(ধারাবাহিক উপন্যাস)
হৃদয়
নেই
আজিজুল হাকিম
----------------------
সীমান্তের দেয়াল
(এক)
তবুও,
বলা যায় জোর করে, ও হাসি মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । যাবার সময় ও কয়েক মুহূর্তের জন্য
পিছনে ফিরে তাকাল । ভীষণ করুন, মায়াবী চোখ । হরিণীর মতো চঞ্চল চোখ আজ গাভীর মতো শান্ত
। স্নিগ্ধ কালো চোখের মাঝে এখনো অশ্রু টলমল করছে । ওর ডান হাতটা তুলল । তারপর বুকের
কাছে নিয়ে গেল । এক বিষাক্ত-মধুর হাতের ইশারায় বিদায় সম্ভাষণ জানাল । তারপর ও চলে গেল
। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম ।
রোজী
আমার ঘরে হয়তো আর কোন দিন আসবে না । মামি ঘরে আসতে গিয়ে দরজা থেকে ফিরে না গেলে এমন
কাণ্ড হত না । রোজীর সামনে মা-বাবা হয়তো আমাকে কিছু বলত না – মনে মনে কেবল রাগ করত
।
মামি
কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এল । মা এসে বসল দরজার সামনে বারান্দায় । তারপরই ঝড়টা উঠল ।
মা বললেন- এত মানা করার পরেও রোজী কেন আমাদের বাড়িতে আসবে ?
মা বারণ
করার পর রোজী আমাদের বাড়িতে আর আসতে চায়নি । বলা যায় আমিই তাকে ডেকে ছিলাম । একটি উপন্যাস
ওকে পড়তে দিয়ে বলেছিলাম – বইটি পড়ে দিয়ে যেও । সেটি দিতে এসেছিল । দিয়ে চলেও যাচ্ছিল
। আমিই বললাম--- বসো । একটু গল্প করে যাবে ।
ও বলল----
আমার জ্বর হয়েছে ।
আমি
হাত ধরে দেখলাম, কিছুটা জ্বর হয়েছে । ও বলল---- কপালে হাত দিন ।
কপালে
হাত দিলাম । বেশ জ্বর । চোখ দুটি ঘোলা দেখাচ্ছে । মাথায় তেল মেখে স্নান করেছে । চুল
এখনও শুকায়নি----এলোমেলো হয়ে আছে ।
বললাম---
উপন্যাসটি কেমন লাগল ?
মুখে
ম্লান হাসি । বলল---- ভাল । কিন্তু এখানে দেখছি নায়কই ভিলেন ।
---
বলতে পার ।
----
নায়ক কিন্তু বেচারা । ওর অনুসন্ধানটাই বৃথা ।
---
বাস্তবই তাই ।
ও বিছানায়
বসল । এমন সময় মামি ঘরে ঢুকতে গিয়ে ফিরে গেল । তারপর আবার ফিরে এল ।
মামি
বলল --- তোমার লজ্জা থাকলে থাকলে তুমি এ বাড়িতে আসতে না । আর কোন দিন যেন এ বাড়িতে
আর না এসো । তোমাকে নিয়ে বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে । তোমার এখানে না এলে হয় না ?
রোজী
কোন উত্তর দিল না । চুপচাপ নীচের দিকে চেয়ে থাকল । আমি টুলে বসে ছিলাম । বললাম
---- ওর কোন দোষ নেই । আমি ডেকেছি ।
মামী
বলল ---- কেন ডেকেছ ?
বললাম
--- একটু প্রয়োজন ছিল তাই ।
মামী
আর কোন কথা বলল না । রোজী বলল---- আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করছি, আমাকে নিয়ে আর ঝামেলা
করবেন না । আমি কথা দিচ্ছি, আর কোন দিন এ বাড়িতে আসব না ।
এমন
সময় বাবা বাইরে থেকে চিৎকার করে বলল --- ও খোবিস মেয়ের লজ্জা থাকলে এ বাড়িতে আসে !
বলে না , “একবার কান কাটলে গাঁয়ের বাহির দিয়ে যায় আর সাতবার কান কাটলে গাঁয়ের ভিতর
দিয়ে যায়” । লোকে কি এমনি বেশ্যা বলে !
