জুতো চুরি/ইসমাত রিজুয়ানা


ছোট গল্প

 জুতো চুরি 

ইসমাত রিজুয়ানা 


হেডস্যার কম্পিউটার রুমের বাইরে নতুন কেনা চামড়ার জুতো জোড়া রেখে ভেতরে ঢুকেছিলেন, প্রিন্টার থেকে প্রিন্ট ঠিকমতো বেরোচ্ছে কি না, ব্যাপারটা দেখার জন্য। বাইরে এসে দেখেন, জুতো নেই।  কম্পিউটারটাও স্কুলে নতুন এসেছে। একটাই কম্পিউটার, হেডস্যারের নির্দেশেই সবাই জুতো বাইরে রেখে ঢোকে। বাইরে বড় বড় করে নোটিশ লাগানো আছে, ‘জুতা পরে কম্পিউটারে রুমে ঢোকা নিষেধ।’—আদেশক্রমে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অবশ্য হেডস্যার ছাড়া কেউই নির্দেশ খুব একটা মানে না।

- স্যার, এটা কী করে সম্ভব? স্কুল থেকে দিনদুপুরে জুতো চুরি! তা–ও আবার আপনার জুতো! কথাটা বললেন বাংলা স্যার রমেশবাবু।

- এই কাজ কে করেছে আমি জানি। গম্ভীর মুখে বললেন হেডস্যার।

কে স্যার?’ একসঙ্গে সবাই প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।

আর কে, ক্লাস ফোরের ছেলেরা। কেন, জানেন না, ক্লাস ফোর, হেডমাস্টারের জুতোচোর।  একমুহূর্তের জন্য সবাই যেন থমকে গেলেন, তারপর সবাই একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠলেন। পরিবেশটা হালকা হয়ে গেল। এবার হেডস্যারের মুখেও হাসি। তিনি বললেন, সবাই ক্লাসে যান। জুতো চুরি গেছে সে না হয় আবার কেনা যাবে।’

কথাটা শুনে ক্লাস ফোরের পল্টুর মাথাটি কেমন গরম হয়ে গেল। এত বড় বদনাম! সে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে নিয়ে ছুটির পর স্কুলের পেছনের মাঠে মিটিং বসালো।

তোরা জানিস হেডস্যার কী বলেছেন আমাদের সম্পর্কে।

"ক্লাস ফোর, হেডমাস্টারের জুতো চোর "। ফাইভের ছেলেরা আমাদের খেপাচ্ছে। আমরা নাকি সত্যিই হেডস্যারের জুতো চুরি করেছি। না, না ...হেডস্যারের জুতা জোড়া খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের!

ঠিক বলেছিস -  পল্টুকে  সমর্থন করল মনা। সে-ও পল্টুর মতো সিরিয়াস।

ঘটনা আরও ঘোলা হলো। যখন ভয়ানক এক খবর নিয়ে এল রাজীব। খবরটা হচ্ছে, সে নাকি চেয়ারম্যান আঙ্কেলের পায়ে হেডস্যারের জুতো জোড়া দেখেছে।

সুযোগ বুঝে চেয়ারম্যান সাহেবের বাসার সামনে ঘুরঘুর করতে লাগল তিনজন। চেয়ারম্যান আঙ্কেল বের হলেই দেখবে। তারপর তারা নিশ্চিত হবে, ওটা সত্যিই হেডস্যারের জুতো কি না। একটু পর চেয়ারম্যান সাহেব পান চিবোতে চিবোতে বের হলেন । এবং ওরা হতভম্ব হয়ে দেখল, রাজীব যা বলেছে, তা–ই। একবারে হুবহু হেডস্যারের জুতো। কোনো সন্দেহ নেই।

এর মধ্যে পল্টু হঠাৎ জ্বরে পড়ল।  টানা তিন দিন বিছানায়। জুতোবিষয়ক কোনো খবরই সে আর পাচ্ছে না। অবশ্য জুতো উদ্ধারের কর্মকাণ্ড এখন রাজীব একাই চালিয়ে যাচ্ছে।

আরও দুদিন পর সুস্থ হলো পল্টু। তখনই একদিন রাজীব উত্তেজিত হয়ে ছুটে এল পল্টুর কাছে। সঙ্গে সজীব।

এদিক–ওদিক তাকিয়ে পকেট থেকে বের করল একটা ভাঁজ করা কাগজ। সেটাতে হেডস্যারের জুতো জোড়ার ছবি।

-মানে কী? পল্টু অবাক। এ ছবি কোথায় পেলি?’

