সম্পাদকীয়
আজ সারা বিশ্ব জুড়ে এক অস্থির অবস্থা। মানবিকতার
আর্তনাদ আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এক চরম ব্যর্থতায়। এতদিন যাদের মানবিকতার পূজারী
বলে মনে হতো, যারা মানবিকতার জয়গান সারা বিশ্বে ফেরি করে বেড়াত আজ তাদের কণ্ঠে দানবের
হুঙ্কার। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার নুন্যতম অধিকারটিও ওরা ছিনিয়ে নিচ্ছে। ফলে মানুষের
জীবনের মূল্যটুকু কোথায় হারিয়ে গেছে তারা নিজেরাই জানে না। যত যুদ্ধবাজ হিমঘরে বসে
বসে মানুষ মারার ফন্দি আঁটছে। আর একটা শিশু হারিয়ে ফেলছে তার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন,
খেলার সাথী, প্রিয় পাঠশালা। কখনো হারিয়ে ফেলছে নিজের হাত অথবা পা। আর যদি জীবনটাকে
হারিয়ে ফেলতে পারছে; তাহলে সে হচ্ছে ভাগ্যবান। কারণ সবসময় বোমারু বিমান আর মিসাইলের
আতঙ্কে অনিদ্রায়, অনাহারে মাসের পর মাস ছুটাছুটি করতে হচ্ছে না। আর এদিকে ধর্মশালায়
বিবেক নিধনের মদের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বিধর্মী বিনাশের ষড়যন্ত্র চলছে সর্বক্ষণ। সাধারণ
মানুষের শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। হারিয়ে যাচ্ছে
প্রেম-ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ।
এমন সময়ে একমাত্র সাহিত্যিক তার সাহিত্যের কারুকার্য
দিয়ে মানুষকে শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার দিশা আলো হাতে আবির্ভূত হতে হবে। আর সেই
জন্যে সাহিত্যের সঞ্জীবনী সুধায় সজ্জিত হয়ে আমাদের এই পত্রিকা ‘ভিন আকাশের তারা’।
কবিতা
ব্যর্থ নজরুল এবং আর একটা জন্মদিন
তৈমুর খান
ধর্মের অন্ধকারে
মানবাত্মার ক্রন্দন শুনতে শুনতে
আমরাও অন্ধকার হয়ে
যাই
হিন্দু মুসলিম দুই
কাঁটাতার
বহু শতাব্দীর পর
আজও কেউ মানুষ হয়নি
এক একটা ষাঁড়ের শিঙে
লাল কাপড় বাঁধা
ছুটে আসে দুর্বোধ্য
ঘাতক
রক্ত গড়ে যায় পাথরে
রক্ত গড়ে যায়
কোথাও মানুষ নেই
সবাই মানুষের মতো
সভ্যতা এক একটা ঘাতকের
সিঁড়ি...
~~~~~~~~
শেষের কবিতা লিখবো না
সেলিম শাহরিয়ার
আমি কোনোদিন শেষের
কবিতা লিখবো না
কারণ, আমার একদিকে
আলো পড়লে
অন্যদিকে ছায়া পড়বেই।
তুমি একটা আকাশ তৈরি
করো
দেখবে অনেকেই সেখানে
মেঘ হতে চাইবে।
ভয় পেয় না, মেঘের
ডানায় বৃষ্টিও থাকে।
সাবধান! বজ্রবিদ্যুৎ
ছাড়া এ পৃথিবীতে বৃষ্টি নামে না কোনোদিন।
অরণ্যের গভীরে একটা
পাহাড় থাকা জরুরী।
যেখানে সমান্তরাল
বলে কিছু হয় না
যেখানে যে যার মতো
সবাইকে বেঁকে যেতে হয়
জীবন আসলে জীবনই
কত রকম ভাবেই না
বাঁচা যায়!
আর কত রকম ভাবেই
না বাঁচতে চেয়েছিলাম!
কিন্তু কোনোটাই ঠিকভাবে
বাঁচা হয়ে উঠেনি।
তোমাকে যে সাগরটা
দেখিয়েছিলাম
ওটা আমার শূন্যতার
সংক্ষিপ্তসার।
আর ঢেউগুলো, আমার
শূন্যতার ঢেউ
শুধু ফেনার বুঁদ
বুঁদগুলোতে কিছু থাকে
ওরাই বালিরেখা আঁকে,
নিজের নতুন পরিচয়
দেখতে দেখতে
আমি পুরোনো হয়ে
পড়ি।
না ভেঙ্গেও যে ভাঙা
যায়
এমন শিল্পের শিল্পী
হতে পারিনি বলেই
আমার দুঃখগুলো মহানুভব
হতে পারেনি
আণবিক সত্যের সীমারেখা
পেরিয়ে
এখন আমাকে জানতে
হবে নিরুদ্দেশ হওয়ার ঠিকানা।
আলোর গতি অতিক্রম
করাই আমার লক্ষ্য হবে।
কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকে
পড়ে উঁকি দিয়ে দেখতে হবে
ভিড় কবে কমবে।
আমার পরিচিত জিনিসই
আমার কল্পনার স্বরলিপি।
আমি চলে গেলেও পৃথিবী
টাল খেয়ে যাবে না।
তাই তোমাকে পেলাম
কি না পেলাম
তাতে কিছু যায় আসে
না,
মিলনে আমি অধীন হয়েও
স্বাধীন
বিরহে আমি স্বাধীন
হয়েও অধীন।
বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার
আগে শান্তই থাকে
ওকে টোকা দিতে যেও
না।
আমি কোনোদিন শেষের
কবিতা লিখবো না।
~~~~~~~~~
একফুঁয়ের জীবন
মীর সাহেব হক
অচেনা
নদীর পাড়ে
এ যেন বনহাসের জলকেলি
শূন্যতাকে ইশারা
করে উড়ে যায়
একফুঁয়ের জীবন।
ঘরের ভেতর ছ্যাতা
শ্যাওলা ধরে ইটে
প্লাস্টারের বালি
ঝরে গেলে
টের পায় শরীরের
লোমকোষ ।
শিকারির মতো বারান্দায়
ঝুলে আছে অন্ধকার
_
এ মন, তুই ফিরে
আয় মনে
একটা কথা রেখে যা'
ধুলোর সিংহাসনে।
যে পথ ধরে বৃক্ষ
হেঁটে যায়
নিহত আলোর সন্ধানে
আমারও একটা কথা
থাক
অসার জীবন , জীবনে।
~~~~~~~~~~~~
তুমি এসো
আজিজুল
হাকিম
তুমি আসছ না কেন?
আর কত হাজার বছর
তোমার অপেক্ষায় থাকলে তুমি আসবে, বলো?
তুমি কি হারিয়ে ফেলেছ
তোমার পথ লু বাহিত অশান্ত সাহারায়?
