ঝুঁজকি আলোর রেখা-১০/আজিজুল হাকিম

 


পর্ব-১০

রাজনীতির আফিমাসক্ত সমাজ

 পরের দিন দুপুরে খাওয়ার পর আমি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বিছানায় গেলাম। আলবেলাও কিছুক্ষণ পর আমার পাশে গিয়ে তার দেহ বিছানায় এলিয়ে দিল। তারপর কাত হয়ে আমার দিকে মুখ করে বলল, বল তারপরের ঘটানা।

আমি বললাম, ও সব গল্প বাদ দিয়ে অন্য গল্প কর।

ও বলল, না। আমি শুনতে চাই। তোমাকে বলতেই হবে।

আমি কিছুক্ষণ থেমে বলতে শুরু করলামঃ পৃথিবী বদলে যায়। সময় গড়িয়ে যায় অদৃশ্য স্রোতধারায়। সেই স্রোতধারায় অথবা তার অদৃশ্য শিকলে বেঁধে আমাদেরকে টেনে নিয়ে চলছে অজানা অপরিচিত কোন এক জগতের দিকে। পিছুনের ঘটনাগুলো স্মৃতির পটে স্বপ্নের মতো ভেসে বেড়ায়। কত বন্ধু যায়। কত বন্ধু আসে। পরিবর্তন হয়ে যায় আমাদের চলা ফেরার স্থান। আমাদের বসবাসের স্থান। খেলাধুলার স্থান। খেলাধুলা, চলাফেরা, কথাবার্তার ধরণ।

আর এই পরিবর্তনের স্রোতধারায় ভাসতে ভাসতে হাইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হলাম। গ্রামের বন্ধুত্বের গণ্ডি পেরিয়ে আশেপাশের দশবারোটি গ্রামের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে পরিচয় ঘটল। ধীরেধীরে তাদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।

এদিকে একটি দলের মিছিলের বহর আরো বড় হতে লাগল। অন্যান্য দলের বহর ছোট হতে হতে কিছু সংখ্যক লোকের মাঝে গিয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে কোন মতে বেঁচে থাকল। সেই সময় দেখেছি রাজনীতির প্রতি মানুষের কতটা টান! কতই না মোহ জড়িয়ে ছিল রাজনীতির মধ্যে!

যখন কোন মিটিং উপলক্ষ্যে লোকেরা মিছিল করে হাঁটতে হাঁটতে যেত, তখন দেখতাম মিছিলে পা মিলিয়ে গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পাঁচ-দশ কিলোমিটার চলে যেত। তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিছিলের লোক দেখতে ঘণ্টা পার হয়ে যেত। তবুও মনে হতো, এই মিছিলের যেন কোন শেষ নেই। কীসের নেশায় এত আনন্দ,  কীসের নেশায় এত উত্তেজনা কিছুই বুঝতাম না। কেবল সেদিকেই তাকিয়ে থাকতাম অপলক।

নানীকে একদিন বলেছিলাম, এই দলে এত লোক কেনে?

উনি বলেছিলেন, এর আগে যে দল ক্ষ্যামুতায়  ছিল তারা সাধারণ লোকের উপরে খুব অত্যাচার করত। বর্ষা না হলে আমাদের দিকে কোন ফসল হত না। গরিব গরিব লোকেরা খুব কষ্ট করে কডা টাকা জমিয়ে রাঢ়ে গিয়ে ধান কিনে আনত। কিন্তু রাস্তাতেই বাজারের ছেল্যারা আর পুলিশেরা সেই সব ধান কাঢ়্যা লিতক। ওই গরিব লোগগুলাকেও খুব মায়রতক। অত্যাচার কর‍্যা বাড়ি পাঠঠ্যা দিতক। অর লাগ্যা এক বছর সভাই রাগ কর‍্যা এই দলকে ভোট দিয়্যা সরকারে আন্যাছে।

আমিও সেই ছোট বেলায় সেই সব মিছিলে মাঝে মাঝে পা মিলিয়েছি। যখন কোন বিজয় মিছিল হতো তখন সেই মিছিল আরো আনন্দময়, আরো জাঁকজমক করার জন্য শোলার ঘোড়া, মাইক, ঢাকঢোল এই সব নিয়ে আসা হত। সেই আনন্দে আমিও সামিল না হয়ে থাকতে পারতাম না। সেই শোলার ঘোড়ার সঙ্গে আমাকেও যে নাচতে হবে। তাই আমিও ওদের সঙ্গে একদিন খুব নাচলাম। সেদিন ছিল বিজয় মিছিল। গ্রাম পঞ্চায়েত ভোটের পরে সেই মিছিল বেরিয়েছিল।

