বহুগামী আমি
সৈয়দ আসরার আহমদ
পর্ব-১০৬ (শেষ পর্ব)
অপরাহ্নে স্বপ্নাভাবির আসার খবর সেই বাচ্চু জানিয়ে গেল৷ সাখোয়াত বলল, চল
শামিমভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি৷ শ্রাবন্তী বলল, চা খেয়ে নাও তারপর যাবে৷ আমি কি যাব
তোমাদের সঙ্গে?
- না যাবার কি আছে? যেতে চাইলে যেতে পার৷ তোমার ইচ্ছে৷ সাখোয়াত জবাব দিল৷
- স্বপ্না বৌদিকে আমার খুব ভাল লেগেছে?
- ভাল লাগবে না কেন ? দুজনেই তো জাত দিয়েছ মুসলিমকে বিয়ে করে৷ সাখোয়াত শ্রাবন্তীকে
ঢিট করল৷
- বেশ করেছি জাত দিয়েছি তোমার তাতে কি ক্ষতি হয়েছে শুনি, বলো তো সোনামনি?
শ্রাবন্তীর কনফিডেন্স দেখে আমার ভাল লাগল৷ এটা বোঝা গেল যে, সে সাখোয়াতকে মনেপ্রাণে
ভালবাসে৷
তার স্ত্রীর কথায় সাখোয়াত উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, শ্রাবন্তী কানে কানে একটা কথা শুনে যাও৷
শ্রাবন্তী বলল, বলো না কি এমন গোপন কথা যা দেলোয়ারের সামনে বলা যাবে না৷
- বলা যাবে না বলেই তো কানে কানে বলব৷
- অপেক্ষা কর যাচ্ছি৷
শ্রাবন্তী আলমারি গুচ্ছাছিল হাতের কাজ ফেলে সাখোয়াতের কাছে এসে মুখ নামিয়ে যেই তার
স্বামীর মুখের কাছে কানটা নিয়ে গেছে তখনই সাখোয়াত শ্রাবন্তীর ঘাড় ধরে লম্বা কিস করল৷
শ্রাবন্তী আমার সামনে তার স্বামীর আচরণে বিব্রতবোধ করে চেঁচিয়ে বলল, একি অসভ্যতা তোমার
ছিঃ!ছিঃ!
- চুম্বন পবিত্র ব্যাপার এতে ছিঃ ছ্যার কি আছে?
- মানলাম পবিত্র তার তো একটা সময় কাল পরিবেশ আছে না কি?
- আমার বন্ধুর সামনে আমার ঘরে আমি আমার বউকে কিস করলাম তাতে ক্ষতি কি হল?
- তুমি একটা হোদল কুতকুত বুদ্ধুরাম দি গ্রেট! কমন সেন্স থাকলে এটা করতে না৷ আমার লজ্জায়
মাথা হেঁট হয়ে গেল৷
সাখোয়াতের এই স্ত্রী-প্রেম দেখে আমার ভাল লাগল৷ তবুও আমি মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম৷ শ্রাবন্তী
স্বামীর হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সাখোয়াতের পিঠে আলতো করে থাপ্পর মেরে বদমাস কোথাকার বলে
উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমি ড্রেস চেন্জ করছি চলো স্বপ্না
বৌদির সঙ্গে দেখা করব৷
- ঠিক আছে তুমি রেডি হও আমি তো প্যান্ট পরেই আছি৷
- ওইটা খুলে রেখে অন্য একটা পর৷
- ঠিক আছে তাই পরছি৷
আমরা তিনজনে নিচে নেমে স্বপ্না বৌদির মায়ের ফ্ল্যাটে গেলাম৷ তিনি পাশের এপার্টমেন্টের
দোতলায় থাকেন৷ দরজা ভেজানো ছিল৷ তবুও আমি কলিং বেল টিপলাম৷ বাচ্চু এসে বলল, আসুন আপনারা,
সেজদি পাশেই বন্ধুর বাড়ি গেছে আমি ডেকে আনছি৷
