সূচীপত্র
কবিতা
সেলিম শাহরিয়ার, মীরসাহেব হক, গোবিন্দ মোদক, নিহার বিন্দু বিশ্বাস, নজর উল ইসলাম, শেখ আব্বাস উদ্দিন, রফিকুল নাজিম, তাম্মানা তুলি, আজিজুল হাকিম, ইমদাদুল ইসলাম, আবু তাহির
গুচ্ছ কবিতা
তৈমুর খান, আব্দুস সালাম
ছোটগল্প
শাবলু শাহাবউদ্দিন, আজিজুল হাকিম
প্রবন্ধ
আব্দুর রহমান
যখন চারিদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, চারিদিকে
যুদ্ধের বীভৎসতা আস্তে আস্তে পৃথিবীকে গিলে খাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে; তখন সাধারণ
মানুষের স্বজনহারা, গৃহহারা কন্নার শব্দ আমাদের কানে ভেসে আসবেই। অনেক কিছুর পরিবর্তন
ঘটবে। খাবারের পরিবর্তে জনগনকে দেশের ‘নাম পরিবর্তন’ খাওয়ানো। মুছে যাবে অনেক কিছু।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য পথের শব্দ প্রতিধ্বনিত
হবে এটাই স্বাভাবিক। আর এর মধ্যেই আমারা খুঁজে বেড়াব একটু আনন্দ, একটু শান্তি আর সৃজনশীলতা
যা প্রকৃতি, সমাজ আর বিশ্বকে হয়তো আলোকিত করবে একদিন।
এদিকে সংসার ধর্মের যাতনা যাপন করার পরও সমস্ত প্রতিকূলতাকে
পেরিয়ে আমার নিজের ও আপনাদের সৃজনশীলতাকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এখনও।
কাগজের মলাটে এই প্রচেষ্টাকে বন্দি করতে গিয়ে যে আর্থিক অপ্রতুলতা হতে হয় প্রযুক্তির
এই অভিনব সম্ভাবনাকে গ্রহন করা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় থাকে না। আপনাদের সহযোগিতা পেলে
আশা করা যায় আরও এগিয়ে যাওয়া যাবে।
আজিজুল
হাকিম
সেলিম
শাহরিয়ার
অনেকদিন তোমার প্রতিমায়
হাত দেওয়া হয়নি।
ইস! কত ধুলোময়লা
পড়েছে।
অন্ধ এ সময়ে, বন্ধ
ছিল তোমার ঘর।
আজকে তোমার সবকিছু ধুয়েমুছে চকচকে করে দেওয়ার জন্য
এসেছি
আসলে কি জানো, আমাকে
একটা কাল্পনিক বিশ্ব নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছিল
সেখানে তোমাকে মানাবে
কিনা এ নিয়ে ভাবতে গিয়েই অনেকদিন তোমার কাছে যাওয়া হয়নি,
অনেকদিন তোমার প্রতিমায়
হাত দেওয়া হয়নি।
ওরা প্রথমত একটা
কবিতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল,
দ্বিতীয়তঃ শর্ত
দিয়েছিল যে এখানে প্রথম হলে তুমি নাগরিকত্ব পাবে
তুমি তো জানো, তোমাকে
নিয়েই তো আমার সবকিছু
তাই তোমাকে নিয়েই যে কবিতা লিখেছিলাম সেটাই সেখানে
পাঠিয়ে প্রথম হয়ে ছিলাম।
তারপরেও ওরা নাগরিকত্ব
দেয়নি
আমার বিশ্বে যে আমি
কি করে বিদেশি হলাম তা আমি নিজেও জানতাম না।
জানো, ওরা আমাকে কিছুদিনের জন্য ওয়ার্ক পারমিট দিতে চাইছিল
আমি নাবালক থেকে
সাবালক হবো বলে সেই পারমিট গ্রহণও করে ছিলাম। ছি ছি ছি ছি! একটুও ভেবে দেখলাম না আমার
কল্পনার বিশ্বেও আমি বিশ্বনাগরিক নই।
আমি ভুলেও একবারও
ভেবে দেখলাম না, আমার কল্পনাও একটা নগর, আর এই নগরের নাগরিক হতে হলে কিছু শর্তাবলী
পূরণ করা দরকার।
তুমিই বলো, কল্পনাতেও
এত শর্তাবলী প্রযোজ্য হলে, স্বাধীনতাকে ঘৃণা করা ছাড়া আর কিই বা করার থাকে।
এভাবেই আমি যত বড়
হতে চাইছি, ততই ছোট হয়ে যাচ্ছি,
আর সব বাড়ির দরজাগুলো আরো বেশি ছোট হয়ে যাচ্ছে
আমি মাথা ঢুকিয়ে
দিচ্ছি কিন্তু গলা আটকে যাচ্ছে, আর চিৎকার করলে ছেড়ে দিচ্ছে ঠিক, কিন্তু আমি অবাক
হচ্ছি, আমার কল্পনায় আমার পৃথিবী এত ছোট হবে কেন!
আমি যখন বুঝতে পারলাম,
তখন আমার পৃথিবী যেমন ছোট হয়ে গেল, তেমনি ছোট হয়ে গেল আমার কল্পনাও
বড় কল্পনায় রচে
ছিলাম যে প্রতিমা,
আজকে হয়তো ছোট কল্পনায়
মুছে দিতে হবে তার ধুলি।
আসলে কি জানো আমার
প্রতিমাকে আমি নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম নদীর ধারে, তখন ডাঙ্গায় ছিল বাঘ আর জলে ছিল কুমীর।
ডাঙ্গায় থেকে হারিয়েছিলাম দুখানা হাত, তার জলে নেমে হারিয়েছিলাম দুখানা পা। এখন
আমার একটা মাথা আছে, আর আছে একটা পেট।
আর তোমাকে ধুয়েমুছে
চকচকে করে দিতে চাইছি, আমার চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে টাপুর টুপুর বৃষ্টি। ও আমার প্রতিমা,
আমাকে ক্ষমা করো, আমাকে ক্ষমা করো,
ক্ষমা করো আমার পঙ্গুত্বের
মেঘলা আকাশটাকে।
মীরসাহেব হক
সে প্রতিদিন দৌড়াচ্ছে
ঝুলে থাকা স্বপ্নের দিকে।
জিভের লালাঝরা দেখে
ওরা ক্ষুধার্ত ভাবেনি
মাতাল ভেবেছে তাকে।
সে জানে তাকে দৌড়াতেই
হবে
ঠোঁট শুকিয়ে গেলেও
আরো একবার জিভ নেড়ে
ভিজিয়ে তুলতে হবে
ফুসফুসের শুকনো দাগ।
রাতের অন্ধকারকে
হার মানিয়েছে
তার বুকের ভিতরে
জমে থাকা
ফুসফুসের শুকনো ভাঁজ।
জন্ম আর মৃত্যু মাঝে
সে উপহার পেয়েছে
অসম দৌড়ের।
আক্ষেপ
গোবিন্দ মোদক
এ সময়ই আমার কোনও
অপেক্ষা নেই
যার সুতোগুলোকে আমি
বিশ্রম্ভলাপে
জুড়ে দিতে পারি
এ সময় আমার কোন
আক্ষেপও নেই
যাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে
বুনে দিতে পারি
তোমার রুমালে
তবু কিছু আগুন-পতঙ্গ
অহেতুক ঝাঁপিয়ে
পড়ে স্মৃতির কোলাজে
মৃত্যু ছাড়া ওদের
আর কোনও উচ্ছ্বাস নেই।
কিছুক্ষণ আগেই একদল
বারবণিতা
এই পথ ধরে মহাস্নানে
গেছে
আমার এমন কোনও জৈবিক
চাহিদা নেই
যাতে আমি ওদেরকে
সম্ভাষণ করতে পারি
তবু কিছু নখরাঘাত
আমার হৃদয়ের সংগোপনে
অতীত হয়ে থাকে
আর একটা কাগজের নৌকা
অপেক্ষা করতে থাকে
বৃষ্টির ঘোলা জলে
দুলতে দুলতে হারিয়ে
যাবে বলে
একটা কেটে যাওয়া
ঘুড়িও অপেক্ষা করে
শেষ পরিণতির জন্য
অথচ আশ্চর্য এই যে
–
আমার তেমন কোন অপেক্ষা
নেই
আক্ষেপও নেই
নেই মহাস্নানের দশমৃত্তিকার
রকমফের।
জীবনের রূপরেখা
নিহার বিন্দু বিশ্বাস
অস্বচ্ছ জীবন রসে
সময় কাটানো এক যুবক;
ধরি মাছ, না ছুঁই
পানি অবস্থা।
জীবন পাল্টায় জীবনের
টানে
জীবন রসিক বোঝ না
জীবনের মানে ;
জীবন চলে জীবনের
টানে।
সরল রৈখিক সীমানায়
দাঁড়িয়ে
পালাবদলের দিনরাতে
আমি খুঁজি জীবনের
মানে।
অন্তিম রোষানলে জ্বলবে
আগুন
দাউ দাউ স্ফুলিঙ্গ
ছুটে পরবে দূরে। অন্য কোথাও।
সেখানে, জলে আগুনে
পিরিত করবে
গন্তব্যের মাঝপথে
কিংবা শেষাঙ্গে।
জীবনের মানে খুঁজতে
নেই যুবক ;
সময় ও জীবন একই অংগে
বসত করে।
গতির টানে চলছে অবিরত।
সবুজপাতা খয়েরি হয়
মরে যায়। ঝরে যায়।
জন্ম হয় না।
তাই,বাঁচি মনানন্দে।যতোটুকু
সময় পাই।
শিল্পী
নজর উল ইসলাম
তোমাকে দেখি আর ভাবি
ডুবে যাওয়া চাঁদের কারুকৃতি
সব ফর্মাটে জীবন
বুঝি এভাবেই গড়ে ওঠে
রাঙে, নেভে পূজার
পাত্র সেই অঞ্জলীতেই
আড়াল হলে বিমোহিত
টান প্রাগাঢ় হয়
এই পাখির ভুবন এই
বিস্মৃতির মন-উঠোন
মেঘের আত্মপরিচয়
খুঁজি বেহায়া হয়ে পাড়ি
লুকিয়ে লুকনোর ভান
এ গ্লাস ও গ্লাস করি
রোদ্দুরে মেলা কাপড়
থেকে বাষ্প শুকানোর নিয়মে
এই তো ক'দিন আগেও
ভাবতরঙ্গ জুড়তাম তোমার
ইতিহাস থেকে বিজ্ঞান
থেকে ভূগোল ঠুকরে
চেনা-অচেনাকে জিজ্ঞাসা
করেছি মন-রাগিনীকে
এখন বুঝি ডানা একটা
স্বারস্বত অভিযোজন, কামিনী স্রোত
দুঃখের সঙ্গে মিলেমিশে
ঘর করছে স্বভাব
নাম নিয়েছি প্রণয়
প্রতিটি স্তবকে নতুন পাতার গান
বিজ্ঞাপনে বলা যায়
না মাপা যায় না মায়াভূমি
কেবল ভালোবাসার আশ্রয়-প্রশ্রয়
ভাঙি
আমি এক আকাশ তুমি
গড়নের তারাপুঞ্জ মুদ্রণশিল্পী...
