো লাগতো”।  

মায়ার পেটেও প্রচুর খিদে, তাই পিছনে এসে চৌকিতে বসলো। সুজন থালাটি সমানে বাড়িয়ে দিলো । মায়া মুখে তুলছে না।

সুজন বলল, “ভয় নেই, আমি বিষ মিশাইনি খাবারে । এইতো আমি আগে এক মোট খেয়ে নিলাম।

মায়া লজ্জা পেয়ে বলল, “ঠিক আছে আমি খাচ্ছি”।  সে বকুলকে আবার শুইয়ে দিয়ে ভাত খেতে লাগলো। সুজনের থালাতে দেখলো খুবই সামান্য পরিমাণ ভাত নিয়ে খাচ্ছে৷ মায়া বুঝতে পারলো, সে একার জন্য রান্না করেছিলো, আর তা দু'জনে খাচ্ছে এবং মায়াকেই বেশি দিয়েছে।

এতক্ষনে মায়া সুজনের উপর কিছুটা বিশ্বাস আনতে পারলো। খাওয়া শেষে করে মায়া বাচ্চার পাশে বসে ভাবতে লাগলো, এমন নিরিবিলি ছোট্ট আশ্রয় যদি ওর হতো।

সুজন রান্নাঘরে গেছে থালা বাসন রাখতে ৷ তখনি বকুল কেশে উঠলো, মায়া তাকিয়ে দেখে বকুল কান্না করছে কাশি দিয়ে। সুজন এসে বলে, “ওরতো অনেক ঠান্ডা লেগেছে”৷

মায়া কথাটা শুনে ভয় পেয়ে গেলো, “বললো কোন ঔষধ নেই আপনার কাছে ?”

সুজন বলে, “আপনি বসুন আমি আসছি এখনি”।

মায়া ততক্ষণে রান্নাঘরে গিয়ে তেল গরম করে বকুলকে মালিশ করে দিচ্ছে৷

সুজন এলো ঔষধ নিয়ে । বললো, “ওকে খাইয়ে দিন, আর ভালো হওয়ার আগ পর্যন্ত বাতাস লাগানো যাবেনা । তাই আপনি এখানে আপতত থাকতে পারেন”।

মায়া কিছু না বলে চুপচাপ কথা শুনতে লাগলো৷ তারপর সুজন বললো আপনি ওকে দেখুন আমি আসছি” ৷ বলেই আবার বেরিয়ে গেলো ।

আসলো দু ঘন্টা পর। মায়ার হাতে ধরিয়ে দিলো কিছু বাচ্চাদের কাপড় আর সাবান লোশন এসব৷ বলল, “এসব রাখুন, আমি বুঝতে পারছি আপনার কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই, যতদিন মন চায় আপনি থাকতে পারেন। আমাকে আপনার ভয় করতে হবে না, আমি বাহিরে কোন গাছের নীচে রাত কাটিয়ে দিতে পারবো”।

মায়া বলে, “আপনি এই একদিনে যা করলেন তার ঋণ আমি কোনদিন শুধাতে পারুমনা।

আমি এইখানে থাকলে মাইনষে কি কৈইবো ?”

সুজনঃ এখানে কোন মানুষ নেই, যাদের দেখছেন ওরা সবাই মানুষের মতো দেখতে শুধু৷ ভেতরে সবাই পশু৷ দেখবেন ? চলুন বাহিরে। ঐ যে দেখেন গাছের আঁড়ালে, ঐ যে দিঘির পারে।

মায়াঃ ছিঃ কি দেখাচ্ছেন এসব ? আপনি কি তবে আমারে !

সুজনঃ না আমি তেমন ভাবিনি, এটা ঢাকা শহর, এখানে কেউ কারো খোঁজ রাখেনা৷ তাই বলছি আপনি যদি নিরাপদ থাকতে চান তবে এখানে থাকতে পারেন। না হলে চলে যাবেন আমি কিছু বলবোনা৷

মায়াঃ আপনে আমার উপর এতো দরদ দেখাইতাছেন কেন ?  

সুজনঃ কারন আমার মাও একদিন আমাকে এমন একটি পার্কে জন্ম দিয়েছিলো, তারপর আমাকে বাঁচাতে গিয়ে মা নিজেই না খেয়ে খেয়ে মরে গেছে৷ আমি তখন মাত্র ১২বছরের বাচ্চা ছিলাম৷ তাই আপনাকে দেখে সে কথা মনে হলো।

মায়াঃ আচ্ছা, আমি থাকবো আপনার এখানে, আনাকেও বাহিরে থাকতে হবেনা। আমি রান্নাঘরে থাকবো, আর আপনি এখানে।

সুজনঃ আচ্ছা, তাহলে আপনি বকুলকে দেখেন আমি বাহির থেকে আসছি।  

মায়া বকুলকে শুইয়ে দিয়ে সারা ঘর পরিষ্কার করে ফেললো, তারপর বসতেই সুজন চলে এলো বাজার নিয়ে৷  বাজার নিয়ে মায়া রান্নাঘরে রেখে এলো; তারপর সুজন একটা কাপড় তুলে দিলো মায়ার হাতে।

সে কিছুই বলতে পারছেনা । সে এমন একটা কাপড় কিনতে চেয়েছিলো বাবার কাছে, ওর সৎ মা কিনে দিতে দেয়নি তখন৷ মায়ার বাবা রাতে নীরবে এসে বলেছিলো, দেখিস তোর যখন বিয়ে হবে তোর স্বামী তোকে এমন কাপড় ঠিকই কিনে দিবে৷

মায়ার চোখের জল গাল বেয়ে পড়লো ফোটায় ফোটায়৷

সুজনঃ পছন্দ হয়নি?

মায়াঃ কিছু পছন্দ মানুষকে অনেক কষ্ট দেয়, আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমার জন্য আপনি এতো কিছু করছেন, আমি কি করে ঋণ শুধাবো?

সুজনঃ যেদিন আপনার সামর্থ হবে সেদিন না হয় আমায় একটা শার্ট কিনে দিবেন৷

মায়াঃ আপনাকে এ পৃথিবী দিলেও কম দেওয়া হবে৷  চলি রান্না করতে হবে।  

                                                        (পরের পর্ব পরবর্তী সংখ্যায়) 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post