কলমেঃ এষা বেলা
দুই
এর মধ্যে গ্রীষ্মের ছুটি পড়ল। ছুটিতে সে বাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু
বাড়ি গেলেও স্কুলের কথা বারবার মনে পড়ছিল। একটু ফুসরত পেলেই আরুশির মুখটি হামেশাই মনের
দরজায় এসে কড়া নাড়ছিল। সেই হাসিমাখা উজ্জ্বল মুখ, সেই মোহিনী মাতাল চোখ, সেই বাঁধভাঙা
উচ্ছল চঞ্চলতা, গোলাপি রঙের আলপনায় মোড়া সেই দুটি ঠোঁট, ভাঁজ পড়ার কারণে গোলাপের পাপড়িতে
যেমন অসংখ্য বাঁকানো দাগ দেখা যায়, ঠিক তেমনি ওর ঠোঁটে উন্মাদনাময় অসংখ্য দাগ; গলায়
একটি সুরু রেখা, হঠাৎ কোন কারণে রমণীয় ছুট, সেই ছুটে ঢেউ খেলা চুলের টগবগে খুশির ঝিলিক,
ছুটতে ছুটতে নীলাদ্রির ঠিক বুকের কাছে এসে হঠাৎ থমকে যাওয়া, চুল নাড়তে নাড়তে বারবার
ওর দিকে তাকানো, মুখটাকে সামান্য হাঁ করে মুখের ভিতরে জিভের খেলা - সবকিছুই ঝটিকা সফরে
মনের বারান্দায় হামেশায় আসে আর হারিয়ে যায়।
ইন্দ্রনীল ভেবেছিল আরুশির আচার আচরণ, কথাবার্তা সবকিছু ঊর্মিকে খুলে বলবে; কিন্তু সাহস হয়নি। যদি কোন রকম সন্দেহ মনের মাঝে জড় হয়, তাহলে পৃথিবীতে এমন কোন ইরেজার আবিষ্কার হয়নি যে সেই সন্দেহ মন থেকে ভ্যানিস করে দিতে পারবে। তাছাড়া মেয়েরা বেশ সন্দেহ প্রবণ। একটুতেই বেশি কিছু ভেবে নেয়। তাই সে মনের কথা মনের মধ্যেই রেখে দিয়েছে।
ছুটির পরে যখন ও স্কুল গেল। তারপর রুটিন অনুযায়ী ক্লাস রুমে ঢুকলো; তখন সে চমকে গেল। মনে হল সে নীলাদ্রিকে চেনেই না। ওর প্রতি কোন আগ্রহই নেই। ও আরুশির দিকে কিছুক্ষণ তাকাল। ও একবার তার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। সে যে আরুশিকে দেখল, সেই আরুশি যেন অন্য কোন আরুশি। অন্যান্য মেয়েদের মত আজ ভীষণ শান্ত। শরীরের মধ্যেও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। লম্বা মুখটা অনেকটা গোলগাল হয়েছে। দেহের মাঝে উঁকি মারছে উন্নত স্বাস্থ্য। গাল দুটি আরও লালাভ হয়েছে।
কিন্তু কেন সে আজ তার প্রতি এত অবজ্ঞা করছে? সে কি ভুলে গেছে অতীতের সব কথা? ও কিছুই বুঝতে পারছে না। সে অবাক হয়ে একটু আরুশির দিকে তাকালো আর ও নীলাদ্রির দিকে চোখ তুলে আবার নামিয়ে নিল। সামনে বইয়ের পাতা খোলা।
যে মেয়েটিকে ক্লাসের সমস্ত সময় বারবার বারণ করার পরেও কথা শোনে না, মাঝে মাঝেই চিৎকার চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা করে দেয়, কখন কাকে চিমটি কাটে ঠিক পাওয়া যায় না, কখন হঠাৎ দাঁড়িয়ে অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে; সেই মেয়েটির এই ক’দিনে এমন কি পরিবর্তন ঘটল যে আজ এমন শান্ত হয়ে গেল! নীলাদ্রি কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
যাহোক কয়েকটি ছাত্রীকে কিছু প্রশ্ন করার পর যখন সে আরুশিকে প্রশ্ন করল তখন সে ফটাফট সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল।
ইন্দ্রনীল আরও অবাক হল - যে মেয়েটি এর আগে কোনদিন পড়া করেনি, পড়ার কথা বললেই “হবে না” বলে দাঁড়িয়ে পড়েছে, কান ধরতে বললে হাসতে হাসতে কান ধরেছে, সেই মেয়েটি কি করে এতো ভাল ছাত্রী হতে পারল!