হলুদ আলোর মতো এক ফোঁটা জল
শেখ আব্বাস উদ্দিন
আমাদের ভাগ্যরেখা
বিলীন হয়ে যাচ্ছে
জলরঙের অস্পষ্টতার
মত;
ভাবনাগুলো ক্রমশঃ
পরম্পরা হারিয়ে
তাঁতে বোনা শাড়ির
গায়ে জেগে ওঠা
নাল ফোঁড়ের মতো
এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
চাঁদের শরীর থেকে
যেমন আলো চুঁইয়ে পড়ে
শব্দের ভেতর থেকে
কেলাসিত হয় অনুরণন;
তোমার মুখের যে দিকটায়
আলো পড়েনা
সেখান থেকেই সূচিত
হোক
রহস্যময় সম্ভাবনার
গোপন কথা....!
প্রেমের ভেতর ভালবাসা
ঢুকে পড়লে
সকলেই মানবিক হয়ে
ওঠে।
মননে ঔচিত্যের বোধ
জেগে ওঠে।
যে চলে যেতে চায়
রফিকুল নাজিম
যে চলে যেতে চায়
তাকে চলে যেতে দাও
কেনো তুমি মরা গাঙে
উজান বাইতে চাও?
কেনো তাকে পিছু ডাকো
কেনো বাধো সুর
যে চলে যেতে চায়-
সে চলে যাক; বহুদূর।
যার তরে পাঁজর তলে
কুঞ্জ সাজাও একা
তোমার বুকের গোপন
ব্যথায় পাও কি তার দেখা?
যে চলে যেতে চায়,
তাকে পিছু ডেকো না
অমঙ্গল যদি হয়; কোনো
দাবী রেখো না।
তামান্না
তুলি
প্রতিটি বাড়িতে
রাত গুজে দিয়েছি। ব্যালকনি থেকে চাঁদের ঝুলন্ত রেলিংয়ে সূক্ষ্ম সিফনের সংযোগ, হোম মনিটর
থেকে নির্গত নীলের বর্ণচ্ছটায় বেহুশ বিড়ালের সাথে গলাগলি করে মধুপায়ী চাঁদকে বলেছি
বিদায়।
এখানে আসতে পারেন, বসতে পারেন, গল্প
হতে পারে এলোভেরার মতো পিচ্ছিল।
আপনি কি চা পানে অভ্যস্ত অথবা ব্রান্ডি বা রাম? আমার প্রথম ব্রাকেটে ধূমের সাথে খুব
ভালো যায় মার্গারিটা ও অন্যান্য ককটেল আপনি কি মাদুরে বসতে
পারেন, অথবা খোলা পিঠে মেঝের সংযোগে, তাকিয়া ঠেস গিয়ে পারস্যের কার্পেট- কোনটি চাইবেন?
প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে
অন্ধকার গুজে দিয়েছি। চুল থেকে নখের ডগায় ডট পেনের বিন্দু। এখান থেকে চাঁদের দূরত্বে
নিরঙ্কুশ মধ্যবর্তিনী স্বচ্ছ আকাশ, আমার সিফনের নিচে চিতার ক্ষিপ্রতা, তার নিচে নাচুনে
পা পায়ের নিচে ধাবমান সময়, সময়ের মুদ্রায় গ্রন্থিত আমার বিবশ নাচের প্রক্ষেপ।
আন্দোলিত হাত হতে
পারে দেয়াল চাপিয়ে দেয়ার অনুভূতি, পুরো আকাশের ভর সহনীয় মাত্রায় চেপে ধরতে পারি বুকে,
বিড়ালী নম্রতার আড়ালে তীক্ষ্ণ নখের আচড়ে উল্কি হতে পারে নির্মেদ আপনার শরীর আপনি আসতে পারেন, সাহসী হতে পারেন,
জুয়ার দানে জিতে যেতে পারেন একনায়তান্ত্রিক সময়আপনি হারতে পারেন স্বকীয়তার জেল্লা,
মদে চুরচুর কাচ রাত্রির আনন্দ, আসঙ্গ বিষ জর্জর
ঠোঁট পোড়াতে পারেন চুরুটের আগুনে।
ক্ষিপ্ত আয়নায় ঢিল
ছুঁড়ে তরঙ্গে বেঁধেছি জীর্ণ মুখ, আমার ভীষণ অসুখ! আমার পাশে বসতে পারেন আলোকিত জানালার
মতো অথবা প্রগাঢ় ভাঙ্গচুড়ে ভেঙ্গে পড়তে পারেন পাঁচতলা ছাদবাড়ি থেকে নির্জন পথের
উপর। যে সব পুলিশ নির্মোহ সাইরেন বাজিয়ে অকুস্থলে পৌঁছে তাদের মুখের উপর বলে দিবো
“বস রাত্রি সরিয়ে আসুন লাশটা ফেলে দিয়ে আসি”। ঠুনকো পানপাত্রে
গোলাপী মদ, বুকের শাসে তরমুজ রং, নীল বাতির ক্লান্ত প্রহরে যদি না ঘুমাতে পারি, আপনাকে
আহ্বান করছি "আসুন, পাশে বসে বলাবলি করি নাচ ও শিহরণ,
আনন্দ ও সুখদ বিলাসের মুহূর্তের মরণ।
তুমি এসো
আজিজুল হাকিম
তুমি আসছ না কেন?
আর কত হাজার বছর
তোমার অপেক্ষায় থাকলে তুমি আসবে, বল?
তুমি কি হারিয়ে ফেলেছ
তোমার পথ লু বাহিত অশান্ত সাহারায়?
না সুড়ঙ্গ পথ ধরে
যেতে যেতে হারিয়ে গেছ পিরামিডের অন্তরালে?
না কি ক্লিওপেত্রার
মমিতে একাত্মা হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছ বিলকুল?
না তুমি এথেন্সের
ব্রেথোলে বেলজিয়াম গ্লাসের চুমুকে হারিয়ে যেতে যেতে
কোন এক অন্ধকার কুঠিরে
নিলামে উঠেছ আজ?
তুমি কি তোমার পথ
ভুলে গেছ, প্রিয়া?
না কি ধর্মীয় মায়াজালে
পড়ে দেবদাসী হয়ে গেছ বরাবর?
আজও কি রাত্রির নিমগ্নতা
ছুঁয়ে আছে তোমার ঠোঁটের প্রান্তে?
অথবা চোখের ভুরুরেখায়
বিদ্যুতাঙ্ক?
কিংবা নৃত্য সুখের
উল্লাসে
ভুল করে জটা আর দাঁড়ির
ঝোপে সঁপেছ নিজেকে?
তুমি তো বলেছিলে,
অপেক্ষায় থাকো, আমি আসবো আবার।
তারপর সেই কবে পঙ্খিরাজে
চড়ে চোখের সীমানার বাইরে…
তারপর আর আসনি কো;
কিন্তু আঁটকে গেছ
আমার মনের মন্দিরের অন্দরে।
সেই সূত্র ধরেই খুঁজে
যাচ্ছি তোমায় প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে যুগান্তরে
পথের পর পথ ভেঙ্গে
গেছি একাকি
কেবল তোমারই নেশায়
সমতল আর পার্বত্য চূড়ার উঁচুনিচু ভুলে গেছি
সেই পথে কত লোকালয়কে
অতীতের চিতায় ভস্ম হতে দেখেছি
কত সম্প্রদায়ের স্বর্ণ
রথের চাকার দুর্বার গতি দেখেছি
আবার সেই চাকা ভেঙ্গেও
গেছে কাল-স্রোতে,
লয় হয়ে গেছে সবই
চোখের পলকে।
আলেকজান্ডারে স্বপ্নের
সাম্রাজ্যে ছাই উড়ে গেছে রাত্রি নিবাসে
চেঙ্গিস খাঁ আর তৈমূরের
তরবারিতে ছিল সূর্যের শান
সে সবের কাছে শুনেছি
কত জং ধরা গান
তারা কি তোমার পথ
আটকিয়ে ছিল সেই দিন?
