একটি ছোট্ট দুর্ঘটনা মাত্র
-
আজিজুল হাকিম
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সুজন একদম
দিশেহারা হয়ে গেল । সমস্ত অবলম্বন হারিয়ে গেলে যেমন হয়; তেমনি অসহায়ভাবে সুবিস্তৃত
মাঠের মধ্যে একাকি বসে আছে । চোখের সামনে সুন্দর মাঠ তার সবুজ হাসি নিয়ে উদ্ভাসিত হচ্ছে
। বাতাসের অদৃশ্য ছোঁয়ায় সবুজ ফসলগুলো তাদের মাথায় সুন্দর ঢেউ তুলতে তুলতে দিগন্তের
ওপারে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে । তবুও তার হৃদয়ে কোন রকম রেখাপাত করতে পারছে না । উদাসিন
মন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে । তার মনের মাঠখানি মরুভূমির শূন্যতায় ভরে আছে ।
আজ থেকে প্রায় চার বছর আগের কথা । সুজন তার বর্তমান
স্ত্রী স্নিগ্ধাকে পাশে রেখে সবিতা নামের একটি আইবুড়ো মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় । তার স্ত্রীর
একটাই দোষ ছিল, তা হল সে শ্যামা বর্ণের । যদিও স্বামীর চাওয়া-পাওয়া, সংসারের দায়দায়িত্ব
যথাযথ ছিল । অপর দিকে সবিতার একটিই গুন ছিল, তা হল, সে দেখতে সুন্দরী ।
একদিন সুজন স্নিগ্ধাকে রেখে সবিতাকে নিয়ে পালিয়ে
গেল । মামনি পড়ে রইল শ্বশুর বাড়িতে । কিন্তু দু-এক মাস যেতে না যেতেই শ্বশুর, শ্বাশুড়ির
গুঞ্জনা, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তিন বছরের ছেলেটিকে নিয়ে চোখের জলে নাক, মুখ,
বুক ভাসাতে ভাসাতে বাবার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিল ।
এদিকে
শ্বশুর বাড়ি থেকে মামনির বিদায়ের দুমাস পরেই সুজন সবিতাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল । শ্বশুর
শ্বাশুড়ি সাদরে নতুন বউকে বরণ করেও নিল ।
তারপর
সুজনের দাম্পত্য জীবন নির্ঝঞ্ঝাটেই কেটে যাচ্ছিল । মাস পেরিয়ে বছর, বছর পেরিয়ে বছর;
এভাবেই তিনটি বছর কেটে গেল । এর মধ্যেই তাদের সংসারে একটি ফুটফুটে ছেলের আবির্ভাব ঘটল
। যার বর্তমান বয়স দুবছর ।
কদিন
থেকেই পাশের পাড়ার মাঠে মেলা বসেছে । একদিন রাতে সুজন সেই মেলায় বেড়াতে গেল । যদিও
সবিতাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সে অনেক পিড়াপীড়ি করে । শরীর খারপ করছে জানিয়ে সে কোনভাবেই
সুজনের সঙ্গে গেল না ।
কিন্তু
সুজন যখন মেলা থেকে বাড়ি ফিরল তখন বাড়িতে ও বাড়ির বাইরে লোকের সমাগম ও ভিড় দেখে অজানা
সংশয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল । যখন সে ভিড় ঠেলে বাড়িতে প্রবেশ করল তখনই বিষয়টি দিনের আলোর
মতই পরিষ্কার হয়ে গেল । জানতে পারল, সবিতা পাড়ার একটি বিবাহিত ছেলে, রতনকে নিয়ে ঘরের
ভিতর ফুর্তি মারছে । বিষয়টি কয়েক জনের নজরে আসায় তারা উভয়কে তালা বন্দী করে রেখেছে
।
সুজন
কাঠের পুতুলের মতই মাটির দিকে চোখ মেলে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ । তারপর জ্ঞান
