কোরবানি ও বিশ্বাসঘাতকতা
আজিজুল হাকিম
~~~~~~~~~~~~~~
চরম বিশ্বাসের এমন করুণ পরিণতি জীবনে আর কোথাও
কখনো দেখিনি । যা দেখে আসছি কোরবানির উল্লাসে । হয়তো অতি বিশ্বাসের এমন করুণ পরিণতি
হয় এবং এমন বিশ্বাসঘাতকতা সম্ভব একজন ধার্মিক ব্যক্তির দ্বারা । আল্লাহ ধার্মিকদের
এরকম নিষ্ঠুর, জল্লাদের মতো বিশ্বাসঘাতক হতে বলেছেন বলেও সন্দেহ হয় ।
এবার কোরবানিতে আমার একটি খাসি ছাগল ছিল ।
এর আগেও ছয় সাতটি খাসি ছাগল কোরবানি দিয়েছি । তখন কিন্তু এমন অনুভূতির উদয় হয়নি, যদিও
এর দু-বছর আগে একটি চরম আঘাত পেয়েছিলাম । সেদিন আমি ছাগলটার পা ধরেছিলাম । আমার মামাতো
ভাই এসে ছাগলটি জবাই করল । তখন সেটি দেহ থেকে প্রাণ চলে যাওয়ার যন্ত্রণায় ছটপট করতে
করতে এক সময় অসাড় হয়ে পড়ল । ভাবলাম ও মারা গেল । কিন্তু কিছুক্ষণ পর ও হঠাৎ মাথা তুলে
আমার দিকে একবার ঘুরে তাকাল । কারণ আমি ওর পিছনে আমি ছিলাম । তারপর ধপ করে পড়ে মারা
গেল । আমি বুঝতে পারলাম না ও আমাকে আশীর্বাদ না অভিশাপ দিয়ে মারা গেল । কেবল মনে হতে
লাগল, ও নিঃশব্দে ওর চাহনিতে বলে গেল, "তুমিও....!" তখন দু চোখ বেয়ে ঝরঝর
করে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল । কেবল আমি নই, দেখলাম বাড়ির সকলের চোখেই অশ্রু
ঝরছে অবিশ্রান্তভাবে ।
তার পরের বছর থেকে আমি আর কোরবানি দেওয়ার সময় সেখানে থাকি না । দু-এক জনকে সেই কাজ করার জন্য পাঠিয়ে দিই ।
সোফাতে নিশ্চিন্তে ঘুম
যাহোক, এবার আসছি এবারের কোরবানির কথায় ।
যে ছাগলটিকে এবার কোরবানি দিলাম সেটি জন্মেছিল জানুয়ারি মাসে । তার মানে ভরা শীতে ।
যেদিন জন্মেছিল সেই রাত থেকেই আমার বিছানায় লেপের তলে নিয়ে শুয়ে থাকতাম । কেবল তাই
নয়, বিছানায় যেন প্রসব পায়খানা না করে সেই কারণে রাতে কয়েকবার করে তাকে উঠতাম এবং ওর
মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে দুধ খাওয়াতাম । কেবল তাই নয়, মানুষ যেভাবে তার সন্তান বা পড়ার
শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে, আদর করে, যত্ন নেয়; সে ভাবেই আমরা ওর যত্ন নিতাম । ওর
সঙ্গে খেলাধুলা করতাম । এমনকি ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার ভয়ে ওকে ঘরের মেঝেতে শুতে না দিয়ে
কোলে নিয়ে কম্পিউটারে কাজ করতাম । আর এভাবেই সে বড় হতে থাকে ভীষণ আদর যত্নে
।
তারপর ও যখন বড় হতে থাকল এবং কোলে নেওয়ার
অবস্থা থাকল না, তখনও আমাকে চেয়ারে বসতে দেখলেই আমার কোলে এসে বসার চেষ্টা করতো । কেবল
তাই নয়, আমি যদি দিনের বেলায় কখনো শুয়ে থাকতাম আর ও যদি সে অবস্থায় দেখে নিত, তাহলে
ও লাফিয়ে খাটে উঠে আমার গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকতো । আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না উঠতাম
ততক্ষণ ও আমার গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতাম । ওকে বিশেষ কোন খাবার না খাওয়ালেও শরীর
স্বাস্থ ভাল থাকতো ও লোমে তৈলাক্ত ও চিকণ থাকতো । অনেকে প্রশংসা করে জিজ্ঞেস করতো আমি
কোন স্পেশাল খাবার দিই কি না । আমি উত্তরে বলতাম যে না, তবে এক্সট্রা কিছু দিই, সেটি
ভালোবাসা ।
যাহোক, ওকে লাঠি দেখালে বা লাঠি নিয়ে তাড়া
করতে গেলেও ও পালিয়ে যেতো না । আদর, ভালোবাসা পেয়ে পেয়ে ওর মনের মধ্যে এমন আত্মবিশ্বাস
জমাট বেঁধেছিল যে তাকে হত্যা করা তো দূরের কথা, আমি ওকে মারতেও পারব না । এমন অবস্থায়
আমার মনে হতে লাগল, আমি কত বড় বিশ্বাসঘাতক ! বিশ্বাসঘাতক না হলে এমন সরল বিশ্বাসী পশুকে
আমি কুরবানি দিতে পারতাম না ।
অবশেষে যখন আমি ওকে কোরবানি করার জন্য বাগানে
নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ও কোন মতেই সেখানে যাচ্ছিল না । অথচ অন্যান্য দিন আমি ওকে যেখানে
ডেকেছি সে নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে, চরম বিশ্বাসে আমার সঙ্গে গেছে । যাহোক, আমি ওকে
জোর করে, শক্তি প্রয়োগ করে সেখানে নিয়ে গেলাম ।
তারপর ওকে জবাইকারীদের হাতে তুলে দিয়ে যখন
ফিরে আসছি তখন ওর বাঁচার জন্য আকুতি ভরা চিৎকার যেন আমাকে বারবার বলছে, "তুমি
একটি বিশ্বাসঘাতক, পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম, নিষ্ঠুর বিশ্বাসঘাতক ।” আমি অশ্রু ভরা চোখে ফিরে আসতে আসতে মনে মনে ভাবলাম,
ওকে কোরবানি দিয়ে আমি কি পাপের হাত থেকে মুক্তি পাবো ? ও কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে
?
বোধের দরজায় দাঁড়িয়ে ভাবতেই হবে।
ReplyDeleteএকদম ঠিক বলেছেন । আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, প্রিয় দাদা ।
Delete