তুমি কি এলিজাবেথিয়ান
রোম্যানটিসিজমে
অথবা নেপোলিয়ন আর
স্তালিনের জনসভায়
উত্তাল হতে হতে ভুলে
গেছো আমায়?
না কি হিরোশিমা নাগাসাকিতে
বসে বসে কেঁদে যাচ্ছ আজও!
ইরাক কিংবা লিবিয়ায়,
জর্ডান কিংবা সিরিয়ায়
উদবাস্ত দলে লিখিয়েছ
কি তোমার নাম?
না কি ভূমধ্য সাগরের
বেলাভূমিতে খুঁজে যাচ্ছ জীবনের উৎসভূমি?
খুঁজে কি পেয়েছ জীবনের
কোন মানে?
আজও তো আমি খুঁজে
যাচ্ছি তোমার যাদুমাখা চোখ,
তোমার ঠোঁটের পাড়ে
লেগে থাকা গোলাপি হাসির শিহরণ।
তবুও তুমি কোথায়?
তুমি কি ইউক্রেনে
ভেসে বেড়াও মিসাইল থেকে মিসাইলে?
তুমি কি ২১শে জুলাইয়ের
অশান্ত মিছিলে মিন্যাডস ড্যান্সে মত্ত?
তুমি কি অস্থির দেশে
শুনে যাচ্ছ আগুনের গান?
না কি রাজনীতির ছেনালিপনায়
নষ্টা দেশের পথে পথে হেঁটে যাচ্ছ আজও?
না কি ব্লাউজের হুঁক
খুলে ক্লিভেজ জাদুতে
ভুলাতে বসেছ যুব-সমাজের
বর্তমান আর ভবিষ্যৎ?
ইতিহাসের পাতায় অ-ইতিহাস
রচনায় কি বিভোর হয়ে আছ?
ভুল যেও না, প্লীজ!
অন্তরা, সব ছেড়ে
কাছে এসো।
আমি আজও বসে আছি
তোমার অপেক্ষায় -
তুমি আর আমি সাঁতার
কেটে যাবো অসীম বেহেস্তি গঙ্গায়।
নীহারিকার জ্যোৎস্নায়
ভেসে যাবে এ দেহ, এ মন, এই জগত সংসার
ময়ূরপুচ্ছে রঙিন
হবে নিকুঞ্জ আমার
পায়রা আর প্রজাপতির
ডানায় উড়ে যাবে কবিতার কলি
কাব্য-নদীতে ভেসে
যাবে শ্বেত-শুভ্র পাল
সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে
অনন্তকাল।
লাগে পরাধীন
(তের্জারিমা চতুর্দশপদী)
ইমদাদুল ইসলাম
অদ্য ভারতীয় মোরা
স্বাধীন এ ভূমে
বুঝি কি স্বাধীনতা
কী? বুঝি রক্ত ঋণ?
দানে যাহা শহীদেরা
কালে চির ঘুমে।
দেখি যেন সারা দেশ
মূর্খের অধীন,
শত মানির সম্মান
ভূলুণ্ঠিত আজ;
ভন্ড কুলের দাপটে
লাগে পরাধীন।
ডাল কুত্তার ছোবলে
আজিকে সমাজ,
ছিড়ে ছিড়ে চাহে
খায় নারীত্ব, সম্মান;
চাহে মুঠো মুঠো সুখ
ত্যজি যত লাজ।
লুটিছে মূর্খের দল যত ধন মান,
নিস্পৃহ বেকুব সভ্য
ধরণী বেসুরে;
দিশাহীন কত শত প্রতিবাদী
প্রাণ।
স্বাধীনতার আস্বাদ
যেন বহু.... দূরে,
জ্ঞাত নহি পাই কবে
ন্যায্যতা হায় রে!
অশ্রু ঝরছে
আবু তাহির
হাজার বছর ধরে অশ্রুপাত
হচ্ছে,
আর এক ফোঁটাও অবশিষ্ট
নেই।
কেউ দিবে!
আছে কেউ, ফিলিস্তিনের
মানুষদের একফোঁটা
অশ্রু দেওয়ার জন্য;
ধারস্বরূপ।
মধ্যপ্রাচ্য অথবা
পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে, মাত্র একফোঁটা।
ওঁরা কান্নাকাটি
করে তোমাদের অশ্রু তোমাদের আবার ফেরত দিয়ে দেবে ,
তখন তোমরা সারাজীবন
ধরে কান্নাকাটি কো'রো
---------
গুচ্ছ কবিতা
রাস্তা
একটি পৃথিবী থেকে
অন্য এক পৃথিবীর দিকে
আমাদের ভাষার ভিতরে
অন্য এক ভাষা আছে
আমাদের বাঁচার ভিতরে
অন্য এক বাঁচা
রাস্তা খুঁজে খুঁজে
বনভোজনের মাঠে
একটি শুধু মৃত প্রেম
বয়ে নিয়ে গেছি
আমরাই নক্ষত্রের
সাইকেলে
সবিনয়
নিবেদন
তারপর সোনালি হাঁস, স্বপ্নদিঘি, চাবিগুচ্ছ
স্বপ্নের তীর ধরে
সোজা হেঁটে গেছি
মৃত বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে
তুলেছি
তারপর সবিনয় নিবেদন
একে একে আকাশে বাতাসে
চিঠি লিখে গেছি
চরিত্র
সারাটা দিন অন্নহীন
শোনো, তবু কখনো চোর
ছিলাম না
খড় বিছিয়ে রাত্রিযাপন
শোনো, তবু রাতে যাইনি
কারও কাছে
আগুন ছিল, উত্তাপে
পুড়ে পুড়ে ছাই হয়েছি
এ ছাই কেউ নেয়নি
হাতে তুলে
মৃতদের মিছিল
সারিবদ্ধ মৃত্যুর
কাছে আমি রাখি আর্তনাদ
আর্তনাদে ভারী হয়
রাত
আর্তনাদে কেঁপে ওঠে
দরজা-কপাট
সাঁজবাতি জ্বলে উঠলে
স্তব্ধ প্রহর পড়ে থাকে
মাথার খুলিরা হেঁটে
আসে পরস্পর
জিভ নেই, চোখ নেই,
শাদা-অন্ধকার
আর্তনাদ এক একটি
কবর
সংগৃহীত অ্যালবামের
গোপন রক্তপাত
অথবা ধূসর অপমান
খণ্ড-খণ্ড বিকেলের
নীরব আহ্বান নেমে আসে
রাস্তায় হাঁটতে
থাকে লাশ
তার করোটিতে ওঠে
দগ্ধ চাঁদ !
শবযান
শব্দে শব্দে বুক ভাঙে
অনবদ্য মুখের গড়ন
নিঃশব্দে স্বপ্ন
ঢোকে
বেজে ওঠে পাতার কাঁকন
পাথর সরলে নদী আসে
সংকেত আজ্ঞাবহ
কলোনির অন্ধকারে
শুয়ে আছে মগ্ন দেহ
ভ্রমরীতির ছিত্রপথে
মুক্ত ডানার অবাধ্যতা
জল ছবিতেই ভাসছে
মানুষ
ডাকছে ক্রূর নিঃসঙ্গতা
সমাপ্তির শস্য তুলে
প্রারম্ভিক চলোৎসব
স্বয়ংক্রিয় ঘূর্ণিজলে
সবারই যান নিজের
শব।
নিজের অসুখের মুখ
নিজের অসুখের মুখ
তুলে নিই
নিরাময়ের গল্প শোনাই
আর সভ্যতার রুমালে
মুখ মুছে দিই
আলো এসো,সৌম্য আলো,
রামধনু এসেছিল কাল
বর্ষারা এখনো আসেনি
খরাদের চোখে শুকনো
জল
কী অসুখ তোমার?