আলবেলা বলল, তুমিও নাচতে পারো! একদিন তোমার নাচ দেখব।

আমি বললাম, ঠিক আছে দেখ। এই নাচের বিষয়ে সেই ছোট বেলা থেকেই আমার লজ্জাবোধ কম ছিল। জানি না এই নাচের বিষয়ে আমার এত আগ্রহ কেন ছিল। প্রাইমারীতে পড়ার অবস্থা থেকেই আমার এই নাচের প্রতি আগ্রহ। যখন প্রাইমারীতে পড়তাম তখন তালের ডাল নিয়ে শোলার ঘোড়া তৈরি করতাম। সুন্দর করে পরিষ্কার করে কেটে, ছিঁলে, সামনের অংশে ফুটো করে সেখানে ঘোড়ার মতো মুখ লাগাতাম। তারপর এর চারিদিকে আঠা লাগিয়ে কাগজ সাঁটিয়ে দিতাম। পরে শুকিয়ে গেলে বিভিন্ন রকম রঙ দিয়ে সুন্দর করে চোখ-মুখ আঁকতাম।

আব্বা কিন্তু এসব একদম পছন্দ করতেন না। ফলে মাঝে মধ্যেই উত্তম মাধ্যমের শিকার হতে হতো। কেবল তাই নয়, উনি আমার সখের শোলার ঘোড়া চুলোতে ভরে পুড়িয়ে দিতেন। তবুও আবার তৈরি করতাম।

একদিন সন্ধ্যার পরে পাড়ার ছেলেদেরকে নিয়ে শোলার ঘোড়া আর ঢোল বাজানোর জন্যে ভাঙ্গা টিন নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ঢোল বাজাতে বাজাতে আর নাচতে নাচতে গেলাম আমাদের পাড়া থেকে অন্য পাড়ায়। সেখানে একটি তেমাথায় বেশকিছু লোক জড়ো হয়ে গল্প করছিল। ওরা আমাদেরকে নাচ দেখানোর জন্য ধরল। আমরাও দেখিয়ে দিলাম। নাচ দেখে ওরা ভীষণ আনন্দিত। খুব প্রশংসা করল আমাদের। কেউ কেউ আরও ভালো করার পরামর্শ দিল। ঢোল বাজনা আর পোষাক আসাকেরও পরামর্শ দিল।

ওদের কথা শোনার পর যেই অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করলাম; ঠিক ওই মুহূর্তে আমার বড় আব্বা গিয়ে পিছুন থেকে আমাকে জোরে একটি চড় কষিয়ে দিলেন। তারপর অন্যদের দিলেন তাড়া। সেই মার খেয়ে আমি দিলাম ছুট। কোথায় থাকল শোলার ঘোড়া কথায় থাকল বাজনা; সে সব ফেলে শুকনো পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে, অন্ধকারের বুক ফেঁড়ে মাঠে মাঠে দিলাম ছুট।

আলবেলা বলল, খুব মজার গল্প তো!

আমি বললাম, খুব মজারই গল্প। এখনও সেদিনের কথা মনে পড়লে সেই সব পাগলামির জন্য হাসি পাই। সেই সময় বিভিন্ন কাজে মাঠে গিয়েও জোরে জোরে গান গেয়ে জমির আলে আলে নেচে বেড়াতাম। এমন কি আমাদের বাড়ির আশেপাশের কোন বাগানে গিয়ে গাছে উঠে গাছের ডালপালা হেলিয়ে দুলিয়ে নাচতাম। সে নাচের আনন্দ, সেই নাচের স্বাদই ছিল আলাদা।

একদিন দেখলাম একটি বড় মিছিল। হাতে লাঠি, তির ধনুক। কারো কারো হাতে দেখলাম পিস্তল। প্রকাশ্য নিয়ে চলেছে আমাদের গ্রাম পেরিয়ে মাঠের দিকে। সেই মাঠ পেরিয়ে একটি গ্রামে। একটি যুদ্ধের প্রস্ততি নিয়েই চলেছে ওরা। তাহলে কি মারপিট হবে? মনের মধ্যে কেমন যেন দাগ কেটে গেল।

