একগুচ্ছ যুদ্ধ বিরোধী কবিতা-আজিজুল হাকিম /A Bunch Anti-War Poetry By Azizul Hakim

 

ঈশ্বরকেই বলছি

~~~~~~~~~~~


ঈশ্বর, শুনছো?    

যখন আমার রক্তে আকাশ লালিমা পায়

তখন তোমার প্রসন্ন মানবিক মুখে তালা ঝুলে।  

আজও নীল নদ কিংবা সাহারায় আমার লাশের উপরে শকুন উড়ে

তবুও তোমার কানে আমার করুণ আর্তনাদ পৌঁছায় না।

তোমার মানব দরদী হুঙ্কারে ইউফ্রেটিস আর টাইগ্রিসে

আমার মূল্যহীন রক্তে জোয়ার আনে

দাজলায় ভেসে বেড়ায় আমার খুনি শব   

তখন ইথারে ধরা পড়ে না আমার আকুতি ভরা চিৎকার,  

পৃথিবী আত্মমগ্নতায় আকাশের তারা গুনে।  

‘আরব বসন্ত’-বুকে যখন নেমে আসে তেজস্ক্রিয় আগুনের ঝলক    

মুহূর্তে ঝরে পড়ে আমার মাথার ছাদ,  

হারিয়ে ফেলি বাবা-মার আদর,   

ভূমধ্য সাগরে নাচে আমার বেওয়ারিশ লাশ।

হে ঈশ্বর! তখনও তুমি বেহেস্তি স্বপ্নে বিভোর!

যখন জর্ডান নদীর ধারে আমি অনিকেত

তখনও তোমার বাজ আমার উপরে ডানা ঝাঁপটায়-

আমার দেহে ফুটে উঠে রক্তের ফুল।

নাফ নদীতে জ্বলে আমার জীবন্ত দেহ

তখনও তুমি মুখে কুলূপ ঠুসে বসে থাকো কেন?

আমার চোখ আর চুল কালো বলেই কি?

 

আর আজ রেশমি চুলে যখন আগুন জ্বলে,

নীল চোখে আতঙ্কের চাহনি

তোমার আর সহ্য হয় না, হে ঈশ্বর!   

এসব দেখে তুমি আঁতকে উঠো মানবতার যন্ত্রণায়

তোমারও বুক ফাটে!

  

এ কেমন মানবিকতা তোমার?

    *** 

    

 বিশ্ব মানবের দাবী

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

তোমরা যুদ্ধের বীভৎসতা নিয়ে থাকো।

তোমাদের রাজনীতি, কূটনীতি আর বিদেশনীতির

মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিনা আমি;

তবুও আমার শ্রম, আমার ঘামকে পণ্য কর

আমার উপর চাপিয়ে দাও হাজারো করের বোঝা

নুয়ে পড়ি ক্লান্ত মুটের মতো

অকালে বাসা বাঁধে বয়সের ভার

বাতানোকুল ঘরে বসে তোমরা বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে বিভোর

পৃথিবীকে বানিয়ে ফেলেছ মারণাস্ত্রের আতুর ঘর

জাতীয়তাবাদের নামে আমার চারপাশে আজ সীমান্ত-মাইন

আমার পড়শিকে করেছ অজাতশত্রু

পৃথিবীর সবুজ বুকে এনেছ রক্তের প্লাবন

নবীন স্বপ্নগুলোকে নিক্ষেপ করেছ কবরের অন্ধকারে।

 

অনেক হয়েছে, আর নয়-

আমার পায়ের আঁচরে উচ্ছিন্নে যাক তার কাঁটার শিকল।

আমার হিমশীতল বুককে ভাসতে দাও উষ্ণ রোদের স্রোতে।              

এখন আমাকে মাখতে দাও জ্যোৎস্নার ক্রিম

গোলাপের রোমাঞ্চে আমাকে নাচতে দাও

মহুল সুগন্ধে আমাকে মাতাল হতে দাও,

ক্যামোমাইলের কাপে আমাকে ঠোঁট ঠ্যাকাতে দাও,

ইরিশের নেশায় আমাকে বিভোর হতে দাও,

লিলি আর পপির ঘ্রাণে আমাকে মগ্ন হতে দাও।

 

পরিপক্ক সময়ে আসুক সোনালি সূর্যাস্ত আমার।

       ***        

 

নতুন পৃথিবী চাই

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

আবারো নতুন পৃথিবী চাই 

চির সবুজ নবীন আলোক শয্যায়   

বিকশিত হোক হৃদয়ের বনানী যত  

এক অক্ষত স্নেহের পরশ মাখা চোখে ,

জোনাকিরা হেসে উঠুক আগুন জ্বালানো বুকে , 

পঙ্গপালের অম্লান হরিত পাখার রঙে

খেলে যাক ঘাসেদের কচিপাতা ।

 

কারখানার যত কর্কশ সাইরেনগুলো

স্তব্ধতার পরশে নির্বাক হয়ে যাক ; 

যত বিমানের কলরব আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী আঁকা বিষাক্ত নীলিমা

সব কালি ঝেড়ে ফেলে তারাদের নির্মল হাসি দেক উপহার ।

আবার না হয় ভাসিয়ে দেব পাল

সাত সমুদ্র তের নদী পার -

মধুমালার দেশে

অবিষাক্ত বাতাসে ।

বারুদ ভর্তি কামান আর মিশাইলের চোখে চোখ রেখে

গেয়ে যাব গোলাপি সম্পর্কের গান ; 

যেখানে অলিক, রূপকথার স্বপ্নরা বাসা বাঁধবে

পৃথিবীর মৃত্তিকায় সুগভীর সম্পর্কে ,  

পৃথিবীর সব শিশুরা যান্ত্রিকতার শিকল পেরিয়ে

এসে দাঁড়াবে প্রাণোচ্ছল প্রকৃতির বুকে

এক নিদারুণ উল্লাসে ।

        ***

                     

মানবতার কান্না

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

 

রক্তে ভিজছে আমার দেহ ,  

পুড়ছে আগুনে আমার বাড়ি ;

হাত বাড়াবার নেই কো কেহ ,

পালাবার নেই তো কোন গাড়ি ।

বাবা আমার হারিয়ে গেছে কবে

কার বিছানায় ডুকরে কাঁদে মা !

কোন দেশেতে চলছি আমি তবে,

কেন আমার মুখটি থাকে হাঁ ?

চোখে সবার রক্ত নেশা লাগে --

হাতে নাচে রক্তে ভেজা ছোঁরা   

সুযোগ পেলেই প্রাণটা নিবে বাগে

দেশের মাঝেই দেশান্তরি মোরা ।

আমার বোনের নগ্ন লাশের 'পরে

ধর্ষন আর অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন

মাছিরা সব চারিপাশে ওড়ে

হাজার বোন, কেউ নয় তো ভিন্ন ।

 

এখন আমি অনাথ শিশু

নেই তো আমার কেউ ।

নামেই তুমি আছ যিশু

যেন লূত সাগরের ঢেও ।

       ***

 

ভাঙ্গনের গান

  ~~~~~~~~~~~~~~~~ 

 

ঘরের ভিতরে ঘর বেড়ে চলছে অবিরত

বিচ্ছেদের দেয়াল ভীষণ স্পর্ধায় আকাশ ছুঁতে চায়

বিশেষ চিহ্নের রঙ-তুলিতে দেয়াল ছয়লাপ হয়

হিংসার অনল-গ্রাসে,

জাত-পাতের বর্বর স্লোগানে

ভাষার ম্লান ব্যাবধানে,

আঞ্চলিকতার সঙ্কীর্ণ টানে

উর্বরা জমিন বুকে বন্ধ্যা বালু জমে

মরু গ্রাস করে ক্যাক্টাসের বনানীতে ।

 

খিদের ক্ষয়রোগে দেহ রক্ত মাংস হারায়

শকুন ওঁত পেতে থাকে মৃত্যুর উপত্যাকায়

চারিপাশে রাক্ষস দানবের হুঙ্কার

শান্তির আগুনে পুড়ে স্বপ্নিল ছেলেবেলা,

ভরা যৌবনি প্রেম, সুখের স্বপ্ন ।

অত্যাচারী মৃত্যুর দূত গেয়ে চলে অমরত্বের গান

আকাশে বাতাসে ছড়ায় শান্তির, অহিংসার বাণী ।

 

হে ভগবান, তুমিও কি গেয়ে যাও ভাঙনের গান,

অপ্রেমের গান, অশান্তির গান ? 