দ্রুত ভয় লুকিয়ে
গেল;
বিশেষণ বাহুল্য কেবল
সর্বনাম ভেঙে চুরমার।
নিজের অসুখের মুখ
ঢেকে রাখি
রুমালে অনেক তারার
ফুল
ফুলের আগুনরেণু জ্বলে
ওঠে
আমি তার গন্ধে বেঁচে
থাকি।
আবদুস
সালাম-এর গুচ্ছ কবিতা
রঙচটা বিকেল ও অনুভবের
পাঠ
সব সরবতা গাঁথা আছে জনদরদী নেতার পরিত্যক্ত বিছানায়
নীরবতার পাঠ নিয়েছি
উটের কাছে বোবা- আতঙ্ক সামনে দাঁড়িয়ে মুখ
ভেঙচায়
রঙচটা বিকেলে কাঁদে
অনুভূতির পাখি অলৌকিক সন্ধ্যা নামে গৃহহীন বারান্দায়
পিচ্ছিল সম্পর্কগুলো
দ্রোহহীন আঁতুর- ঘরে বন্দী
নীরবতার পাঠ নিই
পাহাড়ের কাছে
উদাসীন উত্তর গুলো
তখন ওড়নার ফাঁসে বন্দী
শূন্যতার ঠোঁটে চুমু
খেলে নৃশংস প্রেম ঝরে পড়ে বেদনার আলিঙ্গনে
রোজ ধর্ষিত হই
নিরব পাঠের অব্যক্ত
বেদনা শুষে নেই জীবনে রস
রক্তাক্ত মানবতা
দানবীয় চেহারা নিয়ে দাঁড়ালে বেলা পড়ে আসে
কৃত্রিমতা বর্জিত সাদা
আর্জি ঝরে পড়ে মরুভূমির মাঠে
নীরবতার পাঠ নিই
অন্ধকারের কাছে
জীবন দৈর্ঘ্যের সূচক মাপে কবর ডাঙার নীরবতা
আর্তির ভাষারা হলুদ
হলে
রজনীগন্ধা তার অজস্র
চুম্বন এঁকে দেয় অনুভূতির আকাশে
বেনামী ঘাসে মুখ
গুঁজে অস্তিত্বের প্রজাপতি
প্রেমিক হওয়ার স্বপ্ন
দেখি রোজ হৃতপিন্ডের কাছে
লাশের ভবিষ্যতবাণী
যথেচ্চারের প্রতিবাদ
করি বলে মাঝেমধ্যেই রাস্তাঘাটে ওরা আদর করে
টিউশন ফেরত মেয়েটার চিৎকার শুনে ছুটে যায় নিঝুম রাস্তায়
চায়ের দোকানে তখনও বসেছিল অনেকেই
মেয়েটির লাল- আর্তনাদ আর গোঙানি শুনছিল পাট- ক্ষেত আর
নিঝুম রাতের তারারা
---
রাস্তার ধারে পড়েছিল
আমার হাড়-পাঁজরা ভাঙ্গা নিথর দেহ
তাজা রক্তের আঁশটে গন্ধ মেখে নিচ্ছিল নীরব আকাশ
একটা শুভ সন্ধ্যা চাপা পড়লো
আর্তনাদের ফসিলে
লাশ কাটা ঘর
মাংস পচা
ঝাঁঝালো গন্ধ
ডোম বলে উঠলো এই প্রথম দেখলাম এমন বিটকেলে মরা
নীথর দেহটা ফিস ফিস
করে বললো এখন থেকে এমন লাশ তুমি হরদম দেখতে পাবে
দেখে নিও
প্রতিবাদ গুলোকে
ডোম ফরমালিন মাখিয়ে তুলে দেবে স্বর্গ রথে
শোকস্তব্ধ হাওয়া
পাড়ায় পাড়ায় যাবে --
ধূসর দিগন্তে নেমে
আসবে অচেনা সন্ধ্যা
ঠিকানা
গ্রামের প্রাচীন
ছায়ার নিচে আমি দাঁড়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুভব লুটোপুটি করে
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে
নেমে যাচ্ছে আমাদের সব আশা
বিপন্ন জীবনের কিনারায়
দাঁড়িয়ে আছি
চোখের সামনে ধ্বসে
যাচ্ছে মূল্যবোধের ছাদ
চন্দ্রযান -নিয়ে
গেছে সব আশা
অমসৃণ উপত্যকায়
লেখা হচ্ছে আহাজারি বয়ান
অতিথি শালায় ঝুলছে
নামহীন জীবনের আলোকচিত্র
মৃত মানুষেরা কাঁদছে
জাহান্নামের বারান্দায়
ভয়াবহ নিস্তব্ধতার
আগুনে পুড়ে যাচ্ছে আত্মজীবনী
অন্ধবিশ্বাসগুলোকে
শুয়ে দিলাম কবরে
অনুভূতির ডাকঘরে
ফেলে এলাম প্রাচীন ঠিকানা।
---------
ছোটগল্প
পুনি
আজিজুল হাকিম
আমি একটি মৃত লাশের
ময়দানে হেঁটে যাচ্ছিলাম। অসংখ্য মানুষের সারি সারি লাশ। এদের সকলেই মারা গেছে অবেলায়
- অপরিপক্ক অবস্থায়। অনেকে আবার অন্যায্যভাবেও মারা গেছে। এই সব মৃত্যুকে আমরা ইমম্যাচিউর
ডেথ বলতে পারি। এদের সকলের মনেই ছিল রঙিন আশা, আরও অনেকদিন বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
সেই
মৃত্যুর ময়দানে আমি একাই হেঁটে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার দেহকে আমিই দেখতে পাচ্ছিলাম
না। কেবল আমার ছায়া সামনে হেঁটে চলেছে। সেই ছায়াকেই দেখতে পাচ্ছিলাম। মেঘের ছায়ার
মতো সেই ছায়াটি এক একটি লাশের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
এমন
সময় ওই ময়দানের অপরপ্রান্ত থেকে একটি চিৎকার ভেসে এল। খুব পরিচিত কণ্ঠস্বর। শব্দটি
যেদিক থেকে এল আমি চোখ তুলে সেদিকেই তাকালাম। দেখলাম, পুনি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে
আছে। ওকে দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি আর ও আমার দিকে। নিস্পলক
চোখ।
আর
ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি বিছানা ছেড়ে ধড়পড় করে উঠে পড়লাম। তারপর শোকস্তব্ধ
অবস্থায় বিছানায় বসে থাকলাম।
প্রায়
তিন মাস পার হয়ে গেল ওকে আমি দেখিনি। দেখার কথাও নয়। কারণ যেদিন আমি ওকে কাঁধে করে
বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ওর তিনটি বাচ্চা ভীষণ ভীষণ কান্না করছিল। মা
হারানোর শোকে ওরা উন্মাদ হয়ে গেছিল। তখন আমার চোখ থেকেও ঝর ঝর করে অশ্রু ঝরে পড়ছিল।
ওর বড় ছেলেটা আমার সঙ্গে গেল। তারপর ওকে নিয়ে গিয়ে কবরের পাশে রাখলাম। ওর ছেলেটা
আমার কার্যকলাপ দেখছিল। ও নির্বাক। কেবল দুই চোখের কোন ভিজে গেছে।
কবরটি
ঠিকঠাক করে পুনিকে অন্ধকারের গভীরে রেখে দিলাম। যখন বাড়ি ফিরলাম তখনো ওর বাচ্চারা
আকাশ ফাটা চিৎকারে কান্নাকাটি করে আমাদের বাড়িটিকে শোকাচ্ছন্ন করে তুলছিল। তবে ওরা
বোধ হয় ঠিক বুঝতে পারল না, ওদের মা আবার আসবে কিনা। ওরা তো দুদিনের বাচ্চা মাত্র।
ওরা কেন কান্না করছে? সেটা বোঝাও খুব মুশকিল। মায়ের শোকে, না প্রকৃতগতভাবেই?
ওকে
যখন বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম তখন ও ছিল একটি কিশোরী প্রাণচঞ্চল বালিকা। তখনো যৌবনের
বাতাস ওর শরীরে খেলত শুরু করেনি। ওকে যেদিন নিয়ে এসেছিলাম সেদিন ভেবেছিলাম নতুন বাড়িতে
ও খুব কান্না করবে। কিন্তু না, ও একটুও কান্না করেনি। এমনকি মনে হয়েছিল ও আমাদের বাড়িতে
এসে খুশিই হয়েছে। তারপর ও আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল। আশেপাশের লোকজনের কাছে পরিচিতি
পেল। কেবল তাই নয় ও যেহেতু আমার বাড়িতে এসেছে তাই আশেপাশের লোকের কাছে একটা এক্সট্রা
কদরও পেল। কারণ আমার এই এলাকাতে সামান্য হলেও তুলনামূলক একটু বেশিই কদর আছে। কারণ আমি
ছোটবড় সকলের সঙ্গেই অতি আধারণভাবে মেলামেশা করি।
ও
আস্তে আস্তে আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেল। কেবল তাই নয় ওর আচার ব্যবহার ও
চলাফেরা আমাদেরকে খুব মুগ্ধ করল। ও এত তাড়াতাড়ি আমাদের সংসারে সেটআপ হয়ে যাবে সেটা
আমরা প্রাথমিকভাবে কল্পনাই করতে পারিনি।
যাহোক
ও আমাদের বাড়িতে আসার পর থেকেই আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি।
আমার সঙ্গে ও বেশি চলাফেরা করতে পছন্দ করত। আমি বাড়ির বাইরে গেলেই ও আমার পিছু নিত।
আমি মাঠে গেলেও আমার পিছুন পিছুন মাঠে চলে যেত।
ওর
ঘ্রাণশক্তিও প্রখর ছিল বলে মনে হতো। অনেক দিন দেখেছি রাতের অন্ধকারে ও অন্য দিকে মুখ
করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে দেখে চুপিচুপি আসতে গেলেই ও “হুঁহুঁ” করে শব্দ করত। তারপর
আমার পিছু নিত। আমি বুঝতে পারতাম না যে ও ওই অন্ধকারের মাঝে কিভাবে আমাকে চিনতে পারে।
তাহলে কি ওর ঘ্রাণশক্তি খুব প্রখর? হয়তো হতে পারে। অনেক প্রাণীর ঘ্রাণশক্তি খুব প্রখর
হয়ে থাকে। যেমন, একদিন আমি এক রাতে আমার এক বন্ধুর ডাকে আমাদের ইস্কুলের দোতালার ছাদের
উপরে গেছিলাম। কিন্তু এক ঘন্টা পর দেখলাম ওই স্কুলের সিঁড়ি বেয়ে আমাদের পোষা কুকুরটি
আমার সামনে গিয়ে বসল। আমি সেদিন অবাক হয়েছিলাম; কারণ আমি যখন সেখানে যাই সে আমাকে
দেখেনি। আমাকে যদি দেখত তাহলে তখনি সে আমার পিছু পিছু চলে যেত। তখন থেকেই আমি বুঝতে
পারলাম যে কুকুরদের ঘ্রান শক্তি খুব প্রখর হয়। কিন্তু পুনি, সে তো কুকুর নয়। তাহলে
ওর ঘ্রাণশক্তি এত বেশি হল কি করে? আমি খুঁজে পাইনি।
আমি
যখন গরমের সময় মেঝেতে পাটি পেড়ে শুয়ে থাকতাম; তখন ও এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ত। আমার
গায়ে ও গা ঘেঁষে শুয়ে থাকতো। যেটা একটা ছাগলের কাছ থেকে পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার।
কেবল তাই নয় যখন যেখানে বসে থাকতাম সেখানে ও গিয়ে শুয়ে পড়তো। কোন কোন দিন যখন আমাদের
কাউকে বাড়িতে পেত না তখন ও আমাদেরকে আশেপাশের বাড়িতে খোঁজ করত। কেবল তাই নয় অন্য
পাড়ায় কোন বাড়িতে যদি আমাদের যাতায়াত থাকত সেই বাড়িতে গিয়েও ও খোঁজ নিয়ে আসত।
ওর
যখন দ্বিতীয় সন্তানটি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল তখন ও চরম বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল সবসময়
ঘরে বাইরে কান্না করা ছাড়া তার কোন আর কাজ ছিল না। এমনকি কয়েকদিন তেমন খাওয়া-দাওয়া
করল না। যেন পাগলী হয়ে গেছে আর ওর কান্নায় আমরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়তাম। আমি যখন
বসে থাকতাম তখন ও সোজা ঘরে চলে এসে আমার বুকে ওর মাথা ভরে দিয়ে চরম কান্না করত। ও
যেন বলতো, আমার ছেলেকে এনে দাও। তখন আমি ওর গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলতাম, “তোর ছেলেকে
কোথায় পাবো, বল? আমি যে অক্ষম।”
হয়ত
ওর ভাগ্যটাই খারাপ। আসলে ওর ভাগ্য খারাপ, না আমার ভাগ্য খারাপ সেটা বলা খুব মুশকিল
ছিল। হয়ত আমার ভাগ্য খারাপের জন্য ওর সন্তান মারা যাচ্ছে!