আমরা ভিতরে গিয়ে সোফায় বসলাম৷ সোফাটা খুব দামী৷ লেদার মোল্ডেড ফোমের গদিতে বসলেই শরীরের
অর্ধেকটা ডুবে যায়৷ আমাদের বসতে বলে মাসিমা উঠে গেলেন৷ শ্রাবন্তী বলল, মাসিমা কিছু
করবেন না আমরা এইমাত্র চা খেয়ে এলাম৷
- আমি কিছু করছি না স্বপ্না আসুক তারপরে ও যা করার করবে৷
- মাসিমা আপনার সেজ জামাই আসেন নি৷
- কই এখনও তো আসে নি তবে স্বপ্না বলছিল সন্ধ্যেয় আসবে৷
এর মধ্যে স্বপ্নাভাবি, মনীষাদি ও বাচ্চুরা চলে এলো৷
শ্রাবন্তী বলল, স্বপ্না বৌদি তুমি শামিমদা মাসিমা আর বাচ্চু আগামীকাল আমাদের ওখানে
যাবে আমরা একসাথে খাবো৷
- আরে না না৷ অত্ত ঝামেলা নেয়ার দরকার নেই৷
- ঝামেলার কিছু নেই সাখোয়াত বলছিল, তোমাদের কখনও নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয় নি৷ ও বলছিল,
সাবির থেকে বিরিয়ানি নিয়ে আসবে৷ কেবল মাসিমার জন্য আমি রান্না করব৷
- না রে মা আমার জন্য তোকে কিছুই করতে হবে না৷ আমি নিজেই ডাল ভাত ফুটিয়ে নেব৷
- না না মাসিমা আপনিও যাবেন আমার মা বাবা আসবে৷ আপনি মায়ের সঙ্গে গল্প করবেন৷
- তোমার মা আসছেন৷ ঠিক আছে দেখা হবে তবে আমি খাবো না৷ আমি এবার কাশী চলে যাব৷ শেষ জীবনটা
ওখানে কাটাব ভাবছি৷
মনীষাদি বললেন , সংসার ফেলে তুমি কিভাবে এখন যাবে৷ বাচ্চু বে দাও তারপরে কাশী মথুরা
বৃন্দাবন যেখানে খুশি যাবে, বুঝলে?
স্বপ্না ভাবি বললেন, তোমার এখানে ভাল লাগছে না হঠাৎ করে কাশী ঝাঁসি যাবার পরিকল্পনা
করছ? আমার ঘরে তোমার নাতি বা নাতনির মুখ দেখার ইচ্ছে নেই বুঝি ?
- ওহো দূর ছাই সেকথা তো ভুলেই গেছিলাম! তোর সন্তানের মুখ না দেখে যাবো কিভাবে?
- মনীষাদি বললেন, স্বপ্নার পুত্র সন্তান হলে তুমি তার প্রেমে পড়ে যাবে তখন কেষ্টপুরে
শ্রীকৃষ্ণ চলে আসার অবস্থা হবে৷ তোমাকে বৃন্দাবনে যেতে লাগবে না৷ কেষ্টপুরেই রাধা কেষ্টর
প্রেমলীলা চলবে!
মনীষাদির কথা শুনে সবাই হেসে উঠল৷
- ঝা বলেছিস! একটুও বাজে কথা বলিস নি মনি তুই ৷ মাসিমা মনীষাদিকে কমপ্লিমেন্ট দিলেন৷
টেলিফোন বেজে ওঠায় বাচ্চু ছুটে গিয়ে ফোন ধরল৷ রিসিভারটা নামিয়ে রেখে সে চেঁচিয়ে বলল,
সেজদি তোর ফোন শামিমদা করেছেন৷
স্বপ্না বৌদি ফোনে কথা বলে এসে বললেন, শামিম আসছে সঙ্গে দেলোয়ারদের বন্ধু সেলিমও আসছে৷
- কে সেলিম!দেলোয়ার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল৷
সেলিম আসছে জেনে সাখোয়াত নড়েচড়ে বসে বলল, বেটার সঙ্গে কতদিন দেখা নেই৷ ও এখন দিনাজপুরে
L.R.O. হয়ে আছে৷
- বাহ! খুব ভাল খবর শুনালি সেলিম কি P.S.C দিয়ে পেয়েছে?
