ঈশ্বর নেই/আজিজুল হাকিম


(এই গল্পের সম্পূর্ণ ঘটনা ও সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। যদি কারো সঙ্গে বা কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে কোন কোন জায়গায় মিল থাকে তাহলে সেটি সম্পূর্ণ কাকতালীয়। কাউকে আঘাত করা লেখকের উদ্দেশ্য নয়। তাই কারো সঙ্গে সাদৃশ্য দেখা গেলে লেখক কোন মতেই দায়ী থাকবে না।)

ঈশ্বর নেই

      আজিজুল হাকিম

 

    আমি যে গল্পটি বলতে যাচ্ছি. সে ইসলাম ধর্মের মরিয়ম, খ্রীষ্টান ধর্মের মারিয়াম আর মহাভারতের একটি বিশেষ চরিত্র কুন্তীর মত একটি নারীর। এই সব নারীরা সকলেই পুরুষ সঙ্গম ছাড়ায় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তারা মা হয়েছেন পুরোপুরি অলৌকিক ক্ষমতাবলেই। সকলেই কিন্তু অলৌকিকতার পরশে কেবলমাত্র একটি করে সন্তান প্রসব করেছেন। 
    অবশ্য আমি যে মেয়েটির কাহিনী বর্ণনা করতে যাচ্ছি সে অসংখ্য সন্তানের জননী। সমস্ত সন্তানই চার্বাকের চতুর্ভূত অথবা অলৌকিকতার ছোঁয়ায় জন্মেছে। 
     অনন্তকাল ধরে মেয়েটি স্বর্গে বাস করে আসছে । স্বর্গের একটা অংশ তার অধীনে। তারও একটা বাউন্ডারী আছে। এতদিন তার সন্তানরাই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিল। আজ বাউন্ডারী আছে । কোন সার্বভৌমত্ব নেই।
    এখানে মেয়েটির একটি নাম দেওয়া যাক। স্বর্গীয় নারীদের অপ্সরা বলা হয়। তাই এই মেয়েটিকে আমরা অপ্সরা নামে চিনব। এই অপ্সরা চিরকুমারী, চিরযুবতী, চিরজননী। কালের প্রবাহে এই মেয়েটির যৌবনে ভাটা পড়ে না। সময়ের স্রোত এই মেয়েটিকে বালিকা থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে যুবতী, যুবতী থেকে রমনী, রমনী থেকে বৃদ্ধা অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে না। সে এত সুন্দরী যে তাকে দেখলে তাজ্জব হতে হয়। পড়শিরা তাকে দেখে হিংসে করে। অপ্সরার সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য তারা সহ্য করতে পারে না। তাতে তার কোন যায় আসে না। সে আপন গর্বে গর্বিত। কিন্ত সে বোবা। তার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হয় না। না আনন্দের, না দুঃখের। ওর চোখে ঘুম বলে কিছু নেই। ও সব সময় জেগে থাকে। সমস্ত স্বর্গের মধ্যে সেই তার বুকে প্রথম সভ্যতার আলো ফুটিয়েছে।
    অপ্সরা তার স্বর্গীয় বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু এটিকে স্বর্গ না বলে নরক বলাই ভাল। তার স্বর্গলোকে গোলাপের সুগন্ধ আর ম ম করে না। আগুনের ধোঁয়ায় সব বিষাক্ত হয়ে গেছে। তার চির সবুজ বাগান আর নেই। সব পুড়ে হয় ছায় হয়ে গেছে, নয়তো পুড়ে ঝলসে গেছে। সামান্য কিছু গাছ পাতাবিহীন জীবন কাটাচ্ছে। তার স্বর্গের নদীর জ্বলে রক্ত মিশে দূষিত হয়ে গেছে। তার জান্নাতে আর স্বর্গীয় বাতাস প্রবাহিত হয় না। দোজখের আগুনের ঝালাস তাকে এবং তার সন্তানদের অতিষ্ঠ করে তুলছে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তার