যখন
ওর তিন নম্বরের সন্তানটি মারা গেল তখন ও পুরো উন্মাদ হয়ে পড়ল। একদম পাগল হয়ে গেছিল
যেন। খুঁই খুঁই করে চারিদিকে ওর সন্তানকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঘরের কোণে, খাটের কোণে;
এমনকি রাস্তার বিভিন্ন বাঁকে, বাড়ির পিছনে - সমস্ত জায়গায় চিৎকার করে ওর সন্তানকে
খুঁজে বেড়াতে লাগল। আর বাড়ির সদর দরজা খোলা থাকলেই সোজা এসে আমার সামনে এসে দাঁড়াত।
তারপর চিৎকার করে যেন বলত, “আমার বাচ্চা কোথায়? আমার বাচ্চাকে এনে দাও।” তারপর কান্না করতে
করতে একদম আমার কোলে ঢুকে পড়ত। তারপর মাথাটি তুলে আমার ঘাড়ে মুখ রেখে কেবল চিৎকার
করে যেত। তখন আমার অশ্রুপাত করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকতো না। আমি ওকে বিভিন্নভাবে
সান্ত্বনা দিতাম। গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে যেতাম। অনেকক্ষণ কান্না করার পর একটু শান্ত
হয়ে বাইরে গিয়ে আবার চিৎকার করতে করতে কোন দিকে চলে যেত। একদিন সন্ধ্যাবেলায় ওকে
চারিদিকে খুঁজলাম। কোন হদিস পেলাম না। সন্ধ্যার পরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে থেকে একজন
এসে বলে গেল যে আমাদের ছাগলটি নাকি সুকলালদের বাড়িতে বাঁধা আছে। আমার ছাগল চিনতে পেরে
সে বেঁধে রেখেছে। তা না হলে অন্য কোথাও চলে যেত।
শীতের
সময় ওর দুটো সন্তান হয়েছিল। তখন আমরা ওর সন্তান দুটোকে আমাদের সঙ্গে লেপের মধ্যেই
রেখে দিতাম আর ওকে অন্য জায়গায়। তারপর দুপুর রাতে যখন বাচ্চা দুটোকে দুধ খাওয়ানোর
জন্য ওর কাছে নিয়ে যেতাম। তখন ও চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ওদেরকে দুধ দিত কারণ ও
জানতো যে কোন মুহূর্তে শেয়াল এসে তার সন্তান দুটিকে ছো মেরে তুলে নিয়ে যেতে পারে।
দুধ খাওয়া শেষ হলে ওকে যদি আগেই ঘরে ঢুকাতাম তাহলে ও ঘরে থাকতো না। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে
চলে আসতো। কিন্তু বাচ্চা দুটোকে যখন ওর সামনে আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতাম
তখন ও নিজে থেকেই তার ঘরে ঢুকে পড়ত। ও একটি পশু হয়ে কি করে এত কিছু ভাবে সেটা বুঝতে
পারতাম না।
কেবল
তাই নয়, যদি ওর বাচ্চারা ওর সঙ্গে গিয়ে আর ওর সঙ্গে ফিরে না আসত তখন ও এসে আমার সামনে
কান্না জুড়ে দিত।
আমি
বললতাম, কি হয়েছে? তোর বাচ্চা কোথায়?
তখন
ও হাঁটতে শুরু করত। ওকে অনুসরণ করলে ও ঠিক আমাকে ওর বাচ্চাদের কাছে গিয়ে হাজির করত।
তারমানে ও ওদেরকে ডেকেছিল ওরা ওর সঙ্গে আসেনি। তখন আমি ওদেরকে নিয়ে আসতাম আর ও সঙ্গে
সঙ্গে আসত।
ও
অধিকাংশ সময় মানুষের কাছাকাছি থাকতো। যেখানে মানুষের সমাগম বেশি সেই জায়গাতেই ও চলাফেরা
করত; যার কারণে ও স্কুল যেতে খুব ভালোবাসতো এবং যেদিন স্কুল খোলা থাকতো এবং যতক্ষণ
স্কুল খোলা থাকতো ততক্ষণ সে সেখানে থাকতো। সে যে কেবল স্কুলেই থাকতো তাই নয়। স্কুলের
ছেলে মেয়েদের সঙ্গেই ও বেশি ঘোরাফেরা করত। একদিন স্বাধীনতা দিবসে স্কুলের ছেলে মেয়েরা
প্রভাত ফেরিতে বেরিয়েছিল। ওদের সঙ্গে ছিল বাদ্যযন্ত্র এবং মাইকে বাজছিল দেশাত্মবোধক
গান। একটা লম্বা মিছিল এগিয়ে চলছিল গ্রামের দিকে। ঠিক তখন দেখলাম পুনি ওদের মাঝে ঢুকে
পড়েছে। রাস্তার দুই প্রান্তে ছাত্র-ছাত্রীর লম্বা সারি আর মাঝে পুনি। সেই মিছিলটি
এ পাড়া, ও পাড়া, সে পাড়া হয়ে প্রায় দু'ঘণ্টা পরে যখন ইস্কুলে ফিরে এলো; তখন পুনিকেও
দেখলাম তাদের সঙ্গে এলো। পরে একদিন আমাদের ইস্কুলের হেডমাস্টার আমাকে ডেকে বললেন,
“যাই বলো ভাই, তোমার এই ছাগল ছাগল নয়। ও একটা মানুষ। ছাগলরূপে জন্মগ্রহণ করেছে মাত্র।”
আমি
বললাম, “কেবল তাই নয়, আমি যখন বাইরে থেকে রাত্রি বেলায় বাড়ি ফিরি তখন ও কিভাবে বুঝতে
পারে জানিনা; আমার গাড়ির শব্দ পেলেই ও হুঁ, হুঁ করে যেন জিজ্ঞেস করে, “কোথায় গিয়েছিলে?
এতক্ষণে এলে?”
যাহোক,
ওই ঘটনার পর স্কুলের সমস্ত শিক্ষক আমার পুনিকে ভালবাসতে লাগল।
আমি
জানিনা, ওর মিউজিকের প্রতি এত টান কেন। ও যদি বাড়িতে থাকে আর স্কুলে কোনরকম কোন অনুষ্ঠানের
জন্য মিউজিক বেজে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে ও উঠে দাঁড়ায়। ওকে বাড়িতে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে।
ও ইস্কুলে যাওয়ার রাস্তা না পেলে এদিক ওদিকে ছুটাছুটি করে আর ছেড়ে দিলেই এক দৌড়ে সোজা
স্কুল। তারপর সেই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আবার মিছিলে হাঁটতে শুরু করে।
ওর
এতো গুণের মধ্যে একটা দোষও ছিল। সেটি হল চুরি করা। ও এত চালাক যে ভাবাই মুশকিল। একদিন
দেখলাম, একজন লোক হাট করে বাড়ি ফিরছিল। লোকটির ব্যাগে কলা ছিল। ও চুপিচুপি লোকটির পিছুনে
গিয়ে আচমকা ব্যাগে মুখ ঢুকিয়ে একটি কলা ছিঁড়ে নিয়ে দে দৌড়।
কয়েকজন
দোকানদারও বলেছে, যখন দোকানে থাকব তখন ও যাবে না। আর যখনই দোকান থেকে একটু বেরিয়ে যাব
অমনি কোন খাবারের প্যাকেট নিয়ে দে দৌড়। কোথায় যে লুকিয়ে থাকে বুঝতেই পারি না।
একদিন
একটি নুঞ্ঝুরি ওয়ালা এসে আমাকে বলল, আপনার ছাগলে আমার দুটি নুঞ্ঝুরি খেয়েছে। দাম দেন।
আমি
বললাম, তোমার নুঞ্ঝুরি কোথায় ছিল?
ও
বলল, আমার হাতে।
আমি
বললাম, তাহলে কি করে খেল?
ও
বলল, পিছুন থেকে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গেছে?
