গল্পঃ ঈশ্বর নেই / Iswar Nei

ঈশ্বর নেই
      আজিজুল হাকিম
 ~~~~~~~~~~~~~
    আমি যে গল্পটি বলতে যাচ্ছি. সে ইসলাম ধর্মের মরিয়ম, খ্রীষ্টান ধর্মের মারিয়াম আর মহাভারতের একটি বিশেষ চরিত্র কুন্তীর মত একটি নারীর । এই সব নারীরা সকলেই পুরুষ সঙ্গম ছাড়ায় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন । তারা মা হয়েছেন পুরোপুরি অলৌকিক ক্ষমতাবলেই । সকলেই কিন্তু অলৌকিকতার পরশে কেবলমাত্র একটি করে সন্তান প্রসব করেছেন । 
অবশ্য আমি যে মেয়েটির কাহিনী বর্ণনা করতে যাচ্ছি সে অসংখ্য সন্তানের জননী । সমস্ত সন্তানই চার্বাকের চতুর্ভূত অথবা অলৌকিকতার ছোঁয়ায় জন্মেছে ।
 
অনন্তকাল ধরে মেয়েটি স্বর্গে বাস করে আসছে । স্বর্গের একটা অংশ তার অধীনে । তারও একটা বাউন্ডারী আছে । এতদিন তার সন্তানরাই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিল । আজ বাউন্ডারী আছে । কোন সার্বভৌমত্ব নেই ।
    এখানে মেয়েটির একটি নাম দেওয়া যাক । স্বর্গীয় নারীদের অপ্সরা বলা হয় । তাই এই মেয়েটিকে আমরা অপ্সরা নামে চিনব । এই অপ্সরা চিরকুমারী, চিরযুবতী, চিরজননী । কালের প্রবাহে এই মেয়েটির যৌবনে ভাটা পড়ে না । সময়ের স্রোত এই মেয়েটিকে বালিকা থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে যুবতী, যুবতী থেকে রমনী, রমনী থেকে বৃদ্ধা অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে না । সে এত সুন্দরী যে তাকে দেখলে তাজ্জব হতে হয় । পড়শিরা তাকে দেখে হিংসে করে । অপ্সরার সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য তারা সহ্য করতে পারে না । তাতে তার কোন যায় আসে না । সে আপন গর্বে গর্বিত । কিন্ত সে বোবা । তার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হয় নানা আনন্দের, না দুঃখের । ওর চোখে ঘুম বলে কিছু নেই । ও সব সময় জেগে থাকে । সমস্ত স্বর্গের মধ্যে সেই তার বুকে প্রথম সভ্যতার আলো ফুটিয়েছে ।
    অপ্সরা তার স্বর্গীয় বিছানায় শুয়ে আছে । কিন্তু এটিকে স্বর্গ না বলে নরক বলাই ভাল । তার স্বর্গলোকে গোলাপের সুগন্ধ আর ম ম করে না । আগুনের ধোঁয়ায় সব বিষাক্ত হয়ে গেছে । তার চির সবুজ বাগান আর নেই । সব পুড়ে হয় ছায় হয়ে গেছে, নয়তো পুড়ে ঝলসে গেছে । সামান্য কিছু গাছ পাতাবিহীন জীবন কাটাচ্ছে । তার স্বর্গের নদীর জ্বলে রক্ত মিশে দূষিত হয়ে গেছে । তার জান্নাতে আর স্বর্গীয় বাতাস প্রবাহিত হয় না । দোজখের আগুনের ঝালাস তাকে এবং তার সন্তানদের অতিষ্ঠ করে তুলছে । ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তার বেহেস্তি প্রাসাদ । স্বর্গের সমস্ত স্বাভাবিকতা অস্বাভাবিকতায় পরিণত হচ্ছে । তার চোখে-মুখে লেপ্টে আছে বিষাদ, অবসাদ আর আতঙ্কের ছায়া । ও যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে । সারা দেহ ক্ষত-বিক্ষত । কোথাও কোথাও আঘাতের চিহ্ন আবার কোথাও কোথাও পুড়ে যাওয়ার ছাপ । সারা দেহে ঘা খ্যাতখ্যাত করছে । মুখটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে । সারা দেহ থেকে ঝরে পড়ছে রক্ত আর রসানি । সে প্রায় নগ্ন । তার বিছানায় পড়ে থাকা সবুজ শাড়ি রক্তে ভিজে কালো হয়ে গেছে । চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়ে পড়ছে । তার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বিছানার পাশে পড়ে কাঁদছে । যন্ত্রনায় গড়াগড়ি খাচ্ছে । তাদের দেহে আবার কালচিটে দাগ । তাদের মুখে মা... মা...শব্দ ছাড়া কোন কথা নেই । অপ্সরার দেহে কোন শক্তি নেই ; তবুও অবসাদ্গ্রস্থ রক্তাক্ত হাত সন্তানদের গায়ে বুলিয়ে যাচ্ছে । তার সন্তানরা এখন ভীষণ ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত । তাদের মার দুধ শয়তান এখনই নিঃশেষ করে গেল ।
সভ্যতার আদিকাল থেকেই তার সন্তানরা তার কোলের অধিকার নিয়ে মারামারি করে এসেছে । খুনোখুনি হয়েছে । তাদের রক্তে ভেসে গেছে অপ্সরার বুক । আবার স্বর্গের নদীর জলে একসময় সে সব ধুয়েও গেছে । তার স্বর্গের মধ্যেই গড়ে উঠেছে এক স্বর্গ । সকলে সকাল - সন্ধ্যা হাত ধরে গান গেয়েছে । কোলাকুলি করেছে । অপ্সরা নীল আকাশের তলে জ্যোৎস্নার সমুদ্রে তার সন্তানদের বুকে নিয়ে চাঁদের সাথে মনে মনে কত কথা বলেছে । ভালোবেসেছে সকলকে । 
    অপ্সরার স্বর্গ সময়ের স্রোতে গোষ্ঠীতন্ত্র থেকে রাজতন্ত্রে, রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে, গণতন্ত্র থেকে গণপ্রজাতন্ত্রে চেঞ্জ হয়েছে । কখনও বা তার সন্তানদের সহজ-সরলতা আর খামখেয়ালীর সুযোগে সে বন্দি হয়েছে । এমনকি তাকে ধর্ষণের চক্রান্তও করা হয়েছে । কিন্তু সেই সুযোগের আগেই তার সন্তানরা তাকে উদ্ধার করেছে । সেই উদ্ধার কার্যে অবশ্য অনেকের প্রাণও গিয়েছে । অপ্সরা মুক্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । কিন্তু তার শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে যায় ।
 

    সেই সব ইতিহাস সময়ের প্রবাহে এখন অতীতমাত্র । এখন সবই স্মৃতি । 
    তারপর অপ্সরার বেহেস্তি নদীতে প্রচুর জল গড়ে । হাজারোবার সূর্য উঠে আর ডুবে । হাজারোবার চাঁদ তার মায়াবী রূপ চেঞ্জ করে । কতশতবার সে তার বেহেস্তি বাগিচায় জ্যোৎস্নার সাগর বেলায় শান্তির পাল তুলে ভেসে বেড়ায় । তার রূপসী দেহ আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠে । তার শরীরে ফুটে উঠে আরো লোভনীয় রহস্য ।
 
    গণতন্ত্রের পথ ধরে তার ছেলে-মেয়েরা তাদের মধ্য থেকে একজনকে স্বর্গ পরিচালনার ভার দেয়। ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম আল-লিম । অপ্সরার স্বর্গের সমস্ত শাসনভার তার হাতে অর্পিত হল ।
 
কিন্তু স্বর্গের উত্তরাঞ্চলের কয়েক জনের কাছে বিষয়টি ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াল । তারা আলাদাভাবে স্বায়ত্ত শাসন চেয়েছিল । তবে একতাই বেঁচে থাকার শেষ পথ এই নীতিতেই অন্যান্যরা উত্তরাঞ্চলের দাবিকে মানতে পারল না ।
 
    অন্য দিকে এজিদের নেতৃত্বে আল-লিমের ক্ষমতা অচল করে দেওয়ার জন্যে নানা রকম ষড়যন্ত্র শুরু হলো । আর প্রথমেই শুরু হলো প্রকাশ্য দিবালোকে বন্দুক উঁচিয়ে একটি কুমারী বোনের পোষাক খুলে ধর্ষন করা ।
 
    জনগণ আল-লিমের শাসন পরিচালনায় অক্ষমতার জন্যে ক্ষেপে উঠল । আল-লিম অবশেষে তার মায়ের কাছে প্রতিকারের উপায় জানতে চাইল । অপ্সরা হাতের ইসারায় ষড়যন্ত্র দমনের আদেশ দিল ।
আল-লিম বুল্ডোজার চালাল । মারা গেল অপ্সরার শতাধিক সন্তান । তাদের মধ্যে আবার অনেক আছে যারা নিরাপরাধ শিশু ও নারী । এজিদ স্বর্গ ছেড়ে পালাল । আশ্রয় নিল শয়তানের রাজপ্রাসাদে ।
 
উত্তরাঞ্চলের নেতৃত্বে ছিল সীমার । সেও এজিদের পথ ধরে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করল । ভায়ে ভায়ে খুনোখুনি হলো ।
 
    আল-লিম সেটা বর্দাস্ত করতে পারল না । স্বর্গে শান্তি আর স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এস্রাফিল আর আজরাইলকে নামানো হল । আবার রক্তের প্লাবন দেখা গেল অপ্সরার বুকে । তার শাড়িটি রক্তে ভিজে গেল ।
 
    কিন্তু স্বর্গে একটা শান্তি ফিরে এলো । যদিও আবার বেশ কিছু নির্দোষ শিশু ও নারী মারা গেল । সীমারের অনুগামীদের মনে রইয়ে গেল খত দাগ । সে সব ক্ষতের জন্য দায়ী করা হল আল-লিমকেই । তাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হল আল-লিমের জীবন নেওয়া । তার জন্যে তাদের মধ্যে কয়েকজন সাধুবেশে আল-লিমের দরবারে আশ্রয় নিল । কিন্তু আল-লিম বুঝতে পেরে তাদেরকেও ফিনিশ করে দিল ।
 
    এমন সময় আল-লিমের কাছে খবর এল অপ্সরার ছেঁড়া আঁচলের বাসিন্দারা অপ্সরার গুদাম থেকে সিঁদ কেটে সোনা চুরি করছে । আর সেই সোনা শয়তানের দরবারে খুব কম দামে বিক্রি হচ্ছে । কেবল মাত্র ছেঁড়া আঁচলের বাসিন্দারা নয়, অপ্সরার পার্শ্ববর্তী আর একটি স্বর্গও তার নিজস্ব মজুত সোনা শয়তান আর তার সাগরেদদের দরবারে খুব কম দামে বেচে দিচ্ছে । ফলে আল-লিম সমস্যার মধ্যে পড়ে । কারণ পার্শ্ববর্তী স্বর্গের তুলনায় তার মজুত সোনা কম । এদিকে অপ্সরা আর তার পার্শ্ববর্তী স্বর্গগুলির মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমান সোনা বিক্রির চুক্তি ছিল । সেই চুক্তি তারা উপেক্ষা করতে লাগল ।
 
আল-লিম অপ্সরার আঁচলের আর পার্শ্ববর্তী সকল স্বর্গের মোড়লদের আমন্ত্রন জানাল । তাদের বোঝাল, “আমরা নিজেদের মধ্যে একটা বিভেদ তৈরি করছি । আমরা নিজেরাই সব দিক চিন্তা ভাবনা করে একটা সমঝোতায় এসেছিলাম । তাহলে চুক্তির বাইরে কেন আমাদের সোনা অন্যের কাছে বেচব ?”