রাজীব গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল - চেয়ারম্যান আঙ্কেল যখন মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেন, তখন জুতো জোড়া বাইরে ছিল, তখনই আমি ছবি তুলেছি। আমাদের ক্লাসের মন্টুর ফোন আছে। ওদের বাসায় প্রিন্টারও আছে। ও ছবি তুলে প্রিন্ট বের করে দিয়েছে।

পল্টুর হঠাৎ করে কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। রাজীব যা করছে, সেটা কি ঠিক হচ্ছে? চারদিকে সবাইকে জানাচ্ছে !

পল্টুর ভয়টাই সত্যি হলো। সেদিন রবীন্দ্রনগর মফস্‌সল শহরের চেয়ারম্যান আবদুল জলিল তাঁর অফিসে বসে দু–তিনজন কাউন্সিলরের সঙ্গে একটা মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখন রুমে ঢুকল তাঁর ডান হাত কাল্লু। চেয়ারম্যানের কানে কানে কী যেন বলল কাল্লু। চেয়ারম্যান কী মনে করে তাঁর পায়ের জুতা জোড়ার দিকে একপলক তাকালেন, তারপর একটা সিগারেট ধরালেন। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,

- এই, তোমরা সব যাও। আজকের মতো মিটিং শেষ।

সবাই বুঝল, কিছু একটা গুরুতর ঘটেছে। তারা যার যার কাগজপত্র গুছিয়ে চলে গেল। এবার চেয়ারম্যান কাল্লুর দিকে তাকালেন।

-কী বললি পরিষ্কার করে বল!

- স্যার, আপনার নতুন জুতো জোড়া নিয়ে কথা উঠেছে। এই জুতো জোড়া নাকি রবীন্দ্রনগর প্রাইমারি ইশকুলের হেডস্যারের। সবাই কানাকানি করছে আপনি…আপনি নাকি এই জুতো চুরি করছেন…জুতো জোড়া আপনার পছন্দ হয়েছিল তাই…’

কী? ক্কী কী বললি... টেবিলে প্রচণ্ড একটা ঘুষি বসালেন চেয়ারম্যান সাহেব। ঘুষির চোটে জলভরা গ্লাসটা ছিটকে পড়ে ভেঙে গেল। 

-এটা ওই শয়তান হেডমাস্টরের খেলা। ওকে আমি এলাকা ছাড়া করে ছাড়বো। কলিম চোরকে ডাক। দাঁত কড়মড়িয়ে বললেন চেয়ারম্যান সাহেব।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কলিম চোর হাজির হলো। সে এই এলাকার বিশিষ্ট চোর। কাজে কামে চেয়ারম্যানের মাঝে মাঝে তাকে দরকার পড়ে।

‘হুজুর ডেকেছেন?’

হুমমম ... ডেকেছি... শোন! এলাকার সব জায়গা থেকে জুতো চুরি করবি। যেখান থেকে  যেখান থেকে জুতো চুরি করা যায়, সব জায়গা থেকে । তারপর সেই জুতো দিয়ে একটা মালা তৈরি করবি!

- ক্যান হুজুর?

- আবার প্রশ্ন করে। এবার নিজের পায়ের সেই বিতর্কিত জুতোর এক পাটি খুলে ছুড়ে মারলেন কলিম চোরের দিকে। একলাফে দরজার বাইরে চলে গিয়ে কলিম চোর মিন মিন করে বলল - ঠিক আছে,জুতার মালা বানিয়ে নিয়ে আসব হুজুর।

চেয়ারম্যানের অফিসে যখন এসব হচ্ছে, তখন রবীন্দ্রনগর প্রাইমারি স্কুলের হেডস্যারের রুমে আরেক কাহিনি। হেডস্যার ক্লাস ফাইভের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার খাতা চেক করছিলেন। এর মধ্যে দপ্তরি মহিবুল্লাহ ঢুকল। এদিক–ওদিক তাকিয়ে পকেট থেকে একটা ছবি বের করে হেডস্যারকে দেখলেন।

- এ ছবি আবার কোত্থেকে এল?