আমি
হেসে ওর হাতে দশটাকা ধরিয়ে দিলাম।
ও
চুরি করলে আর ওর জন্যে জরিমানা লাগলেও ও আমার কাছে খুব প্রিয় ছিল। ও এভাবে চলে যাবে
আমি কখনোই কল্পনা করতে পারিনি। ওর বাচ্চা হল এবং সেটা নরমালি হল। কোন সমস্যা হয়নি।
রাত্রি বারোটার সময় আমি বাচ্চা গুলোকে দুধ খাওয়ানোর জন্য পুনির কাছে নিয়ে গেলাম।
আমি ওর কাছে গেলে ও উঠে দাঁড়ালো এবং ওর বাচ্চাগুলোকে দুধ খাওয়াল। তারপর রাতে ঘুমাতে
চলে গেলাম।
পরের
দিন ভোর বেলায় আমার স্ত্রীর ডাকে লাফিয়ে উঠলাম। তারপর ওর পিছুন পিছুন পুনির ঘরে গেলাম।
ঘরে গিয়েই চমকে গেলাম। সারা ঘরটি রক্তে ভাসছে। আর সেই রক্তের মাঝে পুনি শুয়ে আছে।
ওকে কোনক্রমে তুলে বাইরে নিয়ে এলাম। ডাক্তারকে ফোন লাগালাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর
ডাক্তার এল। ওকে ইনজেকশন দেয়া হল। এমন কি স্লাইনও টানানো হল। মনে হল ও আস্তে আস্তে
সেরে উঠবে।
আমি
ওর জন্য খাবার আনতে মাঠে গেলাম। মাঠ থেকে দুপুর বেলায় বাড়ি ফিরলাম। তারপর আমি ওর
কাছে সোজা চলে গেলাম। গিয়ে দেখছি যে ও মুখটিকে মাটিতে ঠেকিয়ে অস্বাভাবিকভাবে নিঃসাড়
পড়ে আছে। আমি ওর কাছে ছুটে গেলাম। ওকে আমি বারবার ডাকতে লাগলাম, “পুনি, পুনি।” কোন উত্তর পেলাম
না। আমি ওর গায়ে ধাক্কা দিয়ে বললাম, “পুনি…!” ও শেষ পর্যন্ত
আমার ডাকে একবার উঁ করে মাথাটা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আবার নামিয়ে নিল। আমি বারবার
চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু হায়! আর কোন উত্তর পেলাম না।
আমি
চেয়ে থাকলাম ওর তিনটে সন্তানের দিকে।
বিধ্বংসী WL 261 ও অন্যান্য
শাবলু শাহাবউদ্দিন
শুফম
সর্বদা ভিতরে ভিতরে তুষের আগুনে পুড়ে ছাড়খার হয়। সব সময় চিন্তামগ্নে থাকে। কিছু একটার
সমাধান চায়। সে চায় কোন একটা কিছুর নীতির পরিবর্তন। টিভি চ্যানেল, পেপার পত্রিকা এমনকি
বিভিন্ন জনসভায় তার এই বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা কথা হয়। কিন্তু কোন সমাধান হয় না। কারণ
কী? শুফম সর্বদা ভাবে। সবাই চাইলে পারে বিষয়টি কোন একটা সুরাহা করতে। কিন্তু কোন এক
অলৌকিক পরাশক্তির বাধা আসছে। হয়তো কোন দিন-ই এই বিষয়টির সমাধান কেউ করে যাবে না। সবাই
লোভের মধ্যে ডুবে আছে। কারো অর্থের লোভ, কারো মর্যাদার লোভ , কারো বা ক্ষমতার লোভ।
এই লোভ থেকে কেউ কোন দিন মুক্ত হতে পারবে না ; তাই কেউ কোন দিন সমাধানও করবে না।
সমাধান
করলে আমাকেই করতে হবে। বিষয়টি দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞার সাথে নেয় শুফম।
হঠাৎ
একদিন এলাকা থেকে উধাও শুফম। শুফম উধাও হয়েছে তাতে কারো কিছু আসে যায় না। যাদের আসে
যায়, তারা অনেক আগেই ইহলোক ত্যাগ করে পরপারে চলে গেছে। দুনিয়াতে যার পিতামাতা নেই
; তার দুনিয়াতে হাহাকার মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই নেই। প্রায় বছর পাঁচেক পরে শুফম আবার
এলাকায় ফিরে আসে। ও আল্লাহ্ এ কী অবাক কাণ্ড! শুফমের বাড়িঘর কিছুই নেই। তথাকথিত জননেতারা
সব গোগ্রাসে গিলে ফেলেছে । শুফম এখন থাকবে কোথায় ! শুফমের যখন থাকার জায়গা নেই, তখন
আর এই গ্রামে বসে সময় নষ্ট করার মানেই হয় না। শুফম আবার হারিয়ে গেলো।
ঠিক
দশ দিন পরে ট্রাক ভর্তি মালামাল নিয়ে আবার গ্রামে ফিরে এলো শুফম। ফিরে এসে দেখে তার
সমস্ত জায়গা জমি রেখে দখলদার নেতারা পালিয়েছে আজ সাত দিন হলো। তারা নাকি এখানে ভূত
দেখেছে। আসলেই এখানে ভূত আছে। এই তো গত চারদিন আগে দুপুর বেলায় এখানে আগুন লেগেছিল।
ফায়ার সার্ভিসের খবর দেওয়া আগেই চোখের পলকে সব কিছু পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেলো। এখন আর পারতো
পক্ষে কেউ আর এই দিকে তাকায় না। বিশেষ করে সন্ধ্যা নামলে একদম নিশুতি হয়ে যায়। শুফমের
ট্রাক ভর্তি মালামাল নামানো দেখে এলাকার অনেক মুরুব্বিরা এসে শুফমকে নিষেধ করে গেলো।
কেউ কেউ আল্লার দোহাই দিয়ে গেলো। আবার কেউ কেউ শুফমের জন্য ফ্রিতে জায়গা দিতে চাইলো।
তবু যেন শুফম এখানে ঘর না বানায়। এখানে ভূতেরা আস্তানা ঘেরেছে। এখানে আর যাইহোক মানুষ
বাস করতে পারবে না।
সন্ধ্যা
নেমে এলো। মানুষের আনাগোনা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেলো। কাজে লেগে গেলো শুফম। কাজের মধ্যে
কেবল বক্সগুলোর তালা খোলা। বক্সগুলোর তালা খুলে শুফম বসে রইলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যে
সব পরিষ্কার। ঘন্টা তিনেকের মধ্যে ঘর উঠে গেলো ।পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে সব কমপ্লিট। এর মধ্যে
শুফমের নজরে এলো WL 269 নামের যন্ত্রটি কাজ
করতে পারছে না। তার মানে চার্জ শেষ। শুফম তাড়াহুড়া করে বক্স বন্দি হওয়ার নির্দেশ দিলো।
WL 269 বক্স বন্দি হয়ে গেলো। আর এক মিনিট সময় অতিবাহিত হলে বিপদ ছিলো শুফমের কপালে।
যাক যাইহোক আল্লাহ্ বাঁচাইছে।
সব
কাজ শেষ। যন্ত্র গুলোকে বক্স বন্দি হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। সবাই বক্স বন্দি হয়ে গেলো
বাড়ির বাইরে এতোগুলো বক্স পরে থাকা কেমন যেন বিশ্রি দেখায়। WL 261 এবং WL 262 নামক
যন্ত্র দু'টিকে নির্দেশ দেওয়া হলো, সবগুলো বক্স ঘরের মধ্যে রাখার। এ কি আজব কারবার।
ঘরের মধ্যে এতোগুলো বক্স খুব খারাপ দেখাচ্ছে। আগামী কাল কেউ যদি ঘরে ঢুকে দেখে এতোগুলো
বক্স । তাহলে তো জিজ্ঞাসা করবে, এগুলোর মধ্যে কী আছে। তখন কী জবাব দেবো ? তারপরে আবার
সোশ্যাল মিডিয়া যুগ। মহা বিপদে পড়ে যাবো।
শুফমের
মাথায় আর কিছু আসছে না। শুফম WL 261 কে জিজ্ঞাসা করলো। এগুলো এখন কোথায় রাখা যায়।
WL 261 বললো ঘরে মেঝে খুঁড়ে গ্রাউন্ড বক্স
বানিয়ে সবগুলো গ্রাউন্ড বক্সে রাখলে ভালো হয়। শুফম তখন রেগে গিয়ে বললো, বসে না থেকে
কাজটি শেষ করে আমাকে উদ্ধার করো। আদেশ করে শুফম ঘরের বাইরে গিয়ে খোলা আকাশে নিচে একটু
হাওয়া খেতে লাগলো ।
WL
261 শুফমের আবিষ্কৃত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ যন্ত্র । যা শুফমের বিকল্প হিসেবে কাজ করে।
কোন চার্জ লাগে না। যে কোন পরিস্থিতি থেকে শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। সেই সঞ্চিত শক্তি
কাজে লাগিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কাজ করে। শুফমের মুখের কমান্ড অনুযায়ী যে কোন কাজে
খুব পারদর্শী সে।
শুফম
বাইর থেকে হাওয়া খেয়ে এসে রুমে ঢুকে অবাক। সারা ঘরে মাটি। বক্সগুলো সব আন্ডার গ্রাউন্ডে
চলে গেছে। কেবল WL 261 এবং WL 262 উপরে দাড়িয়ে আছে। শুফম রেগে অস্থির । সারা ঘরে কাদামাটি।
কে এখন এইগুলো পরিষ্কার করবে ? শুফমকে আশ্বস্ত করলো WL 262। WL 262 সমস্ত ঘরে একটি
মেডিসিন স্প্রে করে ছিটিয়ে দিলো। সমস্ত ঘরের যত মাটি ছিল পানি হয়ে গেলো। তারপরে WL
