ঝুঁজকি আলোর রেখা-৫/আজিজুল হাকিম

 


আমাদের গ্রাম

আমাদের বাড়িটাও ছিল মাটির। তিনটি বড় বড় ঘর। ঘরের উপরে টালির ছাউনি। মূল ঘরের উপরে নিম কাঠের তীর। তার উপরে বাঁশের বাতা পরস্পর সাজানো। তার উপরে কাদার মোটা আস্তরণ। তার উপরে কাদা আর গোবরের গোলা দিয়ে লেপা। চিকন কোঠা। পুরো ঘরের ভিতর, বাইরের দেয়াল আর মেঝে পুরোটাই সুন্দর করে লেপা। উসরার দুই প্রান্তে ছোট বড় কুঠি সাজানো। সেগুলও সুন্দর করে লেপা-কুছা। দুই দেয়ালের মাঝে এক কোণায় ঘাড় পর্যন্ত উঁচুতে একটি ত্রিভুজের মতো তাক। চেয়ার বা টুলে উঠে সেখান থেকে তাকে পা দিয়ে কোঠায় উঠার পথ। মা কখনও সপ্তাহে, কখনও পনেরদিন অন্তর একদিন করে পুরো বাড়ি আর ঘর লেপতেন। কেবল আমাদের বাড়িটাই যে মাটির ছিল তা নয়, পুরো পাড়া বা গ্রামটিতে রাস্তা ছেড়ে কিছুটা দূরে সারিসারি মাটির বাড়িগুলি সাজানো ছিল। তখন তিনটি পাড়া মিলিয়ে পুরো গ্রামে মাত্র চারটি পাকা বাড়ি। অন্য বাড়ির চেয়ে আমাদের বাড়ির স্বতন্ত্র এই যে, আমাদের বাড়িটা ছিল বেশ পরিষ্কার ও পরিছন্ন।

ছোট বেলায় দেখতাম, মা মাঠে থেকে বড় বড় ঢিলের চাপ ঝুড়িতে ভরে কাঁখে করে নিয়ে আসতেন। তখন অবশ্য মেয়েরা অনেক কিছুই কাঁখে করে বইতেন। যেমন আমাদের পাড়াতে মাত্র দুটি ইঁদারা ছিল। সেই ইঁদারা থেকে কলসিতে পানি তুলে কাঁখে করে বাড়ি নিয়ে যেতেন। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ইঁদারার চারিপাশে গোল করে গা ধুতাম। সে কি আনন্দ!

কালের স্রোতে সেই ইঁদারার জায়গায় এলো টিউবওয়েল। পঞ্চায়েত থেকে পাড়ায় পাড়ায় টিউবওয়েল পুঁতে দেওয়া হল। ইঁদারার ব্যবহার আর থাকল না - অকেজো হয়ে গেল। আমরাও ছুটলাম ইঁদারা ছেড়ে টিউবয়েলের কাছে। এটাই হয়ত পরিবর্তন। এটাই হয়তো বিপ্লব। এইভাবেই কখনও কখনও নিঃশব্দে কোন এলাকায় বিপ্লব ঘটে যায়। এই ভাবেই জীবনের রঙ বদলায়। মানুষের আচার ব্যবহার, কথাবার্তা বদলে যায়। বদলে যায় সমাজ জীবনের ধারা।

আমাদের গ্রামের রাস্তা ঘাটও ছিল মাটির। কেবল একটি রাস্তাতেই ইট পাতা দেখেছিলাম। তাও সেই ইট মাঝে মধ্যে উঠে গিয়ে ছোট ছোট গর্তে পরিণত হয়েছিল। সেই মাটির রাস্তাগুলো শীত থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত ধুলোয় পরিপূর্ণ থাকতো আর বর্ষা থেকে হেমন্ত কাল পর্যন্ত থাকত কাদায় ভর্তি। এই বর্ষায় মাঝে মাঝে রাস্তায় দলবদ্ধভাবে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য পথে নেমে পড়তাম। কাদায় গড়াগড়ি খেতাম। সে কি হইহুল্লোড়! সে কি আনন্দের উচ্ছ্বাস! সে সব দিনগুলির কথা কোনদিনও ভুলার নয়।

আমার হৃদয় থেকে বেরিয়ে এল একটি দীর্ঘশ্বাস। কোথায় হারিয়ে গেল সেই সোনালি দিনগুলি!

