বসন্ত
মানব-৩
কলমেঃ এষা বেলা
ইন্দ্রনীল ভিন জেলা থেকে এই স্কুলে এসেছে। স্কুলটি যেহেতু গ্রামে
তাই সে প্রায় চার পাঁচ কিলোমিটার দূরের একটি ছোট্ট শহরে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে
বাস করে। রাঢ় বাংলার সেই শহরের শেষ প্রান্তে তার বাসা বাড়ি।। বাসা বাড়ির পিছন দিক
দিয়ে বয়ে গেছে ললিতা নদী। ও বেছে বেছে ওই ছোট্ট বাড়িটি পছন্দ করেছে। দুটো রুম। আর
একটি কিচেন। সবই অ্যাটাচড। বাড়ির চারিপাশে উঁচু দেওয়াল খাড়া হয়ে আছে। কোন অতিথি
বা বাড়ির কেউ কখনো এলে যেন তাদের থাকার কোনো অসুবিধা না হয় তার কারণেই সমস্ত বাড়িটি
সে ভাড়া নিয়ে আছে। যদিও তারা এখানে তেমন আসে না।
ইন্দ্রনীলের বয়স এবারে পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল। কিন্তু তাকে দেখলে
চল্লিশের মধ্যে বয়স মনে হয় না। এখনো চুলে তেমন পাক দেখা দেয়নি। দাড়ি গোঁফে অবশ্য
কিছু পাক দেখা দিয়েছে। সব সময় সে হাসিখুশিতে থাকে। নিজেকে কখনোই একলা অনুভব করে না।
যেদিন স্কুল থাকে না সেদিন সে প্রায় সারাদিন বইয়ের মাঝে ডুবে থাকে। বিকেল হলেই চলে
যায় ললিতার পাড়ে। সেখানে পাথরের উপর বসে। ললিতার এবং তার চারিপাশের সৌন্দর্য উপভোগ
করতে থাকে। তারপর নদীর বুকে একরাশ রক্তিম স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে সূর্য ডুবে গেলে সে বাসায়
ফিরে আসে।
বাড়িতে তার বাবা-মা এখনো বেঁচে আছেন। তাছাড়া ওর সংসার হয়েছে।
দুটো ছেলে মেয়ে তারাও বর্তমানে স্কুলে পড়ছে। ওরা সকলেই গ্রামের বাড়িতে আছে। অবশ্য
ছেল মেয়ে দুজনে বাইরের মিশনে থেকে পড়াশোনা করছে।
নীলাদ্রি লম্বা ছুটি পেলে বাড়ি গিয়ে ছুটি কাটিয়ে আসে। তাছাড়া দূরে
বাড়ি হওয়ায় সে তেমন বাড়ি যায় না। বাবা মাকে দেখার জন্য বউকে এখানে রাখতে পারেনা।
অবশ্য তার স্ত্রীও এখানে থাকতে চাই না। বৃদ্ধ বাবা মাকে দেখার জন্য সে ওখানেই পড়ে
থাকে। অবশ্য নীলাদ্রি মাসে দুএকবার বাড়ি যায়।
এদিকে আরুশি নামটি তার অনেক পরিচিত নাম। ছোটবেলায় তার খেলার
এবং স্কুলের সঙ্গী ছিল সে। প্রতিবেশী একটি মেয়ে; যার সঙ্গে সে জীবনের ষোলটা বছর খেলাধুলায়
কাটিয়ে দিয়েছে। সে যখন কলেজে ভর্তি হল ঠিক তখনই আরুশি অন্য জগতে চলে গেল। তার জীবন থেকে সে
সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
কতদিন সে আর আরুশি মাঠে-মাঠে, বাগানে-বাগানে ঘুরে বেড়িয়েছে।
তখন তাদের বয়স ষোল পার হয়নি । কোন বাড়ি থেকেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম অভিযোগ ছিল
না। একদম স্বাধীনভাবে তারা চলাফেরা করেছে। কিন্তু কেউ পরস্পরকে কোনদিন একান্তে চাইনি।
তবে এখন সে বুঝতে পারে, আরুশি অনেক অঙ্গভঙ্গিতে তাকে কাছে চেয়েছিল। তাকে এক অন্য জগতে
নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ইন্দ্রনীল মেয়েদের ভাষা তখন ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি।
তাই তার সেই ডাকে সে এগিয়েও যেতে পারেনি।
এদিকে এই আরুশির সঙ্গে যখন ক্লাসে পরিচয় ঘটলো; তখন সে বলেই
ফেলল, তোর নামে আমার এক বাল্যবন্ধু ছিল। সেদিন থেকে আরুশি ইন্দ্রনীলকে মনে হয় একটু
অন্য চোখে দেখে। আস্তে আস্তে সময় গাড়িয়ে বছর পার হয়ে যায়। আরুশীও আস্তে আস্তে
কৈশরে পদার্পণ করে। ওর চলাফেরা কথাবার্তায় অন্যদের চেয়ে ভিন্ন মনে হতে থাকে। তারপর
তো একদিন সে সকলের সামনে বলেই ফেলল, আমি সব স্যারদের চেয়ে আপনাকে বেশি ভালবাসি।
তাতে ইন্দ্রনীল কেবল একটু হেসেছিল। অন্যরাও ইন্দ্রনীল আর আরুশির
দিকে কেমন যেন তাকাচ্ছিল।
যাহোক কিন্তু এতে একটা সমস্যা দেখা দিল। ও এমনিতেই পড়াশোনা
তেমন করতে চায় না। সব সময় চঞ্চলতা আর প্রসন্নতা ওর দেহ-মনে এবং চোখে-মুখে ফুটে ওঠে।
মনে হলো এই পরিচয়েই ও একটা এক্সট্রা ফ্যাসিলিটি পেয়ে গেছে।
যার জন্য ক্লাসে ও একটু বেশি কথা বলে এবং ক্লাসেরও অনেকটা ডিস্টার্ব হয়।
ইন্দ্রনীল মাঝে মাঝে ক্ষেপে উঠে। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
ধমক দেয়। তাতেও তেমন কাজ হয় না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে আবার সে চিৎকার চেঁচামেচি
শুরু করে দেয়। আর মাঝে মাঝে ইন্দ্রনীলের দিকে এমন চোরা চাহনিতে তাকায় যে ইন্দ্রনীল
পড়াতে পড়াতে থমকে যায়। ও তার পড়ার মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। ওই সময় আরশি একটু হেসে
ওঠে । এই কারণে ইন্দ্রনীল মাঝে মাঝে ওকে মারেও; কিন্তু সেই মারেও কোন কাজ হয় না। সাময়িক
ক্লাসের পরিবেশটা শান্ত হয়। কিন্তু পরের দিন আবার দেখা যায় তার একই অবস্থা। ইন্দ্রনীল
ওকে বিভিন্ন ভাবে তিরস্কারও করে, কিন্তু যেন ও লজ্জার সমস্ত মাথা খেয়ে বসে আছে।
ওর দৈহিক সৌন্দর্য ক্লাসের অনেকের চাইতে অনেক বেশি প্রখর। আবার
এদিকে বসন্তের আসন্ন জৌলুস তার চোখে, মুখে আর দেহে এক চমক আনতে চলছে। তাই সে বসন্তের
উন্মত্ত প্রভায় সবসময় হাসিখুশি থাকতে চায়।
কেবল তাই নয়, তার সঙ্গে উঠতি বয়সের ছেলেরা বন্ধুর হাত বাড়াতে
চায় - প্রেম ছড়াতে চায় তার ফাগুন পথে। ও মাঝে মাঝে বিভ্রান্তও হয়। আবার হয়ত মনে
হয় কারও প্রেমে পড়েছে। তবুও সে ইন্দ্রনীলকে যেন মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত করে তোলে।
একদিন একটি ঘরে সে একটি ছেলের সঙ্গে পার্সোনাল কথা বলছিল। অন্য
একটি মেয়ে এসে ইন্দ্রনীলকে সে বিষয়টি জানায়। ইন্দ্রনীল তখন ছুটে যায় সেই ঘরের দিকে।
কিন্তু ছুটে যাওয়ার আগেই আরুশি সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।
ইন্দ্রনীল ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, তোকে কোন ছেলের সঙ্গে
একাকি ঘরে গল্প করতে বারণ করা হয়নি?
