জীবন-যুদ্ধে জয় পরাজয়
ও মুক্তির উপায়
আজিজুল
হাকিম
জীবনটাই যখন একটি যুদ্ধক্ষেত্র; তখন বেঁচে থাকার অপর নাম লড়াই। এই লড়াইয়ে জয় পরাজয় থাকবেই। যুগযুগ ধরে মানুষ লড়াই করেই বেঁচে আছে। তাদের মধ্যে অনেকেই পরাজয়ের শিকল বরণ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। আবার অনেকেই লড়াই করে, বিজয়ের মালা বরণ করে সভ্যতার চাকা ঘুরিয়েছে। আপন জীবনের সফলতার আলোয় নিজেকে এবং কখনও কখনও পৃথিবীকে উদ্ভাসিত করেছে।
তবে
এই বেঁচে থাকার লড়াই এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। এই পৃথিবীতে কেউ আপন ক্ষমতা কায়েম
করার জন্য লড়াই করে, কেউ নিজের আলোয় পৃথিবীকে আলোকিত করার জন্য লড়াই করে, কেউ বা অন্যের
সঙ্গে প্রতারণা করে জয়ী হওয়ার জন্য লড়াই করে আর কেউ দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য
লড়াই করে। এই লড়াইয়ে কেউ জয়ী হয় আবার কেউ পরাজিত হয়।
এই লড়াইয়ে যখন কেউ সফল হয় তখন আমরা তাকে বাহবা
দিই আর যখন কেউ পরাজিত হয় তখন তাকে ঘৃণা করি; কখনও কখনও করুণা বর্ষণ করি। অনেক সময়
কেউ জয়ী হলেও তাকে আমরা ঘৃণা করি আবার ঈর্ষাও করি। এই হচ্ছে আমাদের মনুষ্য চরিত্র।
অনেক ক্ষেত্রে অনেককে দেখেছি জয়য়ের সফলতা বরণ
করতে করতে তারা স্বেচ্ছাচারী হয়ে এক সময় পরাজয়ের কবরে সমাধিস্থ হয়েছে। কখনও কেউ কেউ
একবার জয়য়ের মালা গলায় পরে আত্মসন্তুষ্ট হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকেছে।
যাহোক, এবার আসছি আপন জীবনের পরাজয়ের কিছু দিক
নিয়ে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা বারবার লড়াই করেছে আর বারবার পরাজিত হয়েছে। এই পরাজয় হতে হতে এক সময়
জয়ের স্বপ্নই মন থেকে হারিয়ে ফেলেছে। ফলে ভেবেছে আসলে জয়টা তার ভাগ্যে নেই। তখন প্রতিবাদহীন,
লড়াই বিহীন জীবন কাটাতে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। তবে মনের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়ায় পরাজয়ের গ্লানি
আর অসহ্য আঘাত। যেন মনে হয় একটি জীবন্ত লাশ সমাজের মাঝে চলা ফেরা করছে। এমন মানুষের
সংখ্যাও পৃথিবীতে নেহাত কম নয়।
তখন এই সব মানুষের মনে ও দেহে বাসা বাঁধে নানান
রকম জটিল অসুখ। অনেকের হার্ট বা ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে মারাও যায়। কেউ কেউ যক্ষ্মার মতো
অসুখ হয়ে মারা যায়।
মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এগুলি কেমন পরাজয়? বিশেষ
করে এই পরাজয়গুলি সংসার জীবনে বেশি করে দেখা দেয়। এখানে যে নিজের জৈবিক স্বার্থ চরিতার্থ
করার জন্য অন্যের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে সে নিজেকে জয়ী বলে মনে করে। সে তার
স্বামীর বা স্ত্রীর দুঃখ, যন্ত্রণা আর নিভৃতে নীরব কান্নাকে কোন মতেই আমল দিতে চায়
না। সে ভুলে যায় সমাজের শতজোড়া চোখকে। তাদের ঘৃণাকে। ফলে নির্লজ্জতার চরম সীমায় বিচরণ
করে। ফলে স্ত্রী হলে সে মনের মধ্যেই এক আতঙ্ক বয়ে নিয়ে আসে। হয়তো বা সেই মেয়েটি, তার
স্বামী যে মেয়েটির সঙ্গে যৌন তৃপ্তি চরিতার্থ করছে, তার সতীন হতে পারে। আবার কোন মেয়ে
আছে যারা তার স্বামীর এমন কীর্তির কথা প্রচার করে অন্যের সামনে কয়েক ফোটা অশ্রু ঝরায়।
যেহেতু আমাদের সমাজে ছেলেদের একাধিক বিয়ের প্রচলন আছে। তাতে সে কষ্ট পেলেও তার মতো
অন্যান্য মেয়েদের কপালের সঙ্গে তুলনা করে আত্মতৃপ্তি পায়।
আর যদি ছেলে হয়, তাহলে? বিশেষ করে যে ছেলের
আত্ম মর্যাদাবোধ আছে, সমাজে নাম-যশ আছে, সেই পুরুষ তার স্ত্রীকে যৌন তৃপ্তি দেওয়ার
পরেও যখন তার স্ত্রী অন্যের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলে পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্বের
লড়াই চরম সংকটপূর্ণ ও সমস্যায় জর্জরিত হয়। তারা সহজে না পারে কাউকে বলতে আবার না পারে
নিজেকে ধরে রাখতে। সমাজের সামনে সে কখনই মাথা তুলে চলাফেরা করতে পারে না। সামাজিক কোন
কাজে সে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায় না। মনে হয় সমাজ তাকে অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড়িয়ে
রাখছে। বিশেষ করে অক্ষমতার হীনমন্যতায় নিজেকে ছোট মনে হয়। যদিও সে শক্ত সামর্থ্য পুরুষ।
যার কারণে এক সময় এই সব যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে
সে হয় হঠাৎ করে মারা যায়; তা না হলে জটিল অসুখের সম্মুখীন হয়। সেই অসুখও তিলতিল করে
তাকে মৃত্যুর দোর গোড়ায় নিয়ে চলে যায়।
প্রথম প্রথম অনেকেই চেষ্টা করে সেই সব জটিল
সমস্যা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আর আইনি জটিলতার
কারণে সে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে যতদিন সে বাঁচে পরাজয়ের গ্লানি নিয়েই বেঁচে থাকে।
প্রতিবাদ বা লড়াই করার ইচ্ছাটাও এক সময় মরে যায়। তখন নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে নিজেকে গুছাতে
শুরু করে।
তবে এই পরাজয়ের পরেও কোন ব্যক্তি নিজের হতাশাকে
অনেকটা এড়িয়ে চলতে পারে। যদি সে কোন কাজে তার ব্রেইনকে ব্যস্ত রাখতে পারে। ব্রেইনকে
ব্যাস্ত রাখার উপায় হল কম্পিউটারের মতো কোন কর্ম ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। যতটা
সময় ধরে সে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে ততক্ষণ সে পরাজয়ের যন্ত্রণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে।
পরবর্তী কালে সে ব্যস্ত না থাকলেও অনেকটাই সুস্থ থাকবে।