একদিন ইন্দ্রনীল তাকে বলেছিল, কান ধরতে তোর লজ্জা করে না?
সে হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার কান ধরব, তাতে লজ্জা কিসের? আমি কি অন্য কারো কান ধরছি? আমার কান আমি হাজারবার ধরব।
এসব প্রশ্নের উত্তর ইন্দ্রনীলের কখনোই জানা ছিল না। তাই সে কখনও হেসেছে আবার কখনো রেগে উঠেছে। অনেকবার ধমক দিয়েছে। বলা হয়েছে, যদি পড়া না হয়; তাহলে আগামী দিন আরও শাস্তি বাড়ানো হবে। তাতেও তার কোনরকম পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।
যাহোক আরুশির এই আচরণ ও পড়া করে আসায় ইন্দ্রনীল একটা ভীষণ আনন্দকে হৃদয়ের মাঝে চাপা দিয়ে রাখল। বলল, আজ তোর পড়া কি করে হল?
আরুশি হাসতে হাসতে বলল, পড়া কি এক আশ্চর্যের বিষয় হল, স্যার। ইচ্ছে করলেই তো পড়া যায়। আমি পড়ি না সেটা আলাদা কথা।
ইন্দ্রনীল অবশ্য ছুটির আগে কিছুটা ভয় দেখিয়ে বলেছিল, যদি আগামী দিন পড়া না করে আসিস তাহলে স্কুলের মাঝে তোকে একাকী রোদে দাঁড় করিয়ে রাখব। তুই বেশ বদমাশি করছিস। নিজেও পড়ছিস না, আবার অন্যদেরকেউ ডিস্টার্ব করছিস।
সেদিন ইন্দ্রনীলের কথা শুনে আরুশির কোন অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়নি। মনে হয়নি যে সে পড়া করে আসবে। কিন্তু এ কি করে হল? এও কি সম্ভব?
এদিকে ওর মনের মাঝে একটা গর্ব অনুভব করল যাক এবার তার কাজ হয়েছে। আশা করি এরপরে ক্লাসের মধ্যে কোন ডিস্টার্বনেশ ফিল করবে না।
ক্লাস শেষে ইন্দ্রনীল যখন ঘর থেকে বেরিয়ে জানালার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ করে ওর চোখটা আবার ডানদিকে জানালার ওপারে চলে গেল। এবার দেখল আরুশির একজোড়া উজ্জ্বল চোখ। ও ওর ডান চোখটিকে কেমন বুজে আবার তাকালো । যাকে বলে, চোখ মারা। ওর সেই চোখের পলক মুহূর্তে ইন্দ্রনীলের বুকে এসে লাগলো।
যেতে যেতে ভাবল, ওর কি পরিবর্তন হবে না?
টিফিনের পরে ইন্দ্রনীল যখন অন্য ক্লাস থেকে বেরিয়ে মাঠ দিয়ে অফিসের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল তখন কিন্তু আরুসি ওর দিকে মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছিল। তারপর ও যখন এক পা দু পা করে সিঁড়ির উপরে পা বাড়াচ্ছিল আর ঠিক যে জায়গাটায় সিঁড়ি বাঁক নিয়েছে ঠিক সেখান থেকে চার ধাপ ওপরে উঠতেই সে দেখতে পেল আরুশি ছুটতে ছুটতে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। আর পিছনে একটা মেয়ে ওকে তাড়া করছে। ও কিন্তু ঠিক বারান্দার শেষ ধাপের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু এমন ভাবে দাঁড়ালো যাতে মনে হল সে পড়ে যাবে। ইন্দ্রনীল বলল, এমন অসভ্যের মতো দৌড় কেন? তুই পড়ে যাবি না?
ও হাসতে হাসতে বলল, আমি পড়ে গেলে আপনি ধরে নেবেন না?
- আমি আমি তোকে ধরতে যাব কেন?
-
আপনি আমাকে বাঁচাবেন না?