না সুড়ঙ্গ পথ ধরে
যেতে যেতে হারিয়ে গেছো পিরামিডের অন্তরালে?
না কি ক্লিওপেত্রার
মমিতে একাত্মা হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছ বিলকুল?
নাকি তুমি এথেন্সের
ব্রেথোলে বেলজিয়াম গ্লাসের চুমুকে হারিয়ে যেতে যেতে
কোন এক অন্ধকার কুঠিরে
ব্রা-বিকিনি খুলে নিলামে উঠেছ?
তুমি কি তোমার পথ
ভুলে গেছ, প্রিয়া?
না কি ধর্মীয় মায়াজালে
পড়ে দেবদাসী হয়ে গেছ বরাবর
আজও কি রাত্রির নিমগ্নতা
ছুঁয়ে আছে তোমার ঠোঁটের প্রান্তে?
অথবা চোখের ভুরুরেখায়
বিদ্যুতাঙ্ক?
কিংবা নৃত্য সুখের
উল্লাসে
ভুল করে জটা আর দাঁড়ির
ঝোপে সঁপেছ নিজেকে?
তুমি তো বলেছিলে,
অপেক্ষায় থাকো, আমি আসবো আবার।
তারপর সেই কবে পঙ্খিরাজে
চড়ে চোখের সীমানার বাইরে
তারপর আর আসনি কো;
কিন্তু আঁটকে গেছো
আমার মনের অন্দরে।
সেই সূত্র ধরেই খুঁজে
যাচ্ছি তোমায় প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে যুগান্তরে
পথের পর পথ ভেঙ্গে
গেছি একাকি
কেবল তোমারই নেশায়
সমতল আর পার্বত্য চূড়ার উঁচুনিচু ভুলে গেছি
সেই পথে কত লোকালয়কে
অতীতের চিতায় ভস্ম হতে দেখেছি
কত সম্প্রদায়ের স্বর্ণ
রথের চাকার দুর্বার গতি দেখেছি
আবার সেই চাকা ভেঙ্গেও
গেছে কাল-স্রোতে,
লয় হয়ে গেছে সবই
চোখের পলকে।
আলেকজান্ডারে স্বপ্নের
সাম্রাজ্যে ছাই উড়ে গেছে রাত্রি নিবাসে
চেঙ্গিস খাঁ আর তৈমূরের
তরবারিতে ছিল সূর্যের শান
সে সবের কাছে শুনেছি
কত জং ধরা গান
তারা কি তোমার পথ
আটকিয়ে ছিল সেই দিন?
তুমি কি এলিজাবেথিয়ান
রোম্যানটিসিজমে
অথবা নেপোলিয়ন আর
স্তালিনের জনসভায়
উত্তাল হতে হতে ভুলে
গেছো আমায়?
নাকি হিরোশিমা নাগাসাকিতে
বসে বসে কেঁদে যাচ্ছ আজও!
ইরাক কিংবা লিবিয়ায়,
জর্ডান কিংবা সিরিয়ায়
উদবাস্ত দলে লিখিয়েছ
কি তোমার নাম?
নাকি ভূমধ্য সাগরের
বেলাভূমিতে খুঁজে যাচ্ছ জীবনের উৎসভূমি?
খুঁজে কি পেয়েছ জীবনের
কোন মানে?
আজও তো আমি খুঁজে
যাচ্ছি তোমার যাদুমাখা চোখ,
তোমার ঠোঁটের পাড়ে
লেগে থাকা গোলাপি হাসির শিহরণ।
তবুও তুমি কোথায়?
তুমি কি ইউক্রেনে
ভেসে বেড়াও মিসাইল থেকে মিসাইলে?
তুমি কি ২১শে জুলাইয়ের
অশান্ত মিছিলে মিন্যাডস ড্যান্সে মত্ত?
তুমি কি মতির নেশায়
মতিভ্রমে বুঁদ হয়ে আছ?
না কি রাজনীতির ছেনালিপনায়
নষ্টা দেশের পথ পথে হেঁটে যাচ্ছ আজও?
না কি ব্লাউজের হুঁক
খুলে বক্ষ খাঁজের জাদুতে
ভুলাতে বসেছ যুব-সমাজের
বর্তমান আর ভবিষ্যৎ?
ইতিহাসের পাতায় অ-ইতিহাস
রচনায় কি বিভোর হয়ে আছ?
ভুল যেও না কো প্লীজ!
সব ছেড়ে কাছে এসো।
যদি তুমি আসো
তুমি আমি সাঁতার
কেটে যাবো অসীম বেহেস্তি গঙ্গায়।
নীহারিকার জ্যোৎস্নায়
ভেসে যাবে এ দেহ, এ মন, এই জগত
ময়ূরপুচ্ছে রঙিন
হবে নিকুঞ্জ তোমার
পায়রা আর প্রজাপতির
ডানায় উড়ে যাবে কবিতার কলি
কাব্য-নদীতে ভেসে
যাবে শ্বেত-শুভ্র পাল
সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে
অনন্তকাল।
~~~~~~~~~~~~~
আমার নরকগামী পা
তামান্না সুলতানা তুলি
প্রিয় লিরিক, প্রিয় সিম্ফনি-
‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে
যতনে আমার নামটি লিখো...’
এমন কত কি মুছে ফেলে
মানুষ!
ক্লদ মন’র পেইন্টিংয়ের
মতো প্রিয় কিছু,
লোটাকম্বলের মতো
মনোগ্রাহী জীবনালেখ্য
ভুলে অনেকেই চলে
যাচ্ছে
শরীর ছেড়েও তো আত্মঘাতী
হয় অনেকেই
শিরা উপশিরা ছিঁড়ে
হৃদয়
অস্তিত্বের সাথে
জেদের অবসরে হেরে চলে যায় নিজের থেকে,
দম্ভ ও পতনের সহজাত
মীমাংসায়
দুর্বার প্রেমে অনেকেই
লুপ্ত করে স্ব
স্বীকৃত কারাগার
ছেড়ে যৌথ খামারে
ওষ্ঠ্যে-অধরে মাখামাখি
খুনে অনেকে নিজেকেই ফেলে যায় ।
অনেকদিন আমার কোন
যাওয়া নেই
না আত্মিক না শারীরিক
যাওয়া
না যেতে, না যেতে
ক্লান্ত ভীষণ!