বাবার
মুখে কথাটি শুনে আমার মাথায় হাত পড়ল । একতা মস্ত বড়ো দীর্ঘশ্বাস সশব্দে বেরিয়ে এল ।
আমার নিঃশ্বাসের শব্দে লজ্জিত চোখে ও আমার দিকে তাকাল । ওর গাল বেয়ে তখন আশ্রু গড়তে
শুরু করেছে । আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম । মামী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।
বাবা
পরের মেয়েকে এভাবে কথা বলতে পারল ! অথচ বাবা সে সময় ক্লাস নাইন থেকে পড়েছে ।
বেশ
কিছুটা সময় আমরা নিঃশব্দে কাটিয়ে দিলাম । তারপর রোজী অশ্রুভেজা গালে একটু বিষণ্ণ হাসি
টেনে বলল --- আমার এটাই বড়ো শেষ পাওনা ছিল । আমার বাবার মুখেও এরকম গাল শুনিনি । আসলে
আমার জীবনটা দুঃখে পরিপূর্ণ । এ পৃথিবীতে তো আমি কাঁদতেই এসেছি । কান্না আমার চিরসাথী
। আমি যদি বড়ো লোকের মেয়ে হতাম তাহলে আপনার বাবা এরকম খিস্তি আওড়াতেন না । আমার একটাই
অপরাধ আমি সুন্দর হয়ে জন্মেছি ।
আমি
প্রত্যুত্তরে বললাম --- বর্তমান সমাজ টাকা ছাড়া কিছুই বুঝে না । রুবিয়ার ব্যপারটা দেখ
না, বাবার অগাধ টাকা । প্রেমের নামে দৈহিক মেলামেশা । তারপর ভাওতা । আবার অন্যের কাছে
। সেখানেও একি রকম কেস । এভাবে সে প্রেমে সেঞ্চুরি করে ফেলে । সাবাই জানে --- মুখ খুলে
না । পণের বাজারে তার হাইস্কুলের শিক্ষকের সঙ্গে বিয়ে হয় ।
রোজীর
চোখে জল আরো ছেপে এল । কোন উত্তর করল না । আমার রুমাল ওর হাতে দিলাম । ও রুমাল নিল,
কিন্তু চোখ মুছল না ।
আমি
আবার বলতে শুরু করলাম ---- কেবল তাই নয়; আমার যদি টাকা থাকে আর তোমাকে যদি প্রকাশ্য
রেপ করি তাহলেও আমাকে কেউ কিছু বলবে না । সবাই দর্শকের মতো তাকিয়ে থাকবে আর তোমাকেই
বেশ্যা, চরিত্রহীন বলে চিহ্নিত করবে । এরা সমালোচনা করবে; কিন্তু কারো ভাল করবে না
। কারো ভাল করতে চাইলে এরা বাধা দিবে ।
রোজী
অশ্রুভেজা চোখে আমার দিকে তাকাল । ভীষণ মলিন চোখ দুটি । কোন ইংরেজ লেখক হয়ত এরকম অশ্রুস্নাত
চোখ দেখেই বলেছিলেন--- Tear is the noble language of eye.
ও রুমাল
দিয়ে চোখ মুছল । গাল দুটো মুছল । তারপর হাসির ব্যর্থ চেষ্টা করল । এই সময় ওকে দারুণ
সুন্দর দেখাচ্ছে । চুলগুলো উদ্ভ্রান্তের মতো এলোমেলো । কিছু কিছু চুল মুখে আর গালে
এসে পড়েছে । যাকে বলে সেক্সি । কিন্তু সেক্সি কথাটা কেন যেন আমাকে অশ্লীল মনে হয় ।
তার চায়তে রতিময় কথাটি আমাকে ভাল লাগে ।
ও অতি
হালকা নীল ফ্রক পরে আছে । সেটি ওর পরনে ছোট লাগছে । হাঁটু পর্যন্ত ঘের । হাত দুটো ছোট
- বগল থেকে একটু নীচে । কোলকাতার মেয়েদের সচারচার এসব পোষাকে দেখা যায় । যে কোন মানুষকে
আকৃষ্ট করার মত ।
ওর চোখের
সামনের চুলগুলো সরিয়ে আমার দিকে তার গভীর প্রশান্ত মায়াবী চোখে আমার দিকে অনেকক্ষণ
তাকিয়ে থাকল । আমিও ওর দিকে । সীমাহীন আদিগন্ত বিস্তৃত টলমলে চোখ । বহুদূর হতে যেন
তারাগুলি দিশার আলো জ্বালতে বেরিয়ে এসেছে । অনেকক্ষণ এভাবে চুপচাপ কেটে গেল । তারপর
চোখ নামিয়ে আমি বললাম --- যখন আমার আর তোমার ওপর আমার বাবা-মা’র এতই অবিশ্বাস, চল আমরা
আজই বিয়ে করি ।
আমার
কথায় দৃঢ়তা থাকলেও ও নিঃশব্দে হাসল । হাসলে ওকে ভারি সুন্দর দেখায় । গাল দুটিতে একটু
তোল পড়ে । বলল--- পাগলামো করবেন না । আপনাকে ঘিরে আপনার বাবা-মা’র কত স্বপ্ন আছে ।
আপনাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে । লেখাপড়া শিখিয়েছে । আমার চায়তেও সুন্দর স্ত্রী
আপনার আসবে । কেন আপনি ওদের স্বপ্নকে ভাঙ্গবেন ?