- না বাঁচাবো না।
ও কেমন যেন মাথাটা মাথাটা ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি আপনি আমাকে বাঁচাবেন না?
ইন্দ্রনীল থমকে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। কিছুক্ষণ পর বলল, মনে কর তোকে ধরে ফেললাম, তাহলে?
ও বলল, তারপর আপনি সামলাতে পারবেন তো? আমি আর আপনি যদি নিচের চাতালে পড়ে যাই?
ইন্দ্রনীল বলল, তাহলে কি হবে?
তারপর আপনি আর আমি নিচে গড়িয়ে পড়তে পড়তে হয়তো একসাথেই আকাশে উড়তে থাকবো।
ইন্দ্রনীল ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। আরুশির চোখেমুখে এক অদ্ভুত দুষ্টুমি খেলে বেড়াচ্ছে।
ইন্দ্রনীল ভেবেছিল আরুশির আচার আচরণ, কথাবার্তা সবকিছু ঊর্মিকে খুলে বলবে; কিন্তু সাহস হয়নি। যদি কোন রকম সন্দেহ মনের মাঝে জড় হয়, তাহলে পৃথিবীতে এমন কোন ইরেজার আবিষ্কার হয়নি যে সেই সন্দেহ মন থেকে ভ্যানিস করে দিতে পারবে। তাছাড়া মেয়েরা বেশ সন্দেহ প্রবণ। একটুতেই বেশি কিছু ভেবে নেয়। তাই সে মনের কথা মনের মধ্যেই রেখে দিয়েছে।
ছুটির পরে যখন ও স্কুল গেল। তারপর রুটিন অনুযায়ী ক্লাস রুমে ঢুকলো; তখন সে চমকে গেল। মনে হল সে নীলাদ্রিকে চেনেই না। ওর প্রতি কোন আগ্রহই নেই। ও আরুশির দিকে কিছুক্ষণ তাকাল। ও একবার তার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। সে যে আরুশিকে দেখল, সেই আরুশি যেন অন্য কোন আরুশি। অন্যান্য মেয়েদের মত আজ ভীষণ শান্ত। শরীরের মধ্যেও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। লম্বা মুখটা অনেকটা গোলগাল হয়েছে। দেহের মাঝে উঁকি মারছে উন্নত স্বাস্থ্য। গাল দুটি আরও লালাভ হয়েছে।
কিন্তু কেন সে আজ তার প্রতি এত অবজ্ঞা করছে? সে কি ভুলে গেছে অতীতের সব কথা? ও কিছুই বুঝতে পারছে না। সে অবাক হয়ে একটু আরুশির দিকে তাকালো আর ও নীলাদ্রির দিকে চোখ তুলে আবার নামিয়ে নিল। সামনে বইয়ের পাতা খোলা।
যে মেয়েটিকে ক্লাসের সমস্ত সময় বারবার বারণ করার পরেও কথা শোনে না, মাঝে মাঝেই চিৎকার চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা করে দেয়, কখন কাকে চিমটি কাটে ঠিক পাওয়া যায় না, কখন হঠাৎ দাঁড়িয়ে অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে; সেই মেয়েটির এই ক’দিনে এমন কি পরিবর্তন ঘটল যে আজ এমন শান্ত হয়ে গেল! নীলাদ্রি কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
যাহোক কয়েকটি ছাত্রীকে কিছু প্রশ্ন করার পর যখন সে আরুশিকে প্রশ্ন করল তখন সে ফটাফট সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল।
ইন্দ্রনীল আরও অবাক হল - যে মেয়েটি এর আগে কোনদিন পড়া করেনি, পড়ার কথা বললেই “হবে না” বলে দাঁড়িয়ে পড়েছে, কান ধরতে বললে হাসতে হাসতে কান ধরেছে, সেই মেয়েটি কি করে এতো ভাল ছাত্রী হতে পারল!
একদিন ইন্দ্রনীল তাকে বলেছিল, কান ধরতে তোর লজ্জা করে না?