আর হলও তাই। আমাদের গ্রাম থেকেই শুনতে পেলাম বোম পিস্তলের ভয়ঙ্কর সব আওয়াজ। প্রায় ঘণ্টা তিনেক পর ওরা ফিরে এল। ওদের মধ্যেই অনেকেই খাম, জখম হয়ে ফিরে এল। সঙ্গে নিয়ে এল, লেপ, কাঁথা, কাঁসার থালা বাটি, কলসি - বাড়ির আসবাবপত্র সব। সে সব মালপত্র লুঠ করে নিয়ে আসা হল। বট তলায় সেগুলি জমা করে নিলামে তোলা হল।

এর পর থেকেই শুনতে লাগলাম বিভিন্ন গ্রামে মারপিট আর লুঠতরাজের খবর। সে সব ঝামেলায় মার্ডারের খবরও শুনা যেত। মানুষ কিভাবে নেশাগ্রস্থের মতো বউ ছেলে রেখে মারপিট করত, মার্ডার করত, মার্ডার হতো তা ভেবে পেতাম না। সেই সব ঝামেলায় এক একটি সংসার ধূলিসাৎ হয়ে যেত। নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত এক একটি সংসারের সকল সদস্য।

একদিন শুনলাম, কেবল বিরোধী পার্টি করার জন্য ছোট ভাই এক রাতে, একটি পুকুর পাড়ে বড় ভাইকে মার্ডার করে দিয়েছে। অথচ ওই বড় ভাই অনাথ ভাইকে খুব কষ্ট করে লালন পালন করে মানুষ করেছিল।

তারপর দেখলাম, সেই পার্টির মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। বিরোধী পক্ষও আস্তে আস্তে শক্তিশালী হচ্ছে। আমাদের গ্রামেও এক লিডার বেশ কিছু লোক নিয়ে বিরোধী শিবিরে নাম লিখিয়েছে। ফলে ঝামেলা আরও বাড়তে লাগল। দেখলাম বিভিন্ন গ্রাম থেকে গরু মোষ নিয়ে এসে বিভিন্ন বাগানে মাংস করে ভাগ বাটোয়ার করে খেয়ে নিচ্ছে।

আমাদের এলাকাতেই দেখলাম, সহজ সরল দুটি ছেলে রাজনীতির ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের জীবন আর তার সঙ্গে তার স্ত্রী ও দুটি করে সন্তানের জীবনকে, তাদের রঙিন স্বপনকে, তাদের ভবিষ্যতকে কিভাবে চিরদিনের মতো নষ্ট করে ফেলল। পঞ্চায়েতের প্রধানকে কেন্দ্র করে কয়েক বছরের ব্যবধানে ওই দুটি জোয়ান মরদ মার্ডার হয়ে গেল। ওদের ছেলে মেয়েরা দুর্বিষহ অভাব নিয়ে বড় হতে লাগল। তাদের পৈতৃক স্নেহ চিরিদিনের মতো স্তিমিত হয়ে গেল। ওদের মায়েরা রাতের অন্ধকারে নিলামে উঠতে লাগল। হাতে হাতে, বিছানায় বিছানায় বদল হতে লাগল। যারা তাদের স্বামীদের হত্যা করেছিল তাদেরও ভোগ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে গেল।

আর এদিকে বিভিন্ন দলগুলি তাদেরকে নিয়ে রাজনীতির ফায়দা তুলতে লাগল। এটাই হয়ত রাজনীতির বৈশিষ্ট।

আলবেলা বলল, মানুষ এত নিষ্ঠুর! এত নির্মম!

আমি বললাম, পৃথিবীর সমস্ত মতবাদের মধ্যে আফিমাসক্ত ব্যাপারটি কাজ করে। যাহোক, ওই ফাইবে পড়তে পড়তেই শুনলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে তার বডিগার্ড মেরে দিয়েছে। একদম ছোট বেলায় আব্বা শিখিয়ে ছিলেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন ইন্দিরা গান্ধি।

তারপর খবর আসতে লাগল, যেখানে যেখানে পাঞ্জাবীদেরকে পাওয়া যাচ্ছে তাদেরকে প্রশাসনের তরফ থেকে হত্যা করা হচ্ছে। চরম গণহত্যা নাকি ঘটেছিল সেই সময়।