বেহেস্তি প্রাসাদ। স্বর্গের সমস্ত স্বাভাবিকতা অস্বাভাবিকতায় পরিণত হচ্ছে। তার চোখে-মুখে লেপ্টে আছে বিষাদ, অবসাদ আর আতঙ্কের ছায়া। ও যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে । সারা দেহ ক্ষত-বিক্ষত। কোথাও কোথাও আঘাতের চিহ্ন আবার কোথাও কোথাও পুড়ে যাওয়ার ছাপ। সারা দেহে ঘা খ্যাতখ্যাত করছে। মুখটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে। সারা দেহ থেকে ঝরে পড়ছে রক্ত আর রসানি। সে প্রায় নগ্ন। তার বিছানায় পড়ে থাকা সবুজ শাড়ি রক্তে ভিজে কালো হয়ে গেছে। চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়ে পড়ছে। তার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বিছানার পাশে পড়ে কাঁদছে। যন্ত্রনায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাদের দেহে আবার কালচিটে দাগ। তাদের মুখে “মা... মা...” শব্দ ছাড়া কোন কথা নেই। অপ্সরার দেহে কোন শক্তি নেই ; তবুও অবসাদ্গ্রস্থ রক্তাক্ত হাত সন্তানদের গায়ে বুলিয়ে যাচ্ছে। তার সন্তানরা এখন ভীষণ ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত। তাদের মা’র দুধ শয়তান এখনই নিঃশেষ করে গেল।
     সভ্যতার আদিকাল থেকেই তার সন্তানরা তার কোলের অধিকার নিয়ে মারামারি করে এসেছে। খুনোখুনি হয়েছে। তাদের রক্তে ভেসে গেছে অপ্সরার বুক। আবার স্বর্গের নদীর জলে একসময় সে সব ধুয়েও গেছে। তার স্বর্গের মধ্যেই গড়ে উঠেছে এক স্বর্গ। সকলে সকাল - সন্ধ্যা হাত ধরে গান গেয়েছে। কোলাকুলি করেছে। অপ্সরা নীল আকাশের তলে জ্যোৎস্নার সমুদ্রে তার সন্তানদের বুকে নিয়ে চাঁদের সাথে মনে মনে কত কথা বলেছে। ভালোবেসেছে সকলকে। 
    অপ্সরার স্বর্গ সময়ের স্রোতে গোষ্ঠীতন্ত্র থেকে রাজতন্ত্রে, রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে, গণতন্ত্র থেকে গণপ্রজাতন্ত্রে চেঞ্জ হয়েছে। কখনও বা তার সন্তানদের সহজ-সরলতা আর খামখেয়ালীর সুযোগে সে বন্দি হয়েছে। এমনকি তাকে ধর্ষণের চক্রান্তও করা হয়েছে । কিন্তু সেই সুযোগের আগেই তার সন্তানরা তাকে উদ্ধার করেছে। সেই উদ্ধার কার্যে অবশ্য অনেকের প্রাণও গিয়েছে । অপ্সরা মুক্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিন্তু তার শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে যায়। 

    সেই সব ইতিহাস সময়ের প্রবাহে এখন অতীতমাত্র। এখন সবই স্মৃতি। 
    তারপর অপ্সরার বেহেস্তি নদীতে প্রচুর জল গড়ে যায়। হাজারোবার সূর্য উঠে আর ডুবে ওর বুকে। হাজারোবার চাঁদ তার মায়াবী রূপ চেঞ্জ করে। কতশতবার সে তার বেহেস্তি বাগিচায় জ্যোৎস্নার সাগর বেলায় শান্তির পাল তুলে ভেসে বেড়ায়। তার রূপসী দেহ আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। তার শরীরে ফুটে উঠে আরো লোভনীয় রহস্য। 