- P.S.C. না W.B.C.S ছাড়া L.R.O.র চাকরি হয় না, জানিস না?
- না জানা ছিল না তবে আমার ছোট মামা P.S.C দিয়ে L.R.O. হয়েছিলেন৷
- আগে এই নিয়ম ছিল এখন W.B.C.S. পাশ করলে নিয়োগ করা হয় ৷
- That's a great achievement !
- সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, প্রথম চান্সে ও চাকরি পেয়েছে৷
- বিয়ে করেছে?
- হ্যাঁ, করেছ তো৷ ওর ওয়াইফ রায়গন্জ কলেজে পার্ট টাইম লেকচারার৷ ইতিহাস পড়ায়৷
- বাহ খুব ভাল৷
স্বপ্নাভাবি বললেন, তোমরা বস আমি কফি করে আনি৷
বাচ্চু বলল, সেজদি তুমি বসো আমি করে আনছি৷ তুই এককাজ কর কফি বানিয়ে সানবাঁধা ঘাটে নিয়ে
আয়৷ আমরা ওখানে গিয়ে বসছি৷
- সেজদি যেও না ওখানে এখন, প্রচুর মশা লাগবে৷
- হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস এখানেই কফি করে আন সঙ্গে চানাচুর মুড়ি মাখিয়ে আনবি৷ আর মিষ্টিও
কয়েকটা আনবি৷
- ঠিক আছে৷ তোমরা গল্প কর আমি দশ মিনিটের মধ্যে আনছি৷
শ্রাবন্তী বলল, সেলিমের স্ত্রী মাসুমা পারভিন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে ফার্স্ট
ক্লাস পেয়েছিল৷ পি এইচ ডি করেছে৷ ফুলটাইম লেকচারার হয়ে যাবে৷ আমাদের এখানে আসব আসব
বলেও আসতে পারে নি৷ স্বপ্নাবৌদি সেলিম কি একা আসছে?
- আমি সেকথা বলতে পারব না৷ তোমার শামিমদাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি৷
আমরা কফি খাচ্ছিলাম তখন একটা গাড়ি এসে থামল৷ বাচ্চু বলল, নিশ্চয় সেজ জামাইদা এসেছেন৷
স্বপ্নাভাবি বললেন, দেখ তো শামিম এলো না ভাড়াটেরা কেউ এলো?
বাচ্চু উঠে দেখতে গিয়ে ওখান থেকে চিৎকার করে বলল, জামাইদা আসেন নি৷ সেজদি আমি মনীষাদিদের
ঘরে যাচ্ছি সোনালির সঙ্গে গল্প করতে৷
- বেশ যা তাড়াতাড়ি চলে আসবি তোর জামাইবাবু তোকে খুঁজবে৷
- আচ্ছা৷ আসছি সেজদি৷
- আয়৷
আমরা অনেকক্ষণ গল্প করে উঠতে যাব এমন সময় শামিমভাই সেলিমকে নিয়ে হাজির৷ এপার্টমেন্ট
কম্পাউণ্ডে গাড়ি ঢোকার সময় হর্ন বাজিয়েছিল৷ কিন্তু আমরা গল্পগুজবে মত্ত থাকায় শুনতে
পাই নি৷
সেলিমকে দেখে আমি ও সাখোয়াত যেমন আবেগতাড়িত হয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম তেমনই সেলিম
খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠল৷ সে প্রথমে আমার সঙ্গে কোলাকুলি করল তারপর সাখোয়াতের সঙ্গে৷
আমার আর সাখোয়াতের মধ্যেখানে এসে বসল৷ সাখোয়াত বলল, চল আমার ফ্ল্যাটে গিয়ে বসি৷ স্বপ্না
ভাবি জানতে চাইলেন, এখানে কি অসুবিধা হচ্ছে? সেলিম তো আমাদের এই বাড়িতে প্রথমবার এলো
বসুক৷ সেলিমকে দেখতে মাসিমা পাশের ঘর থেকে এলেন৷ স্বপ্নাভাবি বললেন, সেলিম ইনি আমার
মা৷
সেলিম উঠে প্রণাম করতে যাচ্ছিল তিনি হাত ধরে নিয়ে বললেন, থাক থাক বসো বাবা তোমাদের
কল্যাণ হোক৷
- তুই কি একা এসেছিস? সাখোয়াত সেলিমকে জিজ্ঞেস করল৷
- না না সঙ্গে মাসুমা এসেছে৷
- তিনি কোথায়? তাকে সঙ্গে আনলি না কেন?
