ভারতের বহুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
আব্দুর রহমান
প্রাচীন সভ্যতার দেশগুলির মধ্যে ভারতবর্ষ একটি অন্যতম দেশ। দেশ গঠনের প্রক্রিয়া রাসায়নিক বিক্রিয়ার মত সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে যে ভারত বর্ষ গড়ে উঠেছে তার ইতিহাস যেমন রক্তপাতের তেমনি শান্তির পথের। আমরা যদি মহাভারতের প্রেক্ষাপটে দেখি ; দেখব পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। সেই সময়ে ভারতব্যাপী শক্তিগুলো বিভাজিত হয়ে সমর্থন যুগিয়েছে পঞ্চপান্ডব ও শত ভাইয়ের অধিনায়ক দুর্যোধনকে। সেটা কে বলা হয়েছিল ধর্ম যুদ্ধ, ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাস্তবে তা কিন্তু হয়নি। ধর্মনীতি ও রাজনীতি একীকরণ সম্ভব হয়নি। যুদ্ধ জেতার জন্য কলাকৌশল, কুটকৌশল ও মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। যুদ্ধের শেষে গান্ধারীর অভিসম্পাত সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তারপরে দীর্ঘ সময় ভারত অখন্ড নয়, খন্ড খন্ড রাজ্য।
রাজা অশোক বৃহত্তর ভারতের বিস্তার করে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রিকভাবে প্রথম দেখিয়েছিলেন বৌদ্ধ রাজধর্ম হওয়া সত্ত্বেও পরধর্ম সহিষ্ণুতা আদর্শ গ্রহণে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়। সেই সঙ্গে ছিল মাঙ্গলিক উদ্দেশ্যে প্রজাদের কল্যাণ কর্মসূচি ও রূপায়ণ। সম্রাট আকবরও দেখিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতা দেশ শাসনের বড় এক চাবি। সাহসী দেশভক্ত রাজপুত জাতিও সম্রাট আকবরের অধীনতা স্বীকার করেছে। শুধুমাত্র যুদ্ধে নয় বরং মৈত্রী ভাবনায়। বাংলায় দেখিয়েছিলেন হুসেন শাহ। বাংলা ভাষার প্রাণ প্রবাহ সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর সময়ে। বাংলা এক সময়ে ব্রাত্য ছিল, বাংলা ভাষার কুল মর্যাদা ছিলনা। সেন বংশের সময়ে সংস্কৃত ছিল দেবভাষা। লৌকিক ভাষা গুরুত্বহীন প্রান্তজনের বুলি। এ রকম ভাবনার অবসান ঘটে হুসেন শাহের আমলে। ভারতের ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ভারত চিন্তা ও চেতনায় রয়েছে বহুত্ববাদের অস্তিত্ব। হিন্দু সনাতন ধর্মে বহু মতাদর্শ ও বহু দেবদেবীর সাধনা। এমনকি নাস্তিক্যবাদও সনাতন ধর্মে গুরুত্ব পেয়েছ। ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখা সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য ভারতীয় সাধনার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য হঠাৎ করে হয়নি। যুগ যুগ ধরে ভারতে ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ ভিন্ন দেবদেবীর অনুসরণ করা ভক্তজন ও তাদের সহাবস্থানে গড়ে উঠেছে এই নীতি। কখনো কখনো কোনো ধর্ম মতাবলম্বী মানুষ আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করেছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানিকতার বাড়াবাড়ি পুরোহিত তন্ত্রে দেখা গিয়েছিল তার পরিণামে ভক্তিবাদী আন্দোলনে বৌদ্ধ ধর্মের আত্মপ্রকাশ। প্রেম- ই ধর্ম। প্রেমভক্তি ধর্মের মূল প্রাণ। এমন ভাবনার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন নদের নিমাই চৈতন্যদেব। বর্ণ বৈষম্য ও বিভাজন কে তিনি ভেঙে দিতে পেরেছিলেন প্রেম ও ভক্তির জোয়ারে। বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও বিবেকানন্দ সনাতন ধর্মকে মানবিক ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে সর্বোচ্চ স্থান দিতে পেরেছিলেন। সনাতন ধর্মের এক সুন্দর বিবর্তন ও নতুন টেক্সট দিয়েছেন বিবেকানন্দ। যার মধ্যে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম বোধের সত্তার স্বাধীন অস্তিত্ব। ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে আঘাত হেনে সব ধর্মের মধ্যে সত্যকে স্বীকার করার ঔদার্য তিনি দেখাতে পেরেছিলেন। হিন্দু ও হিন্দুত্ব ভাবনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তাঁর বক্তব্যে আচরণে সংগঠনে প্রতিষ্ঠিত। ভিন্ন মত ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতি কে কেন্দ্র করে ভারতের বহুত্ববাদ গড়ে উঠেছে। এই বহুত্ববাদী ভাবনার মূলে রয়েছে পারস্পরিক সম্প্রীতির স্পৃহা। পরবর্তী ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক ভারতকে, ইংরেজদের হাত থেকে মুক্ত করতে রাজনীতির মূল শক্তিগুলো বহুত্ববাদকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, জহরলাল নেহরু,মওলানা আবুল কালাম আজাদ,খান আব্দুল গাফফার প্রমুখ নেতা ও তাঁদের পরিচালিত জাতীয় কংগ্রেস ভারতের বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বহুত্ববাদকেই অগ্রগণ্য, নীতি হিসেবে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ভারতীয় কম্যুনিস্টরাও ভারতের বৈচিত্র্য অস্বীকার না করে অর্থনৈতিক সাম্যের জন্য লড়াই করেছে। ভারতের বৈচিত্র্য ভাষায় পোশাকে ভাবনায় ও ধর্মীয় চিন্তায় রয়েছে। কখনো কখনো এই বৈচিত্র্য কে ভারতীয় ঐক্য শক্তির ক্ষেত্রে দুর্বল্য মনে হয়েছে। কিন্তু তা সাময়িক। বড় হয়ে উঠেছে বহুমত ও সমন্বয়। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাণ মিলনে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারততীর্থ’ কবিতার মর্ম কথাই হল ভারতীয় সংস্কৃতি। প্রসঙ্গত বলি, আর এস এস, হিন্দু মহাসভা, শিবসেনা প্রভৃতি দল গড়ে ওঠে হিন্দু জাতির স্বার্থ রক্ষার জন্য,একই ভাবে মুসলীমলীগ, মীমের মতো দল মুসলীমদের স্বার্থের কথা বলে। এই সব দলগুলি ভারতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের কথা বলার ক্ষেত্রে কৃপণতা রয়েছে।
তবে একথাও সত্য রাজনৈতিক হিন্দুত্ব বা হিন্দুত্ববাদীরা এবং ইসলামী আদর্শকে সামনে রেখে চলা মুসলিম লীগ ভারতীয় বহুত্ববাদকে সমর্থন করেনি। তার পরিণাম যে কত ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে ভারতবাসীর অভিজ্ঞতা রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজেরা সচেতনভাবে হিন্দু মুসলিম বিভাজনকে চেয়েছে ও তাকে পুষ্টি দান করেছে। মুসলিম লীগ হয়েছে ইংরেজদের তুরুপের তাস। ফলে দ্বিজাতি তত্ত্বের আবির্ভাব বিকাশ ও তার পরিণামে দেশ বিভাগ। বিভাগের আগে ভয়াবহ মর্মান্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যার ক্ষত আজও মিলিয়ে যায়নি। রক্ষণশীল হিন্দু সংগঠনগুলি সেভাবে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি কিন্তু তাঁরা চেয়েছিলেন ভারত হবে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র। আরএসএস, হিন্দু মহাসভা ও জনসঙ্ঘের মতো ধর্মীয় দক্ষিণপন্থী দলগুলোর উদ্দেশ্য ছিল অনুরূপ। এ সবের ফলস্বরূপ সম্প্রীতির সিঁড়িতে কাঁটা বিছিয়ে নিজ নিজ দলের আদর্শকে পুষ্টি দান।