    গণতন্ত্রের পথ ধরে তার ছেলে-মেয়েরা তাদের মধ্য থেকে একজনকে স্বর্গ পরিচালনার ভার দেয়। ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম আল-লিম। অপ্সরার স্বর্গের সমস্ত শাসনভার তার হাতে অর্পিত হল।
কিন্তু স্বর্গের উত্তরাঞ্চলের কয়েক জনের কাছে বিষয়টি ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াল। তারা আলাদাভাবে স্বায়ত্ত শাসন চেয়েছিল। তবে একতাই বেঁচে থাকার শেষ পথ – এই নীতিতেই অন্যান্যরা উত্তরাঞ্চলের দাবিকে মানতে পারল না। 
    অন্য দিকে এজিদের নেতৃত্বে আল-লিমের ক্ষমতা অচল করে দেওয়ার জন্যে নানা রকম ষড়যন্ত্র শুরু হলো। আর প্রথমেই শুরু হলো প্রকাশ্য দিবালোকে বন্দুক উঁচিয়ে একটি কুমারী বোনের পোষাক খুলে ধর্ষন করা। 
    জনগণ আল-লিমের শাসন পরিচালনায় অক্ষমতার জন্যে ক্ষেপে উঠল। আল-লিম অবশেষে তার মায়ের কাছে প্রতিকারের উপায় জানতে চাইল। অপ্সরা হাতের ইসারায় ষড়যন্ত্র দমনের আদেশ দিল।
আল-লিম বুল্ডোজার চালাল। মারা গেল অপ্সরার শতাধিক সন্তান। তাদের মধ্যে আবার অনেক আছে যারা নিরাপরাধ শিশু ও নারী। এজিদ স্বর্গ ছেড়ে পালাল। আশ্রয় নিল শয়তানের রাজপ্রাসাদে। 
উত্তরাঞ্চলের নেতৃত্বে ছিল সীমার। সেও এজিদের পথ ধরে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করল। ভায়ে ভায়ে খুনোখুনি হলো। 
    আল-লিম সেটা বর্দাস্ত করতে পারল না। স্বর্গে শান্তি আর স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এস্রাফিল আর আজরাইলকে নামানো হল। আবার রক্তের প্লাবন দেখা গেল অপ্সরার বুকে। তার শাড়িটি রক্তে ভিজে গেল। 
    কিন্তু স্বর্গে একটা শান্তি ফিরে এলো। যদিও আবার বেশ কিছু নির্দোষ শিশু ও নারী মারা গেল। সীমারের অনুগামীদের মনে রইয়ে গেল খত দাগ। সে সব ক্ষতের জন্য দায়ী করা হল আল-লিমকেই। তাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হল আল-লিমের জীবন নেওয়া। তার জন্যে তাদের মধ্যে কয়েকজন সাধুবেশে আল-লিমের দরবারে আশ্রয় নিল । কিন্তু আল-লিম বুঝতে পেরে তাদেরকেও ফিনিশ করে দিল। 
    এমন সময় আল-লিমের কাছে খবর এল অপ্সরার ছেঁড়া আঁচলের বাসিন্দারা অপ্সরার গুদাম থেকে সিঁদ কেটে সোনা চুরি করছে। আর সেই সোনা শয়তানের দরবারে খুব কম দামে বিক্রি হচ্ছে। কেবল মাত্র ছেঁড়া আঁচলের বাসিন্দারা নয়, অপ্সরার পার্শ্ববর্তী আর একটি স্বর্গও তার নিজস্ব মজুত সোনা শয়তান আর তার সাগরেদদের দরবারে খুব কম দামে বেচে দিচ্ছে। ফলে আল-লিম সমস্যার মধ্যে পড়ে। কারণ পার্শ্ববর্তী স্বর্গের তুলনায় তার মজুত সোনা কম। এদিকে অপ্সরা আর তার পার্শ্ববর্তী স্বর্গগুলির মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমান সোনা বিক্রির চুক্তি ছিল। সেই চুক্তি তারা উপেক্ষা করতে লাগল।
আল-লিম অপ্সরার আঁচলের আর পার্শ্ববর্তী সকল স্বর্গের মোড়লদের আমন্ত্রন জানাল। তাদের বোঝাল, “আমরা নিজেদের মধ্যে একটা বিভেদ তৈরি করছি। আমরা নিজেরাই সব দিক চিন্তা ভাবনা করে একটা সমঝোতায় এসেছিলাম। তাহলে চুক্তির বাইরে কেন আমাদের সোনা অন্যের কাছে বেচব ?” 