আরুশি বলল, আমি টিফিন খেতে ঘরে গিয়েছিলাম।
ইমরানা বলল, তুই তো গল্প করছিলি।
আরুশি বলল, স্যার, আপনার সঙ্গে আমার কিছু পার্সোনাল কথা আছে।
ইন্দ্রনীল বলল, বল।
আরুশির পাশে ইমরানা দাঁড়িয়ে ছিল। ও তাকে বলল, তাই তুই যা তো।
আমার এখন স্যারের সঙ্গে কথা আছে।
ইমরানা সেখান থেকে চলে গেলে ইন্দ্রনিল বলল, বল, কি বলবি।
স্যার, স্কুল জীবনে আপনি প্রেম করেন নি মানে কোন মেয়ের প্রেমে
পড়েন নি?
কথাটি শুনে ইন্দ্রনীল একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তারপর
বলল, আমাকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে? কানের উপরে এক থাপ্পড় মারব।
আরুশি হাসতে হাসতে বলল, সে আপনি মারেন। কিন্তু আমার প্রশ্নের
উত্তর দিয়ে মারেন।
ইন্দ্রনীল এর উত্তর কি দেবে বুঝতে পারে না। তবুও নিজেকে সামলে
নিয়ে সে হাসতে হাসতে বলে, না আমি কারো প্রেমে পড়িনি আর সে সময় সে সুযোগও ছিল না।
স্কুলে কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হত না। এমনকি কোন অবস্থায় যদি কেউ কোন মেয়ের
সঙ্গে কথা বলতো, আর হেডমাস্টার জানতে পারতেন তাহলে হেডমাস্টার তাকে অফিসে নিয়ে গিয়ে
বেধড়ক মারতেন। ওর প্রেম করা চিরকালের মতো ছুটে যেত। যার ভয়ে আমরা স্কুলে কোন মেয়ের
সঙ্গে কথা বলতাম না। আর আমাদের সময় ছোট্টবেলায় মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। যখন ক্লাস
ফোরে পড়ি তখন দেখেছিলাম আমাদের এক ক্লাসমেটের বিয়ে হয়ে গেল। তারপর ক্লাস ফাইবে হাইস্কুলে
ভর্তি হলাম। বিভিন্ন স্কুল থেকে এসে আমাদের সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশটি মেয়ে ভর্তি হল।
কিন্তু ক্লাস টেনে যেতে যেতে কেবলমাত্র পাঁচটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাদবাকি কখন তারা
এসেছে আর কখন তারা হারিয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। এমনকি আমার যে ছোট্ট বেলার খেলার সঙ্গী
সেও ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তে সংসার জীবনে পাড়ি জমিয়েছে।
আপনাদের সময় কত ছোটবেলাতেই বিয়ে হয়ে যেত!