ভারতের প্রান্তিক গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, আর্য সংস্কৃতি, তুর্কি ও মুসলিম সংস্কৃতি, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি— সব সংস্কৃতির সংশ্লেষণে আধুনিক ভারতবর্ষ। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে মিশ্র সংস্কৃতির রূপ লক্ষ করা যাবে, যার মর্মে রয়েছে বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত থেকে নিজ নিজ ধর্ম ও কুলগত রীতিনীতি পালন করে সবাই আমরা ভারতীয়। এই জোর বা শক্তি স্বাধীনতার পরেও ভারতবাসী পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, একাত্তরের জয়বাংলার মুক্তি সংগ্রাম ও করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেখিয়েছে। ভারত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। সাধারণ নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিয়ে সরকার গঠন করে। কোনো কর্তৃত্ববাদী এক দলীয় শাসন নয়, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থান ভারত।
ভারত খন্ড স্বাধীনতা লাভ করেছে কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস ও বিরোধী দলগুলির ভূমিকার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু ভারত সরকার ও ভারতের আঞ্চলিক কিছু শক্তি উত্তরে পূর্বাঞ্চলে ও দক্ষিণে ভারত সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চায়নি। তারমধ্যে হায়দ্রাবাদের নিজাম, কাশ্মীরের হরি সিং, নাগাল্যান্ড মনিপুর। যাহোক ভারত সরকারের উদারতা ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে ভারতের সমস্ত দেশীয় রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে আমরা লক্ষ্য করি কখনো নাগাল্যান্ডে কখনো মনিপুরে উগ্রপন্থী কার্যকলাপ চলে আর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তার নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। ভারত সরকার শুধু সেনাবাহিনী দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে না বরং তাদের সংস্কৃতিকে মান্যতা দেয় স্থানীয় শিক্ষা সংস্কৃতি কে গুরুত্ব দেয়। এর ফলে এইসব উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর বিকাশ তেমন ঘটেনি। কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে একটা সংকট স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত চলছে। স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পরেও কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা চলে। ভারত সরকার ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের মতো কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত করেছে। কাশ্মীরের শান্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ভারত সরকারের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা বরাবর রয়েছে। সেখানে ন্যাশনাল কনফারেন্স ও মেহবুবা মুফতির দল পিপুল'স ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় এসেছে তাঁরাও ভারতের integrity সংহতি ও সার্বভৌমকে মেনেই চলেন। সাম্প্রতিক পায়েল গাঁও হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গিয়েছে কাশ্মীরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে। এসব থেকে মনে হয়েছে কাশ্মীরের বড় অংশের মানুষ কেউ কেউ বলছেন ৮০% এর উপর মানুষ ভারতে থাকতে চায়। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে , সহমত পোষণ করেন।
প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কেন এত সন্ত্রাসী হামলা? কারণ খুব স্পষ্ট। খুব কম হলেও ইসলামী সংগঠন রয়েছে তারা কাশ্মীরের স্বাধীনতা চায়। আর পাকিস্তান এই সুযোগটা নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমাগত কাশ্মীরে গন্ডগোল পাকানোর ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা রয়েছে। উগ্রপন্থী কার্যকলাপ প্রতিরোধ করতে গিয়ে সেনা বাহিনীরও কিছু বাড়াবাড়ি থেকে যায় যা স্থানীয় মানুষকে অসন্তুষ্ট করে। সন্ত্রাসবাদীরা এ অসন্তোষক কাজে লাগায়। গত ৫০ বছর থেকে সন্ত্রাসী হামলার প্রভাব বেড়েছে। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষ সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছে। পাকিস্তানের এই রাগ বা ক্রোধ ভারতকে বিড়ম্বনায় ফেলার উৎস। আবার এটাও দেখা যায় ইসলামী উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর আঁতুড় ঘর পাকিস্তান। ২০০১ সাল থেকে কাশ্মীরে ২৩/২৪ বার সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। কখনও ভারতীয় সিআরপিএফ,কখনো পুলিশি কনভয়ে ,কখনো জনবহুল বাসস্ট্যান্ডে নিরীহ জনতার উদ্দেশে সশস্ত্র হামলা হয়েছে।
এর মধ্যে পুল ওয়ামায় ১৯ এপ্রিল ২০১৯ এর আক্রমণে ৪৬ জন সিআরপিএফের প্রাণ যায়। ২২ এপ্রিল,২০২৫ পাহেলগাঁ হত্যা। নিরীহ পর্যটকদের ধর্মীয় পরিচয়ে হত্যা ভারতবাসীর হৃদয়ে আগাত করে।প্রতিবাদে সারা ভারতে হিংসার আগুনের স্রোত লক্ষ্য করা যায়। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভাষণে প্রতিশ্রুতির বাণী উচ্চারিত হয়। জনগণ যেমন চাইছে তেমনই হবে। পরিণামে ৭ মে মধ্য রাতে ভারত পাকিস্তানের ৯টি স্থানে বলা ভালো জঙ্গি ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। পাকিস্তান প্রতি আক্রমণ করে জম্মু কাশ্মীর, রাজস্থান,পাঞ্জাবের বিভিন্ন স্থানে। আশার কথা ভারতের বাহিনী পাক বাহিনীর প্রতিরোধ করে ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে নিষ্ক্রিয় করেছে। পুঞ্চে পাক বাহিনীর গোলাগুলিতে কয়েক জন নিহত ও আহত হয়েছে। যুদ্ধের চার দিনের মাথায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধের অবসান ঘটেছে।
লক্ষ্যণীয় সম্প্রীতিকে দুদিক থেকে হত্যা করা হচ্ছে। একটা আন্তঃদেশীয় ও আর একটি বহিঃ দেশীয়।
বাইরে থেকে ভারতের সম্প্রীতির উপর সব থেকে বেশী আঘাত হানে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও পাকিস্তানের মদদপুষ্ট উগ্রবাদী সংগঠনগুলো। কখনো কখনো শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং চিন চেষ্টা করে সংহতি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে। মূলত সংকট তৈরি করে পাকিস্তান। এ কথা চরম সত্য যে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হরি সিং এর অধীনে থাকা কাশ্মীরকে জবর দখলের চেষ্টা করে। হরি সিং ভারত সরকারকে আহ্বান করে কাশ্মীরকে রক্ষার জন্য। এবং কাশ্মীর ভারতের অধীনে থাকবে, প্রতিশ্রুতি দেয়। যাহোক বিভিন্ন ঘটনা ও লড়াইয়ের পর বর্তমান এল. ও. সি।সত্তর দশকের সময়ে পাকিস্তানে বেড়ে ওঠা উগ্রবাদী সংগঠনগুলো কাশ্মীরকে ভারতের কাছ থেকে মুক্ত করার জন্য চোরা গুপ্তা সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬৫,১৯৭১, ১৯৯৯,২০২৫ চারটি যুদ্ধ হয়ে গেছে। ২০২৫ মে আক্রমণ পাহেল গাঁওয়ের হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রত্যাঘাত। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে ঠান্ডা গরম শত্রুতা চলতেই আছে। বলা ভালো, পাকিস্তান একটা অঘোষিত যুদ্ধ, উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ছায়ায় চালিয়ে যাচ্ছে। আবার যারা সন্ত্রাসী হামলা চালায় ভারতে তারা সবাই ধর্মে মুসলিম। ফলে ভারতের কিছু মিডিয়া,ও মুসলিম বিদ্বেষী লোকজন সন্ত্রাসী হামলার দায় মুসলমানদের বলে সাধারণী করণ করে। পাহেল গাঁও হামলার পর এটা বেশি করে দেখা গেল। পাকিস্তানের মুসলমান পাকিস্তানের। ভারতের মুসলমানরা ভারতবাসী। ভারত সরকার ভারতের সুরক্ষার জন্য যা করবে,যা সিদ্ধান্ত নেবে তা ভারতীয় মুসলিমদের সমর্থন রয়েছে। এর সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। ভারত সরকার ধর্ম দেখে বিদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক করে না। ইরানের সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক বৈরিতার। এখন তো ইজরায়েল -ইরান যুদ্ধ চলছে। আবার ইরান ও ইজরায়েল দুই দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মধুর। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলার জবাবে হামলা করলে ইরান এবং আফগানিস্তান ভারতের পাশে রয়েছে।
