অণুগল্পঃ প্রেম নেই/মোহাম্মদ আল্লারাখা

 


প্রেম নেই 

       মোহাম্মদ আল্লারাখা

 

শোভাবাজার মেট্রো স্টেশন। এক বৃহস্পতিবারের বিকেল চারটে চল্লিশ। আপ ডাউন ট্রেন ভীড়ে ভরা। প্লাটফর্মেও যাত্রীদের বেশ সমাগম। দমদমের দিক থেকে আগত একটি ডাউন ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে, 

হঠাৎ লোকজনের জোর শোরগোল “গেল গেল” রব শোনা গেল! 

এক তরুণী ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়েছে। ট্রেন তাঁর উপর দিয়ে চলে গেল, তারপর একটু এগিয়ে থামলো। 

যাত্রী সাধারণের ও রেল কর্মচারীদের ছোটাছুটি,  টিকিট না দেবার ঘোষণা,উভয়দিকের ট্রেন বন্ধ। স্টেশন মাস্টার, ডায়াস্টার ম্যানেজমেন্ট টিম ও পুলিশ হাজির। তৃতীয় লাইনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা হলো। 

দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনটি আস্তে আস্তে পিছোল। তরুণীকে দেখা গেল দুই লাইনের মাঝে পড়ে আছে, রক্তাক্ত। 

তরুণী বেঁচে আছে। তার বাম পায়ের পাতা  কিছু আঙুল সমেত কাটা গেছে। সেটা রেল লাইনের বাইরে পড়ে আছে। কাটা আঙুলগুলো যেন তখনো থির থির করে কাঁপছে! 

তরুণী ফর্সা সুশ্রী সুঠাম চেহারার দীর্ঘ গড়ন, বয়স হবে বাইশ তেইশ বছর। পোশাক আশাক চেহারা দেখে স্বচ্ছল ঘরের মনে হয়।

মেডিকেলের এমার্জেন্সিতে তরুণীকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো। বাম পায়ের কড়ে আঙুল সমতে তিনটি আঙুল ও পায়ের পাতার কিছু অংশ কাটা যাওয়া ছাড়া আর বেশি কিছু  বড় ধরনের চোট আঘাত লাগেনি। এভাবে বেঁচে যাওয়া ব্যতিক্রমী ঘটনা। 

এখন সে বিপদমুক্ত, কথা বলতে পারছে। 

তার নাম মিথিলা। থাকে দক্ষিণ কলকাতায়। 

 সে উত্তর কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্সের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী। 

মিথিলার বাড়িতে তার বাবা মাকে খবর দেওয়া হলো। তার বাড়ি থেকে বাবা, মা, ভাই এলো। বাবা সরকারি পদস্থ কর্মচারী। বাড়ির সবাই খুব উদ্বিগ্ন। তরুণীর সুচিকিৎসার জন্য তারা সবাই শশব্যস্ত। চিকিৎসক ও নার্সদের সাথে তারা কথা বলছেন, ছোটাছুটি করে ঔষধ, ইনজেকশন, ব্যান্ডেজ কিনে এনে দিচ্ছেন। 

আর একজনকে খবর দেওয়া হলো মিথিলার অনুরোধে। তার নাম শায়ক। 

এমার্জেন্সি থেকে মিথিলাকে এখন সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের তিন তলায় বেড নম্বর এস১২২ এ স্থানান্তর করা হয়েছে। কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। তার শারীরিক অঙ্গহানি হয়েছে। এখন সে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবে না।

মিথিলাকে জিজ্ঞেস করা হলো, সে কেন এমন করলো? এই ঘটনায় তার তো মৃত্যুও হতে পারতো!

মিথিলা বলল,' আমার মৃত্যু হলেই ভালো হতো।' 

মিথিলা আরও কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। তার চোখে মুখে অব্যক্ত যন্ত্রণা ফুটে উঠলো।

নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখির অব্যহতির পর রেল লাইনের ভিতর রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকার সময় যা দেখা যায়নি। 

 শায়কের সাথে তার সাত বছরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। গত বছর শায়ক ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটি এমএনসির চাকরিতে ঢুকেছে।

এখন শায়ক বলছে, তাদের বিয়ে ওদের বাড়ি থেকে মেনে নেবে না। 

ঘটনা দুর্ঘটনা এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। মিথিলা এখনো হাসপাতালে আছে। আরও দিন কয়েক পর সে ছাড়া পাবে।

এই কয়দিনের মধ্যে একদিনও সেই প্রেমিক প্রবর শায়ক বা তাদের বাড়ির কেউ  আসেনি, খোঁজ নেয়নি, একবার ফোন পর্যন্ত করেনি।

সাক্ষাত মৃত্যু গহ্বর থেকে ফিরে মিথিলা এখন রাগ, হতাশা, ক্ষোভ সব কিছুর উর্ধ্বে যেন এক উদাসী মানবী, যে ভিতরে ভিতরে হৃদয়ের প্রবল রক্তক্ষরণ চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারছে না। 

 ব্যথিত কণ্ঠে মিথিলা বলল, সকলে আমার শারীরিক অঙ্গহানি দেখতে পাচ্ছে। আমার মানসিক হানির খবর কেউ জানে না, কেউ বুঝবে না। 

Post a Comment

Previous Post Next Post