আমার ফেলে আসা দিনের কথা
মনিরা মাসিদ
আমার সাধের
হারিকেন --
সেদিন একটা বই পড়তে পড়তে একটা হারিকেনের
ছবি দেখলাম ( একে আবার অনেকে লণ্ঠন বলে ) আরএই ছবি দেখেই কত কথাই মনে পড়ে গেল ।
হারিকেনের সঙ্গে নশ্চিয় অনেকের কম বেশি পরিচয়
আছে | সে কালে সন্ধ্যা হলেই তো লোডশেডিংয় বাঁধা, আর একবার লোডশেডিং
হলে তো কম করে দুই ঘন্টা আর তার
দেখা পাওয়া যাবে না, আর একটু ঝড় বৃষ্টি হলে তখনকম করে দুই থেকে তিন দিন
কারেন্টের দেখা পাওয়া যাবে না | আর তখনকার দিনে তো আর ঘরে ঘরে ইনভার্টার বা চার্জ
দেয়া ল্যাম্প ছিল না, এই হারিকেনই ছিল সম্বল |
ছোটো বেলায় দেখতাম বিকাল হলেই হারিকেনের কাচ খুলে নরম কাপড়
দিয়ে ঘষে ঘষে মাঝে মাঝে মুখের ভিতেরের ভাপ দিয়ে আবার কাপড় দিয়ে ঘষে পরিষ্কার
করা হতো, কেরোসিন ভোরে, আগের দিনের পোড়া বাতি কেটে মুছে পরিষ্কার করে, হারিকেনটা জ্বালিয়ে
আলোটা কম করে বারান্দার এক পাসে রেখে দেয়া হত | লোডশেডিং হলে শুধু বাতি কলটাঘুরিয়ে
আলোটা বাড়িয়ে নিলেই হলো |
তো এই হারিকেন গুলোর মধ্যে একটা হারিকেন ছিল আমার একার, আমার
সাধের হারিকেন ওটা আমার রোজ রাতে চাইই চাই সে লোডশেডিং হোক বা নাহোক | এমন
কি আমার সেই হারিকেনটা আমার সঙ্গে আমার শশুর বাড়িতে ও এসে ছিল, তারপর
কবে যেন এক দিন আমার বর আমাকে একটা ব্যাটারি দেয়া টেবিল ল্যাম্প কিনে দিলো,
আর আমার হারিকেনটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল |
আজ এটা লিখতে বসে আমার সেই সাধের
হারিকেনের জন্য মনটা বড়ো খারাপ হয়ে আছে | যাক এবার আসল কথা বলি | হারিকেন আমার
সাধের হারিকেন, আমি আর আমার দিদি এক ঘরে শুতাম, তখন
কার সময় তো আর এখন কার মতো আলাদা আলাদা ঘর থাকতো না, সব বাড়িতে
দেখতাম বোনে বোনে একটা ঘরে থাকতো, আর দাদা, ভাই রা সব একটা ঘরে থাকতো | তো আমি আর দিদি একটা ঘরে
থাকি | আমার ছিল রাত জেগে গল্পের বই পড়ার নেশা ! আর দিদি তার নিজের পড়াশোনার বাইরে একটা কিচ্ছু পড়বে না, দিদি ছিল ঘুম কাতুরে,আবার লাইট জ্বালিয়ে রাখলে তার আবার ঘুম
হয় না, তো দিদির হুকুম শোয়ার
সময় লাইট জ্বালিয়ে রাখা যাবে না | আর আমি তো ছোটো বেলা থেকে বই পোকা
| দিদি যেই ঘুমিয়ে পড়বে অমনি আমি উঠে লাইট জ্বালিয়ে আমার সাধের বই পত্র নিয়ে বসে যাব
|আবারো দিদি উঠেলাইট বন্ধ করে এবার শুয়ে পড়
বলে হুকুম জারি করে নিজে আবার
ঘুমিয়ে পড়তো |এই ভাবে লাইট জ্বালানো আর নেভানো রোজই চলতে থাকে |
একদিন আমার খুব রাগ হয়ে ঝগড়া বেধে গেল, আমাদের
ঝগড়া শুনে বাবা, মা উঠে আসলো, সে
দিন দিদির জিত হলো, কারণ মাঝ রাতে সবাই
লাইট বন্ধ করে ঘুমায় এটাই নিয়ম | আমার
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল আমি করুন চোখে বাবার দিকে তাকালাম,
দেখি বাবার মুখ টাও করুন
হয়ে আছে | তারপরের দিন বাবা বেশ সুন্দর
একটা হারিকেন কিনে এনে আমাকে দিয়ে বললো এটা তোর, এটা জ্বালিয়ে ঘরের মেঝেতে বিছানা করে তোর যত্তক্ষন
ইচ্ছা গল্পের বই পড়বি,
দিদিরও আর অসুবিধা হবে না, তোর ও পড়া হবে
| তো এই হারিকেনটা আমার সাধের হারিকেন |
সাধের হারিকেন কেন ? আমার দিদা আমাদের বাড়ি এসে আমার হারিকেনের
গল্প শুনে, হারিকানটাকে আমার যত্ন করা দেখে দিদা বলল এ যে দেখি তোর বড়ো সাধের হারিকেন | সেই থেকে ওটা আমার
সাধের হারিকেন হয়ে গেল
|
আমার আর একটা খুব মিষ্টি সৃতি আছে এই হারিকেনের আলোয় পড়ার সময় | ক্লাস
নাইনের পরীক্ষা শেষ, শরৎ রচনাবলী নিয়ে এসেছি " দেবদাস "পড়া শুরু করেছি
পড়ছি পড়ছি আর পড়ছি মাঝ রাতে এসে শেষ হলো | কেন জানি বুকের মধ্যে কি ভীষণ একটা কষ্ট
হতে লাগলো, অচেনা একটা
ভয় ও অদ্ভুত একটা আতঙ্ক আমাকে ঘিরে
ধরে সেই নিঝুম রাতে এক অন্য রকম পরিবেশের
সৃষ্টি হয়ে ছিল | কখন যে আমি বালিশে মুখ গুঁজে কান্না শুরু করেছি আমি নিজেও জানিনা, দিদি উঠে
আমার কাছে নেমে এসে আমার
মাথায় হাত দিয়ে খুব অবাক হয়ে বলল, কিরে কাঁদছিস কেন, কি হয়েছে
ভয় পেয়েছিস ? এই রকম ভুতের মতো একা জেগে থাকলে ভুতে ভয় দেখাবে নাতো কি করবে | চল খাটে চল ওখানে বসেই পড় তোকে আর লাইট বন্ধ করতে হবে না তুই লাইট জ্বালিয়ে পড় |গল্প, উপন্যাস পড়েও যে কান্না আসে এ আমার দিদির মাথায় ঢোকে না, কিন্তু আমার ভোলেভালা দিদি
জানতেও পারলো না আমি কেন কাঁদছি | এক তো 'দেবদাস ও পার্বতীর ' জন্য, আর নিজের জন্য এক অজানা
ভয়ে ও এক অচেনা কষ্টে |কারণ তখন আমারও একটু একটু শুরু হয়েছে "naino
ki jo baat naina jaane hai " |