- স্যার, এ ছবি এখন সবার হাতে হাতে। মানে স্যার, চেয়ারম্যান সাহেবের পায়ে আপনার জুতো। সেই জুতোর ছবি এটা।

‘উফ্‌, এসব কী হচ্ছে? সামান্য জুতো চুরি নিয়ে এত কাহিনীর মানে কী? হেডস্যার শুধু মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রাখলেন!

এমন সময় ইংরেজির শিক্ষক পরেশ বাবু  ঢুকলেন। গলা নামিয়ে বললেন-

ঘটনা সত্য স্যার। আপনার জুতো চেয়ারম্যান সাহেবের পায়ে শোভা পাচ্ছে। মানে তিনিই এই কাজ করেছেন, মানে কাউকে দিয়ে চুরি করিয়ে এখন নিজে ব্যবহার করছেন। তাঁর তো স্যার প্রিভিয়াস রেকর্ড ভালো নয়। সেই যে গম চুরির কথা মনে নেই? তারপর সেই যে খালকাটা কর্মসূচিতে পাঁচ লাখ টাকার কোনো হদিস নেই…তারপর ওই …’

‘উফ! আপনারা থামুন তো। চেয়ারম্যান সাহেব আমার জুতো চুরি করে পরবেন কোন দুঃখে? তাঁর জুতো কেনার টাকা নেই? এসব বাজে কথা কারা ছড়াচ্ছে? সব কটাকে ধরে চাবকানো দরকার। ছি ছি…আমার তো লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। চেয়ারম্যান সাহেবকে মুখ দেখাব কী করে? এমনিতে ওনার সঙ্গে একটা ঝামেলা হয়েছিল স্কুলের একটা ফান্ড নিয়ে, উনি তো ভাববেন আমি বোধ হয় বদলা নেবার জন্য এই সব করছি।ছি ছি। 

এদিকে আশ্চর্যের ওপরে আশ্চর্য, রবীন্দ্রনগর মফস্‌সল শহরে একের পর এক জুতো, স্যান্ডেল, স্লিপার সমানে চুরি হওয়া শুরু হয়েছে। ঘরের বাইরে জুতা রাখলেই জুতা হাওয়া। কেউ কেউ বলছে, এসব জিনের কাণ্ডকারখানা। নাহলে হঠাৎ করে এত এত জুতো চুরি হবে কেন? তবে এটা ঠিক, হেডস্যারেরটা চুরি হয়েই যেন ঘটনাটা শুরু হয়েছে। কিন্তু পেছনের রহস্যটা কী? এই নিয়ে ফের পুকুরপাড়ে মিটিংয়ে বসল পল্টু, মনা, রাজীব আর সজীবের।

- তুই কাজটা ঠিক করিসনি রাজীব। হেডস্যারের জুতোর ছবির প্রিন্ট এখন এই শহরের সবার হাতে হাতে।

রাজীব কৈফিয়তের সুরে বলল - আমি তো মাত্র একটা ছবি প্রিন্ট করেছিলাম। পরে অন্য কেউ ফটোকপি করে সারা শহরে ছড়িয়েছে।

শিগগিরই ছোট্ট মফস্‌সল শহরটা যেন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল চেয়ারম্যানের পক্ষের লোক। আরেক দল প্রাইমারি স্কুলের হেডস্যারের লোক। অবশ্য হেডস্যারের দলটা ছোট। চেয়ারম্যনের লোকজন হেডস্যারকে স্কুলছাড়া করার সব আয়োজন মোটামুটি সম্পন্ন করে এনেছে। তাঁর জন্য একটা জুতার মালাও তৈরি হচ্ছে। যেদিন স্কুল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে, সেদিন তাঁর গলায় পরানো হবে জুতোর মালা। 

সারা রাত পল্টুর চোখে ঘুম নেই। পল্টু ভালো করে সব দিক থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাকা গোয়েন্দার মতো ঘটনাটাকে সাজিয়ে দেখছিল, যদি কোন সমাধান বার করা যায়!