সে হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার কান ধরব, তাতে লজ্জা কিসের? আমি কি অন্য কারো কান ধরছি? আমার কান আমি হাজারবার ধরব।
এসব প্রশ্নের উত্তর ইন্দ্রনীলের কখনোই জানা ছিল না। তাই সে কখনও হেসেছে আবার কখনো রেগে উঠেছে। অনেকবার ধমক দিয়েছে। বলা হয়েছে, যদি পড়া না হয়; তাহলে আগামী দিন আরও শাস্তি বাড়ানো হবে। তাতেও তার কোনরকম পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।
যাহোক আরুশির এই আচরণ ও পড়া করে আসায় ইন্দ্রনীল একটা ভীষণ আনন্দকে হৃদয়ের মাঝে চাপা দিয়ে রাখল। বলল, আজ তোর পড়া কি করে হল?
আরুশি হাসতে হাসতে বলল, পড়া কি এক আশ্চর্যের বিষয় হল, স্যার। ইচ্ছে করলেই তো পড়া যায়। আমি পড়ি না সেটা আলাদা কথা।
ইন্দ্রনীল অবশ্য ছুটির আগে কিছুটা ভয় দেখিয়ে বলেছিল, যদি আগামী দিন পড়া না করে আসিস তাহলে স্কুলের মাঝে তোকে একাকী রোদে দাঁড় করিয়ে রাখব। তুই বেশ বদমাশি করছিস। নিজেও পড়ছিস না, আবার অন্যদেরকেউ ডিস্টার্ব করছিস।
সেদিন ইন্দ্রনীলের কথা শুনে আরুশির কোন অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়নি। মনে হয়নি যে সে পড়া করে আসবে। কিন্তু এ কি করে হল? এও কি সম্ভব?
এদিকে ওর মনের মাঝে একটা গর্ব অনুভব করল যাক এবার তার কাজ হয়েছে। আশা করি এরপরে ক্লাসের মধ্যে কোন ডিস্টার্বনেশ ফিল করবে না।
ক্লাস শেষে ইন্দ্রনীল যখন ঘর থেকে বেরিয়ে জানালার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ করে ওর চোখটা আবার ডানদিকে জানালার ওপারে চলে গেল। এবার দেখল আরুশির একজোড়া উজ্জ্বল চোখ। ও ওর ডান চোখটিকে কেমন বুজে আবার তাকালো । যাকে বলে, চোখ মারা। ওর সেই চোখের পলক মুহূর্তে ইন্দ্রনীলের বুকে এসে লাগলো।
টিফিনের পরে ইন্দ্রনীল যখন অন্য ক্লাস থেকে বেরিয়ে মাঠ দিয়ে অফিসের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল তখন কিন্তু আরুসি ওর দিকে মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছিল। তারপর ও যখন এক পা দু পা করে সিঁড়ির উপরে পা বাড়াচ্ছিল আর ঠিক যে জায়গাটায় সিঁড়ি বাঁক নিয়েছে ঠিক সেখান থেকে চার ধাপ ওপরে উঠতেই সে দেখতে পেল আরুশি ছুটতে ছুটতে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। আর পিছনে একটা মেয়ে ওকে তাড়া করছে। ও কিন্তু ঠিক বারান্দার শেষ ধাপের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু এমন ভাবে দাঁড়ালো যাতে মনে হল সে পড়ে যাবে। ইন্দ্রনীল বলল, এমন অসভ্যের মতো দৌড় কেন? তুই পড়ে যাবি না?
ও হাসতে হাসতে বলল, আমি পড়ে গেলে আপনি ধরে নেবেন না?
- আমি আমি তোকে ধরতে যাব কেন?
- না বাঁচাবো না।
ও কেমন যেন মাথাটা মাথাটা ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি আপনি আমাকে বাঁচাবেন না?
ইন্দ্রনীল থমকে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। কিছুক্ষণ পর বলল, মনে কর তোকে ধরে ফেললাম, তাহলে?
ও বলল, তারপর আপনি সামলাতে পারবেন তো? আমি আর আপনি যদি নিচের চাতালে পড়ে যাই?
ইন্দ্রনীল বলল, তাহলে কি হবে?
তারপর আপনি আর আমি নিচে গড়িয়ে পড়তে পড়তে হয়তো একসাথেই আকাশে উড়তে থাকবো।
ইন্দ্রনীল ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। আরুশির চোখেমুখে এক অদ্ভুত দুষ্টুমি খেলে বেড়াচ্ছে।
(চলবে)
Tags:
সাহিত্য-উপন্যাস
