আজকের যুদ্ধ ও ঈশ্বরের মানবিকতা
আজিজুল হাকিম
*******
এই পৃথিবী নিয়তই একটি যুদ্ধ কবলিত এলাকা। যুদ্ধের
স্থান, কাল আর ধরণ পরিবর্তন হচ্ছে মাত্র। যুদ্ধ অতীত থেকে বর্তমানকে ছুঁয়ে ভবিষ্যতেও
চলবে। চলতেই থাকবে পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত। আর অন্য দিকে মানবিক মুখগুলো কান্না করে
যাবে বরাবর। প্রতিবাদ হবে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার, চিৎকার হবে; কিন্তু তাদের কান্না
শোনার মতো কান ও মন দুটোই থাকবে না যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কদের। এই মানবিকতার ছবিরও রদবদল
ঘটবে। আজ যিনি কান্না করছেন আগামী কাল তিনি হুঙ্কার ছাড়বেন না, এমন কথা বলা যাবে না।
যে ঈশ্বর পৃথিবীকে পরিচালনা করছেন সেই ঈশ্বরও কখন হাসবেন আবার কান্নাও করবেন। কখনও
কখনও তিনি সবকিছু দেখেও কিছুই দেখবেন না। স্বর্গের গোলাপি বাগিচায় আর গোলাপি-সোনালি
মিশ্রণ সারাবে চুমুক দিয়ে হয়তো বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকবেন। আবার কখনও শয়তানের হুঙ্কারে
জড়সড় হয়ে মুখকে কাঁচুমাচু করে চুপচাপ বসে থাকবেন। এই হচ্ছে আমাদের ঈশ্বর বা আন্তর্জাতিক
জাতিপুঞ্জ।
আজ রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ
মারা যাচ্ছে। ইতি মধ্যে দেড় হাজার মানুষ মারা গেছে। এই নিয়ে মানবতাবাদীদের দরদ উথলে
পড়ছে। তাদের বিলাপে বিশ্ব নাগরিকের কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে সুর মিলাচ্ছে
সাগর পারের বিভিন্ন দেশ। অনেক দেশে এই হত্যালীলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। আন্দোলন
হচ্ছে। যে দেশ অন্য দেশের নাগরিকের রক্তে তাদের উদর ভর্তি করে সেই আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রের
কান্নায় রাজপথ পিচ্ছিল হয়ে পড়ছে। এই যুদ্ধ থামাতে না পেরে রাশিয়ার উপরে একের পর একটি
নিষেধাজ্ঞা জারি করে যাচ্ছে। এমন কি ইউরোপ মহাদেশের অনেক দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন
পণ্যসামগ্রীর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সেই দেশটিকে একঘরে করে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করার
জন্য সমস্ত রকম পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। এত কিছু করার পরেও যখন কাজ হচ্ছে না তখন সবরকম
গণমাধ্যমকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সারা ইউরোপ
মহাদেশ জুড়ে ‘হায়! হায়!’ করে বুক চাপড়ে মাতম পিটছে। জাতিপুঞ্জের দরবারে পুতিনের বিরুদ্ধে
যুদ্ধাপরাধের তকমা লাগানোর জন্য আপিল করা হচ্ছে। জাতিপুঞ্জ থেকেও এই যুদ্ধকে অন্যায়
বলে ঘোষণা করা হচ্ছে।
আমার এই বক্তব্য থেকে অনেকেই বিরক্ত হচ্ছেন।
আমি আজকের রাশিয়ার পক্ষ অবলম্বন করছি বলে মনে হচ্ছে। আসলে আমি কোন যুদ্ধেরই পক্ষে নই।
আমার কাছে আজকের যুদ্ধ মানেই সার্বিক ধ্বংস। যুদ্ধ মানেই নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি।
যুদ্ধ মানেই ধ্বংসযজ্ঞের উপরে বাতাসের মুখে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। তবুও কিছু প্রশ্ন
থেকেই যায়। আজ কেন এসব হচ্ছে? ইউক্রেনীয়রা শ্বেতাঙ্গ বলেই কি? লোভনীয় সোনালি চুল আর
রমণীয় নীল চোখের হাহাকার আর মৃত্যু বলেই কি? এমন অনেক প্রশ্নই থেকে যায়।
এসব বলার জন্য আমাদেরকে পিছুনে চলে যেতে হবে।
২০০৩ সালের আগের ঘটনা। জাতিপুঞ্জের চাপে সাদ্দাম
হুসেন ইরাকের সমস্ত রকম অস্ত্র নষ্ট করলেন। জাতিপুঞ্জের দালালরা
ইরাকের বুকে তন্নতন্ন করে মারণাস্ত্র খুঁজলেন। সেখানে কোন ধরণের মারণাস্ত্রের
চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। তেল বিক্রি থেকে অনেক কিছু আমদানি রপ্তানির উপর
নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। একটি সমৃদ্ধশালী দেশকে সার্বিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হল।