হঠাৎ পল্টুর মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা আলো জ্বলে উঠলো। আরে তাই তো... এদিকটা তো একেবারে ভেবেই দেখা হয়নি ! যেদিন জুতা চুরি হয়, সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল। তার মানে হেডস্যারের চামড়ার জুতো বৃষ্টিতে ভিজেছিল। চামড়া জলে ভিজলে ফুলে উঠে এক ধরনের গন্ধ ছড়ায়, যে গন্ধ কুকুরকে আকর্ষণ করে। তার মানে হেডস্যারের জুতো  নিয়ে গেছে কুকুরে। কারণ, ওদের স্কুলের কম্পাউন্ডে কুকুর ঢোকে। 

পল্টু আর দেরি করল না। পরের দিন মনাকে নিয়ে ছুটল কুকুরের সন্ধানে। তারা বেরোল যে কুকুরগুলো ওদের স্কুলের আশপাশে থাকে, ওইগুলোর খোঁজে। মনা জানাল, তাদের স্কুলের পেছনেই একটা বাড়ি আছে। এক দর্জির বাড়ি। তার দুটি পোষা দেশি কুকুর আছে।

দুজন গিয়ে দেখে, কুকুর দুটি উঠোনে বসে ঝিমোচ্ছে। বাড়ির কোনায় তাদের জন্য টিন–কাঠ দিয়ে একটা ঘরও বানানো আছে। ততক্ষণে মনা পৌঁছে গেছে কুকুর দুটির ছোট্ট ঘরটায়। আর কী আশ্চর্য, তাকিয়ে দেখে হেডস্যারের এক পাটি জুতো পড়ে আছে। তবে অর্ধেকটা খাওয়া।

আনন্দে চকচক করে উঠল দুজনের চোখ। কিন্তু আরেক পাটি কোথায়?’তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আরেক পাটি জুতো পাওয়া গেল না।’

বাইরে এসে দেখে, রাস্তার পাশে গাছতলায় কয়েকটা ছাগল বসে আছে। কী মনে করে পল্টু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ছাগলগুলোর দিকে। একটা ছাগল খুব আয়েশ করে কী যেন চিবাচ্ছে। কাছে গিয়ে আঁতকে উঠল, হেডস্যারের আরেক পাটি জুতো ছাগলের মুখে।

‘তাই তো, ছাগলে কী না খায় আর পাগলে কী না বলে।’ বলে দুজনই হি হি করে হেসে ওঠে। ছাগলটার মুখ থেকে মোটামুটি জোরজবরদস্তি করে টেনে জুতোটা ওরা কেড়ে নিল। ছাগলটা অবশ্য খুব আপত্তি করল না। মনে হয় জুতো চিবিয়ে সে খুব বেশি মজা পাচ্ছিল না।

পল্টু আর মনা ঠিক করল, আজ তো বিকেল হয়ে গেছে। কাল সকালে বরং ওরা স্কুলে গিয়ে হেডস্যারকে জুতো জোড়া দেবে। তারপর যা হয় হবে। 

পরদিন। পল্টুদের ছোট্ট মফস্‌সল শহরে কেমন একটা থমথমে ভাব। সবাই কেমন যেন ফিসফাস করছে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে, কেউ জানে না। তবে খুব শিগগির জানা গেল। চেয়ারম্যান সাহেব তাঁর দলবল নিয়ে আজ স্কুলে যাবেন, হেডস্যারকে একহাত নেবেন। হেডস্যারকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের কাগজও নাকি ম্যানেজ করেছেন। কিন্তু তার আগেই পল্টু আর মনা ছুটে গেল হেডস্যারের রুমে। হেডস্যার থমথমে মুখে বসে আছেন। কারণ, তাঁর কাছেও খবর এসেছে, চেয়ারম্যান সাহেব আজ কিছু একটা করবেন স্কুলে এসে। কিন্তু কী করবেন, সেটা অস্পষ্ট। ঠিক তখনই দরজায় পল্টু আর মনা—দুজনের মাথা দেখা গেল। জুতো জোড়া নিয়ে ওরা স্যারের রুমে ঢুকে পড়লো। 

এই দেখেন স্যার, আপনার জুতো। একটা কুকুর নিয়ে গিয়েছিল আরেকটা ছাগল…’

হেডস্যার তাঁর জুতো জোড়া হাতে নিলেন। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

চেয়ারম্যান সাহেবের ছোট্ট দলটা এসে দাঁড়াল স্কুলের গেটের সামনে। তিনি সবার দিকে তাকালেন একবার। চোখে কিছু একটা ইশারা করলেন। তারপর ষন্ডামার্কা সালাম আর রমজানকে নিয়ে ঢুকে গেলেন স্কুলের ভেতর। বাইরে দাঁড়িয়ে রইল বাকিরা। কাল্লু মিয়া টেনশনে পড়ে গেল, কলিম চোরার খবর নেই। তার কাছে আছে জুতোর মালাটা।

হেডস্যার তাঁর আধা খাওয়া জুতো জোড়া হাতে নিয়ে তখনো তাকিয়ে আছেন। তারপর ওদের দুজনের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘ছাগলে আর কুকুরে নিয়ে গিয়েছিল আমার জুতো!…হো হো, কী কাণ্ড! তোরা খুঁজে বের করেছিস…হো হো…কী কাণ্ড কী কাণ্ড!’

এ সময় হঠাৎ চেয়ারম্যান সাহেব দুজন ষন্ডামতো লোক নিয়ে ঢুকলেন। তখনো হেডস্যার হো হো করে হাসছেন। টেবিলের ওপর তাঁর জুতো দুটি, একটির সামনে দিকে খাওয়া, একটির পেছন দিকে খাওয়া। একটি কুকুরে খেয়েছে…একটি ছাগলে। হেডস্যার চেয়ারম্যান সাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। হাসতে হাসতে বললেন,

‘চেয়ারম্যান সাহেব, দেখুন কাণ্ড! আমার জুতো জোড়া আমার ছাত্ররা খুঁজে বের করেছে। একটা কুকুরে নিয়ে গিয়েছিল আরেকটা ছাগলে। কুকুরে অর্ধেকটা খেয়েছে আর ছাগলে…হো হো, ছাগলে কী না খায়…দেখুন দেখুন, কুকুর অর্ধেকটা খেয়েছে আর ছাগলেও অনেকটাই খেয়ে শেষ করেছে…!’

হাসি খুব সংক্রামক জিনিস। চেয়ারম্যান সাহেব কুকুরে আর ছাগলে খাওয়া জুতো জোড়ার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেললেন। আর কী আশ্চর্য, চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে আসা লোক দুটি হায়েনার মতো হ্যা হ্যা করে হেসে উঠল।

হাসতে হাসতেই হেডস্যার কোনোমতে বললেন,

- এই কে আছ? মহিবুল্লাহ? চেয়ারম্যান সাহেব এসেছেন, চা–মিষ্টি আনো।

খুব দ্রুত মিষ্টি, চা, শিঙাড়া সব চলে এল। একটু আগে হেডস্যারের শালা গাঙ্গুরামের দই এনেছে, সেই দই ও এখন চেয়ারম্যানের সামনে। চেয়ারম্যান বেশ আয়েশ করে খাচ্ছেন, মাঝেমধ্যেই টেবিলের ওপর জুতো জোড়ার দিকে তাকাচ্ছেন আর হাসছেন। একটা মারদাঙ্গা পরিবেশ মুহূর্তে যেন পাল্টে গেল। সবাই জুতো জোড়ার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে করতে মিষ্টি, চা, শিঙাড়া, দই খেতে লাগলেন। আগের বিষয় সব যেন ভুলে গেলেন সবাই।