এখান থেকে সোজা চলে
যাবো যেমন উচ্ছন্নে চলে গেছে
আমার নরকগামী পা।
~~~~~~~~~~~
খতিয়ান বদল
আবদুস সালাম
দিন বদলের সীমানায়
খতিয়ান বদলে যায়
বিভৎসদিন প্রহরাবিহীন
করিডোরে বন্দি
সভ্যতার বিকাশ পথে
উল্লাস শ্লোগান দেয়
ক্ষমতা দেখা দেখানোর খেলা চলে নিরন্তর
ভুয়ো সংস্কারের স্বরলিপি
লেখে নষ্ট মানুষ
একমনে করুন সুরে বাজে
বেহালায়
জীবনের আনাচে কানাচে
খুঁজে পায় সর্বনাশ
উল্লাস গেয়ে চলে
ভৈরবী
পাল্টে যায় সংবিধান
অদ্ভূত সব পঙ্ক্তি
দিয়ে রচিত হয় সভ্যতার গান
নারী আর্তনাদে কাঁপে
সভ্যতার প্রাচীর
ক্ষুধা আর অপুষ্টির খতিয়ানে অবিচার
ডানা মেলে
শপিং মলের দরজায় শুয়ে থাকে
জীবন্ত লাশ
অত্যাচারের বাজনা
বাজে তারস্বরে
রাতের আকাশে আঁকা
হয় নিষিদ্ধ আলপনা
স্বপ্নেরা আল্পনার
শ্লীলতাহানি করে
নিষিদ্ধ প্রান্তর,
জঙ্গলে খেলা করে সভ্যতা
দুমড়ে মুচড়ে যায়
প্রকৃতির গর্ব
স্বর্গ বানায় ইট
কাট পাথরে
পুরুষ সভ্যতার খতিয়ান
বারবার বদলে যায়
~~~~~~
আঁধারের অগ্নিকুণ্ডে উলঙ্গ সুইয়ের সুতা কুড়াই
তাফসি অন্তরা
কি আর করবো বলো!?
আঁধারের অগ্নিকুণ্ডে
উলঙ্গ সুইয়ের সুতো কুড়াই
কথা ছিল কথা হবে
দেখা হবে....
ঘুমের ঘোরে গোপন
স্বপনে
হলুদ চুম্বনের ফুল
ফুটলে নাইতে যাব!
শ্রাবনের স্নাত দুপুরে
দ্রবীভূত রোদ্দুরের
এলোথেলো নাচের তালে
মহিনের গান ধরে লাউ
ডগার ঘুম ভাঙ্গাবো
নিঃসঙ্গতার ফাটল
ঘুচে জলকেলিতে উঠবো মেতে
নিলাজ নদীর অথৈ জলে।
এসবের কিছুই করা
হল না
স্বপ্নহীন রাত -
বিরাতে
দুচোখ গলে অন্তর্লীন
আঁধার ঝরে বিভীষিকার ছদ্মনামে
কি আর বলবো বলো!?
সবই ছিল মোহনছল কচু
পাতার নষ্ট জল।
~~~~~~~
আদিখ্যেতা
ফজলে রাব্বি নবাব
কোনো এক বাচনিক বয়ানে
আদিখ্যেতা
নাকি সুরে ভ্রুকুঞ্চনে
উষ্মা প্রকাশে হটেনটট,
পিগমি,লৌহিতকূলের
সোমালি যুবা
অথচ প্রত্যাশার গণ্ডি
ছিল বড়োই নগণ্য
তদুপরি নাক সিটকানো,ভ্রুকুচকানো,ওষ্ঠাধারের
পল্টি
কখনো নিরুত্তরী ভাবলেষ
‘থ’
কখনো লালমুখো রাগত:
‘তো’¡
কখনো বাকহীন রাহীন
গম্ভীর পাথর প্রতিম।
প্রসঙ্গতঃ
স্মৃতিরা খোঁচায়,ঘুমেরা
জাগায়,স্তম্ভরা বিমূর্ত
ইহজাগতিক মুষড়ে পড়া
প্রান্তিকতার অবয়ব।
নিরামিষাশী অরণ্যে
অভিবাসী প্রাপ্তিটুকু কেড়োনা
বরং ক্ষমো তবু মাংসাশী
সেজোনা
সাজতে পারো আলেয়ার
লাহান বাঁশঝাড়ের
গোরারণ্যের ভৌতিক
রানি।
~~~~~~~
কাল
রেহানা জামান
একটা সাঁঝবাতির মায়া
আমাকে টানে, প্রবল টানে
তার মায়াবতী আলো
লেগে আছে আজও প্রাণে
চারপাশে এতো আলো,
তবু আমার আঁধার কাটে না
আমি খুঁজে বেড়াই;
শহর থেকে গাঁ, গাঁ
থেকে পাড়ায় পাড়ায়
ঘরে ঘরে, দোরে দোরে
পরখ করি হাজার বাতি
সেই সাঁঝবাতি মেলে
না।
ছিল এক টিনশেড ঘর,
দরজা খোলা
গোধূলির হলুদ আলো
ধীরে ধীরে সরে গেলে,
আঁধার নামলে-
সাঁঝবাতি হাতে এক
রমনী উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢুকতো,
ডাক দিয়ে বলতো,
"বকুল, ঘরে আয়, বাইরে আন্ধার নামিছে"
আঙিনায় তখন জোনাকির
মেলা, ঘরে সাঁঝবাতি
আমি জোনাকির মেলা
ফেলে সাঁঝবাতির কাছে ছুটে যেতাম কি এক মায়ায়!
সেই ঘর- উঠোন, সেই
রমনী, সেই সাঁঝবাতি
কিচ্ছু নেই এখন, সব বিলিন কালের
গহ্বরে
কাল, তোমার গহ্বর
কতো বড়ো,
কতো ক্ষুধা-তৃষ্ণা
তোমার?
আর কতো গ্রাস করবে,
কতো গ্রাস করবে মায়া,
মায়াবতী দৃশ্যাবলি?
~~~~~~~
শিশির ঝরে
আব্দুল বাসার খান
সবাই আসে কেউ আসে
না
তবু তো কেউ আসে,
রোদের গায়ে বিকেল
খেলা
গল্পবেলার ঘাসে।
রোদ থেমে যায় সন্ধ্যা
নামে
কেউ ফিরে যায় ঘরে
মন বিছানো খোলা হাওয়াই
রাতের শিশির ঝরে।
~~~~~~~
এমন যদি হতো
শরীফ মোঃ সালমান
এমন যদি হতো তোমার
আমার দেশ
জলাঞ্জলি দিয়ে বিগত
হিংসা বিদ্বেষ।
উঁচু নিচু ভেদাভেদ
যত সবকিছু ভুলে
সকলে সকলের হাতে
দিত ফুল তুলে।
পিছনে যে পড়ে আছে
হাত ধরে তার
অনেক চড়াই উৎরাই
করে দিত পার।
ছুটে আসতো বিপদে
বড় ভাইয়ের মত
মুছাতে মমতার হাতে
আঁখি জল যত।
ভুলে যেত পর শব্দ
পরমাত্মীয় জেনে
পর কে আপন করত বুকে
টেনে এনে।
শিখত সবে উদার চিত্তে
স্বার্থ বলি দিতে
ছুটে যেত পরস্পর
পরস্পরের হিতে।
বুঝত আমরা মানুষ
জাতি ধর্ম বর্ণ নয়
সবখানে মানবতার হোক
আগে জয়।
তাহলে ধন্য হতো জাতি
ধন্য হতো দেশ
কারো মনে থাকতো না
দুঃখের লেশ।
~~~~~~~
তোমার হেঁশেল
মণি জুয়েল
তোমার হেঁশেলে ঢোকার
অনুমতি দেবে?