রাজনীতির কারণে আমাদের পাড়াতেই ঝামেলা কম হতো না। তবে কেউ মুখোমুখি লড়াইয়ের ময়দানে নামত না। ভোট এলে দেখেছি সি,পি,আই (এম)-এর লোকেরা কংগ্রেসের লোকেদের সঙ্গে কথা বলছে না আবার কংগ্রেসের লোকেরা সি,পি,আই (এম)-এর লোকেদের সঙ্গে কথা বলছে না। লিডারদের পক্ষ থেকেই নাকি বারণ করা হতো। কিন্তু আমাকে কেউ কোন দিন এমন নির্দেশ দেয়নি। বরং আমি সি,পি,আই(এম) পার্টির ছত্রছায়ায় বড় হলেও আমি অনেক কংগ্রেস পার্টির ছেলেদের সঙ্গে গল্প করতাম, আড্ডা মারতাম। আমার জন্যে ছিল অবাধ বিচরণ। আমাদের পঞ্চায়েতের উভয় দলের অধিকাংশ বড় লিডাররা আমাদের গ্রামেই বাস করত আর তারাই সমস্ত গ্রামগুলিকে পরিচালনা করত।

এরকমই একদিন সন্ধ্যাবেলায় কলেজ থেকে ফিরে এসে শুনলাম, আমাদের গ্রামেও ঝামেলা হয়েছে। এমনকি গোলাগুলিও হয়েছে। তবে কেউ হতাহত হয়নি। ফলে এই ঝামেলার কারণে পাড়ায় যুবক ছেলে থেকে বয়স্ক লোক কেউ নেই। পুলিশে ধরার ভয়ে সকলেই পাড়া ছাড়া। যারা ঝামেলা করেছে তারাও নেই, যারা ঝামেলা করেনি তারাও নেই। মাঠে গিয়ে পাটের জমিতে লুকিয়ে লুকিয়ে মশার কামড় খাচ্ছে। কেবল মেয়েরাই বাড়িতে আছে।

আমি বাড়ি ফিরতেই মা বললেন- খেয়ে দেয়ে মাঠে পাল্ল্যা যা। তোর আব্বাও পাল্ল্যা গেলছে।

আমি একটু ঠাট্টা করে বললাম- আব্বা মারপিটে ছিল নাকি?

তুই জানিস ন্যা, ঝামেলা লাগলে তোর আব্বা আগেই মাঠে পাল্ল্যা বস্যা থাকে?

আমি জানি, মারপিট করার মতো আব্বার কোন সাহস নেই। এমনিতেই কারো সঙ্গে ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে থাকেন না। কেবল সংসারের কাজ নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু আজ পুলিশের ভয়। তাছাড়া পুলিশেরা তো আর ক্রিমিন্যালদেরকে ধরে না। ওরা কেবল সাধারণ লোককে ধরে হয়রানি করে। এই ভয়েই আব্বা পালিয়েছে।

আসলেই আব্বার পুলিশের প্রতি খুবই ভয়। সেই ছোট্ট বেলায়  একদিন আমি একাকি কোঠায় উঠে খেলা ধুলা করছিলাম। এমন সময় আব্বাও কোঠায় উঠলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, চিল্লাবি না। পুলিশ আস্যাছে। ধর‍্যালিবে।

আমি কোঠা থেকে নেমে দেখলাম কয়েকটি বাড়ির ওপারে পুলিশ। কেন এসেছে, কি কাজে এসেছে, কিছুই জানি না। ওরা নানার সঙ্গে কিছু কথা বলল; তারপর চলে গেল। পুলিশ আমাদের গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার পরে আব্বা কোঠা থেকে নামলেন। এরকমই আব্বার সাহস ছিল।

আমি মাকে বললাম, আমি পালাব না। তাছাড়া আমি কলেজ থাক্যা আস্যা আল্যা গেলছি, মাঠে যায়্যা আমার নিন্দ আসবে না। ধরে লিয়্যা গেলে যাক। থানাতেই নিন্দ পারব।

নানী এসেও আমাকে খুব বুঝালেন। পুলিশের মারের ভয় দেখালেন। তবুও আমি বাড়িতেই থাকলাম।

খাওয়া দাওয়া করে ল্যাম্পটি জ্বেলে বৈঠকে পড়তে বসলাম।

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে দেখলাম, পুলিশ এসে আমাদের বৈঠকের সামনে দাঁড়াল। তারপর ওদের মধ্যে একজন আমাকে ডাকলেন। আমি বৈঠক থেকে নেমে রাস্তায় গেলাম। একজন বললেন, প্রধানের বাড়িটি কোথায়?

প্রধানের বাড়িটি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ ছয়টি বাড়ির পরে। ইশারা করে দেখালাম।

উনাদের মধ্যে একজন বললেন, কি নিয়ে গ্রামে ঝামেলা?

আমি বললাম, আমি কলেজে ছিলাম। বাড়িতে ছিলাম না। বাড়ি ফিরে শুনলাম রাজনৈতিক ঝামেলা।

এর জন্য কারা দায়ী?