 
তারা আবার সলাপরামর্শে বসল, যাতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা সকলেই বেচতে পারে । কিন্তু তারা একমত হতে পারল না ।
 
    অবশেষে আল-লিম ছেঁড়া আঁচলের মোড়ল সাবাকে বলল, “তোমাকে যে টাকাটা তোমার অভাবের সময় ধার দিয়েছিলাম সেটি শোধ কর । এখন তো তোমার সুদিন চলছে
 
    সাবা মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, যখন ধার নিয়েছি তখন তো পরিশোধ করতেই হবে । ঠিক আছে, আর কটা দিন অপেক্ষা কর । তোমার দেওয়া সব ঋণ শোধ করে দিব

    কিন্তু কয়েকদিন পরে সাবা আরো কম দামে সোনা বেচতে লাগল । আর সব সোনা অপ্সরার ভান্ডার থেকে চুরি করা ।
 
    তার ধন চুরি জন্যে আল-লিম সাবার বিরুদ্ধে ঈশ্বরের কাছে প্রমাণসহ নালিশ জানাল ।
 

    এখানে একটা কথা বলে রাখার প্রয়োজন । ঈশ্বরকে কেউ কোন দিন দেখেনি । ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি কারো নেই । সে তার এক বিশাল স্বর্গীয় প্রাসাদে থাকে । সে স্বর্গবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যে ফেরেস্তা নিয়োগ করেছে । তাদের মাধ্যমেই স্বর্গবাসীদের যত অভাব অভিযোগ ঈশ্বরকে জানানো হয় । কখনো কখনো তার কথা শোনা যায় । আর সে কথার আইনই সমস্ত স্বর্গে বলবৎ আছে । সে আইন কেউ অমান্য করলে তার ওপর বিভিন্ন প্রকার শাস্তি ধার্য করা হয়েছে । সে শাস্তি আবার ঈশ্বর কাউকে নিজের হাতে দেয় না । ফেরেস্তাদের মাধ্যমেই দেওয়া হয় । 
আল-লিমের কথা শুনে ঈশ্বর বলল ফেরেস্তা পাঠানো হচ্ছে । তদন্ত হবে । চুরির প্রমান পাওয়া গেলে সাবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
 
    কিন্তু সময় বয়ে গেল । ঈশ্বর কোন ফেরেস্তা পাঠাল না । তদন্তও হল না ।
 অবশেষে আল-লিম সাবার ওপরে কিছুটা চাপ সৃষ্টি করল । কিন্তু সাবা বলল, “আমার ওপর চুরির এনজাম লাগানো হচ্ছে । এরকম অপমান আমি বর্দাস্ত করব না । আমার পাশে এক শক্তিশালী বন্ধু আছে । তোমার দেওয়া ঋণ আমি একটাও শোধ করব না 
    কারো হুমকি শোনার মত মানসিকতা আল-লিমের আর অবশিষ্ট রইল না । কারণ কারো চেয়ে তার শক্তিও কম ছিল না । সে সাবার রাজ্যকে আক্রমণ করল । আর অতি সহজে তা দখলও করে নিল ।
 
ঈশ্বর একটু নড়ে চড়ে বসল । তার সাম্রাজ্যে একজন অপরের সম্পত্তি দখল করে নিবে তা সে মানতে পারল না । এ ঘোর অপরাধ । এ অন্যায় । সে সাবার রাজ্যে শান্তি বাহিনী পাঠাল তার রাজ্যকে উদ্ধার করার জন্য । তার শান্তি বাহিনী মাসখানেকের মধ্যেই আল-লিমের হাত থেকে সাবার রাজ্যকে উদ্ধার করল । কিন্তু তার সেনাবাহিনী সেখানেই থেমে থাকল না । অপ্সরার সারা স্বর্গ জুড়ে এক তান্ডবলীলা চালানো হল । অপ্সরার অনেক সন্তান মারা গেল । ধ্বংস করে দেওয়া হল স্বর্গীয় উদ্যান আর গুদাম ঘরগুলি ।
 
    তারপর ঈশ্বরের নির্দেশে অন্যান্য স্বর্গ থেকে অপ্সরাকে বিচ্ছিন্ন করা হল । তার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপানো হল । তাকে একঘোরে করে দেওয়া হল । এমন কি ঈশ্বরের আইন তাকে দুবেলার পরিবর্তে এক বেলা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিল ।
 