রাতে, আমি খাই না,
তুমিও বেড়ে দাও না তো
কিন্তু দুপুরে...
কিন্তু রাতে, ইচ্ছে
করে
নিজেকে, নিয়ন্ত্রণ
করে নিই, সয়ে নিয়ে
চোখ বুঁজিয়ে দেখতে
থাকি
দুই ফাঁক করা
কেটে দেওয়া পেয়াঁজ
ঝাঁঝে পানি বেরিয়ে
আসে দেখতে থাকি
বীফএর মজবুত হাড়
গোস্তে পুশ করে-
ভিজে আছে, গাঢ়-গ্রেভিতে
তবু খাই না ডুবে
গিয়ে তারিয়ে তারিয়ে
কিন্তু ইচ্ছে? খুব
করে
যেমন দুপুরে।
তবুও খাই না। আসলে
তুমি বেড়ে দাও না তো
চোখ বুঁজে দেখতে
থাকি তোমার হেঁশেল
~~~~~~~
ছোটগল্প
পালাবার রাস্তা
তৈমুর খান
অনেক রাত। রাস্তায় একা। একটা কাক তালগাছে ডানা ঝাপটাচ্ছে। হাওয়ায়
শুকনো পাতাগুলো মড়্ মড়্ করছে। কোথাও পেঁচা ডাকছে। একটা বেড়াল সামনের রাস্তা কেটে পালাল।
বারবার চমকে উঠছি। এই বুঝি কেউ আমার রাস্তা ঘিরে দাঁড়াল। এই বুঝি কে বলল, এই, কোথা
যাস? তোর মুণ্ডুপাত করে ছাড়ছি! চারপাশে একটা আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করতে আসছে। হা-হা করে
ছুটে আসছে রাক্ষস খোক্কসের দল। হ্যাঁ রাক্ষস-খোক্কসই। মানুষ তো আজকাল ভয়ংকর রাক্ষস-খোক্ষস!
একের পর এক গ্রামের সবাই একই রাজনীতির দলে নাম লিখিয়েছে, শুধু আমিই বাকি। তারা সবাই
মিটিং মিছিলে যায়, শুধু আমিই যাই না। একা একা এভাবে কতদিন বাঁচব? তাই গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছি।
না পালালে রাজনীতির লোকেরা আমাকে আর বাঁচতে দেবে না। সেদিন একদল লোক পতাকা, লাঠি, বোমা,
পিস্তল এনে আমাকে শেষবারের মতো বলে গেছে, মত পাল্টিয়ে ফ্যাল, তা হলে আমরা কিছুই বলব
না। আর যদি আমাদের দলে না থাকিস তবে তোর দেহ টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ছড়িয়ে দেবো। কুকুর-শেয়ালে
খাবে।
কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে। কত লাশ তো রাস্তায়
পড়ে থাকে। কত লোকের ঘর পোড়ে। কী বিচার হয়? অনেক সময় পুলিশও আসে না। রাজনীতির ব্যাপারে
পুলিশও নাক গলাতে চায় না। এই দেশ নাকি গণতন্ত্র বিশ্বাস করে। ভোট দিয়ে সরকার হয়। যার
যা ইচ্ছা সে তাকে ভোট দিতে পারে। কিন্তু আমি তো কোনও সময় ইচ্ছামতো ভোট দিতে পারিনি।
আগে থেকেই ওরা মাথা গুনে ঠিক করে কটা ভোট পাবে। ওদের কথা মতোই ভোট দিতে হয়। যে ছাপটি
দেখিয়ে যায় সেই ছাপেই ভোট দিতে হয়। না দিলে ঠিক ওরা বের করে নেবে কে ভোট দেয়নি। তখন
প্রকাশ্য দিনের বেলায় তার বাড়ির বউ-মা-বোনদের টেনে নিয়ে যাবে। একেই কি গণতন্ত্র বলে?
জোরতন্ত্র, শক্তিতন্ত্র, ভয়তন্ত্র, মৃত্যুতন্ত্র, ধর্ষণতন্ত্র, দখলতন্ত্র যা ইচ্ছা
বলা যায়। কেউ কেউ ইতরতন্ত্রও বলতে পারেন।
আমি বি.এ পাশ একজন
বেকার যুবক। বহুদিন এই দলের সঙ্গেই ছিলাম। একটা চাকুরি পাব আশা ছিল। দলের নেতা আমাকে
বলেছিলেন, আমাদের সঙ্গে থাক, চাকুরি এলেই ব্যবস্থা করে দেবো।
নেতার কথা শুনে দলের আগে মিছিলের হোর্ডিং
ধরে যেতাম। কখনো পতাকা ধরে দলেরই শ্লোগান বলতে বলতে সারা শহর ঘুরতাম। বন্ধের দিন ট্রেন,
বাস যাওয়ার সড়কগুলি আঁটকে দিতাম রাস্তায় শুয়ে পড়ে। পুলিশের মারও কত খেয়েছি। অল্পদিনেই
দলের সবার সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হাসি-ঠাট্টাও করার মতো লোক পেয়ে যাই। ভোট এলেই
মজা করে বলতাম, কই হে উৎসব তো এলো, টাকা-কড়ি কিছু ছাড়ো, খরচাপাতি করি!
নেতাও বলতেন, পাবি, পাবি, তোদের জন্যই
তো উৎসব!