সম্প্রীতির সোপানে বাংলাদেশও আঘাত করে
বাংলাদেশর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ভারতের গৌরবজনক ভূমিকা ছিল। মুজিব ও মুজিব কন্যা হাসিনার আমলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। আবার তার বাইরে বাংলাদেশের শাসক ভারতের সঙ্গে টক মিষ্টি ঝাল সম্পর্ক রাখে। সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যালঘু। তাদের উপর মাঝে মধ্যে নির্যাতন হয়। তার প্রভাব পড়ে এ বাংলায়। ফলে সংখ্যাটা যতই কম হোক,তারা মনে করে ভারত কেন মুসলিমদের উপর ভালো ব্যবহার করবে। এখানে প্রতিশোধ নিতে হবে। তার পরিণামে কোথাও মব লিঞ্চিং, কোথাও হেনস্থা করছে এবং সম্প্রদায় সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা চলছে কোন না ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কোটা সংরক্ষণের পটভূমিতে জুলাই আন্দোলন ও হাসিনার দেশত্যাগ, ** আওয়ামী লীগের নেতা মন্ত্রী সমর্থকদের ঘরবাড়ি লুঠ করা, হিন্দুদের ওপর নির্যাতন এ দেশের মানুষের কাছে অসহনীয় হয়েছে। তার প্রতিক্রিয়া কলকাতায় দেখা গেছে।
সেই সঙ্গে রয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কপচা কপচি। ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির অঙ্গে অঙ্গে রয়েছে বিভাজন,বিভেদ ও হিংসা।ভারতে রাম-বাবরি কেন্দ্রিক রাজনীতির বলয় থেকে মুক্ত জাতীয় দল নেই। প্রত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে বর্তমান ভারত। কুকথা,অপভাষা প্রয়োগ হচ্ছে রাজনৈতিক ভাষণে। মানবতাবাদী,সেকুলার মানুষ গালাগালি খাচ্ছে, ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির কাছে। সম্প্রীতির মানচিত্রে এগুলো দহনের জ্বালাকারক।অথচ মৌলবাদ ও ধর্ম অনুশাসিত রাষ্ট্র কোথাও কোনো দিন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ইসলামী রাষ্ট্রের ইতিহাস বলতে গেলে যুদ্ধের ইতিহাস। বরং অশোক ও আকবর,হুসেন শাহ ধর্মীয় পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রীতির কৌশলী রাজনৈতিক ফিচার রেখেছেন। আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশ সম্প্রীতির সব থেকে বড় আশ্রয়। অথচ গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তারা কর্তৃত্ববাদ ও আধিপত্যবাদের উর্বর জমি তৈরি করছে। আমেরিকার ট্রাম, ইজরায়েলের নেতানিয়াহু, ইরানের খোমেইনি, চিনের শি জিন পিং দক্ষিণ কোরিয়ার কিম, রাশিয়ার পুতিন,ভারতের নরেন্দ্র মোদির কথায় আধিপত্যের স্বর জোরালো। আধিপত্যবাদ, কর্তৃত্ববাদ ধর্মবাদ সম্প্রীতি রক্ষা করে না। একটা ভয় আতঙ্কের ছায়ায় মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে।ভারতে এই আতঙ্কের ছায়া বহমান।
আবার এটাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ভারতের গণতন্ত্রে বহুদলীয় ব্যবস্থা রয়েছে। কেন্দ্রে গরিষ্ঠতা থাকা দল বা কোয়ালিশন সরকার রয়েছে কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে রয়েছে আলাদা রাজনৈতিক দলের শাসন। বলেই বহুমত, ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের রাজনৈতিক দল শাসনে থাকায় দেশে একক মতাদর্শ চলে না । কেন্দ্রে রয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি, বিজেপি।এই দলের অন্তরাত্মা আর এস এস। তাঁদের রয়েছে হিন্দুত্ব, হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদ। আর এস এস ভারতের এত কালের লালিত বহুত্ববাদ(pluralism) মানে না। সাভারকার সোজাসুজি বলেন, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের হিন্দুত্ব মেনে চলতে হবে।
এ হিন্দুত্ব শ্রীকৃষ্ণের প্রেম ধর্ম নয়, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব , বিবেকানন্দের ভাবাদর্শের হিন্দুত্ব নয়, বিনায়ক দামোদর সাভারকারের হিন্দু জাতীয়তাবাদ। খ্রিস্টান বৌদ্ধ ও মুসলিম তাঁর হিন্দুত্বে স্থান নেই। অথবা তাদের আর এস এসের হিন্দুত্ব গ্রহণ করতে হবে।স্বাভাবিকভাবে বিজেপি ২০১৪ সালে একক গরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও চিড় দেখা যাচ্ছে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধির প্রকোপে অনেক স্থানে অশান্তি বাড়ছে। বাড়ছে রাজনীতিতে ধর্ম প্রাধান্য। ধর্মীয় বিভাজন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের কৌশল অব্যাহত।দিল্লি ও হিমাচল প্রদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা গেল,বলা ভাল এক পক্ষীয় আক্রমণ।
ভারতের নাগরিকদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব, সৌজন্য ও পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠার জন্য গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা জারি থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া নেই। নেতারা অ-কথা কুকথা অপ-ভাষা ব্যবহারে প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। দলকে ও নাগরিকদের দলদাস বা আজ্ঞাবহ করে তোলার চেষ্টায় যত্নবান নেতৃত্ব। রাম-বাবরি রাজনীতির বলয়ে সম্প্রীতির শরীরে আঁচড় লেগেছে। এই আঁচড়ে রাজনীতির সাফল্যে বিজেপির ঘর সমৃদ্ধ।
অথচ ভারত মানেই বহু ধর্ম, বিচিত্র সংস্কৃতি, ভিন্ন ভিন্ন রুচির পরিচয় বহন। স্বাভাবিকভাবেই সম্প্রদায় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দেয়। ভারতীয় সংবিধান সব শ্রেণির মানুষের সম মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও বিশ্বাসকে গুরুত্ব দেয়। আবার এটাও দেখা যায় শাসক শ্রেণি কংগ্রেস,জনতা পার্টি ও ভারতীয় জনতা পার্টি সংবিধানকে অনেক সময় নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।তার ফল স্বরূপ দেশীয় সম্প্রীতি সংকটে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রাসী আচরণ ও পরস্পরের বিরোধ সমর্থকদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে হিংসার রাজনীতি বড় হয়ে ওঠে গ্রামীণ সম্প্রীতির মূলে কুঠারাঘাত চলছে। আমাদের সম্প্রীতি ধ্বংসের মূলে রয়েছে হিংসা আর ঘৃণার রাজনীতি।
সংখ্যালঘু দেশের বোঝা না সংকট? পৃথিবীর প্রায় দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একটা বিভাজন ও বৈষম্যমূলক আচরণের স্বীকার হচ্ছে। ইউরোপ উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার চালিত হয়। দেশের নাগরিকদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে খুব একটা দেখে না। তবে সমস্যা তৈরি হচ্ছে মুসলিমদের নিয়ে। ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ, সিরিয়া ও তুরস্ক (আত্মরক্ষার কারণে ইউরোপে অনুপ্রবেশ) পভৃতি দেশ থেকে উন্নত জীবিকার সন্ধানে ইউরোপে গেছেন। তাঁরা কেউ ধর্ম প্রচারের অভিমুখী হয়ে ইউরোপের নাগরিক হননি কিন্তু সংখ্যাটা বা উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হওয়ার পর তাঁরা সেই দেশের আইনের বাইরে শরিয়তের বিধান মানতে চায়। ফলে সেসব স্থানে কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ধর্মীয় বিধান মেনে চলবে মুসলিমরা এতে কেন প্রশ্ন উঠবে। দেশীয় আইন মেনে চলা রাষ্ট্রীয় নাগরিকদের আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। স্কুল কলেজ সিভিল লাইফ চলে সে সব দেশের লোকাচার এবং সিভিল ল অনুযায়ী। মুসলিম ব্যক্তি সে সব দেশে গিয়ে সেসব নিয়ম মেনে চলেছে। কেই দাবী করেনি যে সে হিজাব পরে স্কুল কলেজ কর্মজীবন শুরু করবে।সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্য হলে এটা শুরু হয়েছে। সেখানকার লোকাচার ও সিভিলিটির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক দৃষ্টি আকর্ষণের ধর্মীয় বিশ্বাসের ছায়া দৃশ্যত মানানসই হচ্ছে না। জোর করাতে ফ্রান্সে দেখা যায় বিড়ম্বনায় পরিস্থিতি। হিজাব, বোরখা, জোব্বার বিরুদ্ধে বলতে চাইনা, বলতে চাইছি যাঁরা গেছেন ওই সব দেশে তাঁরা তো জেনে বুঝে গেছেন ওই সব দেশের নিয়ম কানুন। তাহলে সেই দেশের ঔদার্য গুণকে হাতিয়ার করে ধর্মীয় বিধান পালনের দাবী কেন? আরবের দেশ গুলোতে ইউরোপীয় পোশাক পরে মেয়েরা থাকতে পারে না। তাঁরা দাবীও করতে পারেন না, তাঁদের নিজস্ব পোশাক নির্ভর চলাফেরা। পর্যটকদের কথা বলছিনা।
সংখ্যালঘুরা কীভাবে জীবন যাপন করবে। তারা কোন নিয়মে চলবে? তাদের জীবন জীবিকা, আশ্রয় ও নিরাপত্তার কী হবে? সংখ্যাগুরুর দৃষ্টিতে সংখ্যালঘুদের অবস্থান কী? এসবের মধ্যে রয়েছে সম্প্রীতি ও অ-সম্প্রীতির সম্পর্ক। আমরা কেউ ভাবতে পারি না, তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ী, দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রসঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআইএম, বিজিপির সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ রাজনৈতিক সুসম্পর্ক ও সু-ঐক্য।সুতরাং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও কখনো সংঘাত অনিবার্য। অথচ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় অ্যাতো বেশি সংঘাত থাকা প্রত্যাশিত ছিল না। আবার এই দ্বন্দ্ব শ্রেণি সংঘাতের মধ্যে পড়ে না। ক্ষমতাসীন থাকা ও ক্ষমতাসীন হওয়ার লড়াই। ভোট যুদ্ধে ভোটাধিকার দখলের লড়াই। এক নীতিহীন অগণতান্ত্রিক আদর্শের লড়াই।সেই সঙ্গে রয়েছে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের এক দেশ এক জাতি এক ভাষার প্রচার। অথচ ভারত মহাদেশ বহু জাতি ও বহু পরিচিতির নানা ভাষা নানা পরিধান, বিবিদের মাঝে মিলন মহানের আদর্শ। আবার সংখ্যালঘু মুসলিমদের মধ্যে রয়েছে বিশেষ অংশের ইসলামিক আইডেন্টিটির সংকট। কিন্তু দেশে কোনো উগ্রবাদী কার্যকলাপের ঘটনায় সাধারণী করণের বক্তব্য উদার ভারতীয় মুসলিমদের আঘাত করে। দেশের নাগরিক হিসেবে সমসুযোগ, সম বিকাশ প্রত্যাশা থাকে ভারতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে অঘটন এবং জীবন জীবিকার সংকট সম্প্রীতির আবহ মন্ডল বিঘ্নিত হয়। ধর্মীয় কারণে কোনো নাগরিকের বিশেষ সুবিধা ও সুযোগ প্রয়োজন নেই। আছে দেশের মানুষের সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন এবং মানবিক সংস্কৃতির সংশ্লেষণে আধুনিক মনন নির্মিতির প্রয়োজনীয়তা। পরিচিতির ক্ষেত্রে একক পরচিতি নয়, বহু পরিচিতির (multi identify) কে গুরত্ব দিতে হবে। তা নাহলে পরমত সহিষ্ণুতার সংকট দেখা দেবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও বাজার যাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করতে পারলে সম্প্রিতি সুরক্ষিত হবে।
***