উভয় দলের নেতাদের তুলে নিয়ে যান, তাহলেই আসল কারণ পেয়ে যাবেন।

উনারা আমাকে প্রধানের বাড়ি দেখানোর জন্য নিয়ে গেলেন। বাড়ির সামনে গিয়ে প্রধানকে ডাকলেন। প্রধান বেরিয়ে এলেন। একজন পুলিশ অফিসার বললেন, গ্রামে ঝামেলা লাগিয়ে দিয়ে বাড়িতে ঘুমাচ্ছেন? থানাতে এই গ্রামের একটা যথেষ্ট সুনাম ছিল; কিন্তু আপনি প্রধান হওয়ার পরেই প্রথম এই গ্রামে মারপিট, গোলাগুলি। আগামী কালকের মধ্যেই যদি ঝামেলা না মিটে, শান্তি ফিরাতে না পারেন তাহলে সবার আগে আপনাকেই থানাই তুলে নিয়ে গিয়ে পিঠের চামড়া তুলে নেবো। কথাটা মনে রাখবেন।

প্রধান কোন উত্তর দিলেন না।

পুলিশেরা ফিরেলে আমিও ওদের সঙ্গে ফিরে এলাম। আমাদের বৈঠকের সামনে এলে আমাকে বললেন, যাও, তুমি পড়াশোনা কর।

পুলিশ চলে গেলে মা আর নানী আমার কাছে এলেন। নানী বললেন, তোর সাহস তো মন্দ লাই। তুই পুলিশের সাথে কথা বুললি! অধের সাথে বেড়ালি, তাও তোকে ধর‍্যা লিয়্যা গ্যালো না!

মা বললেন, তোর চোদ্দ পুরুষের এমন সাহস নাই। তোর আব্বা তো বিল্যায়ের মতো কুন পাটের ভুঁইয়ে যায়্যা লুকক্যা আছে।

ল্যাম্পের আলোয় আমার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

এই রাজনীতির ঝামেলা কেবল গ্রামের লোকেদের মধ্যে হতো তাই নয়; পাড়ার মেয়েদের মধ্যেও দেখা যেত।

আলবেলা আশ্চর্য হয়ে বলল, মেয়েরাও?

আমি বললাম, হ্যাঁ। বিশেষ করে যাদের স্বামীরা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত সেই সব মেয়েরা বিরোধী পার্টির মেয়েদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে তর্ক করতে করতে এক সময় ঝগড়া করতে শুরু করত। আস্তে আস্তে সেই ঝগড়া চরম আকার ধারণ করত। দুই হাতকে উপরে তুলতো আর নামাতো। সেই হাত দুটির সঙ্গে মাথা আর শরীর এক সঙ্গে উঠতো আর নামতো। এক জন উপরে হাত তুললে অপরজনের হাত নীচে। এরকম ব্যায়াম ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলত; যতক্ষণ পর্যন্ত ওদের গলা না ভেঙ্গে পাতি হাঁসের মতো ফ্যাস ফ্যাস করত। ওই ঝগড়ায় সমস্ত খারাপ কথাগুলি উঠে আসতো। গোষ্ঠীর পিণ্ডি দেওয়া হলে তবেই ছাড়ত।

মাঝে মাঝে ঝগড়ার চিৎকার চেঁচামেচি শুনেই ঘুম ভাঙ্গত। কখনো কখনো এমন হতো একটি ঝগড়ার রেশ কয়েক দিন চলে যেতো। সকালে দু ঘণ্টা এই ঝগড়া চলত তারপর নিজের নিজের কাজে চলে যেত। পরের দিন আবার। এই ভাবেই চলত। তখন এমন মনে হতো যে এই সব ঝগড়ার চিৎকারেই বুঝি সূর্যেরও ঘুম ভাঙ্গে।

তবে এই সব ঝগড়ার মন্দের মধ্যেও একটি ভাল দিক ছিল; সেটি হল এই সব মেয়েরা কখনোই হাতাহাতি করত না। এমনকি মাকেও দেখেছি, তিনি কাস্তে হাতুড় ছাপা কাগজের ছোট পতাকা বুকে নিয়ে শুয়ে থাকতেন।

এ নিয়ে আমরা কত ঠাট্টা তামাশা করতাম। মা কোন উত্তর দিতেন না; কেবল হাসতেন।

আলবেলা আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, এখন ঘুমাও আবার পরে শুনব।

(চলবে)

Post a Comment

Previous Post Next Post