উৎসব চলেও যেতো। কিছুই পেতাম না। কয়েক বোতল মদ আর দু-একদিন
মাংস ভাত ছাড়া। এভাবেই জীবনটা কাটছিল। বয়সও চাকুরি পাওয়ার সীমানা অতিক্রম করে গেল।
শেষ বয়সে একটা বিধবা মেয়েকেই বিয়ে করতে হল কিছু পাবার আশায়। পেলামও বিঘেদুয়েক জমি।
একটা সন্তান হল। গত বছর বাবা-মা দুজনেই মারা গেলেন। এখন তিনটে প্রাণী আমরা। একজোড়া
বলদ কিনে জমি চাষ করি। রাজনীতিতে আর যাই না। কোনও ঝামেলাতেই থাকতে চাই না।
কিন্তু রাজনীতির লোকেরা আমাকে ছাড়বে
না, ক' দিন থেকেই আমার পেছেনে লেগেছে। এখন যদি আমাকে খুন করে তা হলে আমার দু বছরের
সন্তানের কী হবে। আমার স্ত্রী তো দ্বিতীযবারও বিধাব হবে.... এ সবই ভাবছি অনবরত। ভাবতে
ভাবতে ক-রাত ঘুম আসছিল না। স্ত্রী বলছিল, তুমি এভাবে আর কত দিন কষ্ট পাবে? এভাবে কি
বাঁচা যায়? আমি একটু ভেবে নিয়ে বলেছিলাম, যতদিন না দেশের পরিবর্তন হয়। স্ত্রী বলেছিল,
দেশের পরিবর্তন হোক বা না হোক, আমাদের তো বাঁচতে হবে। রাজনীতির লোকেরা মায়া-দরদ কিছুই
বোঝে না, খুন করে দেয়।
আমি বলেছিলাম, তা হলে চলো, আমরা গ্রাম
ছেড়ে পালিয়ে যাই। অন্য কোথাও গিয়ে থাকব। জমি-বাড়ি সব বেচে দেবো।
স্ত্রী তাতেই রাজি হয়েছিল। আগে বাবার বাড়িতে
গিয়ে উঠি তারপর কোথায় থাকব ঠিক করা যাবে এই বলেই আজ দুই দিন হল স্ত্রী বাবার বাড়িতে
আছে। আমি দুই দিন পর আসছি বলেই ওকে পাঠিয়ে দিই।
দুইদিন ধরে গ্রামে জমি-বাড়ি বিক্রি করার লোক
খুঁজে পাচ্ছি না। দলের নেতা যদি জানতে পারে আমি গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছি তা হলে তো কথাই
নেই আমাকে শহিদ হতেই হবে। খুব সাবধানে এ সব করতে চাইছিলাম, কিন্তু হল না। হালের গোরু
দুটি শুধু বিক্রি করতে পেরেছি। সেই টাকাগুলো আমার সঙ্গেই আছে বাড়িতে কিছু চাল, গম,
সরষেও আছে। বাড়ি বিক্রি না হলে তো আবার ফিরতেই হবে। কিন্তু ফিরবই বা কী করে। রাজনীতির
লোকেরা জোঁকের মতো লেগেছে। স্ত্রী আর ওদের সঙ্গে আমাকে পাঠাতে রাজি নয়। সন্তানটিও খুব
বাবা বাবা করে। আমার এখন ঘরেই বেশিক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করে। বয়সও হয়েছে। ওসব ঝামেলা আর
কি সহ্য হয়? কিন্তু কে বোঝে! রাতের অন্ধকারে দুদ্দাড় করে সব চলে আসে। বলা নেই, কওয়া
নেই এসে সোজা আমার শোবার ঘরে ঢুকে বলে, চল্ শালা, বউ পেয়ে দল ভুলে গেলি! কেউ কেউ একধাপ
এগিয়ে বলে, এই মাগিই যত নষ্টের গোড়া! আগে সুবল ভালোই ছিল। এই মাগিকেই নিয়ে চল্!
এত অপমানকর কথাবার্তা শুনেও চুপ করে থাকতাম। কারণ ওদের হাতে
থাকত আগ্নেয় অস্ত্র। সংখ্যায়ও বেশি। সুতরাং সহ্য করাই ভালো। স্ত্রী ফুঁপিয়ে কাঁদত।
কী বলে সান্ত্বনা দোবো! খাল কেটে তো কুমির আমিই এনেছি। আগে ওদেরই সঙ্গে ঘুরেছি। ওদেরেই
দলে নাম লিখিয়েছি।
আজ পরিস্থিতি আলাদা।
বাঁচলে আমার সন্তানকে বলে যাব, বাবা কোনও দিনও রাজনীতি কোরো; না রাজনীতির লোকেরা ভালো
হয় না। আমি জীবনে কখনো ভালোলোক দেখিনি।
কিন্তু এখন কী হবে?
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছি।
গ্রাম পেরিয়ে মাঠ। মাঠ পেরিয়ে একটা জঙ্গল। এখন এই জঙ্গল পেরিয়ে গেলেই বড় রাস্তা। ভোরের
দিকে একটা বাস পাওয়া যায়। ওই বাস ধরেই যাব বলেছি। আমার কোনও মোবাইল নেই। এই যুগে যে
কেউ একথা শুনলে হাসবে। দলের নেতা একবার বলেছিলেন, একটা মোবাইল তোকে দেবো।
আমি আর কোনওদিন ও কথা ওর মনে স্মরণ করে দিইনি।
ওদের কোনও কিছু নেওয়া তো দারুণ রিক্সের ব্যাপার। তখন আরও আমাকে ব্যস্ত করে তুলত। কিসে
যেন পাখিটাকে ধরেছে আর সে বাঁচার জন্য প্রাণপণ ডানা ঝাপটাচ্ছে!
কঁক্ কুঁক্ কঁক্ একটানা চিৎকার করেই
যাচ্ছে। আমার বুকটা ধড়াস্ করে উঠল। এই পাখিটার মতো আমারও অবস্থা। কিছুতেই বেরিয়ে আসতে
পারব না। ভয়ে ভয়ে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই টর্চের আলো পড়তে দেখলাম সামনের রাস্তায়। মনে
হল কারা যেনা আছে ওখানে। গাছের আড়ালে থেকে এক-পা দু-পা করে এগোচ্ছি। দেখলাম আমাদের
গাঁয়েরই একদল মানুষ সবাই রাজনীতির লোক। নাচু, ফুটু, সাবির, আনসার, মগরা, হলু, লগড়া
জব্বার, মাসুদ, কালু সবাই আছে। না, আর আগানো যাবে না, ধরা পড়ে যাব। এই মুহূর্তে ধরা
পড়লে আর রক্ষে থাকবে না। আমাকে শেষ করেই দেবে। প্রাণের মায়ায় পা দুটো স্থির হয়ে গেল।
চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। অসহায় বালকের মতো নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হল।
*******
রূপসী
আজিজুল
হাকিম
দুপুর রাতে কারেন্ট চলে যাওয়ায় সলিমুদ্দিনের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
গরম কাল এলেই কারেন্টের এই একটাই রোগ – যখন তখন চলে যাওয়া। এখন মানুষ একটু নিশ্চিন্তে
ঘুমাবে তা না। অফিসের লোকেরা রাতদিন কিছুই মানে না।
ও কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে উসখুস করতে লাগল। কি করবে, সে কিছুই
বুঝতে পারল না। বিড়ি ধরাবার জন্য ও দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালাল। পাশে বউটা তখনও বেঘোরে