সেই সময়ের মানুষগুলোও ছিল খুব সহজ সরল। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল প্রচুর। মাঠে গিয়ে দেখতাম, কারো জমিতে ফসল বোনার জন্য মইয়ের প্রয়োজন পড়লে পাশের জমিতে যে মই টানছে তাকে বললেই সে সেই কাজটি করে দিত। তার বিনিময়ে কোন টাকা পয়সা নিত না। এখন অবশ্য সমস্ত কাজই টাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। টাকার বিনিময়েই আজ সব কিছু হয়।

তখন দেখতাম মাঠের সব ফসল ফলত বৃষ্টির উপর নির্ভর করে। যে বছর অনাবৃষ্টি দেখা দিত সেই বছর কোন ফসল ফলত না। ফলে খরার নিষ্ঠুর দাপটে মানুষ অস্থির হয়ে পড়ত। ঘরে ঘরে চলত উপোষের উৎসব।

সেই ছোট্ট বেলা। বয়স আর কতই হবে; বড়জোর ছয় বা সাত। তখন দেখলাম দু বছর ধরে খরা চলছে। আকাশে মেঘ নেই। কখনো কখনো তুলোর মতো মেঘ আকাশে এলেও সেই মেঘে বৃষ্টির কোন বালাই নেই। সেই খরায় দেখলাম, কোন পুকুরে পানি নেই। পুকুরের মধ্যে কুঁয়োর মতো গর্ত খুঁড়ে মাটির তলা থেকে পানি তোলা হত। সেই পানি দিয়েই খাওয়া বাদ দিয়ে সব কাজ করা হতো। সেই খরার প্রথম বছরই পুড়ে-মরে কোন ক্রমে যে পাটগুলো বাঁচল সেগুলিকে জাগ দেওয়ার কোন জায়গা নেই। পাট ভুঁয়েই শুকিয়ে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তিন কোশ দূরের এক বিলে সেই পাট গরু মোষের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হল। পাট পচে গেলে সেই পাট সেখান থেকেই ধুয়ে নিয়ে আসা হল।

আস্তে আস্তে ঘরে ঘরে শুরু হল হাহাকার – হা ভাতের করুন কাহিনী। কারো কারো কোন মতে ফ্যান-ভাত জুটলেও কারো কারো সেই টুকুও জুটছে না। মাঠে কাজ নেই। যতটা সম্ভব সূর্য তার আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে মাঠ-ঘাট। সেই সময় একদিন সন্ধ্যা রাতে দেখলাম, জামসেদদের বাড়িতে আগুন লেগে গেল। সেই আগুন নেভানোর মতো ইঁদারা ছাড়া কোথাও পানি নেই। সেই আগুন নেভানোর জন্য নিজের নিজের বাড়ি থেকে যত জোয়ান লোক সবাই বালতি হাতে আগুন নেভানোর জন্য ছুটল। কিন্তু কোন পুকুরেই পানি নেই। ফলে একটি বাড়ির আগুন তার জ্বালাময়ী লকলকে শিখায় পাশের বাড়িগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এভাবেই প্রায় আধঘণ্টার মধ্যে পাড়া সুদ্ধ আগুনের নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠল। আগুন জ্বলার আগে কোন বাতাস ছিল না। আগুন জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে ঘূর্ণি হাওয়া শুরু হল। আকাশছুঁয়া আগুনের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে পড়ল পাড়ার সমস্ত মানুষের কান্না বিগলিত চেহারা। কান্নার মাতম চলল সারা পাড়া জুড়ে। কেউ কেউ আবার পাথরের মূর্তির মতো নির্বাক হয়ে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকল সর্বগ্রাসী আগুনের দিকে। 

সব পুড়িয়ে যখন দূরের বাড়িগুলিকে আগুন আর ছুঁতে পারল না; তখন আগুন নিজে নিজেই নিস্তেজ হয়ে পড়ল। আর যখন আগুন সবই নিভে গেল তখন জানতে পারা গেল পাড়ায় চার-পাঁচটা গরু, কুড়িটার উপরে ছাগল আর তিনজন মানুষ আগুনে পুড়ে মারা গেছে। তাদের মধ্যে একটি মা আর তার চার বছরের বাচ্চা। আর খাবার দাবার যা কিছু মজুত ছিল সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