    কয়েক মাসের মধ্যেই অপ্সরার স্বর্গে নেমে এল হাহাকার । পাঁচ বছরের যে ছেলেটিকে তার বাবা-মা ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখাত; সেই বাবা-মা-ই তার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলতে বাধ্য হল । স্কুলের পথ তার জন্য চিরকালের মত বন্ধ হয়ে গেল । ক্ষুধার তাড়নায় সেই ছেলেটি কামারশালায় কাজ নিতে বাধ্য হল ।
 
    তারপর সময় বয়ে চলে । স্বর্গের বুকে নেমে আসে আরো হাহাকার, আরো অভাব, আরো অনটন । সকলের মুখে একমুঠ ভাত তুলে দিতে আল-লিম ধুকিয়ে উঠে । মাঝে মাঝে সে দিশেহারা হয়ে যায় । সে সোনা বেচতে পারে অতি সামান্য পরিমাণে; যাতে সামান্য পরিমাণে খাদ্য আর ঔষুধ কেনা যায় । অপ্সরা আর তার সন্তানদের না মরে বেচে থাকার জোগাড় ।
 
    আল-লিম ঈশ্বরের প্রতি ভীষণ বিব্রত আর বিরক্ত হয়ে পড়েছে । ঈশ্বর যখন তখন ফেরেস্তা পাঠাচ্ছে । সেই ফেরেস্তারা বারবার অপ্সরার পোষাক খুলছে । নগ্ন করছে । তার দেহে তল্লাসি চালাচ্ছে অসংখ্যবার । তার বুকের মাঝে নাকি এক আশ্চর্য অগ্নিশিখা আছে । যার সাহয্যে সমস্ত স্বর্গগুলি ধ্বংস করা যেতে পারে । আল-লিমের মনটা মাঝে মাঝেই বিদ্রোহী হয়ে উঠে । কিন্তু ঈশ্বরের আইন ভাঙার মত সাধ্য কার !
 
    অবশেষে ফেরেস্তারা অপ্সরার বুকে আশ্চর্য অগ্নিশিখার কোন রকম সন্ধান দিতে পারল না । তবু শয়তান জেদ ধরল । বলল, “আমি জানি ওর বুকে অগ্নিশিখা আছে । আর আমি তা বের করে দেখাব
 
    শয়তান অপ্সরার স্বর্গে বেশ কিছু ঈগল পাঠাল । সেগুলি অপ্সরার বুকের ওপর দিয়ে উড়ে গেল । তাদের ডানার ঝাপটায় ওর বুকের কাপড় কেঁপে উঠল । সারিসারি ঈগলের ডানার ঝাপটায় সেটি একসময় বুক থেকে সরেও গেল । ঈগলগুলি ওর প্রাসাদের ওপর বড় বড় নুড়ি পাথর ফেলল । তার ফলে প্রাসাদগুলি ধ্বংস স্তূপে পরিণত হল । তাদের ডানার ঝাপটায় অপ্সরার সারা স্বর্গে লকলকে অগ্নিশিখা ঝরে পড়তে লাগল । অপ্সরার স্বর্গ জুড়ে জ্বলে উঠল আগুন । পুড়ে ছাই হয়ে গেল অসংখ্য ঘর-বাড়ি, পথ, ঘাট, মাঠ । মারা গেল অগুনিত সন্তান ।
 
    অবশেষে আল-লিম রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে গেল । আশ্রয় নিল এক গুহায় ।
 
    তারপর অপ্সরার বেহেস্তে আর সূর্য দেখা যায় না । জ্যোৎস্নার সাগরে চিৎ হয়ে শুয়ে অপ্সরা আর সবুজ শাড়ি পরে সাঁতার কাটে না । স্বর্গের আকাশটা ঢেকে গেছে কালো ধোঁয়ায় । চারিদিকে কেবল অনন্ত অন্ধকার । তার সন্তানদের পোড়া মাংসের দুর্গন্ধ চারিদিকে জমাট প্রাচীর তুলেছে । অপ্সরা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে । কেবল কেঁদেই চলেছে ।
 
    শয়তান এজিদ আর সীমারকে ঈগলের ডানায় চড়িয়ে অপ্সরার স্বর্গে পাঠাল । এজিদ বসল আল-লিমের মসনদে । সীমার নিল শাসনভার । দুজনেই আপন আপন ক্ষমতায় গর্বিত ।
 
এদিকে আল-লিম তার দেহ রক্ষীর বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়ল । শয়তানের হুকুমে এজিদ আর সীমার আল-লিমকে কুরবানি দিল ।
 
    কিন্তু ঈশ্বরের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না ।
 
    তারপর কালো বাজপাখির ডানায় চড়ে শয়তান অপ্সরার স্বর্গে পদার্পণ করল । এজিদ আর সীমার রাজদরবারে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল । সে রাজদরবারে প্রবেশ করে কোন ভনিতা না করেই বলল, “এজিদ, আমি তোমার মাকে চাই
 
    এজিদ বলল, “জি হুজুর ! আপনাকে আবার অনুমতি নিতে হবে ?”