ঘুমাচ্ছে। কি গরম আর কি ঠান্ডা ও কিছুই বোঝে না। ঘুম পেলেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু সলিমুদ্দিনের ব্যাপারটা আলাদা। ঘামে যদি ঘাড়, গলা একটু ভিজে যায় তাহলেই আর
ঘুম আসবে না। তখন হয় বিছানায় পড়ে উসখুস করতে হবে; তা না হলে বিছানা ছেড়ে এদিক ওদিক
ঘুরে বেড়াতে হবে।
ও বিড়ি ধরিয়ে চৌকি থেকে নিচে নেমে এল। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে
উসরার নিচে পড়ে থাকা স্যান্ডেল জোড়ায় পা দুটো গলিয়ে দিল। তারপর আঙ্গিনা পার হয়ে,
গলির ঝাপটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে, ঝাপটা পুনরায় লাগিয়ে দিল।
জ্যৈষ্ঠ মাসের রাত। কোথাও একটুও হাওয়া বইছে না। গাছের পাতাগুলো
নড়াচড়া করছে না। শরীরটা একটু ফুরফুরে হবে তার কোন জো নাই। ও হাঁটতে শুরু করল। তখন
আকাশে একফালি বাঁকা চাঁদ উঠেছে। চাঁদটা দেখতে কামারের হাপরে পোড়ানো চকচকে বাঁকা লাংল্যার
মত মনে হচ্ছে।
ও আস্তে আস্তে এক পা দু পা করে বিলের দিকে এগিয়ে গেল। যদি
ফাঁকা জায়গায় একটু বাতাস পাওয়া যায়; তাই সে ওদিকেই গেল। তারপর দু চারটে বাড়ি পার
হয়ে ওই বিলের ধারে মাঠের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। একটু শিরসিরে হাওয়া বিল থেকে খুব
কষ্টে উঠে আসছে বলে মনে হচ্ছে। ও দাঁড়িয়ে আবার একটা বিড়ি ধরাল। দূর থেকে দেখে মনে হবে যে,
কোন ভুত; যেন মুখে আগুন জ্বলছে আর নিভাছে। বিড়িটা শেষ হলে বিড়ির মুঠোটাকে
একপাশে ছুঁড়ে ফেলে ও ঘাসের উপরে বসল।
এটাকে এখন সবাই বিল বলেই ডাকে। কিন্তু এর আলাদা একটি নাম আছে।
তার নাম হল রূপসী। একে একসময় রূপসী নামেই ডাকা হত। কিন্তু যেহেতু তার আগের সেই রূপ,
সেই সৌন্দর্য নেই; সেহেতু সে এখন রূপসী নাম থেকে বঞ্চিত হয়ে একটি বিল এ পরিণত হয়েছে।
এখনও ভারী বর্ষণ হলেই এই রূপসীর বুক থৈ থৈ পানিতে ভরে ওঠে।
তারপর শীতকাল চলে গেলেই এই পানি কোথায় যে হারিয়ে যায়! বুড়ো মেয়ের জড়সড় মুখশ্রী এবং
হাত-পায়ের চামড়াগুলো যেভাবে ফেটে ফেটে খসখসে হয়ে যায়; ঠিক সেই ভাবে এই রূপসীর সারা
বুক ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আর এখন সেই অবস্থাতেই ও পড়ে আছে। আজকালের বৃদ্ধ–বৃদ্ধারা
যেভাবে ছেলে-মেয়ে আর বউ-ঝির অনাদর, অবহেলা আর লাঞ্ছনা বুকে করে বিছানায় পড়ে থাকে; ঠিক
সেইভাবে রূপসীও পড়ে আছে।
বেশি দিন আগের কথা নয়, সলিমুদ্দিন বারোমাস রাত জেগে জেগে এখানে
মাছ ধরেছে। সেই মাছ বেচে সংসার চালিয়েছে, কিছু জমি-জিরেত কিনেছে, ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছে।
সত্য কথা বলতে কি এই রূপসী তার জীবন জীবিকার একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু এখন আর হয় না।
ভরা বর্ষ নাহলে এই বিলে আর পানি থাকে না। তবুও রাত হলেই যেন এই বিল ওকে ডাকে। কি বর্ষা,
কি গ্রীষ্ম, কি শীত - বারোমাস। কোন কোন বছর বর্ষা না হলে ওর বুকটার দিকে তাকালে সলিমুদ্দিনের
বুকটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে। যে ডোঙায় করে সারারাত ধরে মাছ ধরত সেই ডোঙাটা রূপসীর ফাটা বুকে মরা মানুষের মতো চুপচাপ
পড়ে আছে।
একথা ওকথা ভাবতে ভাবতে কতটা সময় চলে গেছে, সেটা সলিমুদ্দিন
বুঝতে পারিনি। চাঁদটাও বেশ কিছুটা উপরে উঠে গেছে।
রূপসীর শেষ প্রান্ত থেকে হঠাৎ করে ও ঝড়ের সাঁইসাঁই শব্দ শুনতে
পেল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের ঝাপটা সলিমুদ্দুনের গায়ে এসে লাগল; তখন ও ঠান্ডা
ফুরফুরে মেজাজে উৎফুল্লিত হয়ে পড়ল। যে দিক থেকে ঝড়টি আসছিল ও সেদিকেই তাকিয়ে থাকল।
কিছুক্ষণ পরে ও আরো একটা বিড়ি ধরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু না,
বারবার চেষ্টা করেও সে বিড়ি ধরাতে পারল না। বাতাসে বারবার দেশলাইয়ের কাঠিকে নিভিয়ে
দিচ্ছে। ও বিরক্ত হয়ে বিড়িটাকেই পাশে ছুড়ে ফেলতে গেল আর অমনি ওর নজরে পরল একটি মেয়ে
ওর পাশে বসে আছে। পুরো সাদা শাড়িতে আচ্ছাদিত একটি বৃদ্ধ মহিলা। চাঁদের আলোতেও ওর বুঝতে
অসুবিধা হল না যে মেয়েটি একসময় অসাধারণ সুন্দরী ছিল। ও চমকে উঠল। বলল, কে তুমি? তোমাকে
তো চিনতে পারছি না।
বৃদ্ধাটি খুব কষ্টে মুখে এক ঝলক হাসি নিয়ে বলল, আমাকে চিনতে
পারছিস না। অথচ আমার বুকে তুই কতদিন রাত পার কর্যা দিয়াছিস, কতদিন আমার বুকে ডোঙা
ভাসিয়েছিস, কতদিন খলই ভর্তি মাছ ধর্যাছিস আর আজ আমাকে চিনতে পারছিস না?
কথাগুলি শুনে সলিমুদ্দিনের সারা গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল।
শিরশির করে উঠল ওর সারা শরীর। ও আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। বলল, না, আমি তোমাকে চিনতে
পারছি না।
ও বলল, এড্যাই তো আমার দুর্ভাগ্য রে। তুই আমাকে আজও চিনতে পারলি
না। তাহলে কে চিনবে, বল?
আমি তো তোমাকে কোনদিন দেখিনি। তাহলে কি করে চিনব? সলিমুদ্দিনের
বুকে একটু সাহস নিয়ে বলল, এসব ন্যাকামি বাদ দিয়ে আসল পরিচয় দাও তো।
আমি রূপসী, এবার চিনতে পারলি?
কোন রূপসী?
