গল্প
চৌদ্দ-পোয়া - ১
রাহুল পারভেজ
জেকের আলীকে চোর বলা খুব মুশকিল। তবে কুমড়ো-কদু কিম্বা গাছ-গাছালির ফলমূলে তার কিঞ্চিৎ
আসক্তি থাকায় কেউ কেউ তাকে বলত--হাত লবকা। বেলাগাম খানাপিনার কারণে
মানুষের হাঁক-ডাকে গোটা এলাকায় তার নামটি উচ্চারিত হত জেকের ‘ঢাকি’।শব্দটির
ব্যুৎপত্তি হল ‘ঢাক’ আকৃতি পেট যার।সকাল হলেই কাঁচা-লঙ্কা-পেঁয়াজ,
সর্ষে তেল নিষিক্ত এক চাটু পান্তা আমানিসহ সাঁটিয়ে নিয়ে কাজে বেরিয়ে যেত
সে। পেট তার এমনই যে রাত দু’পহরেও ছাতুর শরবত না খেলে ঘুম হত না তার।বিবি লালবানু তো হর-হামেশাই খোঁটা
দিত--মইষ্যা রাক্ষস!
আপন-পর কেউই তাকে দাওয়াত দিতে চাইত না। কিন্তু না ডেকে
উপায় কি? পঞ্চের রীতি-রেওয়াজ এরকমই। গুড়ের ক্ষীর হোক বা
পায়েস, গামলা সাবাড় না করে সে উঠত না। মাংস মিষ্টি
জিলাপি ধ্বংসেও তার সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল পাঁচ সের।
জমি-জিরেত অল্প-স্বল্প ছিল বটে তবে তা ছেলেদের কব্জায়। ছেলে-মেয়ে ছয়।পর পর তিন মেয়ে।
তারপর ছেলেরা। মেয়েদের মক্তবে আমপারা খতম হতেই বিবি লালবানুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগিয়ে ঘর-গেরোস্তির পোষ্য
গাই-বকনা-মুরগি- ছাগলের বদৌলতে দু'আনির কান মাকড়ি, নাকের নোলক, চাঁদির গোট-বিছা,
পায়ের মল, মানটিকলির বিনিময়ে অর্থাৎ যাকে যেমন তাকে
তেমন দিয়ে থুয়ে তিন মেয়েকে ক্রমান্বয়ে পরের ঘরে পাঠিয়ে দেয়ার ফরজ কাজ
সম্পন্ন করেছে জেকেরালী।
তিন ছেলেকে জেকেরালী যথাকালে স্কুলে দিতে কোন খামতি রাখেনি। কিন্ত গোবর-গণেশদের
ক্লাশ টুতেই দৌড় শেষ।তিন রত্নের দিন দিন নানান বদগুণ বৃদ্ধির আতঙ্কে জেকেরালী সকাল
সকাল তাদেরও বিয়ে দিয়ে হাত তুলে নিতে বাধ্য হয়। তারাও
তাদের অর্জিত গুণ মাফিক রাজত্ব চালাতে থাকে।চাষের জমি লিজ দিয়ে, হাটে হাটে
গরুর দালালি করে, তিন তাসের জুয়া খেলে নবাবি চালে ঘুরে বেড়ায়। বাপ-মার দিকে ফিরেও তাকাই
না।
অন্যদিকে বিবি লালবানুও তাই।ছয় সন্তানের পর থেকেই পগার তুলে দিয়েছে দাম্পত্যের সীমান্ত রেখায়।পাড়ার
গেরস্ত বাড়ি বাড়ি ঢেকিতে পাহার (প্রহার) দিয়ে,চাক্কিতে আনাজ পিষে, পচানো পাট ছড়িয়ে
বেবশ দেহে বিছানার এক কোনে জিন্দা লাশ হয়ে পড়ে থাকে লালবানু। রাত ভোর নাক
ডাকায়। ভুল করেও পাশের দিকে গড়াই না। ছুঁতে গেলেই হাঁউ মাউ চিৎকার জুড়ে দেয়।
জেকেরালীর বুকের খাঁচার পাখি তখন ছটপট ধক ধক করতে থাকে।অনেক ক্ষণ ভেতর থেকে তপ্ত লাভাস্রোত উগরাতে থাকে। তীব্র
গন্ধমদন মগজের মগডালে হুঁড়ুক দেয়। কিন্তু অর্ধেক আকাশ, না গর্জায় না বর্ষায়! কেবল নাক ডাকায়।
জেকেরালী ভাবে,তার সংসারে লালবানুর হাড়ভাঙ্গা খাটুনির দাম কোনদিনও তো সে শোধ
করতে পারবে না। কাজের চাপেই তো সে বুড়িয়ে গেছে। নানা এলোমেলো কথা এসে ভীড় করে। রাতও
গাঢ় থেকে গাঢ় হয়। লালবানুর পাশ থেকে নিঃশব্দে সে সরে যায়। হেঁসেলে
মাটির কলসী থেকে ঠান্ডা পানি ও ছাতুর শরবত খেয়ে থির হয়।
তখন ধীরে ধীরে দিনে দেখা কারো পাকা পেঁপে কারো গাছ-পাকা আম-কাঁঠালের প্রাচুর্য
তার নাসারন্ধ্রে বেহদ বাস ছড়ায়। হাতের নিসপিসানি চাগাড় দেয়। দড়া-দড়ি, হেঁসো আর লগা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিশির ডাকে।
মেতে উঠে আরেক নেশায়।
জেকেরালীর ‘ঢাকি’ নাম ছড়ানোর ফর্দটাও ছিল খুব লম্বা যা ধীর-লয়ে উন্মোচিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়।আশপাশের চৌদ্দ খানা
গ্রামে সেই ছিল সেরা কাঠ-ফাড়ুয়া। ষাট ছুঁই ছুঁই শরীরখানা ছিল গাঁট্টাগোট্টা পাকানো
বেতের মত মজবুত। তার মজুরি ছিল এক বেলা পঞ্চাশ,দিনাবধি এক নম্বরী। এক মুঠো বিড়ি, আরেকটা
দেশলাই। সে দর-দাম যাই হোক, কারো কাঠে কুড়োল মারার আগেই তাকে দিতে হতো চারটে স্বাস্থবান কলাই রুটি।সঙ্গে লাল টুকটুকে
শুকনো পোড়া লঙ্কা বাটা। আর আচারের তেলমথিত পর্যাপ্ত কাঁচা-পেঁয়াজ। সঙ্গে আখের গুড়
পেলে সে একটু ফাউ কাজও করে দিত।
(চলবে)
গল্পটি খুব ভাল লাগল। পরের পর্বগুলো পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ।
ReplyDelete