    --তা নয় । তোমাকে আর সীমারকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে ।
 
    --তাহলে এখনই চলুন ।
 
    অপ্সরা শুয়ে আছে । শিকলে আবদ্ধ হাত-পা । অসহ্য যন্ত্রনায় সে ছটপট করছে । তার হাজার হাজার সন্তান ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর আঘাতের যন্ত্রনায় আর্তনাদ করছে । অপ্সরার বুকের ওপর দিয়ে একটা রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে । অসংখ্য লাশের সভা পেরিয়ে শয়তান অপ্সরার কাছে গেল । সঙ্গে এজিদ আর সীমার । শয়তান বলল তোমরা এই ভাঙা দরজায় দাঁড়িয়ে থাক
 
    এজিদ আর সীমার অপ্সরার প্রাসাদের দরজায় দাঁড়িয়ে শয়তানের অশ্লীল কার্যকলাপ দেখতে লাগল । একদম দর্শকের মতই ।
 
    অপ্সরা কান্নায় ভেঙে পড়ল । তার সতীত্ব অটুট রাখতে সে সমস্ত কৌশল অবলম্বন করল । তবুও শয়তানের দানবিক শক্তির কাছে পরাস্ত হল । খুলে পড়তে লাগল রক্তে ভেজা সবুজ স্বর্গীয় পোশাক।
 
এমন সময় ভগ্নস্তূপের আঁড়াল থেকে কয়েকটি ছেলে মাঝে মাঝে ইটের টুকরো ছুঁড়ছে । সেই ইটের টুকরো গিয়ে পড়ছে কখনও অপ্সরার কপালে আবার কখনো শয়তানের মাথায়, কখনও তার কপালে ।
শয়তানের এমন কীর্তি বিদ্যুৎ গতিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল । যারফলে কিছু দিনের মধ্যেই কয়েকটি স্বর্গ বাদ দিয়ে সকল স্বর্গবাসী শয়তানের বিরুদ্ধ্যে ক্ষেপে উঠল । প্রতিবাদ জানাতে জমায়েত হল ঈশ্বরের প্রাসাদের সামনে ।
 
    প্রাসাদের ভিতর থেকে ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “ঠিক আছে । বিষয়টি নিয়ে ভাবছি
 
জনগন চিৎকার করে উঠল, “ কোন রকম ভাবনা চিন্তা নয় । এই মুহূর্তে শয়তানকে হত্যা করতে হবে
 
    ঈশ্বর বললেন, “না । তা সম্ভব নয়

    সকলেই অবাক হয়ে গেল । ঈশ্বর কেন শয়তানকে বাঁচাতে চায়ছে !
    এমন অবস্থায় ঈশ্বরের আদেশ শোনার মত মানসিকতা স্বর্গবাসীদের আর থাকল না । তাদের ধর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল । তারা অশান্ত হয়ে পড়ল । তারা ঈশ্বরের প্রাসাদে প্রবেশ করার চেষ্টা করতে লাগল । ফলে ফেরেস্তাদের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করতে লাগল । শুরু হল ফেরেস্তাদের সঙ্গে লড়াই । রক্তের বন্যা বয়ে গেল । জন-সমুদ্রের ঢেঊয়ের মুখে । সমস্ত ফেরেস্তা খড়-কুটোর মত ভেসে গেল । অবশেষে জনগন ঈশ্বরের প্রাসাদে প্রবেশ করল । প্রাসাদে প্রবেশ করে তারা অবাক হয়ে গেল । দেখল, ঈশ্বরের সিংহাসনে শয়তান বসে আছে । 

Post a Comment

Previous Post Next Post