----
কিন্তু ওরা তো আমাদেরকে ভুল বুঝছে ।
----
তা বুঝুক । সে ভুল একদিন ভাঙ্গবে । যেদিন আপনার বৌ আসবে । আমি ওর কাছে পড়বো । ইয়ার্কি
করব । আপনারা দুপুরে শুয়ে থাকবেন, আমি এসে ডিস্টার্ব করব । সেদিন ওদের ভুল ভাঙ্গবে
।
আবেগে
রোজীর কথাগুলি বেরিয়ে আসছিল ।দুটো অশ্রুবিন্দু ওর চোখের কোনে এল । রুমাল দিয়ে চোখ মুছে
বল--- আমি আপনাকে শতবার কাঁদাতে পারি; কিন্ত আপনার বাবা-মাকে নয় ।
আমি
আর কোন কথা বলতে পারলাম না । অবাক হয়ে ওর চোখের দিকে তাকালাম । রোজী আমাকে বিয়ে করতে
চায়না । অথচ হেনা তো কম সুন্দরী ছিল না ! সে আমাকে বলেছিল--- আমি যতগুলো হেনা নামের
মেয়ে দেখেছি সকলের পলাশ নামের ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে ।
হেনার
কথা শুনে আমি হেসেছিলাম ।বলেছিলাম--- তাহলে তুমি মরেছ ।
-----
কেন ?
-----
তাহলে তুমি বলতে চায়ছ, তোমার বিয়ে আমার সঙ্গে হোক ।
-----
তা তো বলছি না ।
-----
তাহলে ?
হেনা
হাসতে হাসতে বলেছিল ---- তুমি একটা পাগল ।
হয়তো
আমি পাগল । ওর অভিলাষটা বুঝেও বুঝার চেষ্টা করিনি । কারণ অর্থনৈতিক বৈসাম্য । ওরা অনেক
বড়লোক । তারপর যখন আমি তাকে বুঝবার চেষ্টা করলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে । আমি ওর
কাছে গেলাম । আগের হেনাকে চিনতে কষ্ট হল । অপরিচিতের মতো বলল ----- এখন কথা বলার সময়
নেই ।
আমি
বললাম ----- আমার যে কথা ছিল ।
----
পরে হবে । দেখছ না বেরিয়ে পড়েছি । সময় হলে ডেকে পাঠাব ।
কিন্তু
ও আমাকে আর ডেকে পাঠায় নি । যখন ডেকে পাঠিয়ে ছিল তখন তার সঙ্গে পাঠিয়েছিল ওর বিয়ের
নিমন্ত্রণ পত্র ।
কিন্তু
রোজীর মনে কি কোন দূরভিসন্ধি লুকিয়ে আছে ! কারো প্রতি দুর্বলতা ! এখনো কি কাউকে ভালোবাসে
! আমার মনে অজানা সংশয় উঁকি মারছে ।
আমি
রোজীর চোখের দিকে তাকালাম । ও অভিনয়ের ভঙ্গিতে মুখে একরাশ হাসি নিয়ে চৌকি থেকে নামল
। চোখে অশ্রু নেই । কিন্তু গালে অশ্রু শুকিয়ে যাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট । ও আমার থুতনিতে
স্বস্নেহে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বলল ----- আমাকে আর কোন দিন ডাকবেন না । বুঝলেন ?
আমার বুকের ভিতর কি যেন অস্বাভাবিকভাবে মোচড় দিয়ে
উঠল । ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে হল; কিন্তু পাষাণ চোখে এক ফোটাও জল এল না । কেবল হতবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে । ও সেকহ্যান্ড করল । আমি কেবল একটি শিশুর মতই অনুকরণ করে গেলাম
। যাবার সময় ও বলল – গুড ডে ফর এভার টু ইউ স্যার !
অনেকক্ষণ হল রোজি চলে গেছে । আমার চারিদিকে
ভীষণ নিঃসঙ্গতা বিচরণ করছে । কিছুই ভাল লাগছে না । কেবলমাত্র ওর মুখটা আমার ভগ্ন হৃদয়ে
ভেসে উঠছে বারবার । ওর অশ্রুসিক্ত চোখে মুখে অদ্ভূত উপহাসের প্রসন্ন হাসি । আমার হৃদয়
মোচড়ানো কাগজের মতো যেন চুপসে যাচ্ছে । দম বন্ধ হওয়ার মতো একটা ব্যাথা উসকাচ্ছে । এভাবেই
কি মানসিক আঘাতে সবার হার্ট ফেল হয়ে যায় ! তাহলে আমার কেন ফেল হচ্ছে না ? আমি আর ভাবতে
পারছি না । দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ।