সরকার
আজিজুল
হাকিম
~~~~~~~~~~~~~~~~
নীল নদের তীরে মেমফিস-এ খেজুর
বনবীথিকায় দেবতা তাহ মধ্যাহ্ন বিশ্রামে নিমগ্ন ছিলেন; তখন উহার পত্নী দেবী সেখমেত
উহার মাথার কেশে অঙ্গুলি বিন্যাস করিতে করিতে তাহাকে জিজ্ঞাসিলেন, “অত্যাধুনিক
সময়ে রাষ্ট্র-নেতা কেমন হইবেন তাহা বর্ণনা করিয়া আমার মনের কৌতূহল নিবারণ করিয়া
বাধিত করিবেন” ।
দেবতা তাহ প্রসন্ন মুখে একরাশ
হাসির আলো বিচ্ছুরিত করিয়া বর্ণনা করিতে আরম্ভ করিলেন—“অত্যাধুনিক কালে গণতন্ত্র,
প্রজাতন্ত্র, গণপ্রজাতন্ত্র রাজতন্ত্র নাম্নী যত সব তান্ত্রিক দেশ জন্মলাভ করিবে ।
তৎকালীন সময়ে প্রজা সকল অঙ্গুলি ডগায় কালিমা লিপ্ত করিয়া, ভোট নামক প্রথার মাধ্যমে
তাহাদের সর্বস্ব শক্তি সঁপিয়া দিয়া সরকার নামক রাষ্ট্র-নেতাদের আবির্ভাব ঘটাইবে । সেই
সব প্রজাসকলের উৎসর্গকৃত ঐক্যশক্তি সরকার নামক আগ্রাসী শক্তিতে রূপান্তরিত হইয়া
বুমেরাং-এর মতো তাহাদের অমঙ্গলার্থে তাহাদের দিকেই ধাবিত হইবে। সেই
শক্তির নিষ্পেষণে প্রজাগণ জর্জরিত হইয়া মরিবে; তথাপি মুক্তি লাভ করিতে পারিবে না ।
এবার সেই সকল রাষ্ট্রনেতা বা
সরকার সম্পর্কে সবিস্তারে বর্ণনা করিতেছি । তুমি তাহাতে গভীর মনোনিবেশ সহকারে তাহা
শ্রবণ করিতে থাকো ।
যাহারা জনগণকে সহস্র মিথ্যা
প্রতিশ্রুতি দিয়া, তাহাদের পক্ষে টানিয়া, সমর্থন আদায় করিয়া দেশের ক্ষমতা হস্তগত
করিয়া থাকিবে; তাহাদিগকে সরকার বলা হইবে । অতঃপর সকল
দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করিয়া অসহায় প্রজাসকলের নিকট হইতে অর্থ লুণ্ঠন করিয়া ভিন
দেশের কোষাগারে চৌদ্দপুরুষের জন্য সঞ্চয় করিয়া রাখিবে, তাহাদিগকে সরকার বলা হইবে । যাহারা
সাধারণ নাগরিককে নির্বোধ বানাইয়া, তাহাদের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া, তাহাদের
মধ্যে বিবাদ বাধাইয়া রক্তের হোলি খেলায় নিবিষ্ট করিবে আর তাহাদিগকে অন্ধ বানাইবে; যাহাতে
তাহাদের অজ্ঞাতে দেশ এবং দশের সর্বনাশ ঘটাইতে পা্রিবে, তাহাদিগকে সরকার বলিয়া
থাকিবে । যাহারা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থাকে পঙ্গু করিয়া প্রজাসকলের
হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করিয়া বিদেশ বিদেশ ফুর্তি মারিয়া বেড়াইবে, তাহাদিগকে
সরকার বলিয়া থাকিবে । যাহারা প্রজাসকলকে স্বর্গীয় সুখের স্বপ্ন দেখাইয়া, নরকের
আগুনে নিক্ষেপ করিয়া, নরকের কীট বানাইয়া ফেলিবে, তাহাদিগকে সরকার বলিয়া থাকিবে
। যাহারা জনসাধারনের সম্মুখে, প্রকাশ্য
সভায় মধুর বাণী বর্ষণ করিবে, তাহাদের দুঃখে মায়া কান্না করিবে আর গোপনে তাহার ঠিক
উল্টোটি করিবে, তাহাদিগকে সরকার বলিয়া থাকিবে । যাহারা জনগণকে নিরাশ্রয় করিয়া,
ক্ষুধার আগুনে পুড়াইয়া মারিয়া তাহাদের অর্থে বিশ্বশান্তি রক্ষা করিবার নিমিত্ত
দেশকে শক্তিশালী করিতে অস্ত্র ক্রয়ের প্রতিযোগিতায় মত্ত হইয়া পড়িবে, তাহাদিগকে
সরকার বলা হইবে । যাহারা প্রজাসকলকে উপবাসে রাখিয়া তাহাদের রক্ত ঘর্ম করা অর্থে
দেশের গৌরব ফলাইবার নিমিত্ত দেশের অন্দরে আকাশচুম্বী মূর্তি বানাইবে, তাহাদিগকে
সরকার বলিয়া থাকিবে ।
যাহারা রাষ্ট্র পরিচালনার
ক্ষেত্রে নিজেদের দুর্বলতা, অক্ষমতা
লুকাইবার হেতু দেশের অভ্যন্তরিন আর্থিক কাঠামোকে পঙ্গু করিবার নিমিত্ত সেই দিক
হইতে মানব সকলের মুখ ফিরাইবার জন্য দেশের অন্দরে প্রজাসকলকে মারপিট খেলিতে উৎসাহিত
করিবে, তাহাদিগকে সরকার বলিয়া মান্যতা দেওয়া হইবে । যাহারা দেশের জনসাধারণের অন্নসংস্থান,
বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাকে ভুলাইবার জন্য ধর্মের জাপানি তেল মাথায় মালিশ
করিয়া, ধর্মীয় উত্তেজনায় মশগুল করিয়া, বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ, আতঙ্ক
ছড়াইতে থাকিবে, তাহারা সরকার বলিয়া গন্য হইবে । যাহারা প্রজাসকলের ভোটে পাশ করিয়া
আপন স্বার্থ কায়েম করিবার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জন্ম দিয়া তাহা প্রজাসকলের
উপর প্রয়োগ করিয়া থাকিবে তাহাদেরকে সরকার বলিয়া থাকিবে। যাহারা বিভিন্ন কৌশল
অবলম্বন করিয়া মনুষ্যকে বিভেদের পথে ঠেলিয়া মানবিকগুন সম্পন্ন মানুষকে অমানবিক,
বর্বর, হিংস্র পশুতে পরিণত করিবে তাহাদিগকে সরকার বলিয়া থাকিবে । যাহারা সহজ, সরল
প্রজা সকলের গলায় অন্ধ, উন্মত্ত, ভিনধর্মীনাশক ধর্মের আফিম ঢালিয়া, গলাধঃকরণ
করাইয়া দেশের মাঝে দাঙ্গা ফ্যাসাদ বাঁধাইবে আর হাজার হাজার নাগরিকের রক্ত স্নানের
উৎসবে মাতন পিটাইবে, তাহাদেরকে সরকার বলিয়া থাকিবে । যাহারা গোপনে সংখ্যালঘুদের মঙ্গল
চাহিবে না; কিন্তু বাস্তবে তাহাদের ভোট চাহিয়া থাকিবে, অতঃপর তাহাদের ভোটে ক্ষমতার
সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করিবে তাহাদের সরকার বলিয়া সম্বন্ধন করিয়া থাকিবে ।
যাহারা সাধারণ নাগরিকদের বলিবে
ভিনদেশী আর ভিনদেশীদের বলিবে আসল নাগরিক তাহাদেরকে সরকার বলিয়া গণ্য করিয়া থাকিবে
। যাহারা আগামীতে নিজেদের কুর্সি টিকাইয়া রাখিবার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশের সহিত
মিছেমিছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলিবে আর দেশের তাজা তরুণের রক্তে হস্ত স্নাত করিবে,
তাহারাই সরকারের মর্যাদায় ভূষিত হইবে। যাহারা মাতৃ বক্ষ হইতে সন্তানকে, ভগিনীর
নিকট হইতে ভ্রাতাকে আর পত্নীর হৃদয় হইতে স্বামীকে বিচ্ছিন্ন করিবে, তাহারাই সরকার
বলিয়া পরিগণিত হইবে । যাহারা সন্ত্রাসী, জঙ্গিদের সহিত গোপনে আঁতাত করিয়া অপন
দেশের সেনাদের উপর হামলা চালাইয়া থাকিবে, তাহাদিগকে সরকার বলিয়া বিবেচিত করিবে । যাহারা
নিজেদের সাচ্চা দেশপ্রেমিক বলিয়া ঢাকঢোল পিটাইবে আর বিরোধীরা তাহাদিগের বিরুদ্ধে
বাক্যবাণ করিলে তাহাদের দেশদ্রোহী বলিয়ে প্রচার চালাইবে; এমনকি অন্য
ধর্মাবলম্বীদের জব্দ ও নিশ্চিহ্ন করিবার স্বার্থে সরকারী সেনাবাহিনীর মুখে চুনকালি
লেপন করিয়া, তাহার উপর আস্থা হারাইয়া আপন ধর্মের পক্ষ অবলম্বন করিয়া ‘ধর্ম বাঁচাও সংগঠন’ করিয়া আগ্নেয় অস্ত্রবিদ্যায়
পারদর্শী করিয়া তুলিবে আর অন্য ধর্মাবলম্বীরা নিরস্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িলে
তাহাকে সন্ত্রাসের আঁতুড় ঘর বলিয়া আখ্যায়িত করিবে, তাহারাই সরকার বলিয়া গণ্য হইবে
।
সরকারের শিক্ষার ব্যাপারে আসল রূপ হইল, তাহারা
মুখে শিক্ষার দরদী আর কর্মে শিক্ষার বিরোধী । যাহারা কোনরকম বেকার সমস্যার সমাধান
না করিয়া জনসভায় চিৎকার করিয়া ঘোষণা করিয়া থাকিবে - লক্ষ লক্ষ বেকারদের চাকরির বন্দবস্ত
করা হইয়াছে, তাহারাই সরকার। যাহারা উচ্চ শিক্ষিত বেকারদের
তৈল-শিল্পে উৎসাহিত করিবে, তাহারাই সরকার নামে জ্ঞাত হইবে। যাহারা নিজেদের বেতন
পনেরো গুন বৃদ্ধি করিয়া থাকিবে আর সমস্ত কর্মস্থলে সম কাজে সম বেতনের স্থলে অসম
বেতন দিয়া বিমাতৃসুলভ আচরণ করিবে আবার আন্দোলন করিলে বেত্রাঘাত বর্ষণ করিবে,
তাহাদের সরকার বলিয়া মান্যতা দেওয়া হইবে ।
যাহারা পাড়ায় পাড়ায় মদের দোকান করিতে অনুমতি পত্র
প্রদান করিবে অথচ কেহ মদ পান করিলে তাহাকে জেলের ঘানি টানাইবে, তাহারাই সরকার নামে
পরিচিতি লাভ করিবে । যাহারা প্রজা সকলকে পরকীয়া প্রেমে উদ্বুদ্ধ করিয়া সংসারের
মধ্যে অশান্তির বাতাবরণ সৃষ্টির পথ উন্মোচিত করিবে, তাহারাই সরকার নামে নামাঙ্কিত
হইবে । যাহারা চাকুরি প্রদান করিবার জন্য শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীর নিকট উপঢৌকন
স্বরূপ লক্ষ লক্ষ টাকা আদাই করিবে, তাহাদেরকে সরকার বলিয়া থাকিবে ।
যাহারা অপরের সাহায্যপ্রার্থী, কাল্পনিক দুর্বল,
শঠ, ছল-চাতুর্যে পরিপূর্ণ ব্যক্তিকে
ঈশ্বরের আসনে স্থলাভিষিক্ত করিয়া তাহার পূজা ও জয়গানে প্রজাসকলকে ব্যস্ত রাখিবে,
তাহারাই সরকার নামে সম্মানিত হইবে । যাহারা মনুষ্যকে পশু আর পশুকে দেবতার আসনে
বসাইয়া সাধারণ নাগরিককে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে নিবিষ্ট রাখিবে, তাহাদের সরকার
বলা হইবে ।
এইবার আসিতেছি তৎকালীন সময়ের শক্তিশালী সরকারের
বৈদেশিক নীতিতে । যাহারা একদেশ হইতে জ্বালানি ক্রয় করিয়া অন্যদেশে স্বল্প মূল্যে
বিক্রয় করিবে; কিন্তু আপন দেশের নাগরিকদের নিকট অত্যাধিক মূল্যে বিক্রয় করিবে,
তাহাদের সরকার বলিয়া থাকিবে । যাহারা এক দেশে সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য করিবে, অপর
দেশে সেই জঙ্গি গোষ্ঠীর সহিত লড়াই চালাইয়া যাইবে, তাহাদের সরকার বলিয়া ঘোষণা করা হইবে
। যাহারা আপন স্বার্থ চরিতার্থ করিবার অভিপ্রায়ে অন্যায়ভাবে কোন কোন দেশ দখল করিয়া
সেই দেশের রাষ্ট্রনায়ককে অন্যায়ভাবে হত্যা করিবে, তাহারা সরকার বলিয়া সমাদৃত হইবে
। যাহারা নিজেদের স্বার্থে অ্যাটম বোম্ব, হাইড্রোজেন বোম্ব-এর মতো মারণাস্ত্র
তৈয়ার করিবে; অথচ দুর্বল দেশ তাহা বানাইতে চাহিলে তাহাকে আর্থিক দিক দিয়া একঘরে
করিয়া রাখিবে; এমন কি প্রকাশ্য আক্রমণ করিবে, তাহাদেরকে সরকার বলিয়া থাকিবে ।
যাহারা বিশ্বকে শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়া আন্তর্জাতিক একটা প্রতিষ্ঠান গঠন করিবে;
কিন্তু ব কলমে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন ও নানান দেশের নিকট অপন অস্ত্র বিক্রয় করিয়া
সারা বিশ্বকে অশান্তির প্রসূতিকাগারে পরিণত করিবে, তাহারাই সরকার বলিয়া সমাদৃত
পাইবে । কোন দুর্বল সরকার আপন দেশে অশান্তির আগুনকে নিভাইতে শ’খানেক নাগরিককে
হত্যা করিলে তাহাকে জব্দ করিতে এবং সেই দেশে শান্তি ফিরাইবার লক্ষ্যে ওই দেশের
লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করিবে; তাহাদের সরকার বলিয়া ভূষিত করা হইবে” ।
দেবী সেখমেত কহিলেন, “ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি
এমন সরকারের আবির্ভাব কোন কালে পৃথিবীতে যেন নাহি ঘটে । আপনি লাইলি মজনু বা শিরি
ফারহাদের প্রেম কাহিনি বর্ণনা করুন” ।
Tags:
আমার জগত - প্রবন্ধ
বর্তমান বিশ্বরাজনীতির বিশ্বকোষ
ReplyDeleteআন্তরিক ধন্যবাদ রইল, প্রিয় দাদা ।
Delete