কিন্তু স্যার আমার পিছনে যে অনেক ছেলেই কুকুরের মত ফ্যালফ্যাল
করে ঘুরছে। একজনকে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছি তখন আর একজন এসে আমার পিছনে ধাওয়া করছে। মনে
হচ্ছে আমি ছুটছি আর পিছনে অনেকগুলো কুকুর আমাকে তাড়া করছে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে আবার
কোনটি দেশি আবার কোনটি বিলেতি। তারা আমার চারিপাশে বারবার ল্যাজ নাড়ছে আর আমার ভালবাসা
চাইছে।
কোন
কোন ছেলে তো দারুন দারুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ওরা আমাকে একাকী থাকতে
দেবে না। কেবল প্রেমের দোহাই দিয়ে আমাকে সংসারে নিয়ে যেতে চাইছে। মাঝে মাঝেই মনে
হচ্ছে ওরা আমাকে প্রেমের বাগানে নিয়ে যেতে চাইছে। আর ওদের কারো কারো আহব্বানে আমিও
যেন একটু কেমন হয়ে যাচ্ছি।
ইন্দ্রনীল বলল, এই সময় এমন একটা হবেই। কিন্তু তোকে শক্ত হয়ে
দাঁড়াতে হবে। তোর সম্পূর্ণ জীবন বাকি আছে। এখনই যদি প্রেমের আলোর ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে
অন্ধকার পেয়ে যাস তাহলে সারা জীবনই হয়ত অন্ধকারে চলতে হবে। এ অবস্থায় তোকে চরম শান্ত
মাথায় কাজ করতে হবে এবং ভীষণ কঠিন হতে হবে। এটা মনে করবি যে তোর সঙ্গে ওরা প্রতারণা
করতে চায়ছে। কারণ অনেকেই আছে, যারা ভালোবাসার নামে প্রতারণার হাতছানি দিয়ে তোকে ডাকছে।
তুই এখন বুঝতে পারবি না। তাছাড়া কেউ ইভটিজ করলে আমাদেরকে জানা, তোর বাবা-মাকে জানা।
এখন তো তোর জীবন তৈরি করার সময়। জীবনে এমন একটা সময় আসবে যখন এ বিষয়টি একটি ফালতু
মায়াজাল বলে মনে হবে। আর একটা কথা মনে রাখবি, যারা প্রেম করে বিয়ে করেছে তাহলে কখনোই
সুখী হতে পারেনি। হয়তো এমন একটা সময় আসে যখন তারা পরস্পরকেই দোষারোপ করে।
কিন্তু আমি তো দেখেছি অনেকে প্রেম করে অনেক সুখে সংসার করছে।
তুই যাদেরকে দেখছিস হয়তো তাদের বিয়ে দু-এক বছর বা দু-পাঁচ
বছর হয়েছে। কিন্তু এমন একটা সময় আসবে যখন কয়েক বছর কেটে যাবে। আর ওদের মধ্যে পরস্পর
বিরোধিতা কাজ করবে। অতএব এখন তোর পড়ার বয়স; এখন তোর জীবনকে জানার বয়স। একটি লক্ষ্য
নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
আরুশি আবার বলল, প্রেম করা কি পাপ?
ইন্দ্রনীল বলল, অবশ্যই এই বয়সে পাপ।
ও বলল, আমি তেমন কিছু বুঝিনা; তবু মনে হয়, একটি ছেলে ও একটি
মেয়ের ভালোবাসায় কোন পাপ নেই। কারণ সেখানে দারুণ আনন্দ আছে।
কথাগুলো বলার সময় ওর মুখ আর ঠোঁটের প্রান্তে এক আনন্দের ঝিলিক
কেলে গেল।
ইন্দ্রনীলের কেমন একটা সন্দেহ হল। বলল, তুই কি এর মধ্যে কারো
সঙ্গে মেলামেশা করেছিস?
আরশির মুখটা কেমন লাল হয়ে গেল। তখন বিকেলের পড়ন্ত রোদ ওর
ফর্সা ঘাড়ে এসে একটা চকচকে সোনালী প্রলেপ ফেলছিল। তাতে ওর উন্মুক্ত কাঁধ জ্বলজ্বল
করে জ্বলছিল।
আরুশি যেন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর ইন্দ্রানীলের চোখে
চোখ ফেলল। কিছুক্ষণ পর বলল, না, তেমন নয়; তবে আমার তেমনই মনে হয়।
ইন্দ্রনীল ওর কথা বিশ্বাস করতে পারল না। কেবল অবাক হল, এই তের-চৌদ্দ
বছর বয়সেই! তারপর ভাবল, এই যৌনতাকে কেউ কি উপেক্ষা করতে পারে? সে কি কোন বয়স বুঝে?
আর যখন তা এক নেশার ঘোরে আসে, সে না বলবে কি করে?
(চলবে)