261 আরেকটা মেডিসিন স্প্রে করে দিলো, সমস্ত পানি বাষ্পীয় হয়ে উড়ে গেলো। শুধু সীমিত
কিছু তলানি পড়ে রইলো মেঝেতে। WL 262 সেটা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দিলো।
শুফম
খুব ক্লান্ত। মোটামুটি একটু ক্ষুধাও লেগেছে। শুফম WL 261কে খাবার তৈরি নির্দেশ দিলো।
WL 261 পানি, মাটি আর বায়ুকে কাজে লাগিয়ে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বেশ কিছু খাদ্য
তৈরি করে ফেললো। শুফমের কাছে হাজির হয়ে দেখে শুফম ঘুমিয়ে গেছে। আবার সেই খাদ্য গুলো
সরলীকরণ তরল করে শরীরের মধ্যে পুস করে দিলো। শুফম ঘন্টা খানেক বিশ্রামে পর। ফ্রেস একটা
শরীর নিয়ে জেগে ওঠে দেখে তার বাড়ির চারি দিকে মানুষের গুমগুম শব্দ। বাইরে এসে তো হতবাক।
সবাই ভিডিও করছে। সোশ্যাল মিডিয়া ছড়িয়ে পড়ছে সেই ভিডিও।
নিজের
বাড়ি নিজে দেখেই অবাক। করছে কী যন্ত্রের দল ! রাজ প্রাসাদ নির্মাণ করেছে কেন ! কোন
মত একটা আবাসন বানালেই তো পারতো। এর মধ্যে কেউ কেউ দুর্নীতিবাজ শুফমের বাড়ি শিরোনামে
ভিডিও ধারণ করে নেট দুনিয়ার ছেড়ে দিচ্ছে। কেউ
কেউ একটু বেশি ভিউ পাওয়া আশায় কী যে বিশ্রী ভাষায় কথা বলছে ; তা আর সহ্য করতে পারছিল
না শুফম। শুফম ঘরে ঢুকে WL 261 কে নির্দেশ দিলো,
সব ডিভাইস নিষ্ক্রিয় করে দেও। খুব আজেবাজে বকছে পাবলিক। শুফমের কথা শুনা মাত্র
WL 261 লাফিয়ে ঘরে বাইরে আসতে বসলো। শুফম রেগে গিয়ে বললো, এ কি করছো? ছদ্মবেশ ধারণ
করো। আমাকে আবার নতুন বিপদে ফেলতে চাও? ছদ্মবেশ ধারণ করো।
শুফম
WL 261 বাদে সবাইকে আন্ডার গ্রাউন্ড বক্স বন্দি
হওয়ার নির্দেশ দিলেন। একমাত্র WL 261 কেবল পারে গিরগিটি মত রঙ পাল্টাতে । সে যে কোন
পরিবেশে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম । এমনকি কোন ধরনের স্ক্যানিং যন্ত্রের ধরা পড়ে না।
সুতরাং
WL 261 কে নিয়ে শুফমের কোন চিন্তা নেই।
WL
261 ডে কালার ছদ্মবেশ ধারণ করে ঘরের বাইরে এসে। সবার ডিভাইস নিষ্ক্রিয় করে দিলো। এতো লোক!
আরো লোক আসিতেছে। এ কী মহা বিপদ। অবস্থা বেগতিক দেখে WL 261 শুফম কে অজ্ঞান করে মাটির
নিছে একটি অক্সিজেন বক্সে রেখে সমস্ত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল।
এতে
বিপদ আরো বৃদ্ধি পেলো। মানুষের বাণ পড়ে গেলো। পদ্মা নদীর স্রোতের মত মানুষ আসতে লাগল।
এখন কী করা যায়।
মিনিট
বিশেকের মধ্যে হুইসেল পারতে পারতে দমকল বাহিনী হাজির হয়ে গেলো। পানি দিয়ে আগুন নেভাতে
লেগে গেলো। ততক্ষণৎ বাড়ি পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেছে। দমকল বাহিনী আগুনে পড়া সবকিছু সরানোর কাজে লেগে গেলো। ও মা, এ কি বিপদ। তারা দিখছি,
আন্ডার গ্রাউন্ডের খোঁজ পেয়ে গেছে। কে যেন চিৎকার করে বলে উঠলো, There are many
boxes below the underground. Open it.
খান
দশেক লোক লেগে একটি বক্স অপেন করল। বক্স অপেন করে তারা তো হতবাক। এ কী জিনিস এই বক্সে।
WL
261 এখন একদম দিশেহারা। এবার সব গেছে। ছদ্মবেশ অবস্থায় সে ঐ বক্সের উপর হ্যাভি ওয়েটের
তরলকরণ মেডিসিন স্প্রে করে দিলো। মানুষের পোশাক সহ ধাতব পদার্থ যা ছিল সব পানি হয়ে
বাষ্পীয় রূপান্তরিত হয়ে গেলো।
সবাই
তো টা দেখে ভয়ে যে যে দিকে পারে দৌড়াতে শুরু করে দিলো।
ততক্ষণে
উপর মহলের নিকট বিষয়টি চলে গেছে। কয়েক প্লাটুন পুলিশ সহ সেনাবাহিনী মতায়ণ করা হলো সরকারের
পক্ষ থেকে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিট যোগ করা হলো। সরকারের
ধারণা এখানে ইউরেনিয়াম জাতীয় দামী কোন বস্তু আছে। যার জন্য এমন বিপত্তি কর ঘটনা ঘটেছে।
সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার দিয়ে সব কিছু স্ক্যানিং করে , রিপোর্ট দিছে, এখানে কিছু বক্স
কাছে। বক্সে কিছু যন্ত্রপাতি আছে আর একটা মানুষের লাশ হয়তো থাকলে থাকতে পারে।
তখন
WL 261 মাথায় এসেছে। শুফমকে তো অজ্ঞান করে এখানে রাখা হয়েছে। শুফমকে তো উদ্ধার করতে
হবে। কি করা যায়? সব কিছু মনিটর করা হচ্ছে। WL 261 কে স্ক্যানিং করে ধরা না গেলেও এখান
থেকে যাই সরানো হোক সব ধরা পরবে। শুফমের সরানোর উপায় কী তাহলে ?
অবশেষে
WL 261 একটা পরিকল্পনা করলো। এখানে যা কিছু আছে সব স্ক্যানিং করে মেমোরিতে স্টোরেজ
করতে হবে এবং স্প্রে করে সব কিছু নষ্ট করে দিতে হবে। যাতে সরকার কোন তথ্য উদ্ধার করতে
না পারে। এবং একটা সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করতে হবে। যে পথ দিয়ে শুফমকে উদ্ধার করা যায়। আগে
সুড়ঙ্গের কাজ শেষ করতে হবে। শুফমকে আগে বাঁচাতে হবে। ঘন্টাখানেকের চেষ্টায় প্রায় কিলো
দশেক পথের সুড়ঙ্গ তৈরি করে পদ্মার নিঝুম চরে গিয়ে উঠলো WL 261।
সেখানে
শুফমকে রেখে আবার সুড়ঙ্গ পথে ফিরে এলো WL 261। স্প্রে ছিটানো প্রায় শেষ। তখন আকাশ থেকে
গুলিবর্ষণ হতে লাগলো। তার মানে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বুঝতে পেরেছে এখানে কিছু
একটা হচ্ছে। তাদের স্ক্যানিং হয়তো স্প্রে মেশিনের নড়াচড়া ধরা পড়েছে। WL 261 আবার সুড়ঙ্গ
পথে পলায়ন দিলো। পলায়ন পথে কিলোখানেক সুড়ঙ্গ পথ নষ্ট করে দিলো যাতে তারা এই পথের অনুসরণ
না করতে পারে।
WL
261 এসে দেখে শুফমের জ্ঞান ফিরেছে। সে কাতরাচ্ছে। খুব ক্লান্ত শুফম। শুফমের সতেজ করতে
খাদ্য তৈরি কাজে লেগে গেলো WL 261 । কিন্তু এখানে খাদ্যের উপাদান বিরল। বালুর মাঝে
রস নেই। খাদ্য উপাদান সীমিত। সে আবার সুড়ঙ্গের তলদেশ ফুটো করে দিলে ফলে। হাতের নাগালে
সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে পানি ও মাটি চলে আসলো। খাদ্য উপাদান এখন যথেষ্ট । মাটি বায়ু ও
পানি বিশ্লেষণ করে খাদ্য তৈরি করা হয়ে গেলো। শুফম পানাহার করে এখন একটু সতেজ হল।
WL 261 সব বর্ণনা করলেন। শুফম সব বুঝলো। পরিস্থিতি খুব একটা ভালো ছিল না। শুফম WL
261 কে ধন্যবাদ দিলো তার বুদ্ধিদৃপ্ত কাজের জন্য।
শুফম
WL 261 কে নির্দেশ দিলো চিকিত্সা বিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য। শুফমের একটু চিকিত্সার দরকার।
WL 261 বিশ্বের সব অনলাইনে বই বিক্রি ওয়েবসাইট হ্যাক করে চিকিত্সা শাস্ত্রের সকল বই
পড়ে চিকিত্সা করলো শুফমকে। সমস্যা তৈরি হল মেডিসিন তৈরিতে। এই বিষয়টি খুব গোপনী। খোলামেলা
কোন উপাদান পাওয়া যায় না। তবে বাঁচা গেলো শুফমের তেমন কোন কঠিন রোগ হয়নি। মেডিসিন তৈরি
ঝামেলা পোহাতে হলো না WL 261 কে।
এখন
ফিরে আসলো শুফম ও WL 261 তাদের আসল কাজে। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে হবে। সবাইকে
সমান অর্থনৈতিক সুবিধা তৈরি করে দিতে হবে। প্রথমে চিন্তা করা হল বিশ্বের সকল ব্যাংক
হ্যাক করে সবাইকে সেই অর্থ সমান ভাবে বিলি করে দিলেই হবে। কিন্তু এখানে কাহিনী একটা
আছে। সবার ব্যাংক একাউন্ট নেই। সবাই এই সুবিধা সমান হারে পাবে না। তাহলে কী করা যায়?