যখন আগুন ধরে তখন বাচ্চাটি ঘরের ভিতর। বাড়িতে আগুন লাগলে শিশুটির মা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। প্রথমে বাচ্চাটির কথা ওর মনেই ছিল না। আর যখন মনে পড়ে তখন ও বাড়ির দিকে ছুটে আসে। গোটা বাড়িকে আগুনে ঘিরে ফেলেছে। উসরার চালে আগুন। শিশুটি মা………মা……. করে চিৎকার করছে। একজন মেয়েটিকে ধরতে যায়। কিন্তু মেয়েটি ওর হাত ছাড়িয়ে আগুন টপকে আঙিনায় পড়ে। তারপর একছুটে ঘরে। মুহূর্তে বাচ্চাটিকে বুকে তুলে নেয়। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গেলে চাল সমেত আগুন উসরার উপরে হুড়মুড় করে পড়ে যায়। বাচ্চাটিকে নিয়ে মেয়েটি ঘরের কোণে লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘরের মাথার চালাটাও ওদের মাথায় পড়ে যায়।

তখন আমি ছোট। তাই আমাকে ওদের মৃত দেহ দেখতে দেওয়া হয়নি। মায়ের মুখে শুনেছিলাম, যখন ওদের লাশ ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসা হল তখনও নাকি মা তার বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরেই বসে ছিলেন।   

এক দিকে খরা আর অন্য দিকে ঘর পোড়ার অসহ্য যন্ত্রণায় মানুষ কাতর হয়ে পড়ল। এসব সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ আবার বিষ খেয়ে আত্মহত্যাও করে ফেলল।

সেই সময় আমাদের প্রায় দশ বিঘা জমি থেকেও বজরার আটার রুটি খেয়ে কোন ক্রমে আমরা বেঁচে থাকতাম। সেই রুটি কোন ভাবেই মুখে তুলতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু কোন উপায়ও ছিল না। সেই খরার বছরই আমাদের পাড়ায় একটি মুদিখানা দোকান বসল। মা-এর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি সেই দোকানে গিয়ে বজরার আটা কিনে নিয়ে আসতাম। অনেকে আবার লতাপাতা রান্না করে খেয়ে দিনপাত করতেন।

শেষ পর্যন্ত এই খরা থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য সরকারিভাবে শুরু হল বিল সংস্কারের কাজ। বিলটি ছিল আমাদের গ্রামের উত্তরে। বিলের সংস্কারের কাজে আব্বা ছিলেন লেবারদের ম্যাট। সেই ছোট বেলায় পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বাবার জন্যে সেখানে মাথায় করে খাবার নিয়ে যেতাম। সেটি ছিল বেশ বড় বিল। মানুষের মাথার খুলি দেখে আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – “আব্বা, এখানে মানুষের মাথার খুলি কেন?”

আব্বা বলেছিলেন, “কোন এক সময় এখানে হিন্দু লোকেরা শ্মশান দিত। মানে কোন হিন্দু মারা গেলে তাদেরকে এখানে পুড়ানো হতো। যেসব হাড়গুলি পুড়ত না সেগুলি এই বিলে ফেলে দিত।”