        ***

 

বারুদের স্তূপে গোলাপ

 ~~~~~~~~~~~~~~~

আমি তপ্ত সাহারা মরুর বুকে দাঁড়িয়ে 
নিঃসঙ্গ -- একাকি।
 
চোখে একফোঁটা অশ্রুবিন্দু।
 
এই একফোঁটা অশ্রুবিন্দু দিয়ে
 
সাহারার বুকে আনব প্লাবন,
 
সুনামির বিধ্বংসী ঢেউ আসবে আমার পায়ের আঁচড়ে।
 
ঘুমন্ত প্রশান্তকে কেবল একটি আঙুলের ডগায় তুলে
 
এখানে নাচাব –– বানাব অশান্ত সাগর।

 

এষাবেলা, 
তুমি আমার কথায় মুচকি হাসছ?

যদি শিশু ইসমাইলের পায়ের আঁচড়ে 
জমজমের কূপে জলের ফিনকি ছুটে,
বয়ে চলে স্রোতধারা আপন খেয়ালে
 
পাখিদের ঝাঁক তাদের যাত্রা ফেলে থমকে দাঁড়ায়
 অবাক বিস্ময়ে 
কাকলির কলতানে মুখরিত হয় আকাশ বাতাস
পথিকের দল নেচে উঠে অব্যক্ত উল্লাসে;

যদি ফরহাদ একটি মাত্র কুঠার দিয়ে 
পাহাড় কেটে প্রিয়তমা শিরির মূর্তি তৈরি করে--
 
তাহলে?

 

আমিও আমার একফোঁটা অশ্রু দিয়ে 
বদলে দিব নীলনদের ধারা
 
যত যুদ্ধবাজ আর জল্লাদের দল
ভুলে যাবে তাদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা
 
বারুদের স্তূপে ফুটে উঠবে হাজারো গোলাপ।

       ***


এক সুন্দর পৃথিবী চাই

 

আমি এক সুন্দর পৃথিবী চাই,

চাই ছায়া-শীতল সুন্দর পৃথিবী

চাই অবিষাক্ত মুক্ত বাতাস ।

প্রতিনিয়ত ইরাকে আর শিরিয়ায়

কখনো বা লেবাননে, কখনো তিউনিশিয়ায়

কখনো ফ্রান্সে , পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্থানে,

কখনো বা ভারতে

অথবা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে -

ধর্মের উর্দিধারী পান্ডাদের বন্দুক বা বোমের আঘাতে

আমি ঝাঁঝরা বা বিদগ্ধ হয়ে যাই বারবার ।

 

প্রতিনিয়ত

প্যালেস্টাইন, ইরা্‌ক, আফগানিস্থান আর শিরিয়ায়

রাজনৈতিক ষাঁড়দের হুঙ্কারে

তাদের যুদ্ধ - যুদ্ধ খেলায়

আর অনবরত বিমান হামলায়

হারিয়ে যায় আমার বালিকা বেলা

পিছনে পুড়ে আমার খেলা ঘর -

আমার প্রিয় পাঠশালা ।

আমার বাগিচা ভরা ফুল ঝলসে যায় আগুনের লেলিহান শিখায়

আমার নিরাপত্তার অভবে

বয়সের বাধা ডিঙ্গিয়ে অন্য কাউকে টেনে নিয় আমার বুকে

সাগর পেরিয়ে নিরুদ্দেশে পাড়ি দিই

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় ।

আমার এসব পরিণতি - সবই

ধর্মের নকল পান্ডা আর রাজনৈতিক দালালদের স্বার্থে ।

 

আমি এক সুন্দর শান্তিময় পৃথিবী চাই

যেখানে ফুরাত কিংবা নীল,

সিন্ধু, গঙ্গা, ভল্গা অথবা সীন

আমি চাই সব নদী প্রবাহিত হোক রক্তহীন ।

            ***

Post a Comment

Previous Post Next Post