তাহলে অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে। শুফম ও WL 261 তাদের নৈতিক নীতির সেই পথ অবলম্বন
করে কাজ করা শুরু করে দিল।
( চলমান...............)
সন্ধিক্ষণ
হাবিবুর রহমান
স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রাক্কালে, পুলিশ সম্বন্ধে দারুন বিরূপ
ধারণা ছিল- কি জনগণ আর কি নেতা লিডার সবার মধ্যে। সাধারণ কনসেপ্ট ছিল,
নতুন করে আবার বাহিনী তৈরি হোক। ব্রিটিশ তৈরি এই পুলিশ বাহিনী স্বাধীন দেশে কাম্য হতে
পারে না। তখন মহাত্মা গান্ধী
বলেছিলেন, এই পুলিশকে তাড়িয়ে দিতে হবে না, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে, তারা
নিজেরাই চাকরি ছেড়ে চলে যাবে। স্বাধীনোত্তর যুগের
অনেক দশক চলে গেছে। কিছু অদল বদল হলেও পুলিশ বাহিনী সেই পুলিশ বাহিনীতেই আছে। যুগের
সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশের পুলিশ বাহিনীকে। ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা ঘটলেও,
পুলিশ যে স্বেচ্ছায় দেশের জন্য চাকরি ছেড়ে চলে গেছে, তার প্রমাণ কিন্তু এখনো মেলেনি। তবে অনেকের মতে এবার
বোধহয় গান্ধীজীর উক্তি সত্যিকারে বাস্তব রূপ পাবে।
বাস করি পশ্চিমবঙ্গে। তাই আসুন পশ্চিমবঙ্গ
পুলিশের কথাই ধরি। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন কংগ্রেস রাজ্য
শাসন করেছে পশ্চিমবঙ্গে, তারপর ৩৭ বছর ধরে বামফ্রন্ট রাজত্ব করেছে, আর বিগত ১২ বছর
ধরে তৃণমূল কংগ্রেস শাসন করছে। কিন্তু পুলিশ সেই
পুলিশেই আছে। পুলিশ একটা ডিসিপ্লিনড বাহিনী, মুখ বন্ধ করে
ডিউটি করাই তার কাজ। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন এটাই হলো পুলিশের আসল কাজ। কিন্তু বাস্তব অন্য
কথা বলে। শাসক শ্রেণীর মন
জুগিয়ে চলাই হচ্ছে পুলিশের আসল কাজে দাঁড়িয়েছে। আমি কি ভুল বললাম?
না, এটাই সাধারণ
জনগণের অ্যাসেসমেন্ট। কংগ্রেস শাসনে অভিযোগ ছিল, পুলিশ তাদের
হয়ে কাজ করছে। যেভাবে পুলিশ নকশাল আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করেছে। তা কিন্তু শুধু
আইন মোতাবেক হয়নি। বামফ্রন্টের সময় সরগোল উঠেছিল, পুলিশ
প্রশাসন তাদের দলদাস হয়ে
গেছে। আর বর্তমান তৃণমূল
শাসনে সেই বিরূপ ধারণা আরো প্রকট হয়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে
গেছে যে, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে সরকার আর মাননীয় রাজ্যপাল মহাদয়ের
মধ্যে ল অর্ডার নিয়ে মতান্তর চলছে। আর এই পরিস্থিতিতে
বিরোধী দলগুলো গেল গেল রব তুলছে। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পুলিশও যথেষ্ট পাজেলড। বিরোধীদল এবং জনগণের
একাংশ ভাবছে পুলিশ মেরুদণ্ডহীন দলদাস। কিন্তু দুঃখের বিষয়,
কথাটা ঠিক নয়। বাহিনীর অধিকাংশেরই মেরুদন্ড খাড়া আছে। কিন্তু
কার্যক্ষেত্রে সেই মেরুদন্ড খাড়া করার সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন পুলিশে
চাকরি করেছি, সেই অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, মেরুদন্ড
খাড়া করা পুলিশ অফিসার কোনদিন সেই পোস্টিং পাবে না, যেখানে মেরুদণ্ড খাড়া করে কাজ
করা যায়। পুলিশে অনেক ডাম্পিং গ্রাউন্ড আছে। যেখানে ইচ্ছা থাকলেও কাজ করে দেখানোর
কোন সুযোগ নেই। সেই মেরুদণ্ডওয়ালারা সেখানে বসে বসে গুমরচ্ছে। আর অনেক অল্প দক্ষ
জো হুজুর টাইপের অফিসার কাজের জায়গায় বসে আছেন। পদের গরিমায় তারা গৌরবান্বিত হচ্ছেন,
অথচ দেখা যাচ্ছে, বাস্তবে পুলিশ নিন্দিত হচ্ছে।
ফলে বাড়ছে আনরেস্ট, আইন শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন। এরও কারণ আছে। মূল কারণ হলো, পুলিশ
বাহিনীর পোস্টিং ও ট্রান্সফার সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী হয়। ফলে হয় কি, যেই কোন অফিসার
আইনসম্মত কাজে স্টিক থাকেন এবং তা শাসকদলের বিরুদ্ধে
যায়। দেখা যায় তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর কে চায় বলুন,
বিশেষ পদ থেকে স্বেচ্ছায় ডাম্পিং গ্রাউন্ডে চলে যেতে। সাধারণ মানুষ অনেকেই
জানেন না, পোস্টিং ট্রান্সফার নিয়ে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে
কতটা আকড়া আকড়ি চলে। কাজ দেখানোর পদ সীমিত। আর অফিসার হল প্রচুর। কে কাকে ছাড়বে
বলুন? তাই সবাই চায়, টাউনের
ভালো জায়গায় ভালো পদ টি। তাহলে তিনি পরিবারবর্গকে কাছে রেখে,
ছেলে মেয়েকে টাউনের নামকরা ইস্কুল কলেজে পড়িয়ে আর নানান
সুযোগ সুবিধা ভোগ করে চাকরি করতে পারবেন। আর পদের দৌলতে
লোকে তাকে এক কথায় খাতির করবে। কোন দুর্গম প্রত্যন্ত
ও ডিস্টার্ব জায়গায়
স্বেচ্ছায় কেউ যেতে চায় না। এক্ষেত্রে তাদের
টিকি বাঁধা থাকে সরকারের কাছে । তাই যে অফিসার যত
শাসকদলের আস্থাভাজন হয়, সে গুড বুকে থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তার পোস্টিংটাও মনের
মত হয়। বিনিময়ে শাসকদলের মনের মত কাজ করতে হবে। আর পুকুরে থেকে কুমিরের
সঙ্গে লড়াই করতে কে চাইবে? ফলে যত দিন যাচ্ছে,
আন্ডারেস্ট আর ল অর্ডারের সমস্যা বেড়েই চলেছে।
হয়তো গান্ধীজীর বাক্য সত্য হতে চলেছে। অতিশয় ক্ষুদ্র মাথা।
তবু দ্বিমত পোষণ করছি। কেননা সময়ের সাথে সাথে সমাজ ও মানুষের
বিবেক অনেক বদলেছে । দেশে কর্মসংস্থান উঠে গেছে। একটা কনস্টেবল
এর পোস্ট পেতে গেলে শোনা যায় লাখ লাখ টাকা ডিপোজিট করতে হয়। এই যদি অবস্থা হয়,
তাহলে বাহিনীর কে চাকরি ছাড়বে? বিবেকহীন ও ধান্দাবাজ মানুষ নিজের ধান্দা
পূরণে ব্যস্ত থাকছে। তাহলে কি এর পরিবর্তন হবে না?
নিশ্চয়ই
হবে।
আমার মতে, সমাজের বিজ্ঞ ব্যক্তি ও পুলিশের সৎ স্বচ্ছ ভাবমূর্তির
অফিসারদের নিয়ে ট্রান্সফার ও পানিশমেন্ট বোর্ড গঠন করা হোক।
যারা কোন দলের বা পক্ষের হয়ে কাজ করবে না। উপযুক্ত ব্যক্তিকে
উপযুক্ত জায়গায় পোস্টিং ট্রান্সফার করবে। আর বাহিনীর শৃঙ্খলা
ভঙ্গকারী পুলিশের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করবে। যেটা সমস্ত পুলিশ বাহিনীর কাছে দৃষ্টান্ত হবে। তাহলে দেখবেন, পুলিশবাহিনী
চাবুকের মত কাজ করবে। পুলিশ সম্বন্ধে যে সমস্ত অভিযোগ প্রায়ই
শোনা যাচ্ছে। দেখবেন সেসবের আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে। দুষ্ট
বা অপরাধী সাজা পাবে, শিষ্ট বা শান্তিপূর্ণ মানুষরা নিরুপদ্রবে বসবাস করতে পারবে। একটা
নতুন সমাজ আমরা দেখতে পাবো।
আপনাদের সুচিন্তিত মতামত কামনা করছি।
ReplyDelete