চেয়ারম্যান সাহেব বলে উঠলেন, ‘ছাগলে কী না খায়, এটা এবার সত্যি প্রমাণিত হলো।’

‘ঠিক এ কথাই আমি বলেছিলাম ওদের। কই রে তোরা? এদিকে আয়।’

রন্টু আর মনা এসে হাজির হলো। পেছনে রাজীব আর সজীব। জুতো উদ্ধারের খবর পেয়ে ওরাও চলে এসেছে। হেডস্যার বললেন,

‘এরাই আমার জুতো খুঁজে বের করেছে।’

‘কোন ক্লাস তোমরা?’‘

'স্যার ফোর।’

‘ফোর…হেডমাস্টারের জুতোচোর …’ এবার কথাটা বললেন চেয়ারম্যান সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে আরেক দফা হাসির হুল্লোড় উঠল।

হাসতে হাসতে চোখে জল চলে এসে গিয়েছে হেডস্যারের। কোনোমতে বললেন, ‘বুঝলেন চেয়ারম্যান সাহেব, আমিও আপনার এই বাক্যই ঠাট্টা করে বলেছিলাম…’

‘এই ঠাট্টাই এখন হয়ে গেল সবার জন্য গাট্টা।’ আবার একটা হাসির হুল্লোড় উঠল। চেয়ারম্যান আঙ্কেল যে এ রকম কথার পিঠে কথা বলতে পারেন, কে জানত?

‘খুব খুশি হয়েছি আপনি এসেছেন, আসলে আমিই যেতাম আপনার কাছে।’ হেডস্যার বললেন।

ইতিমধ্যে চমন বাহার দেওয়া মিষ্টি পান চলে এসেছে। পান মুখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন চেয়ারম্যান সাহেব। বিদায়ের সময় দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন। এই দৃশ্য দেখে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যারের চোখে জল চলে আসার জোগাড়। এ সময় দেখা গেল কলিম চোরকে, তার হাতে একটা বড়সড় ব্যাগ।

হুজুর ,মালা নিয়া এসেছি। দরজা থেকে মাথা বাড়িয়ে চেয়ারম্যান সাহেবকে বলল কলিম চোর।

- কিসের মালা?’ হেডস্যার অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।

চেয়ারম্যান সাহেব অমায়িক হেসে বললেন - ও কিছু না স্যার! তারপর কলিম চোরের দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে ইশারা করে বললেন - ওই যা যা, এখন ভাগ এখান থেকে। তাহলে স্যার আমরা এখন আসি…’

দুই সাগরেদ নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব হাসিমুখে বের হয়ে গেলেন। হেডস্যার গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন ওঁদের । ওদিকে পল্টু, মনা , রাজীব ,সজীব দই আর মিষ্টি খাচ্ছে ইচ্ছেমতো…হেডস্যারের রুমে বসেই। আগে এই রুমে ঢুকতেই প্রাণ উড়ে যেত ওদের আর আজ যেন সব ফ্রি। 

সবশেষে হেডস্যার স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবলেন, ‘ক্লাস ফোর হেডমাস্টারের জুতোচোর’, এটা কোনো কাজের কথা নয়। ভালো কিছু কথা হওয়া দরকার। তিনি হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলেন, কী হতে পারে। হঠাৎ তাঁর মাথায় এল একটা লাইন।

‘ক্লাস ফোর, আনবে ওরা নতুন ভোর’, বাহ্‌, সুন্দর হয়েছে তো। নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হলেন। পরদিন সবাই দেখল, ক্লাস ফোরের দরজায় কম্পিউটারে টাইপ করা একটা কাগজ সাঁটানো। সেখানে বড় বড় ফন্টে টাইপ করে লেখা—

‘ক্লাস ফোর

আনবে ওরা নতুন ভোর’ ।

সেই লেখা দেখে পল্টু, মনা , রাজীব, সজীব ক্লাস ফাইভের ছেলেদের সামনে গিয়ে "হুররে" বলে চেঁচিয়ে উঠলো!

Post a Comment

Previous Post Next Post