হারিয়ে ফেলল । যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন জানতে পারল সবিতা আর রতনকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে
। কিন্তু থানায় নিয়ে গিয়েও কারো কোন রকম বিচার হয়নি; কারণ দেশের আইন বলছে, পরকীয়া প্রেম
নিষ্পাপ সঙ্গম ছাড়া কিছুই নয় । ফলে দুদিন পরেই সবিতা আর রতন পরস্পরের বাড়িতে ফিরে এল
। সুজন সবিতাকে বাড়িতে তুলতে না চাইলেও জেলে ঘানি টানার ভয়ে এসব মেনে নিতে বাধ্য হল
।
তারপর
কয়েকদিন যেতে না যেতেই রতন সবিতার কাছে প্রকাশ্যে চলে আসতে থাকে । সুজনের অবর্তমানে
সবিতার সঙ্গে এক ঘরে থাকে । এতে সুজন সব কিছু জেনেও কোন প্রতিবাদ করতে পারেনা । কেবল
তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে । বাড়তে থাকে ঘৃণা আর সামাজিক অপমানবোধ । এক অনিঃশেষ
অদৃশ্য ঘূর্ণি ঝড়ে মন, মানসিকতা, হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে । দেহে নানান আসুখ বাসা
বাঁধতে থাকে ।
তবূও
এভাবেই চলে যাচ্ছিল । কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই সুজন ভোর বেলায় উঠে দেখল, সবিতা
বিছেনায় নেই । এমনকি তাদের কোলের ছেলেটিও নেই । চারিদিকে খুঁজাখুঁজি চলল । সারা পাড়ায়
খবরটি ছড়িয়ে পড়ল - সবিতা রতনের সঙ্গে পালিয়ে
গেছে । পরের দিন সকালে খবর এল একটি বাচ্চা ছেলের ক্ষতবিক্ষত লাশ মাঠের মধ্যে পড়ে আছে
।
তারপর
নানান দুশ্চিন্তায় সুজনের নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত হতে লাগল । এমন দিশেহারা নিঃসঙ্গ জীবন সময়ের অশরীরী হাতের ছোঁয়ায় প্রবাহিত
হতে লাগল । সময়ের তালেতালে দিনের পর মাস, মাসের পর বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল ।
এর
মধ্যে খবর এসেছিল, মুম্বাই থেকে রতন ও সবিতাকে গ্রেফতার করেছে । খুনের দায়ে উভয়ের জেল হয়েছে ।
কখন
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে সুজনের সেদিকে কোন খেয়ালই ছিলনা । কিন্তু মাথার উপর দিয়ে
যখন একটি নিশাচর পাখি ভীষণ চিৎকার করতে করতে উড়ে গেল তখনই সম্বিত ফিরে পেল ।
উঠে
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল । পূর্ণিমার চাঁদের আলোর রূপোলী আস্তরণে সারা মাঠখানি নিঃশব্দে
হেসে উঠেছে । সুজন এক পা, এক পা করে হাঁটতে লাগল । কিন্তু বাড়ির পথে না গিয়ে ভিন্ন
পথে হাঁটতে লাগল । এক সময় সে মামনির বাড়ি গিয়ে উঠল । বাড়ির উপস্থিত সকলেই এতে ক্ষুব্ধ
হয়ে পড়ল । চাপা গুঞ্জন শুনে মামনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই সুজন ছুটে গিয়ে মামনির পায়ে
পড়ল । বুকের সঙ্গে পা জড়িয়ে ধরে শিশুর মতই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল । মামনির মুখ
থেকেও কোন কথা বেরিয়ে এল না । তারও চোখ ফেটে গাল বেয়ে আশ্রু ঝরে পড়তে লাগল । বিদ্যুতের
আলোয় মামনির গালের অশ্রুবিন্দুগুলি স্বর্ণের দানার মতই জ্বলজ্বল করছিল ।