দারিদ্রতার কারণে চার বছরের শিশুটি স্কুলের পড়া ছেড়ে কামারশালায় কাজ নিল। তবুও সেই
দেশটি জাতিপুঞ্জ আর ন্যাটোর অন্যায় হামলা থেকে রক্ষা পেল না। কেবল মাত্র
মারণাস্ত্র থাকা আর আল কায়দার সঙ্গে সাদ্দাম হুসেনের লিঙ্ক আছে, এই সন্দেহে কোন
রকম প্রমাণ ছাড়ায়, ইরাকের উপরে হামলা হল। এই আক্রমন করল আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্র,
ব্রিটেন, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া সহ আরো ছত্রিশটা দেশের এক যৌথ বাহিনী। যাকে বলা
হচ্ছে Multi National Force. কেবল মাত্র ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা আর
নিউজিল্যান্ড ছাড়া কোন দেশ প্রতিবাদ করেনি। সেই হামলার জেরে সামরিক আর বেসামরিক সহ
আট লক্ষ ইরাকবাসী মারা গেল। এটা অন্যায় হচ্ছে বলে কেউ মুখ খুলল না। ইউরোপ আমেরিকা
সহ সারা বিশ্ব যুদ্ধের এমন ভয়ঙ্কর খেলা দেখে মজা লুটল। মানবতাবাদীরাও মুখে কুলুপ
এঁটে বসে থাকল। জাতিপুঞ্জের মতো একটি শান্তিকামী সংস্থা মুখে ঠুসি পরে চুপচাপ বসে
থাকল। ইরাকিদের কান্না মানবতার দরবারে পৌঁছাল না। আন্তর্জাতিক জাতিপুঞ্জ জর্জ
ডাব্লিউ বুশকে যুদ্ধাপরাধী বলার মতো কেউ সাহস দেখাতে পারল না। কেবল একটি শান্তির
দেশে দীর্ঘমেয়াদি অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল।
এভাবেই লিবিয়ার মসনদ থেকে মুয়াম্মার
গাদ্দাফিকে হত্যা করে আন্তর্জাতিক জাতিপুঞ্জ সহ ন্যাটো বাহিনী লিবিয়ার সংস্কৃতি,
অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিল। সেখানে পঁচিশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হল। সারা পৃথিবী
চুপচাপ থাকল। অথচ তসলিমা নাসরিনের ভাষায় সাদ্দাম হুসেনের জামানা ছিল 'ইরাকের এক
স্বর্ণ যুগ' আর লিবিয়াবাসীদের কথায় গাদ্দাফির আমলের দিনগুলি আজকের দিনের চেয়ে অনেক
ভাল, উজ্জ্বল সোনালি দিন। তিনি লিবিয়াবাসীদেরকে ১০% থেকে ৯০% শিক্ষিত করতে
পেরেছিলেন। আর্থিক দিক দিয়ে চমক লাগিয়ে এক সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করেছিলেন। ২০১১
সালে 'আরব বসন্তের' এই দেশটিকে ন্যাটো বাহিনী একদম পঙ্গু করে দিল। ছুঁড়ে ফেলে
দেওয়া হল অতীতের অন্ধকারময় জগতের দিকে। কেউ মুখ খুলল না!
বছরের পর বছর ধরে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের
ঘরবাড়ি, জমি জায়গা জেরুজালেম দখল করে নিচ্ছে। সাধারণ লোককে হত্যা করছে। ২০ বছর ধরে
এই ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্থানে দুই লক্ষের উপর লোককে হত্যা করল। কেউ মুখটি পর্যন্ত
খুলল না। উহু, আহা করার মতো কোন লোক দেখতে পাওয়া গেল না। সারা পৃথিবী সেদিক থেকে
চোখ ফিরিয়ে নিল। মানবতার পূজারীরা ভুলেই গেছে, এরাও মানুষ।
আর আজ যখন ইউক্রেনে হামলা হল তখন জাতিপুঞ্জ
নামক ঈশ্বরের আর কান্না থামছে না। পুতিনকে যুদ্ধাপরাধীর তকমা দিতেও পিছ পা হচ্ছে
না। এখন সারা বিশ্বের মিডিয়ারাও মানবতার দরবারে আপিল করতে শুরু করছে। সারা বিশ্ব
যেন জেগে উঠেছে মানবতার যন্ত্রণায়। কারণ কি? কারণ একটাই – ওরা শ্বেতাঙ্গ। ওরা
মানুষ। ওদের জীবনের মূল্য আছে। ওরা এমন আক্রমণে মরার জন্য জন্মায়নি। যুদ্ধে মরার
জন্য জন্মেছে কেবল আফ্রিকা আর পশ্চিম এশিয়ার মানুষেরা। আজ ঈশ্বরও বলছেন,
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হচ্ছে। তাহলে ন্যাটো কি আন্তর্জাতিক আইনের উর্দ্ধে
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে না?
তবুও বলব, যুদ্ধ থামুক। কেবল সাধারণ বন্দুক
ছাড়া পৃথিবীর সব অস্ত্র ধ্বংস করা হোক। এক দেশ অন্য দেশকে আক্রমণ থেকে দূরে থাকুক।
সাদা-কালো নির্বিশেষে পৃথিবীর সব দেশে শান্তির পায়রা নিশ্চিন্তে পাখা মেলুক নীল
আকাশের বুকে।