ক্যানে, যে রূপসীর ধারে তুই বস্যা আছিস। এই তো, আমি সেই রূপসী।
আমি তো বিলের ধারে বস্যা আছি। তুমি একটা বিল না, মানুষ? একটা
বুড়হ্যা মিয়্যা।
হ্যাঁ, আমি তো এখন বুড়হ্যা হয়ে গেলছি। আমার গাল, হাত-পা –
সব জড়োজড়ো হয়্যা গেলছে। হবেই বা না কেনে, আমি তো আর আগের মতো জোয়ান নাই।
আমি তোমার হেঁয়ালি কথা বুঝতে পারছি ন্যা।
ও বলল, বুঝবি, বুঝবি সব বুঝবি। যে নদীকে দেখছিস এই নদী আমি।
আজ এই নদী আমি মানুষের রূপ ধরে তোর কাছে আস্যাছি। তোর সাথে দুট্যা সুখদুঃখের কথা বুলবো
বুল্যা আনু।
সলিমুদ্দিনের মনে পড়ে গেল, ওকে অনেকে বলেছে গভীর রাতে এই বিলের
পানির উপরে নাকি সাদা কাপড় পড়ে একটি মেয়ে হেঁটে বেড়ায়। অনেকে দেখেছে কিন্তু সলিমুদ্দিন
কোনদিন দেখেনি। কি করবে বুঝতে পারল না। ও কি উঠে পালিয়ে যাবে? কিন্তু ও তো শুনেছে
জিন ভুতের খুব শক্তি। ওরা যে কোন মুহূর্তে জোয়ান মানুষকেও মেরে দিতে পারে। তাই সে
অসহায় ভাবে বসে থাকল।
রূপসী বলল, আমার কি কোন কাহিনী তুই জানিস?
সলিমুদ্দিন বলল, না। তোমার কোন কাহিনী জানিনা। কেবল শুনেছি,
তোমার নাম রূপসী। এর বেশি কিছু জানিন্যা।
জানিস, আমি এক সময়ে বিশাল বড় নদী ছিনু। ভাগীরথী থাক্যা আমি
আস্যাছিনু। তারপর আঁকাবাঁকা পথে পদ্মার একটা শাখা এসে আমার সাথে মিল্যাছিল। তারপরে
আমি আরও বড় হনু। তারপর এদিক দিয়্যা আমি ভৈরব নদী গেলছি। আবার ওই মাঠ পার হয়্যা, ঘুর্যাফির্যা
গেলছি গোবরা নালার কাছে। কিন্তু এখন আমি হাত-পা হারা একটা অক্ষম বুড়হ্যা মিয়্যা।
সলিমুদ্দিনের মনের মধ্যে কৌতুহল জন্মাল। বলল, তারপর?
রূপসী বলতে থাকল, সেই ম্যালাই দিন আগেকার কথা। আমি ম্যালাই
উসার ছিনু; তা এক মাইলের কাছাকাছি আর দিঘলের কথা তো তোকে আগেই বুল্যাছি। আমার বুক দিয়্যা সারা বছর কুলকুল কর্যা পানি বহাতক।
তখন জোয়ান ছুঁড়ির মতই ছিল আমার রূপ-যৌবন। তখন আশপাশের সারা গা থাক্যা লোকেরা আসতক বাসন-কসন
আর পাতল্যার লাগ্যা।
সলিমুদ্দিন বলে উঠল, বাসন কসন ক্যানে? তুমি ওসবের ব্যাবসা করত্যাক
নাকি?
রূপসী বলল, ছোড়ার কথা শুন্যা গা জ্বল্যা গ্যাল! আমাকে লিয়্যা
ঠাট্টা করছিস?
সলিমুদ্দিন একটু হেসে বলল, ঠাট্টা করছি ন্যা গো? জানতে চাইছি।
তোমার কাছে কিসের লাগ্যা থালা বাসন লিতে আসবে?
সে যুগের কথা তো তুই জানিস ন্যা। তখন নদীর কাছেই মানুষ নির্ভর
কর্যা চলতোক। তখন আশপাশের গাঁয়ে কারো বাড়িতে বিহ্যাশাদীর ঘটা ঘটলে আমার কাছে আস্যা
কেবল মুখ ফুট্যা বুললেই যখান থালি বাসনের কথা বুলতোক, ঠিক আমার বুকের মাঝখান থাক্যা
একটা বড় ঢেউ তুল্যা তখনই দিতুক। এভাবেই যুগের পর যুগ পার হয়্যা গেলছে। তখনকার মানুষ
সহজ সরল ছিল। মনের মধ্যে লোভ লালসা ছিল না। কিন্তু আস্তে আস্তে মানুষের স্বভাব বদলাতে
লাগল। একদিন একটা লোক আস্যা একশোটা থালি চায়ল। আমি দিয়্যাও দিনু। কিন্তু সেই থালি আর
ফ্যারত আসলো না। ওর আগেও কয়কজনা অমন কাজ কর্যাছিল। কিন্তু ওরা দু-এখান কর্যা লিয়্যা
লিয়্যাছিল। তাতে আমি রাগ করিনি। কিন্তু যখন আমার কাছ থাক্যা লিয়্যা যাওয়া সব থালিগুলান
লিয়্যা লিলো তখন আমার খুব রাগ হল। আমি আর কাহুকে একটাও কিছু দিনুনা।
সলিমুদ্দিন বলল, তাহলে লোকেরা বিহ্যাশাদি কি কর্যা দিল?
রূপসী বলল, যা কর্যা পারলো দিল। তারপর থাক্যা লোক আসে আর ফির্যা
যায়। মুনের মাঝে মায়া আসলো। আমার বুকে আস্তে আস্তে পদ্মপাতায় ছাহ্যা গ্যালো। সেই পাতা
লিয়্যা লোকেরা খানাপানি দিতে শুরু করল।
সলিমুদ্দিন বলল, কিন্তু আমি তো তোমার বুকে কোনদিন পদ্মপাতা
দেখিনি?
রূপসী একটু ঝাঁঝিয়ে বলল, তোদের চৌদ্দপুরুষরা ভাল ছিল? পদ্মফুল,
পদ্মের বিচি সব খাতে শুরু করল। রাক্ষসের বাচ্চা সব। তাহলে কি কর্যা দেখবি, বোল?