তারা আবার সলাপরামর্শে বসল, যাতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা সকলেই বেচতে পারে। কিন্তু তারা একমত হতে পারল না।
    অবশেষে আল-লিম ছেঁড়া আঁচলের মোড়ল সাবাকে বলল, “তোমাকে যে টাকাটা তোমার অভাবের সময় ধার দিয়েছিলাম সেটি শোধ কর । এখন তো তোমার সুদিন চলছে।” 
    সাবা মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, যখন ধার নিয়েছি তখন তো পরিশোধ করতেই হবে। ঠিক আছে, আর ক’টা দিন অপেক্ষা কর। তোমার দেওয়া সব ঋণ শোধ করে দিব।” 
    কিন্তু কয়েকদিন পরে সাবা আরো কম দামে সোনা বেচতে লাগল। আর সব সোনা অপ্সরার ভান্ডার থেকে চুরি করা। 
    তার ধন চুরি জন্যে আল-লিম সাবার বিরুদ্ধে ঈশ্বরের কাছে প্রমাণসহ নালিশ জানাল। 

    এখানে একটা কথা বলে রাখার প্রয়োজন। ঈশ্বরকে কেউ কোন দিন দেখেনি। ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি কারো নেই। সে তার এক বিশাল স্বর্গীয় প্রাসাদে থাকে। সে স্বর্গবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যে ফেরেস্তা নিয়োগ করেছে। তাদের মাধ্যমেই স্বর্গবাসীদের যত অভাব অভিযোগ ঈশ্বরকে জানানো হয়। কখনো কখনো তার কথা শোনা যায়। আর সে কথার আইনই সমস্ত স্বর্গে বলবৎ আছে। সে আইন কেউ অমান্য করলে তার ওপর বিভিন্ন প্রকার শাস্তি ধার্য করা হয়েছে। সে শাস্তি আবার ঈশ্বর কাউকে নিজের হাতে দেয় না। ফেরেস্তাদের মাধ্যমেই দেওয়া হয়। 
আল-লিমের কথা শুনে ঈশ্বর বলল – ফেরেস্তা পাঠানো হচ্ছে। তদন্ত হবে। চুরির প্রমান পাওয়া গেলে সাবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 
    কিন্তু সময় বয়ে গেল। ঈশ্বর কোন ফেরেস্তা পাঠাল না। তদন্তও হল না। অবশেষে আল-লিম সাবার ওপরে কিছুটা চাপ সৃষ্টি করল। কিন্তু সাবা বলল, “আমার ওপর চুরির এনজাম লাগানো হচ্ছে। এরকম অপমান আমি বর্দাস্ত করব না। আমার পাশে এক শক্তিশালী বন্ধু আছে। তোমার দেওয়া ঋণ আমি একটাও শোধ করব না।” 
    কারো হুমকি শোনার মত মানসিকতা আল-লিমের আর অবশিষ্ট রইল না। কারণ কারো চেয়ে তার শক্তিও কম ছিল না। সে সাবার রাজ্যকে আক্রমণ করল। আর অতি সহজে তা দখলও করে নিল। 
ঈশ্বর একটু নড়ে চড়ে বসল। তার সাম্রাজ্যে একজন অপরের সম্পত্তি দখল করে নিবে তা সে মানতে পারল না। এ ঘোর অপরাধ। এ অন্যায়। সে সাবার রাজ্যে শান্তি বাহিনী পাঠাল তার রাজ্যকে উদ্ধার করার জন্য। তার শান্তি বাহিনী মাসখানেকের মধ্যেই আল-লিমের হাত থেকে সাবার রাজ্যকে উদ্ধার করল। কিন্তু তার সেনাবাহিনী সেখানেই থেমে থাকল না। অপ্সরার সারা স্বর্গ জুড়ে এক তান্ডবলীলা চালানো হল। অপ্সরার অনেক সন্তান মারা গেল। ধ্বংস করে দেওয়া হল স্বর্গীয় উদ্যান আর গুদাম ঘরগুলি। 
    তারপর ঈশ্বরের নির্দেশে অন্যান্য স্বর্গ থেকে অপ্সরাকে বিচ্ছিন্ন করা হল। তার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপানো হল। তাকে একঘোরে করে দেওয়া হল। এমন কি ঈশ্বরের আইন তাকে দু’বেলার পরিবর্তে এক বেলা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিল।