বিলটির নাম ছিল মগরাদহ। নানী বলেছিলেন, “ওখানে একটা মরঘাটি ছিল।” মরঘাটি বলতে শ্মশানকে বোঝানো হত। ওই বিল সম্পর্কে নানীর মুখেও অনেক গল্প শুনেছিলাম। উনি বলেছিলেন,  “একসময় এই বিল ছিল বিশাল একটা নদী। সেই নদীর উপর দিয়্যা চাঁদ সওদাগর বাণিজ্য করতে যাচ্ছিল। ঠিক তখন এই বিলের দহায় পড়্যা লা গেল ডুব্যা। তারপর বেহুলা লখিন্দরের মরা লাশ লিয়্যা কলার মাড়ে কর‍্যা ওই নদীর বুক দিয়্যা স্বগগে গেলছিল। ম্যালাই দিন পরে, যেখানে চাঁদ সওদাগরের লা ডুব্যাছিল সেই লায়ের দু মাথায় দুট্যা গাছ হয়্যা ছিল। সেই দুট্যার মধ্যে একটা গাছের গুঁড়িতে একটা বড় খোটর ছিল। সেই খোটরে ছিল মনসা সাপ। বোশেখ মাসের সময় পতি সমবার ওখানে বিশাল ম্যালা বসত। দ্যাশ–বিদ্যাশ থাক্যা ম্যালা লোক আসতো। ওই বিলের ধারে লোকে গহোগহো করত। হাতি ঘোড়াতে চোড়হ্যাও লোক আসত। তারও ম্যালাই আগে ওখানে সুন্দর সুন্দর কাঁসার থালি, পাতল্যা পাওয়া যাতোক। কোন বাড়িতে খানা হলে সেই বাড়ির লোক ওই বিলের কাছে যায়্যা চাহাতোক। যখন চাহাতোক একটা ঢেউ আস্যা তখন পাতল্যা, থালি পাহাড়িতে থুয়্যা যাতোক। তারপর এক সময় একজুনা থালি লিয়্যা আর দিল না। তখন থাক্যা বিলও থালি বাসন দেওয়া বন্ধ কর‍্যা দিল। লোকজন যখন বিলের ধারে যায়্যা কান্নাকাটি করল; তখন গোটা বিলের বুকে ভেসে উঠল বড় বড় পদ্মপাতা আর সুন্দর সুন্দর পদ্মফুল। থালি বাসনের বদলে বিল পদ্মপাতা দিতে লাগল।”            

ওই খরা অবস্থায় যখন পর পর দুটো বছর চলে গেল তখন মানুষেরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ল। সকলের ধর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। আশ পাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের লোকজন সলা পরামর্শ করে একদিন ওই উত্তপ্ত আগুন ঝরানো দুপুর বেলায় ভাণ্ডারার বিলের মাঝে বাল্যাঘাট নামক এক জায়গায় প্রচুর লোক জমায়েত হয়ে নামাজ পড়তে গেল। নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে সকলে আল্লাহর কাছে হাত তুলে মোনাজাত করতে শুরু করল। মোনাজাত করতে করতে সকলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সকলের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রুর ঝর্ণা ঝরতে লাগল। অনেকে আবার ব্যাকুল হয়ে চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করল এক ফোটা আকাশের পানির জন্য।

এইভাবে সময় গড়াতে লাগল। এক এক করে দু ঘণ্টা কেটে গেল। সেই কান্নার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল মাঠ থেকে গ্রামে। গ্রামের কোণায় কোণায় প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই কান্নার রোল। তবুও মানুষের কান্নার কোন বিরাম নেই।

এমন সময় কোথা থেকে মেঘ এসে আস্তে আস্তে সূর্য ঢেকে গেল। সে কি ঘন মেঘ! সেই ঘন মেঘ দেখে নামাজীরা সব আরো জোরে চিৎকার করে কান্না করে চলল। তারপর হঠাৎ মসুলধারে বৃষ্টি শুরু হল। নামাজীদের তখনও হাত নামানোর কোন কথাই নেই। এবার ওরা সন্তুষ্টি চিত্তে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানিয়ে কান্না করতে  লাগল। চোখের অশ্রু আর বৃষ্টির ধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। চোখের অশ্রুর রঙ এক হলেও পরিস্থিতি অনুযায়ী কান্নার ধরণ আলাদা, কান্নার স্বাদও আলাদা। দুঃখে যেমন বুক ফাটে, আনন্দেও বুক ফাটে; কেবল স্বাদটুকু আলাদা।

সেদিন এত বৃষ্টি হল, সারা মাঠ ভেসে গেল। মোনাজাত শেষে সেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এক বুক প্রত্যাশা নিয়ে, আগামীর সবুজ স্বপ্নে বিভোর হয়ে সকলেই ফিরে এলো। সে কি আনন্দ! সে কি উচ্ছ্বাস! সে কি শুকরিয়া আল্লাহ্‌র প্রতি! বাড়ির ছেলে মেয়ে থেকে বউ-ঝি কারো মনেই যেন সেই আনন্দ আর ধরে না।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post