- ও দেওদার স্ট্রিটে মামার বাড়িতে গেছে৷
- তোরা কি ওখানে উঠেছিলি?
- না আমরা শিয়ালদহে দূর্গা হোটেলে উঠেছি৷
- ওকে সঙ্গে আনতে পারতিস৷ শ্রাবন্তীর সঙ্গে গল্প করত৷
- আমি তো শামিমভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে শুনলাম তোরা স্বপ্নাভাবির ফ্ল্যাটে থাকছিস৷
শামিমভাই বললেন, উনি কেষ্টপুরে যাবেন৷ দেলোয়ার ওছানে সাখোয়াতের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে৷
সেকথা শুনে ভাবলাম, আমার ভাগ্য কত ভাল যে দুই পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে তাই শামিমভাইয়ের
সঙ্গে চলে এলাম৷
আমি বললাম, ভাল করেছিস৷ আমার সাথে সাথে সাখোয়াতও একই কথা বলল৷ আমাদের দুজনের একই অভিব্যক্তি
সেলিমকে প্রফুল্ল করল৷
- আমার ভাগ্য ভাল তোদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷ কতদিন দেলোয়ারকে দেখি নি৷ আমার জানা হল
সাখোয়াত এখানে থাকে৷ মাসুমাকে নিয়ে আসব৷ আর সাখু তোরা তিন জনে রায়গন্জ যাবি৷ কেবল যাবার
আগে একবার ফোন করে জানাবি৷ আমি তোদের রিসিভ করে নেব৷ রায়গন্জ শহরটা তোদের ভালই লাগবে৷
কুলিক নদী পাড়ে তোদের ঘোরাতে নিয়ে যাব৷ এখানের মানুষের ব্যবহার খুবই ভাল লাগবে৷ ওখান
থেকে তোদের দার্জিলিং নিয়ে যাব৷
সাখোয়াত বলল, পূজোর ছুটিতে যেতে পারি৷
- আচ্ছা, ঠিক আছে তাই যাবি৷ তবে ওই সময় প্রচুর মানুষ বাইরে যায়৷ তোরা আগে থেকে দার্জিলিং
মেলের টিকিট কেটে রাখবি৷ নইলে টিকিট পাবি না৷
- ভাল কথা বলেছিস৷ ঠিক আছে আগেভাগে টিকিট কেটে নেব৷
শামিমভাই বললেন,মে জুন মাসে টিকিটের রিজার্ভেশন করে নিও৷ তারপরে আর রিজার্ভেশন পাবে
না৷
সাখোয়াত বলল, তাহলে তাই করতে হবে৷
শ্রাবন্তী বলল, যদি যেতে চাও তাহলে শামিমদা যেটা বললেন সেই মতো মে জুন মাসে টিকিট বুকিং
করে নিতে হবে৷
আমি বললাম, যাওয়ার ব্যাপারে পরে একদিন আমরা তিনজনে বসে ফাইনাল করব কবে যাবো৷