    কয়েক মাসের মধ্যেই অপ্সরার স্বর্গে নেমে এল হাহাকার। পাঁচ বছরের যে ছেলেটিকে তার বাবা-মা ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখাত; সেই বাবা-মা-ই তার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলতে বাধ্য হল। স্কুলের পথ তার জন্য চিরকালের মত বন্ধ হয়ে গেল। ক্ষুধার তাড়নায় সেই ছেলেটি কামারশালায় কাজ নিতে বাধ্য হল।
    তারপর সময় বয়ে চলে। স্বর্গের বুকে নেমে আসে আরো হাহাকার, আরো অভাব, আরো অনটন। সকলের মুখে একমুঠ ভাত তুলে দিতে আল-লিম ধুকিয়ে উঠে। মাঝে মাঝে সে দিশেহারা হয়ে যায়। সে সোনা বেচতে পারে অতি সামান্য পরিমাণে; যাতে সামান্য পরিমাণে খাদ্য আর ঔষুধ কেনা যায়। অপ্সরা আর তার সন্তানদের না মরে বেঁচে থাকার জোগাড়। 
    আল-লিম ঈশ্বরের প্রতি ভীষণ বিব্রত আর বিরক্ত হয়ে পড়েছে। ঈশ্বর যখন তখন ফেরেস্তা পাঠাচ্ছে। সেই ফেরেস্তারা বারবার অপ্সরার পোষাক খুলছে। নগ্ন করছে। তার দেহে তল্লাসি চালাচ্ছে অসংখ্যবার। তার বুকের মাঝে নাকি এক আশ্চর্য অগ্নিশিখা আছে। যার সাহয্যে সমস্ত স্বর্গগুলি ধ্বংস করা যেতে পারে। আল-লিমের মনটা মাঝে মাঝেই বিদ্রোহী হয়ে উঠে। কিন্তু ঈশ্বরের আইন ভাঙার মত সাধ্য কার! 
    অবশেষে ফেরেস্তারা অপ্সরার বুকে আশ্চর্য অগ্নিশিখার কোন রকম সন্ধান দিতে পারল না। তবু শয়তান জেদ ধরল। বলল, “আমি জানি ওর বুকে অগ্নিশিখা আছে। আর আমি তা বের করে দেখাব।”  
    শয়তান অপ্সরার স্বর্গে বেশ কিছু ঈগল পাঠাল। সেগুলি অপ্সরার বুকের ওপর দিয়ে উড়ে গেল। তাদের ডানার ঝাপটায় ওর বুকের কাপড় কেঁপে উঠল। সারিসারি ঈগলের ডানার ঝাপটায় সেটি একসময় বুক থেকে সরেও গেল। ঈগলগুলি ওর প্রাসাদের ওপর বড় বড় নুড়ি পাথর ফেলল। তার ফলে প্রাসাদগুলি ধ্বংস স্তূপে পরিণত হল। তাদের ডানার ঝাপটায় অপ্সরার সারা স্বর্গে লকলকে অগ্নিশিখা ঝরে পড়তে লাগল। অপ্সরার স্বর্গ জুড়ে জ্বলে উঠল আগুন। পুড়ে ছাই হয়ে গেল অসংখ্য ঘর-বাড়ি, পথ, ঘাট, মাঠ। মারা গেল অগুনিত সন্তান। 
    অবশেষে আল-লিম রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে গেল। আশ্রয় নিল এক গুহায়। 
    তারপর অপ্সরার বেহেস্তে আর সূর্য দেখা যায় না। জ্যোৎস্নার সাগরে চিৎ হয়ে শুয়ে অপ্সরা আর সবুজ শাড়ি পরে সাঁতার কাটে না। স্বর্গের আকাশটা ঢেকে গেছে কালো ধোঁয়ায়। চারিদিকে কেবল অনন্ত অন্ধকার। তার সন্তানদের পোড়া মাংসের দুর্গন্ধ চারিদিকে জমাট প্রাচীর তুলেছে। অপ্সরা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। কেবল কেঁদেই চলেছে।
    শয়তান এজিদ আর সীমারকে ঈগলের ডানায় চড়িয়ে অপ্সরার স্বর্গে পাঠাল। এজিদ বসল আল-লিমের মসনদে । সীমার নিল শাসনভার। দুজনেই আপন আপন ক্ষমতায় গর্বিত।
এদিকে আল-লিম তার দেহ রক্ষীর বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়ল। শয়তানের হুকুমে এজিদ আর সীমার আল-লিমকে কুরবানি দিল। 
    কিন্তু ঈশ্বরের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। 
    তারপর কালো বাজপাখির ডানায় চড়ে শয়তান অপ্সরার স্বর্গে পদার্পণ করল। এজিদ আর সীমার রাজদরবারে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল। সে রাজদরবারে প্রবেশ করে কোন ভনিতা না করেই বলল, “এজিদ, আমি তোমার মাকে চাই।”
    এজিদ বলল, “জি হুজুর! আপনাকে আবার অনুমতি নিতে হবে?”