সলিমুদ্দিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তাই তো।
রূপসী বলল, তখন আমার সুন্দর রূপ দেখ্যা এক কবিয়াল নাম দিয়্যাছিল,
‘রূপসী’।
সলিমুদ্দিন রূপসীর দিকে তাকাল। কোথায় সেই রূপ! জড়সড় চেহারা।
রূপসী বলল, সেই সব হেমন্ত কালের জোছনায় কত মাঠের পর মাঠ আমি
হেসে খেলে ঘুরে ব্যাড়ালছি। গান গাহ্যাছি। কত সুন্দর সুন্দর রঙিন পাখিরা আমার বুকে ডানা
মেলেছে। আমার বুকের আয়নায় অরা মুখ দেখ্যাছে। চর্যা ব্যাড়ালছে আমার কূলে। তারপর কুঠে
থাক্যা ইংরাজরা উড়্যাপুড়্যা আসলো, আমার বুকে পানি আসার সব রাস্তা বান্ধ দিয়্যা বন্ধ
কর্যা দিল। তখন থাক্যা পানি ব্যাগর আমি মরার মতো হতে লাগনু। তারপর তো তুই সবই দেখলি।
সলিমুদ্দিন রূপসীকে ভাল করে দেখার জন্যে বিড়ি খাওয়ার বাহানায়
একটা কাঠি বের করে দিয়াসালাই ধরাতে গেল। আগুন জ্বলে উঠলে একটা নিঃশ্বাসের মতো শব্দে
আগুন নিভিয়ে গেল। ওর চোখের সামনে অন্ধকার কিছুক্ষণের জন্যে প্রকট হয়ে গেল। ও পাশে তাকাল।
রূপসী নেই। ও চমকে উঠল। তাহলে কি ও এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল?
হঠাৎ বিলের বুকে চোখ পড়ল। মৃদু আলোয় উদ্ভাসিত একটি মেয়ে বিলের
মাঝ বরাবর হেঁটে চলেছে। মাথার উপরে চাঁদ আর একখণ্ড বিশাল কালো মেঘ চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে।
****
বই পড়া নিয়ে মজার সব তথ্য
আমিনা তাবাসসুম
১) Dog’s Ear– বুকমার্ক
হিসেবে বইয়ের পাতার ওপরের দিকের কোণাটা ভাঁজ করে রাখেন তো পড়তে পড়তে উঠে যাওয়ার আগে।
ওটাকে Dog’s Ear বলে। কেন? আবার বলতে হবে, কিছু কিছু কুকুরের কানটা ঐভাবেই থাকে যে।
২)Librocubicularist
(লিব্রোকুবিকুলারিস্ট) – যে ব্যক্তি বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ে।
৩)Epeolatry (এপিওলাট্রি)
– এ হল গিয়ে শব্দের আরাধনা করা। শব্দের মধ্যে এক অসামান্য মাধুর্য, বাক্যে তার ব্যবহার
মন কে যখন মুগ্ধ করে দেয়। ভাষাবিদ দের মধ্যে এই মোহ বিশেষ দেখা যায়।
৪)Logophile (লোগোফাইল)
– যে ব্যক্তি শব্দের প্রতি মোহাবিষ্ট।
৫)Bibliosmia (বিব্লিওসমিয়া)
– পুরনো বইয়ের গন্ধ
৬)Book bosomed
(বুক বোসম্ড) – যে ব্যক্তি বই ছাড়া এক মুহুর্ত থাকতে পারে না।
৭)Omnilegent (অমনিলেজেন্ট)
– যে বিষয়ের বাছ বিচার না করে সব ধরনের বই পড়ে।
৮)BallyCumber (ব্যালিকাম্বার)
– অর্ধেক পড়া অবস্থায় যে সব বই রেখে আপনি উঠে যান,সেই সব বই কে BallyCumber বলে
৯)Tsundoku (সুন্দোকু)
– জাপানীজ শব্দ। ইংরেজী প্রতিশব্দ নেই। এর অর্থ কেনার পর থেকে বই একবারের জন্য না খোলা।
১০)Princep (প্রিন্সেপ)
-কোন বইয়ের প্রথম ছাপা কপিটিকে princep বলে।
১১)Sesquipedalian
(সেস্কুইপিডালিয়ান) – যে শব্দে অনেকগুলি Syllable বা পদাংশ থাকে।যেমন-
ses/qui/pe/da/li/আন
১২)Colophon (কোলোফন)
– বইয়ের শিরদাঁড়া, কিংবা প্রচ্ছদে প্রকাশকের যে প্রতীক চিহ্ন দেখা যায়
১৩) Biblioclasm
(বিব্লিওক্লাসম) – ইচ্ছাকৃতভাবে বই নষ্ট করা।
১৪)fascile (ফ্যাসাইল)
– খন্ড।প্রথম খন্ড,দ্বিতীয় খন্ড…ইত্যাদি।fascile হল কোন বই অনেকটা সময় ধরে যখন বিভিন্নখণ্ডে
প্রকাশিত হয়-যেমন এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, অক্সফোর্ড ডিকশনারি।
১৫)Afficted (আফিক্টেড)
– কোন গল্পের শেষটায় চরম মর্মান্তিক এবং সেটা পড়ার পর প্রবল কাঁদতে ইচ্ছে হলেও কাঁদতে
না পারা,লোকে কি ভাববে এই অনুভূতিকে afficted বলে।
১৬)Bookklempt (বুকক্লেম্প্ট)
– যখন কোন সিরিজের শেষ বইটা পড়ে ফেলেছেন।জানেন যে আর কোন খন্ড বেরোবে না।তবু এই সত্যি
কে মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নন আপনি।এই অনুভূতিকেই বুককলিম্পিত বলে।
১৭)Chaptigue (চ্যাপটিগ)
– সারারাত জেগে বই পড়ার পরের দিন সকাল বেলা আপনার যে ভীষন ক্লান্তিবোধটা আসে, জানবেন
ওই ক্লান্তিটাকে Chaptigue বলে।
১৮) Delitrium (ডেলিট্রিয়াম)
– নতুন কেনা বইয়ের গন্ধে আপনার মনে যে ফুরফুরে ভাবটা ওটার নামই Delitrium।
১৯)Madgedy (ম্যাজেডি)
– কোন দুঃখের গল্প বারবার পড়া এবং পড়তে পড়তে আবার যে আশা করা এবার নিশ্চয়ই শেষটা অন্য
রকম হবে।
২০) Mehnertia (মেনারটিয়া)
– কোন বই অনেকটা পড়ার পর থামিয়ে দিয়ে পুনরায় প্রথম থেকে পড়া শুরু করা।কারণ ততক্ষনে
আপনি পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে ফেলেছেন যে কি পড়ছেন।
২১)Rageammend (রেজামেন্ড)
– যখন আপনি পছন্দের বইটা অন্যান্য বন্ধুদেরকে পড়ার জন্য সুপারিশ করবেন আর করার পরই
শুনবেন যে তাদের সেটা আগেই পড়া হয়ে গেছে এবং মোটেও ভাল লাগেনি,তখন আপনার মনের যা অবস্থা
হয়, সেটাই।
২২)Swapshame (স্বপশেম)
- যখন একটা বই পড়ছেন।পড়তে পড়তে অন্য একটা বই যার শুরুটাও মনে ধরেছে।এখন বুঝতে পারছেন
না কোনটা আসলে পড়বেন। মনের এই অবস্থাটাই Swapshame.
~~~~~~~