    --তা নয়। তোমাকে আর সীমারকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে। 
    --তাহলে এখনই চলুন। 
    অপ্সরা শুয়ে আছে। শিকলে আবদ্ধ হাত-পা। অসহ্য যন্ত্রনায় সে ছটপট করছে। তার হাজার হাজার সন্তান ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর আঘাতের যন্ত্রনায় আর্তনাদ করছে। অপ্সরার বুকের ওপর দিয়ে একটা রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে। অসংখ্য লাশের সভা পেরিয়ে শয়তান অপ্সরার কাছে গেল। সঙ্গে এজিদ আর সীমার। শয়তান বলল – তোমরা এই ভাঙা দরজায় দাঁড়িয়ে থাক।
    এজিদ আর সীমার অপ্সরার প্রাসাদের দরজায় দাঁড়িয়ে শয়তানের অশ্লীল কার্যকলাপ দেখতে লাগল। একদম দর্শকের মতই। 
    অপ্সরা কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার সতীত্ব অটুট রাখতে সে সমস্ত কৌশল অবলম্বন করল। তবুও শয়তানের দানবিক শক্তির কাছে পরাস্ত হল। খুলে পড়তে লাগল রক্তে ভেজা সবুজ স্বর্গীয় পোশাক। 
এমন সময় ভগ্নস্তূপের আঁড়াল থেকে কয়েকটি ছেলে মাঝে মাঝে ইটের টুকরো ছুঁড়ছে। সেই ইটের টুকরো গিয়ে পড়ছে কখনও অপ্সরার কপালে আবার কখনো শয়তানের মাথায়, কখনও তার কপালে।
শয়তানের এমন কীর্তি বিদ্যুৎ গতিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। যারফলে কিছু দিনের মধ্যেই কয়েকটি স্বর্গ বাদ দিয়ে সকল স্বর্গবাসী শয়তানের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠল। প্রতিবাদ জানাতে জমায়েত হল ঈশ্বরের প্রাসাদের সামনে। 
    প্রাসাদের ভিতর থেকে ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “ঠিক আছে। বিষয়টি নিয়ে ভাবছি।” 
জনগন চিৎকার করে উঠল, “ কোন রকম ভাবনা চিন্তা নয়। এই মুহূর্তে শয়তানকে হত্যা করতে হবে।”  
    ঈশ্বর বললেন, “না। তা সম্ভব নয়।” 
    সকলেই অবাক হয়ে গেল। ঈশ্বর কেন শয়তানকে বাঁচাতে চায়ছে!
    এমন অবস্থায় ঈশ্বরের আদেশ শোনার মত মানসিকতা স্বর্গবাসীদের আর থাকল না। তাদের ধর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তারা অশান্ত হয়ে পড়ল। তারা ঈশ্বরের প্রাসাদে প্রবেশ করার চেষ্টা করতে লাগল। ফলে ফেরেস্তাদের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করতে লাগল। শুরু হল ফেরেস্তাদের সঙ্গে লড়াই। রক্তের বন্যা বয়ে গেল। জন-সমুদ্রের ঢেউয়ের মুখে। সমস্ত ফেরেস্তা খড়-কুটোর মত ভেসে গেল। অবশেষে জনগন ঈশ্বরের প্রাসাদে প্রবেশ করল। প্রাসাদে প্রবেশ করে তারা অবাক হয়ে গেল। দেখল, ঈশ্বরের সিংহাসনে শয়তান বসে আছে। 

Post a Comment

Previous Post Next Post